সাক্ষাৎকার
সঠিক এআই বিজ্ঞানীদের জন্য দারুণ সহায়ক—ডেমিস হাসাবি, এ বছর রসায়নে নোবেলজয়ী
নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের নোবেল প্রাইজ ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে ফোন করে প্রতিক্রিয়া নেওয়া হয়। এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে উঠে আসে তাঁদের গবেষণা, দর্শন ও নিজস্ব চিন্তাভাবনার কথা। নোবেল প্রাইজ ডটঅর্গের পক্ষ থেকে ডেমিস হাসাবির এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অ্যাডাম স্মিথ। সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার, এর গুরুত্ব এবং মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্পর্ক, গুগল ডিপমাইন্ডে গবেষণার পরিবেশসহ আরও অনেক কিছু। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন উচ্ছ্বাস তৌসিফ।
রসায়নে এবারের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে প্রোটিন গবেষণার জন্য। কম্পিউটেশনাল প্রোটিন ডিজাইনের জন্য এই পুরস্কারের অর্ধেক পেয়েছেন মার্কিন বিজ্ঞানী ডেভিড বেকার। আর প্রোটিনের গঠন অনুমানের জন্য বাকি অর্ধেকটা পেয়েছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ডেমিস হাসাবি ও মার্কিন বিজ্ঞানী জন এম জাম্পার। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন: প্রোটিন রহস্যের সমাধান করে রসায়নে নোবেল পেলেন তিন বিজ্ঞানী)
ডেমিস হাসাবির জন্ম ১৯৭৬ সালের ২৭ জুলাই, যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন ১৯৯৭ সালে। পরে আগ্রহী হয়ে ওঠেন নিউরোসায়েন্সে। নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞানের জ্ঞান ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির গবেষণায় যুক্ত হন। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন ২০০৯ সালে। এরপর বন্ধু মুস্তাফা সুলায়মান ও শেইন লেগকে নিয়ে গড়ে তোলেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ডিপমাইন্ড। এই ডিপমাইন্ড ২০১৬ সালে গুগল কিনে নেয়। আবার, এই ডিপমাইন্ডকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেই তিনি ও জন এম জাম্পার মিলে তৈরি করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল আলফাফোল্ড, যার উন্নত সংস্করণ আলফাফোল্ড২ ও আলফাফোল্ড৩। এই এআই মডেল প্রোটিনের গঠন অনুমান করতে পারে, আর গঠন ওপরেই নির্ভর করে প্রোটিনের কাজ। এটিই তাঁর নোবেলজয়ী গবেষণা।
নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের নোবেল প্রাইজ ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে ফোন করে প্রতিক্রিয়া নেওয়া হয়। এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে উঠে আসে তাঁদের গবেষণা, দর্শন ও নিজস্ব চিন্তাভাবনার কথা। নোবেল প্রাইজ ডটঅর্গের পক্ষ থেকে ডেমিস হাসাবির এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অ্যাডাম স্মিথ। সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার, এর গুরুত্ব এবং মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্পর্ক, গুগল ডিপমাইন্ডে গবেষণার পরিবেশসহ আরও অনেক কিছু। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন উচ্ছ্বাস তৌসিফ।
ডেমিস হ্যাসাবিস: হ্যালো, ডেমিস বলছি।
অ্যাডাম স্মিথ: হ্যালো, ডেমিস। নোবেল প্রাইজের ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে অ্যাডাম স্মিথ বলছি।
ডেমিস: দারুণ! আপনার ফোন পেয়ে ভালো লাগল।
স্মিথ: অনেক, অনেক অভিনন্দন।
ডেমিস: ধন্যবাদ।
স্মিথ: আপনি বয়সে তরুণ। ইতিমধ্যেই অনেক অর্জন ও স্বীকৃতি রয়েছে ঝুলিতে। এই পুরস্কারটা আপনার কাছে কীরকম? পুরস্কার পেয়ে কেমন লাগছে?
ডেমিস: এটা আমার জন্য অবিশ্বাস্যরকম অসাধারণ এক পুরস্কার, বুঝলেন? সত্যি বলতে, মনে হচ্ছে যেন পরাবাস্তব দুনিয়ায় চলে এসেছি। এখনো বিষয়টা পুরোপুরি হজম করতে পারিনি। অসাধারণ এক সম্মান এটা। আর বলা বাহুল্য, সব হিসাবেই এটা সর্বোচ্চ পুরস্কার।
স্মিথ: প্রথম যখন শুনলেন নোবেল পেয়েছেন, তখন কী মনে হলো?
ডেমিস: সত্যি বলতে, আমি কিছু ভাবতেই পারিনি। মন পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। অসাধারণ ব্যাপার। এ এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা।
স্মিথ: ধারণা করছি, গুগল ডিপমাইন্ডে সম্ভবত পার্টি শুরু হতে যাচ্ছে।
ডেমিস: তাই তো মনে হয়। আমি অবশ্য ও নিয়ে অত ভাবিনি। সারাদিনের কাজ পড়ে আছে সামনে। তবে আমার মনে হয় এখন ওসব পরিকল্পনা বদলাতে হবে।
স্মিথ: আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু এটা তো আসলে খুশির খবর। আলফাফোল্ড, আলফাফোল্ড২ আর এখন আলফাফোল্ড৩—এগুলো বিজ্ঞানের জগতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। ব্যক্তি বিজ্ঞানী আর এসব যন্ত্রের মধ্যকার সম্পর্কটা আপনি কীভাবে দেখেন?
ডেমিস: জীবনভর আমি এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) নিয়ে কাজ করেছি, কারণ আমি বিজ্ঞান এবং নতুন জ্ঞান অন্বেষণের প্রতি প্যাশনেট (দারুণ আগ্রহী)। বরাবরই আমার মনে হয়েছে, আমরা যদি সঠিক উপায়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গড়ে তুলতে পারি, তবে সেটা হবে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করার দুর্দান্ত এক টুল। আমাদের চারপাশের মহাবিশ্বটাকে বুঝতে সেটা আমাদের সাহায্য করবে। আমি আশা করি, আলফাফোল্ড তারই একটি উদাহরণ।
স্মিথ: কিন্তু (এআই) কীভাবে কাজটা করছে, সে দিক থেকে যদি প্রশ্ন করি, এর (এআই) ফলে ব্যক্তি বিজ্ঞানীর জায়গাটা ঠিক কোথায় দাঁড়াচ্ছে? কারণ, এই ক্ষমতাটা তো অবিশ্বাস্য—মাইন্ড ব্লোয়িং। কিন্তু এখনো আলাদা আলাদাভাবে ব্যক্তি হিসেবে বিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন করছেন। তাহলে, দুটো মিলেমিশে বিষয়টা কী দাঁড়াচ্ছে?
ডেমিস: আমার ধারণা, অন্তত নিকট ভবিষ্যতে—যতটা আমরা দেখছি আরকি—আমার মনে হচ্ছে, এটা ব্যক্তি হিসেবে বিজ্ঞানীদের আরও অনেক কিছু করার সুযোগ করে দিচ্ছে। কারণ, এই ব্যবস্থাগুলো, এগুলো হচ্ছে টুল—যন্ত্র বা মাধ্যম। এগুলো ডেটা বা তথ্য দারুণভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে, প্যাটার্ন খুঁজে বের করতে পারে, অবকাঠামো খুঁজে নিতে পারে। কিন্তু জানেনই তো, কোন প্রশ্নটা সঠিক, ঠিক কোন প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে হবে, এগুলো তা নির্ণয় করতে পারে না। সঠিক কনজেকচার বা হাইপোথিসিস (পরীক্ষণযোগ্য সম্ভাব্য যথাযথ অনুমান) কোনটা, এগুলো তা বুঝতে পারে না। এগুলো মানুষকেই করতে হয়। আমার ধারণা, ভালো বিজ্ঞানীরা এসব টুলের সাহায্য নিয়ে অসাধারণ সব কাজ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে ছোট বা অল্প সদস্যের দল নিয়েও বিজ্ঞানীরা দারুণ কাজ করতে পারবেন বলে আমি মনে করি, কারণ খাটাখাটনির অনেক কাজের জন্য তাঁরা এসব টুলের ওপর নির্ভর করতে পারবেন।
স্মিথ: গুগল ডিপমাইন্ডের পরিবেশটা কী রকম, জানতে চাই।
ডেমিস: শুরু থেকেই আমরা এখানকার পরিবেশ এমনভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছি যেন কাটিং এজ (সর্বাধুনিক) গবেষণা করা যায়। পরিবেশটা যেন সেরকম হয়। চেষ্টা করেছি, বিভিন্ন ডিসিপ্লিন বা ক্ষেত্রের সেরা বিশেষজ্ঞরা যেন এখানে এক হতে পারেন। অবশ্যই মেশিন লার্নিং ও এআই বিশেষজ্ঞদের চেয়েছি আমরা। পাশাপাশি প্রকৌশল, পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, এমনকি দর্শনের মতো বিষয়ের বিশেষজ্ঞদেরও এক করতে চেয়েছি। মানে, সব বিষয়ের সেরাদের এক জায়গায় জড়ো করা, তাদের প্রয়োজনীয় সবকিছুর পর্যাপ্ত যোগান দেওয়া এবং সেগুলো কম্পিউট করার মতো রিসোর্স ও অন্যান্য সবকিছুর ব্যবস্থা করা। আমাদের আশা ছিল, এ থেকে দারুণ কিছু হবে। আগে আমরা বেল ল্যাবে এমনটা দেখেছিলাম (মার্কিন টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান এটিঅ্যান্ডটির এই গবেষণাগারে দারুণ সব গবেষণা হয়েছে, আবিষ্কৃত হয়েছে মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ বা কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডসহ আরও অনেক কিছু)। আর ওরকম জায়গাগুলোর স্বর্ণযুগের গল্প থেকে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। ফলে নিজেও আমি অমন কিছু করতে চেয়েছিলাম।
জানেনই তো, নতুন দিনের বিজ্ঞান, নতুন বিষয় ও ক্ষেত্রগুলো এবং নতুন আবিষ্কারের জন্য অনেক রিসোর্স প্রয়োজন। আমাদের ক্ষেত্রে, অনেক কম্পিউটার প্রয়োজন। আর, জানেনই তো, এ জন্য প্রয়োজন অনেক টাকা। তাহলে প্রয়োজনীয় ফান্ডিংয়ের জন্য প্রাইভেট খাতে গেলে সমস্যা কী?—ডেমিস হাসাবি
স্মিথ: কিংস ক্রসে নতুনভাবে বেল ল্যাব তৈরি করা, কী আশ্চর্য সুন্দর ব্যাপার! দারুণ আইডিয়া।
ডেমিস: হ্যাঁ, ঠিক তাই।
স্মিথ: শেষ প্রশ্ন। এই কাজটা যে প্রাইভেটভাবে করা হচ্ছে, এটা যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা নয়, গুগল ডিপমাইন্ডে কাজটা হচ্ছে, এতে কি কিছু যায় আসে? এটা কি কোনো পার্থক্য গড়ে দেয়?
ডেমিস: আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয়, সঠিকভাবে এগোলে আপনি যেখানেই গবেষণা করেন না কেন, গ্রেট সায়েন্স (ভালো গবেষণা) করতে পারবেন। তবে সেটা, বলা বাহুল্য, মৌলিক গবেষণা হতে হবে। জানেনই তো, নতুন দিনের বিজ্ঞান, নতুন বিষয় ও ক্ষেত্রগুলো এবং নতুন আবিষ্কারের জন্য অনেক রিসোর্স প্রয়োজন। আমাদের ক্ষেত্রে, অনেক কম্পিউটার প্রয়োজন। আর, জানেনই তো, এ জন্য প্রয়োজন অনেক টাকা। তাহলে প্রয়োজনীয় ফান্ডিংয়ের জন্য প্রাইভেট খাতে গেলে সমস্যা কী? যতক্ষণ আপনি সঠিকভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে কাজ করছেন, বৈজ্ঞানিক নৈতিকতা যথাযথভাবে মানছেন, বড় প্রশ্নগুলো নিয়ে কাজ করছেন, ততক্ষণ কোনো সমস্যা নেই। আমার ধারণা, গুগল ডিপ মাইন্ডে আমরা তা-ই করছি।
স্মিথ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আশা করি, আজকের রোমাঞ্চকর দিনটা আপনি দারুণভাবে উপভোগ করবেন।
ডেমিস: আপনাকেও ধন্যবাদ আমাকে সময় দেওয়ার জন্য।
স্মিথ: আচ্ছা। ধন্যবাদ, ডেমিস।