আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে ডার্ক ম্যাটারের গুরুত্ব নিয়ে ১৯ জুন রাজধানীর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত হয় এক সেমিনার। ‘মেরুল বাড্ডা টকস ইন ম্যাথ অ্যান্ড ফিজিকস’ সেশনের অংশ হিসেবে আয়োজিত এই সেমিনারে ডার্ক ম্যাটার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাইস ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোস্তফা আমিন। কী এই ডার্ক ম্যাটার?
মহাবিশ্বের বিশালতা আর নান্দনিক গঠন সম্পর্কে জানতে বিজ্ঞানীরা দিনরাত কাজ করছেন। নতুন রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা চলছে। মহাবিশ্বের এমন এক রহস্যময় ও অদৃশ্য পদার্থের নাম ডার্ক ম্যাটার। গবেষকেরা মনে করেন, মহাবিশ্বের মোট ভরের প্রায় ২৭ ভাগ এই ডার্ক ম্যাটার দিয়ে তৈরি। সাধারণ দৃশ্যমান পদার্থের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি রয়েছে মহাবিশ্বে। দৃশ্যমান পদার্থ বলতে বোঝায় নক্ষত্র, গ্রহ, গ্যাস বা ধুলাবালিসহ আমাদের পরিচিত সবকিছু যে ধরনের পদার্থ দিয়ে তৈরি। ডার্ক ম্যাটার আলো বা অন্য কোনো তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ, যেমন রেডিও তরঙ্গ, এক্স-রে বা গামা রশ্মি শোষণ করে না। শুধু শোষণ নয়, প্রতিফলিত বা কোনো ধরনের রশ্মিও নির্গত করে না। এ কারণেই ডার্ক ম্যাটারকে সরাসরি দেখা যায় না বা শনাক্ত করা যায় না। মহাকর্ষীয় প্রভাবের মাধ্যমে এর অস্তিত্ব শনাক্ত করা যায়, এর পরিমাণ মাপা যায়। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, কিছু একটা আছে। সেটাকেই বলা হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার। এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে অনেক বছর লেগেছে বিজ্ঞানীদের। এখন তাঁরা ব্যস্ত এর প্রকৃতি বুঝতে।
সেমিনারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক শিক্ষার্থী, গবেষক এবং শিক্ষাবিদ উপস্থিত ছিলেন। অধ্যাপক মোস্তফা আমিন তাঁর বক্তব্যে প্রথমে ডার্ক ম্যাটারের মৌলিক ধারণাটি অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ডার্ক ম্যাটার কেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি পদার্থ। তিনি বলেন, ‘সাধারণ পদার্থ প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন দিয়ে গঠিত। এরা তড়িৎ-চুম্বকীয় বলের মাধ্যমে মিথস্ক্রিয়া করে। ফলে আমরা তাদের দেখতে পাই। কিন্তু ডার্ক ম্যাটারের ক্ষেত্রে তা ঘটে না। এর মৌলিক কণা (যদি থাকে) আলোর কণা বা ফোটনের সঙ্গে কোনো মিথস্ক্রিয়া করে না। ফলে এরা অদৃশ্যই রয়ে গেছে। ডার্ক ম্যাটারের রহস্যময়তার কারণ হলো, এটি মহাবিশ্বে প্রচলিত চারটি মৌলিক বলের (মহাকর্ষীয় বল, তড়িৎ-চুম্বকীয় বল, শক্তিশালী ও দুর্বল নিউক্লীয় বল) মধ্যে শুধু মহাকর্ষীয় বলের মাধ্যমে মিথস্ক্রিয়া করে। তাই আমরা এই পদার্থের অস্তিত্ব শনাক্ত করতে পারি, কিন্তু দেখতে পাই না। এই পদার্থ কোনো কিছু স্পর্শ করে না, কোনো শক্তিও নির্গত করে না।
অধ্যাপক আমিন ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ এবং আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে এর অপরিহার্য ভূমিকা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্যালাক্সি, গ্যালাক্সি ক্লাস্টার এবং কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ডার্ক ম্যাটারের অদৃশ্য উপস্থিতি অনুমান করেন। অধ্যাপক মোস্তফা আমিন তাঁর সেমিনারে এই পর্যবেক্ষণগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষণার বিভিন্ন ফলাফল তুলে ধরেন এবং ডার্ক ম্যাটার শনাক্ত করার জন্য চলমান বিভিন্ন পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা সম্পর্কেও আলোকপাত করেন। সেমিনারে শিক্ষার্থীরা ডার্ক ম্যাটারের প্রকৃতি, ভবিষ্যৎ গবেষণা এবং মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। ধৈর্য ধরে সেগুলোর জবাব দেন মোস্তফা আমিন।
সেমিনারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দা তাসনুভা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানের গবেষকের কাছ থেকে সরাসরি ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে জানতে পারা আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এ ধরনের সেমিনার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক কৌতূহল বাড়াতে এবং গবেষণার প্রতি আগ্রহী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী তাহমিদ শাহরিয়ার বলেন, ‘এখন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা অনেক বৈশ্বিক গবেষণায় অংশ নিচ্ছে। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য এই সেমিনার বেশ কার্যকর।’