সন্ধ্যা নামার আগমুহূর্তে খোলা মাঠে কাজ করছিলেন কয়েকজন কৃষক। একসময় আকাশে দেখতে পান বিশাল দুটি পাখি ওপর-নিচ করে নেমে আসছে। কাজ রেখে তাঁরা দেখেন, প্রথম পাখিটি নামে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের তারের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়াল প্রচণ্ড শব্দে। পাখিটিও সশব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ার আগে দ্বিতীয় পাখিটি নামল ওটার পাশে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, সঙ্গীর বিপদে ওটা এগিয়ে এসেছিল উদ্ধার করতে। আবারও প্রচণ্ড শব্দ, স্ফুলিঙ্গ, পরমুহূর্তেই মাটিতে পতন। দেখতে দেখতে সন্ধ্যার অন্ধকার যেমন নেমে এল, তেমনি বাড়ল উত্সুক মানুষের ভিড়। কত বড় পাখি? কী পাখি এ দুটি? মাংস খাওয়া যাবে? বয়সী মানুষেরা চিনলেন—শকুন এ দুটি। যাঁদের বয়স ৩০ থেকে ৪০ বছর, তাঁরা তো শকুনই দেখেননি, চিনবেন কীভাবে! নতুন প্রজন্মের বহুজনই শকুনের নাম পর্যন্ত শোনেননি। অথচ ১৯৭০ সাল পর্যন্ত শত শত দেশি শকুন বা গিন্নি শকুন ছিল আমাদের দেশে। এখন বলতে গেলে উধাও! আঙুলে গোনা কিছু গিন্নি শকুন টিকে আছে সিলেটের বনে। তবে বেশি বয়স্ক ব্যক্তিরা বললেন, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট শকুন দুটি গিন্নি শকুন বা দেশি শকুন নয়। অন্য কোনো বিদেশি শকুন হবে। উপস্থিত উত্সাহী কিছু নারী ও শিশু-কিশোর মৃত শকুন দুটির ডানার বড় বড় পালক টেনে তুলে বাড়িতে নিয়ে গেল।
এ ঘটনা ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বরের, নরসিংদী জেলার চরসিন্দুর ইউনিয়নের মালিতা গ্রামের। চরসিন্দুর সদরেই পাখি আলোকচিত্রী ও পাখিপ্রেমী সরওয়ার পাঠানের বাড়ি। খবর শুনে তিনি পরদিন সকালে মালিতা গ্রামে যান। মৃত ঝলসানো শকুন দুটিকে তিনি যথাস্থানে পড়ে থাকতে দেখেন। ছবি তোলেন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে আলাপ করেন তিনি। একটি শকুনের ডানা ধরে শূন্যে তুলে আন্দাজে ওজন হিসাব করেন, ১০ থেকে ১২ কেজি তো হবেই! শকুন দুটিকে তিনি শনাক্তও করেন। আনাড়ি বা কম বয়সী শকুন ও দুটি, জীবনে প্রথমবার বাংলাদেশে এসেছিল শীতের পরিযায়ী পাখি হিসেবে। অনভিজ্ঞ। তা না হলে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের তারে রাতের আশ্রয় শকুন দুটি নিতে চাইত না। বিদ্যুতায়িতও হতো না। বসার জন্য আশপাশে বড় বড় গাছ তো ছিলই!
এই প্রজাতির শকুন আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে আসছে শীতকালে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এগুলোর খাদ্যসংকট ছিল না। এখন তো খাদ্যসংকট প্রবল-প্রকট। এ ছাড়া আরও কয়েকটি বিজ্ঞানসম্মত কারণে এ দেশ থেকে বাংলাদেশি শকুন যেমন ‘নেই’ হয়ে যেতে বসেছে, তেমনি এই পরিযায়ী শকুনও তার নিজ দেশে কিংবা বাংলাদেশে মোটেও ভালো অবস্থায় নেই। বিজ্ঞানসম্মত কয়েকটি কারণেই এই দুর্দশা। তবে আমার বিবেচনায় অন্যতম মূল সংকট হচ্ছে খাদ্যসংকট। বাংলাদেশে আজ আর গরু-মহিষ মরে না, মরার আগেই মাংস হয়ে কসাইখানায় ঝুলে যায়। ক্বচিৎ মরার সুযোগ পেলেও জনমানুষের স্বাস্থ্যসচেতনতার কারণে মাটিচাপা পড়ে যায়। গবাদিপশুর চিকিত্সাসেবাও এখন অনেক উন্নত মানের। মৃত্যুর হার তাই গত ৫০ বছরের তুলনায় অনেক কম। শকুনের মূল খাবারই হলো গরু-মহিষের মড়ি বা মৃতদেহ, যা সত্তর দশক পর্যন্ত মাঠ-চর-খোলা প্রান্তর, হাওর-বাঁওড়ের শুকনা জায়গাসহ নদীতীরে ফেলে দেওয়া হতো। ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন নেমে মাংস খেত হুড়োহুড়ি-কাড়াকাড়ি ও টানাটানি-ঝগড়াঝাঁটি করে। বাংলাদেশের যেসব মানুষের বয়স এখন ৫০ বছরের বেশি, তাঁদের শকুনের স্মৃতি খুবই সমৃদ্ধ। আমি নিজেও আমার বয়সী বন্ধুবান্ধবসহ বাল্য, কৈশোর ও তরুণবেলায় শকুনকে এতবার মড়ি খেতে দেখেছি যে তা মনে পড়লে এখন নস্টালজিক হয়ে পড়ি। দেখলাম রাজশকুন, দারোগা শকুন বা মোরগ শকুন (Red-headed Vulture), গিন্নি শকুন ও ক্বচিৎ পুলিশ শকুন (Slender-billed Vulture)। গিন্নি শকুন বা দেশি শকুনের (White-Rumpl Vulture), দৈর্ঘ্য ৮৫-৯০ সেন্টিমিটার, ওজন ৪ দশমিক ৩ কেজি। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Gyps bengalensis। ছেলেবেলায় আমার গ্রামে বা বাগেরহাটের অন্য কোথাও নরসিংদীর চরসিন্দুরের ওই প্রজাতি নজরে পড়েনি। গবাদিপশুর মড়ক লাগলে কতশত শকুন যে আসত! দারোগা শকুন, পুলিশ শকুন (বাগেরহাটের স্থানীয় নাম) ও গিন্নি শকুনগুলো একসঙ্গে খেত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে খুলনা-বাগেরহাটে গবাদিপশুর মড়ক লেগেই ছিল। দক্ষিণ বাংলায় নরসিংদীর ওই প্রজাতি যেত না। নাকি যেত! ক্বচিৎ পুলিশ শকুন দু-একটি দেখতাম। বাগেরহাট-ফকিরহাটে পুলিশ শকুন যেটিকে বলা হতো, সেটিও কিন্তু শীতের পরিযায়ী শকুন। এখন বোধ হয় ওগুলো আর আসে না আমাদের দেশে! আসে কি কালো শকুন!
চরসিন্দুরের বিদ্যুতায়িত মৃত শকুন দুটি ছিল কম বয়সী, আনাড়ি ও ক্ষুধার্ত। পেটের দায়ে বাংলাদেশে এসে খাবার কি আর মেলে সহজে! খাবার না পেলে কদিন আর শক্তি থাকে শরীরে, বিশাল দুখানা পাখায়? উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে ঊর্ধ্বাকাশে চক্কর মারে পেটের জ্বালায়—চোখে মড়ি পড়ে না! তাই তো বুঝি দুর্বল হয়ে ১ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি শহরের মধ্যে ও খাগড়াছড়ি শহর থেকে অল্প দূরের ‘চারমাইল’ নামের স্থানে দুটি একই প্রজাতির শকুন ভূপতিত হয়। স্থানীয় জনগণ বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেন। গত ৬ জানুয়ারি পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ার একটি ধানখেতে আরেকটি একই প্রজাতির শকুন আছড়ে পড়ে। বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয় সেটিও। বন বিভাগের ভাষ্যমতে, শকুনটি ক্ষুধার্ত ও অসুস্থ ছিল। চিকিত্সা দিয়ে ও খাবার খাইয়ে শকুনটিকে সুস্থ-সবল করে যথাসময়ে (এপ্রিল মাসে) অবমুক্ত করবে বন বিভাগ। শকুনটি ফিরে যাবে আবার নিজের দেশে।
বন বিভাগের উদ্যোগে দেশের দু-একটি স্থানে এই পরিযায়ী শকুনগুলোর জন্য রেসকিউ সেন্টার বা সেবাকেন্দ্র খোলা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে আরও নানা রকম প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ক্ষুধার্ত ও অসুস্থ (যেগুলোর অধিকাংশই জীবনের প্রথমবার পরিযায়ন করেছে বাংলাদেশে, অনভিজ্ঞতার কারণে যত্সামান্য খাদ্য কোথাও থাকলেও সন্ধান পায়নি) শকুন মাটিতে পড়ার খবর পেলেই আনা হচ্ছে সেবাকেন্দ্রে, চিকিত্সায় সুস্থ হচ্ছে। নিয়মিত খাবার পেয়ে সবলও হচ্ছে, যথাসময়ে অবমুক্ত করা হচ্ছে। প্রতিবছরই মাটিতে পড়া শকুনের খবর জানা যায় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেগুলোর অধিকাংশই পরিযায়ী হিমালয়ান শকুন। গত পাঁচ দশকের ভেতরে মাত্র কয়েকবার পরিযায়ী কালো শকুনের (cinereous vulture) কথা জানা যায়। যেগুলো মাটিতে আছড়ে পড়েছিল, ওগুলোর কিছু ছবি আমার সংগ্রহে আছে।
কয়েক বছর ধরে মাটিতে পড়া সব শকুনই হচ্ছে হিমালয়ান শকুন। দৈর্ঘ্য ১২০ সেন্টিমিটার, ওজন ১০ কেজি। এটি বৃহত্তম ‘গিদরি’ নামেও পরিচিত। নরসিংদী-খাগড়াছড়ি ও পটুয়াখালীর শকুনগুলো এই প্রজাতির। নীলফামারী-দিনাজপুর-লালমনিরহাট অঞ্চলে এ বছরও ২০ থেকে ২৫টি শকুন সেবাকেন্দ্রে স্থান পেয়েছে। প্রতি শীতেই ওগুলো আসত, আসছে ও আসবে। ওগুলোকে বাঁচাতে হবে, যত্ন করতে হবে ও যথাসময়ে অবমুক্ত করতে হবে। বন বিভাগ ও সাধারণ মানুষ সচেতন হলেই হিমালয়ান শকুনগুলো মাটিতে পড়ে গেলেও যথাযথ বাঁচার ঠিকানা পাবে। এ ছাড়া তো উপায়ও নেই। সেই ৫০ থেকে ১০০ বছর আগের পরিবেশ আর তো ফিরিয়ে আনা যাবে না কিছুতেই। মাঠঘাট, নদীতীর-চর, হাওর-বাঁওড়ের শুকনা জায়গায় পড়ে থাকবে না গরু-মহিষের মরদেহ। কৃত্রিমভাবে সারা দেশে এই ব্যবস্থা তথা খাবার সরবরাহ করাও সম্ভব নয়। গিন্নি শকুন বা দেশি শকুনও তাই আগের অবস্থায় আসবে না ফিরে আমাদের এই বাংলাদেশে।
লেখক: পাখিবিশারদ