রেডিয়াম কেন বিপজ্জনক ধাতু

তেজস্ক্রিয় উপাদানগুলো এমন কণা নির্গত করে যা কোষের ক্ষতি করতে পারেছবি: গেটি ইমেজ

ধরুন, আপনার হাতে এক টুকরো রূপালি ধাতু আছে। দেখতে হয়তো সাধারণ কোনো পাথরের টুকরোর মতোই সাদামাটা। কিন্তু এই নিরীহ দেখতে বস্তুটিই হতে পারে এক নীরব ঘাতক। এর নাম রেডিয়াম। পৃথিবীতে এই ধাতু খুব সামান্যই পাওয়া যায়।

রেডিয়াম তার ভেতর থেকে অদৃশ্য এক শক্তি আর ক্ষুদ্র কণা ক্রমাগত ছুড়ে মারে। একে বলে তেজস্ক্রিয়তা বা রেডিয়েশন। এই বিকিরণ আপনি দেখতে পাবেন না। কারণ এর কোনো গন্ধ নেই। কিন্তু এটি আপনার অজান্তেই শরীরের ভেতরে ঢুকে মারাত্মক ক্ষতি করে ফেলতে পারে। এমন ক্ষতি, যা হয়তো ধরা পড়বে বহু বছর পর।

কিন্তু কেন কিছু মৌল এমন বিপজ্জনক আচরণ করে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে পদার্থের একেবারে মূলে, অর্থাৎ পরমাণুর ভেতরে। আমাদের চারপাশের সবকিছু, এমনকি আমাদের নিজেদের শরীরও পরমাণু নামে অতি ক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি। প্রতিটি পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে একটি নিউক্লিয়াস। এই নিউক্লিয়াসে প্রোটন আর নিউট্রন নামে দুই ধরনের কণা একসঙ্গে থাকে। আর এগুলোর চারপাশে ঘুরতে থাকে ইলেকট্রন। প্রোটনের চার্জ পজিটিভ, ইলেক্ট্রনের নেগেটিভ এবং নিউট্রনের কোনো চার্জ নেই। 

একটা পরমাণু কোন মৌল হবে, তা ঠিক করে মৌলের প্রোটন সংখ্যা। যেমন, কার্বনের সব পরমাণুর ৬টি প্রোটন থাকে, অক্সিজেনের থাকে ৮টি। আর রেডিয়াম অনেক ভারী, এর প্রোটন সংখ্যা ৮৮। মজার ব্যাপার হলো, একই মৌলের পরমাণুতে নিউট্রন সংখ্যা আলাদা হতে পারে। এদেরকে বলে আইসোটোপ।

আরও পড়ুন
একটা পরমাণু কোন মৌল হবে, তা ঠিক করে মৌলের প্রোটন সংখ্যা। যেমন, কার্বনের সব পরমাণুর ৬টি প্রোটন থাকে, অক্সিজেনের থাকে ৮টি। আর রেডিয়াম অনেক ভারী, এর প্রোটন সংখ্যা ৮৮।
একটি পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের মধ্যে নিউট্রন ও প্রোটন থাকে এবং ইলেকট্রন এর চারপাশে ঘোরে
ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

এখন, নিউক্লিয়াসের সঙ্গে প্রোটন আর নিউট্রন কতটা ভালোভাবে আছে, তার ওপরই সব নির্ভর করে। কিছু কিছু প্রোটন-নিউট্রনের মিশ্রণ খুব স্থিতিশীল। কিন্তু কিছু মিশ্রণ হয় অস্থিতিশীল। যখন কোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াস অস্থিতিশীল হয়, তখন সে স্থিতিশীল হওয়ার জন্য ভেঙে যেতে চায়। এই ভেঙে যাওয়ার প্রক্রিয়াকেই বলে তেজস্ক্রিয়তা বা তেজস্ক্রিয় ক্ষয়। যখন এই ভাঙন শুরু হয়, তখন নিউক্লিয়াস থেকে প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন কণা বা তরঙ্গ বিকিরণ হিসেবে বেরিয়ে আসে। এই অদৃশ্য শক্তিই আমাদের শরীরের কোষকে আক্রমণ করে অসুস্থ করে তোলে।

মাঝেমধ্যে এই ভাঙনের ফলে পরমাণুটি তার প্রোটনও হারিয়ে ফেলে। আর প্রোটন সংখ্যা বদলে যাওয়া মানে এটি আর আগের মৌল থাকে না, সম্পূর্ণ নতুন একটি মৌলে পরিণত হয়! এই প্রক্রিয়া খুব ধীরও হতে পারে, কিংবা লেগে যেতে পারে হাজার হাজার বছর।

রেডিয়ামের বেলায় এর সব পরমাণুই অস্থিতিশীল। তবে এর সবচেয়ে পরিচিত আইসোটোপ হলো Ra-226। এতে ৮৮টি প্রোটন আর ১৩৮টি নিউট্রন আছে। এটি সবচেয়ে ধীরে ভাঙে। এক টুকরো Ra-226-এর অর্ধেক ভেঙে অন্য মৌলে পরিণত হতে সময় লাগে ১ হাজার ৬০০ বছর! একে বলে অর্ধায়ু। এটি যখন ভাঙে, তখন তা রেডন নামে আরেকটি তেজস্ক্রিয় মৌলে পরিণত হয়। রেডন আবার ভাঙে...এভাবে ভাঙতে ভাঙতে একসময় সিসা নামে আরেকটি স্থিতিশীল মৌলে পরিণত হয়। আর এই প্রতিটি ধাপেই মারাত্মক তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়াতে থাকে। রেডিয়াম ছাড়াও ইউরেনিয়াম, পোলোনিয়ামের মতো আরও কিছু মৌল আছে যাদের কোনো স্থিতিশীল আইসোটোপ নেই।

আরও পড়ুন
এক টুকরো Ra-226-এর অর্ধেক ভেঙে অন্য মৌলে পরিণত হতে সময় লাগে ১ হাজার ৬০০ বছর! একে বলে অর্ধায়ু।এটি যখন ভাঙে, তখন তা রেডন নামে আরেকটি তেজস্ক্রিয় মৌলে পরিণত হয়।

এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ আমাদের শরীরের কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে ত্বকে পোড়া দাগ, ক্যানসার এবং অন্যান্য মারাত্মক রোগ হতে পারে। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো, এই ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয়তাকেই মানুষ ভালো কাজেও লাগাতে পারে। একে নিয়ন্ত্রণ করে ক্যানসারের মতো রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। তেজস্ক্রিয়তা দিয়ে ক্যানসারের কোষগুলোকে নিখুঁতভাবে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব।

মেরি এবং পিয়েরে কুরি রেডিয়াম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করায় তাঁদের স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দিয়েছিল
ছবি: আন্দ্রে কাস্টেইন

যারা এই তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে কাজ করেন, তাদের খুব কড়া নিয়ম মেনে চলতে হয়। তারা বিশেষ ঢাল এবং ডিটেক্টর ব্যবহার করেন। ১৮৯৮ সালে পিয়েরে ও মেরি কুরি এই রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু এই আবিষ্কারের জন্য তাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। মেরি কুরি সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদী বিকিরণের কারণেই রক্তস্বল্পতাজনিত রোগে ভুগে মারা যান। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ১০০ বছরেরও বেশি সময় পর, মেরি কুরির সেই গবেষণার নোটবুকগুলো এখনো তেজস্ক্রিয় হয়ে আছে। এ কারণেই রেডিয়ামের মতো ধাতু নিয়ে এত ভয়!

সূত্র: দ্য কনভার্সেশন-এর ‘কিউরিয়াস কিডস’ অবলম্বনে

আরও পড়ুন