ডিএনএ পরিবর্তনের মাধ্যমে উৎপাদিত উন্নত ফসল ও এ বিষয়ক নীতিমালা নিয়ে আয়োজিত হলো সেমিনার। ‘বাংলাদেশে জিএমও ফসল: নীতি ও অনুশীলন’ নামের এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় ২৮ অক্টোবর, শনিবার রাজধানীর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে (এনএসইউ)।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্স (এসপিআইজি) ও এনএসইউ-ইউডব্লিউএ এগ্রিবিজনেস সেন্টার অব এক্সিলেন্স (এসিই) যৌথভাবে এ আয়োজন করে। সেমিনারে জিএমও ফসল, এ সম্পর্কিত বর্তমান নীতিমালা ও কার্যক্রম মূল্যায়ন, জিএমও নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা, জিএমও গবেষণা ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ, অগ্রগতি ও ভবিষ্যতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ—এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও মূল বক্তা ছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরতত্ত্বে নোবেলজয়ী স্যার রিচার্ড জে রবার্টস। সভাপতিত্ব করেন এনএসইউ উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম। বিশেষজ্ঞ হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক, এনএসইউর বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল খালেক, এসআইপিজির সহযোগী অধ্যাপক এম মাহফুজুল হক, পরিবেশ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শওকত ইসলাম সোহেলসহ আরও অনেকে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এনএসইউ-ইউডব্লিউএ এগ্রিবিজনেস সেন্টার অব এক্সিলেন্সের (এসিই) অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘এ ধরনের আলোচনার মাধ্যমে দেশ-বিদেশের গবেষকদের মতবিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এটা গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
‘পৃথিবীর অনেক উন্নয়নশীল দেশে শিশুরা খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছে, ভুগছে অপুষ্টিতে। জিএমও ফসল—ডিএনএ পরিবর্তনের মাধ্যমে উৎপাদিত উন্নত ফসল—এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
এর পরেই বক্তব্য রাখেন প্রধান অতিথি নোবেলজয়ী স্যার রিচার্ড জে রবার্টস। স্যার রিচার্ড বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক উন্নয়নশীল দেশে শিশুরা খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছে, ভুগছে অপুষ্টিতে। জিএমও ফসল—ডিএনএ পরিবর্তনের মাধ্যমে উৎপাদিত উন্নত ফসল—এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কম জমিতে, কম সময়ে বেশি ফলন পাওয়া যেতে পারে জিএমও ফসলের মাধ্যমে। অনেকে বলেন, জিএমও ফসল ক্ষতিকর। এ ধরনের কথা দ্রুত ছড়িয়ে যায়। তবে এটা ঠিক নয়। বৈজ্ঞানিকভাবে যতরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে, কোথাও এতে ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি। কারণ, জিএমও ফসলে আসলে খারাপ কিছু বা অপ্রাকৃতিক কিছু দেওয়া হয় না। এটা মানুষের কল্যাণে বানানো। ভালো ফসল থেকে জিন নিয়ে পরিবেশ উপযোগী উচ্চ ফলনশীল ও উপকারী ফসল বানানোই জিএমওর কাজ।’
ইংরেজিতে ‘জিএমও’ শব্দটির পূর্ণরূপ হলো জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অর্গানিজম। অর্থাৎ এমন জীব, যার ডিএনএ সিকোয়েন্স পরিবর্তন করা হয়েছে। পরিবর্তনটা হতে পারে অন্য কোনো জীবের জিন অনুপ্রবেশ করানোর মাধ্যমে অথবা নির্দিষ্ট ডিএনএ সিকোয়েন্স বিলুপ্তি ও নতুন ডিএনএ সিকোয়েন্স প্রতিস্থাপন বা জিনোম এডিটিংয়ের মাধ্যমে। অর্থাৎ জিএমও ফসল বলতে বোঝানো হয় ডিএনএ পরিবর্তনের মাধ্যমে উৎপাদিত উন্নত জাতের ফসল। আর জিএম ফুড হলো এ ধরনের ফসল থেকে প্রাপ্ত খাদ্য। সয়াবিন, তুলা, সুগারবিট, বেগুন, পেঁপেসহ বর্তমানে বিশ্বজুড়ে শতাধিক জিএমও ফসল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে। শুধু খাদ্যই নয়, গুরুত্বপূর্ণ কিছু ওষুধও জিএমও থেকে সংগ্রহ করা হয়। যেমন ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় রিকম্বিন্যান্ট ইনসুলিন। এই ইনসুলিন নিয়মিতই মানুষ গ্রহণ করছেন। এতে কারো ক্ষতি হচ্ছে না, বরং জীবন রক্ষা পাচ্ছে অনেকের।
সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক বাংলাদেশে জিএমও ফসলের সম্ভাবনা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘২০৪০ সালের মধ্যে আমাদের খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ দ্বিগুণ করতে হবে। এর একটা উপায় জিএমও ফসল—মডিফায়েড জিনবিশিষ্ট শস্য। এ নিয়ে নানারকম ভুল ধারণা আছে। সেগুলো ভাঙাতে হবে এবং এ পথে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কারণ, এতে ক্ষতিকর কিছু আসলে নেই। অন্তত বিজ্ঞান আমাদের তাই বলে। তবে এটা কৃষকদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। বরং এটা একটা অপশন—বিকল্প। যেন প্রয়োজনে আমরা এর সাহায্য নিতে পারি।’
অধ্যাপক আব্দুল খালেক কৃষিতে জীবপ্রযুক্তির গুরুত্বের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। সে জন্য জিএমও ফসল বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন বিটি বেগুন। এটা একধরনের জিএমও ফসল। এতে কীটপতঙ্গ খুব বেশি ধরে না। তাই কৃষকেরা ৫১% ফলন বাড়াতে পেরেছেন, কীটনাশক ব্যবহার কমে গেছে ৬৬%-এর মতো। কীট আক্রমণের হার কমে গেছে ৩৭%-এর মতো। প্রায় নয় বছর এটা বাজারে আছে। এতে ক্ষতিকর কিছু নেই।
এ ছাড়াও গোল্ডেন রাইস যেমন ফিলিপিনে অনুমোদিত। যুক্তরাষ্ট্রের রকফেলার ফাউন্ডেশন এর সঙ্গে আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেবা ইসলাম সেরাজ, অধ্যাপক হাসিনা খানের মতো গবেষকেরা এ নিয়ে কাজ করেছেন। এটাও বাংলাদেশে অনুমোদন পেলে আমাদের জন্য ভালো হবে।’
এ ছাড়াও অন্য বক্তাদের কথায় উঠে আসে জিএমও ফসলের নানা দিক। এম মাহফুজুল হক বাংলাদেশে জিএমও নীতিমালা সম্পর্কে আলোচনা করেন। শওকত ইসলাম সোহেল দেশে জিএমও ফসল চাষের ক্ষেত্রে পরিবেশগত যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে, তা নিয়ে আলোচনা করেন। তবে বক্তারা এও জানান, এসব বিষয়—যেমন কোনো ফসল কতটা নাইট্রোজেন বাতাসে ছাড়ছে, জলবায়ুতে কী প্রভাব ফেলছে—সব ফসলের ক্ষেত্রেই এটা খেয়াল রাখতে হবে।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এসআইপিজির পরিচালক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস কে তৌফিক এম হক। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সের ডিন অধ্যাপক হাসান মাহমুদ রেজা সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।