সাক্ষাৎকার

‘জগৎটাকে গাণিতিকভাবে দেখা শুরু করা উচিত’—আরশাদ মোমেন

অধ্যাপক আরশাদ মোমেন বর্তমানে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে ফিজিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগে কর্মরত। এর আগে ২৪ বছর অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পদার্থবিজ্ঞান তাঁর ধ্যানজ্ঞান। বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড দলের কোচ। পদার্থবিজ্ঞানের কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে সহজ করে লিখেছেন বিজ্ঞানচিন্তায়। সম্প্রতি তিনি এসেছিলেন বিজ্ঞানচিন্তা কার্যালয়ে। সে সময় বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর, পড়াশোনা, গবেষণা, দর্শন, ফিজিক্স অলিম্পিয়াডসহ আরও অনেক কিছু। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার ও সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানচিন্তায় আপনাকে স্বাগত। শুরুতেই জিজ্ঞেস করি, কেমন আছেন?

আরশাদ মোমেন: আমি ভালো আছি। ধন্যবাদ।

বিজ্ঞানচিন্তা:

অনেকের কাছে পদার্থবিজ্ঞান মানেই একটা রসকষহীন বিষয়। এ কারণে শিক্ষার্থীদের একাংশ পদার্থবিজ্ঞান পড়তে চায় না। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

আরশাদ মোমেন: আমি এটাকে একটা তুলনা দিয়ে বলি। উচ্চাঙ্গসংগীতও তো অনেকে পছন্দ করেন না। কারণ, জিনিসটা সবাই বুঝতে পারেন না। উচ্চাঙ্গসংগীত সম্পর্কে যাঁদের জানা আছে বা যাঁরা শিখেছেন, তাঁরা কিন্তু খুব পছন্দ করেন, প্রশংসা করেন। পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়টাও অনেকটা এমন। গত ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শিক্ষার্থীরা প্রথম পর্যায়ে বেশ কিছু সময় পদার্থবিজ্ঞান পছন্দ করে। কিন্তু কিছুদিন পর গিয়ে জিনিসটা থেকে তারা সরে যায়। কারণ, আমার ধারণা, আমাদের দেশে বেশির ভাগ স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের অনেকেই পদার্থবিজ্ঞান সুন্দর করে শেখাতে পারেন না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে শিক্ষার্থীরা মুখ থুবড়ে পড়ে।

সহজ ও আকর্ষণীয়ভাবে পদার্থবিজ্ঞানকে তুলে ধরতে হবে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে গণিত সঠিকভাবে বোঝা। পদার্থবিজ্ঞানে ভালো করতে হলে বা বিষয়টাকে ঠিকভাবে বুঝতে হলে গণিতের জ্ঞান থাকা খুব জরুরি। যেমন আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী (a+b)2-এর সূত্র মুখস্থ করে লেখে a2 + 2ab + b2। কিন্তু এটা খুব সহজ একটি উদাহরণের মাধ্যমে মনে রাখা যায়। উদাহরণটা এমন—একটা বর্গক্ষেত্রকে এমনভাবে টুকরা করি, যাতে বর্গক্ষেত্রের পাশগুলোকে a ও b দৈর্ঘ্যে ভাগ করা যায়। এভাবে বর্গক্ষেত্রের চারটা টুকরা হবে। এর মধ্যে দুটো বর্গক্ষেত্র ও দুটো আয়তক্ষেত্র পাওয়া যায়। দুটো বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল হবে a2 + b2, আর দুটো আয়তক্ষেত্রের জন্য তা হবে 2ab। এভাবে শেখালে শিক্ষার্থীরা সুন্দর করে শিখতে পারবে।

আমি পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াডসহ অন্যান্য অলিম্পিয়াডের সঙ্গে অনেক দেরিতে যুক্ত হয়েছি। আগে কায়কোবাদ স্যার (কম্পিউটারবিজ্ঞানী মোহাম্মদ কায়কোবাদ) ও জাফর ইকবাল ভাই (শিক্ষাবিদ ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল) এসব অলিম্পিয়াড করতেন। যেটুকু দেখেছি বা আমার যেটা মনে হয়েছে যে আমাদের আসলে জাতীয় পর্যায়ে একটা ইনস্টিটিউট দরকার। এনসিটিবি যে কাজ করে, সেটা সবাইকে পড়ানোর জন্য। কিন্তু পড়ালেখাটাকে আনন্দদায়ক করতে আমাদের কাজ করতে হবে। আমিও এনসিটিবির দু-একটা বইয়ের কিছু অংশ পর্যালোচনায় অংশ নিয়েছিলাম। তখন আমার মনে হয়েছে, নিয়তটা ভালো, কিন্তু প্রয়োগ করাটা খুব মুশকিল। কারণ, এখানে যে দক্ষ শিক্ষক লাগবে, তা আমাদের নেই। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না দিয়ে এসব জিনিস প্রয়োগ করে লাভ নেই।

অনেক কথা বললাম। তবে সারকথা হচ্ছে, আপাতদৃষ্টে পদার্থবিজ্ঞানকে রসকষহীন মনে হতে পারে, তবে প্রচুর লোক এ বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। এ বিষয়ে ভালো ভালো কাজ হচ্ছে। শুধু পেশা হিসেবে নয়, তাঁরা বিষয়টাকে ভালবাসেন। বিষয়টাতে রাতারাতি আগ্রহ জন্মায় না, সে জন্য সময় লাগে।

অধ্যাপক আরশাদ মোমেন
বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি নিজে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে আগ্রহী হলেন কেন? এর পেছনে কি কোনো বিশেষ ঘটনা ছিল?

আরশাদ মোমেন: হ্যাঁ, আপনি আমাকে জীবনের অন্যতম সেরা প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছেন। আমার বন্ধুবান্ধব বা সমসাময়িক কেউই আমাকে পদার্থবিদ হিসেবে মনে রাখেনি। আমি পড়াশোনা করেছি ক্যাডেট কলেজে। ‘কলেজ’ বলতে বোঝাচ্ছি সপ্তম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। প্রথম যখন কলেজে গেলাম, আমার খেতাব ছিল ‘আলকেমি’। কারণ, আমি রসায়নে অনেক ভালো ছিলাম। আমি তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি—এই সময়ে সবার কাছে খুব বিরক্তিকর ছিলাম। বিরক্তিকর বলছি কারণ, বাসায় তরলজাতীয় কিছু পেলেই একটাকে আরেকটার সঙ্গে মিশিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতাম। ব্যাটারি বা বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ভেঙে দেখতাম।

দাদার বাড়ি থেকে একবার আমি চারটা টেবিলঘড়ি ছিনতাই করে ভেঙেছিলাম শুধু এটা দেখার জন্য যে ঘড়ির কাঁটা কীভাবে শব্দ করে, ভেতরটা কীভাবে তৈরি।

অন্যদিকে আমার পড়াশোনাটা একটু উদ্ভট। কারণ, আমি ছোট থেকে ছয়-সাত বছর বয়স পর্যন্ত ইরানে ছিলাম। অন্য শিশুদের যেভাবে স্কুল শুরু হয়, আমার স্কুলিংটা সেভাবে শুরু হয়নি। বাড়িতেই পড়াশোনা করেছি। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বাসায় পড়িয়েছেন আমার মা। আমার নানি বাংলাদেশ থেকে বই পাঠাতেন, ওই বই দিয়ে মা আমাকে পড়াতেন। দেশে আসার পর আমার একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন; কারণ, আমি বাংলায় লিখতে চাইতাম না। আবার লিখতামও বাঁ হাতে। গৃহশিক্ষকের মূল কাজ ছিল ডান হাতে লেখা শেখানো। মা আমার গৃহশিক্ষকের কাছে নালিশ করলেন যে আমি বিভিন্ন পরীক্ষা করতে গিয়ে তাঁর লিপস্টিক, বার শেভিং ফোমসহ বিভিন্ন প্রসাধনী নষ্ট করে ফেলি। তখন পঞ্চম শ্রেণিতে সবে উঠেছি। মায়ের কাছ থেকে এসব কথা শুনে আমার সেই গৃহশিক্ষক আমাকে মাধ্যমিকের রসায়ন বই এনে দিয়ে বললেন, ‘তুই এত শয়তানি করিস, আগে এটা পড়; তারপর দেখি এগুলো তুই পারিস কি না।’ সেই থেকে রসায়নের সঙ্গে আমার পরিচয়।

সপ্তম শ্রেণিতে ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় আমার নবম-দশম শ্রেণির রসায়ন বই সম্পূর্ণ পড়া শেষ। কেউ আমাকে রসায়নের কিছু বললে আমি গড়গড় করে সব সঠিক বলতে পারতাম। এর ফলেই আমার নিকনেম হয়ে যায় ‘আলকেমি’। আমার প্রথম প্রেম যদি বলা হয়, তাহলে তা হলো রসায়ন।

তখন সিনিয়র ভাইদের মধ্যে একজন আমাকে বিএসসি লেভেলের একটা রসায়ন বই দিলেন, সেটা মির পাবলিশার্সের রুশ বই, কিন্তু ইংরেজিতে লেখা। সেই বই পড়তে গিয়ে দেখি, পারমাণবিক গঠন (Atomic Structure) আছে এবং সেখানে লেখা আছে বোর মডেল, শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণ ইত্যাদি। তখন তো আমি ওগুলো সম্পর্কে কিছু জানতাম না। সেই ১৯৭৯ সালের কথা বলছি। সে বছর প্রফেসর আবদুস সালাম (পাকিস্তানি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী) নোবেল পুরস্কার পেলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি স্টিভেন ওয়াইনবার্গ ও শেল্ডন লি গ্ল্যাশোর সঙ্গে যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। প্রথম কোনো মুসলিম বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এ নিয়ে ঢাকায় তখন অনেক আলোড়ন চলছে।

সে সময় বাংলা একাডেমি বিজ্ঞান পত্রিকা বের হতো। আমি পারমাণবিক গঠনের ওপর বই খুঁজতে গিয়ে দেখি, ওটা পদার্থবিজ্ঞানের ব্যাপার। তখন জানলাম যে ‘পদার্থবিজ্ঞান’ বলে একটা বিষয় আছে, যার ভেতর এটা নিয়ে আলোচনা হয়। আমি পড়তে গিয়ে দেখি, কিছুই বুঝি না, সব অঙ্কের ভাষা। এক সিনিয়র ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী? তিনি বললেন, ক্যালকুলাস। তখন আমার মাথায় এল যে এই বই পড়ে বুঝতে হলে আগে ক্যালকুলাস শিখতে হবে। আমি ছুটিতে কলেজের এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ক্যালকুলাস বই ধার নিলাম। সেই বই থেকে নিজে নিজেই এক মাসের প্রচেষ্টায় ক্যালকুলাস শিখে ফেললাম। তারপর আমি পদার্থবিজ্ঞান বুঝতে শুরু করি। আরও জানতে পারলাম যে যতই রাসায়নিক বিক্রিয়া করি না কেন, এর পেছনে কাজ করে পদার্থবিজ্ঞান। তখন থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে পথচলা শুরু। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

স্নাতকে আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। শুনেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্টিভেন ওয়াইনবার্গের দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। আপনি নাকি মূল কপিটা সংগ্রহ করতে না পেরে সম্ভবত হারুন স্যারের (অধ্যাপক এ এম হারুন-অর-রশীদ) কাছ থেকে সেই বই ধার নিয়ে পুরো বই হাতে লিখে কপি করেছিলেন। গল্পটা শুনতে চাই।

আরশাদ মোমেন: এই গল্পের মধ্যে কিছুটা ভুলভ্রান্তি আছে। আমার জেনারেল রিলেটিভিটি (GR) শেখার খুব ইচ্ছা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে স্টিভেন ওয়াইনবার্গের জেনারেল রিলেটিভিটির ওপর লেখা বইয়ের একটা কপি ছিল। তবে সেটা ইস্যু করা ছিল আমাদের আরেক স্যারের কাছে। তখন আমি জানতাম যে হারুন স্যারের কাছে বইটার ব্যক্তিগত কপি আছে। সাহস করে সেটাই স্যারের কাছে চাইলাম। স্যার আমাকে বইটা দিলেন।

আমরা তখন থাকতাম কুর্মিটোলার কাওলায়। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আসতে কুর্মিটোলা থেকে শাহবাগ পর্যন্ত বাসভাড়া ছিল সাড়ে তিন টাকা। আর কুর্মিটোলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত আড়াই টাকা। তখন এক পাতা ফটোকপির এক পাশ করতে দুই টাকা লাগত। স্টিভেন ওয়াইনবার্গের সেই বই ছিল ৭৫০ পাতার। সেটা ফটোকপি করতে গেলে আমার দেড় হাজার টাকা খরচ হবে। সে সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। এটা যদি বাসভাড়ার সঙ্গে তুলনা করি, বুঝতেই পারছেন, অনেক ব্যয়বহুল। তখন ছুটি চলছে, আমার হাতে অনেক সময়। সৃষ্টিকর্তার অশেষ দয়া যে আমাদের ওই সময় ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব ছিল না। থাকলে আমার মনে হয় না যে আমার পড়াশোনা আদৌ হতো। বাসার সামনে মাঠ ছিল, সেখানে দিনের বেলায় ক্রিকেট খেলতাম। আমার পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে প্রতিদিন লেগ স্পিন প্র্যাকটিস করতাম। আর সন্ধ্যা হলেই আমি ওই বই নিয়ে পড়তাম।

তখন আমি প্রতিটি পাতা হাতে লিখে লাইন বাই লাইন কপি করেছি। ২৪০ পৃষ্ঠার তিনটা মোটা মোটা খাতা লেগেছে। প্রতিটি জিনিস পড়েছি এবং তারপর লিখেছি। ফলে যা একবার শিখেছি, তা ভালোভাবে শেখা হয়েছে। বইটার নাম হচ্ছে গ্র্যাভিটেশন অ্যান্ড কসমোলজি। বইটার ইন্ডিয়ান কপি এখন আমার কাছে আছে। হাতের লেখাটা এখন আর রাখিনি; কারণ, এই ভার্সনটা এখন অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। আর বইটা এখন আর আমি পড়ি না বা ওটা ধরে পড়াই না। কারণ, এর চেয়ে অনেক জ্যামিতিভিত্তিক বই এখন বেরিয়েছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বটা হচ্ছে একটা জ্যামিতিক তত্ত্ব। জ্যামিতিক উপায়ে লেখা অনেক ভালো বই এখন পাওয়া যায়। আমি সেগুলো পড়ি ও পড়াই।

আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে গেলাম, সেখানে দেখি জ্যামিতিকভাবে সবকিছু পড়ানো হয়। আমি যখন বললাম যে আমি স্টিভেন ওয়াইনবার্গের বই পড়ে এসেছি, তারা চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিল যে আমার আসলে তেমন কিছু পড়া হয়নি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ওয়াইনবার্গের বইটা খারাপ। বলা যেতে পারে, সময়ের সঙ্গে যে জ্ঞানের পরিধির পরিবর্তন হয়, এটা তার একটা উদাহরণ।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানচিন্তা:

পিএইচডি শেষ করেই কি আপনি সার্নে চলে যান?

আরশাদ মোমেন: আমি পোস্টডক থাকা অবস্থায় সার্নে গিয়ে কিছুদিন কাজ করেছি। পোস্টডক করেছি অক্সফোর্ডে। আমি যাঁর অধীন অক্সফোর্ডে পোস্টডক করেছি, তিনি সার্নে কাজ করতেন। তিনিই আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে কিছু কাজ করিয়েছেন। সার্নে আমি নিযুক্ত ছিলাম না, নিযুক্ত ছিলাম অক্সফোর্ডে। অক্সফোর্ডের যে কেউ সার্নে গিয়ে কাজ করতে পারতেন। ইউরোপের যে কেউ, যাঁরা ইউরোপের নাগরিক ও সার্নের সদস্যপদ আছে, এমন যেকোনো মানুষ সার্নে গিয়ে কাজ করতে পারেন। আমার এখনো সার্নে যাওয়া-আসা আছে। সার্নের সঙ্গে আবারও যোগাযোগ শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে সার্নের পরিচালক আসার পর। আমি দেখলাম, আরে, আমি যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি, সেই পুরোনো মানুষই তো এসেছেন।

অধ্যাপক আরশাদ মোমেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার ও সহসম্পাদক উচ্ছ্বস তৌসিফ
বিজ্ঞানচিন্তা:

বর্তমানে আপনার কাছে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার কোনটা বলে মনে হয়?

আরশাদ মোমেন: এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অত্যন্ত কষ্টকর। আজকাল কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের সংজ্ঞাটাই পাল্টে যাচ্ছে। ১৫ বছর আগেও আমরা কোনোভাবে চিন্তা করতে পারিনি যে কম্পিউটার সায়েন্সের মেশিন লার্নিং বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) মতো জিনিস কণাপদার্থবিজ্ঞানের মতো বিষয়ে চলে আসবে। কিন্তু এখন এটা হচ্ছে।

আমি মনে করি, একদিক থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটা দারুণ আবিষ্কার। তারপর এ বছর যে নোবেল পুরস্কার দিল অ্যাটোসেকেন্ড স্কেলে পরিমাপ করার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য, তা–ও একটা দারুণ আবিষ্কার। আইনস্টাইনের যে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার। আমরা তাত্ত্বিক পদার্থবিদেরা তাত্ত্বিকভাবে জানি যে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। কিন্তু কেউ কি চিন্তা করেছিল যে এর সঙ্গে জিপিএসের যোগসূত্র আছে? এটা আমরা বুঝতে পারলাম প্রায় ১০০ বছর পর এসে। এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না যে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আসলে কোনটা। এটা শুধু কালের ইতিহাসই বলে দিতে পারবে যে কোন বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ দিয়ে বলি—কথিত আছে, পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার কামান ভিজে গিয়েছিল। যাঁরা ওই মুহূর্তে দেখেছিলেন যে কামানটা ভিজে গেছে, তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, অন্য কিছু দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তো বোঝা গেল যে কামান ওই যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিল।

বিজ্ঞানচিন্তা:

ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের যে আন্তর্জাতিক সাফল্য, এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আরশাদ মোমেন: আমাদের ছেলেমেয়েরা সত্যেন বোসের মতো। সত্যেন বোস গণিতে খুব ভালো ছিলেন। আমার জানা আছে, কোনো একটা পরীক্ষায় তাঁকে ১০০–তে ১১০-এর বেশি নম্বর দেওয়া হয়েছিল। আর তাঁর যে আবিষ্কার, এটাও তাঁর গণিতে দক্ষতার কারণেই সম্ভব হয়েছে। আমার ক্ষুদ্র মতে, তিনি ইউরোপে গিয়েছিলেন ভুল ল্যাবগুলোয়। তিনি একজন তাত্ত্বিক। তাঁর উচিত ছিল হাইজেনবার্গ, বর্ন—তাঁদের কাছে যাওয়া। তিনি ওখানে না গিয়ে গেলেন মাদাম কুরির ওখানে। মাদাম কুরি ম্যাথমেটিশিয়ান নন, তিনি একজন এক্সপেরিমেন্টালিস্ট। ফলে আমার মনে হয়, সেখানে ওই সময় যেসব তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ল্যাব ছিল, সেসব জায়গায় গেলে সত্যেন বোস আরও অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কার

করতে পারতেন।

যা–ই হোক, আমাদের শিক্ষার্থীরা ওই সত্যেন বোসের মতো। তারা গণিতটা ভালো পারে। কায়কোবাদ (বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ) স্যার আমাদের বলেছিলেন, ‘এই তোমরা গোল্ড মেডেল পাও না কেন? তোমাদের তো এখন গোল্ড মেডেল পাওয়া উচিত।’ আমরা সিলভার মেডেল পর্যন্ত পেয়েছি। কিন্তু সবাই বলে গোল্ড মেডেলের কথা। গোল্ড মেডেল পেতে হলে আমাদের শিক্ষার্থীদের যে ঘাটতি আছে, তা হলো আমরা পরীক্ষা পারি না। আমাদের কমতিটা মূলত এক্সপেরিমেন্টাল ব্যাকগ্রাউন্ডে।

সিঙ্গাপুর বা তাইওয়ানের প্রতিযোগীদের ল্যাবের সুযোগ-সুবিধা অনেক ভালো। শুধু তা–ই নয়, তাদের জন্য আলাদা ল্যাব প্রশিক্ষক আছে। আমি একজন তাত্ত্বিক। আমাকে সারা দিন দিলেও আমি তাদের জন্য একটা পরীক্ষা ডিজাইন করতে পারব না। আমার সে দক্ষতা নেই। এ জায়গায় আমাদের কিছু ঘাটতি আছে। ভারতে একটা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটই আছে, যারা সব ধরনের অলিম্পিয়াডের প্রশিক্ষণ দেয়। আমি অবাক হয়ে গেলাম, ক্যালটেক (যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) থেকে পিএইচডি করেছে, স্ট্রিং থিওরিতে কাজ করেছে বালা সাথিয়াপালান। সে–ও গিয়ে ওখানে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আমাদের যেমন একটা জাতীয় মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আছে, তার পাশাপাশি মেধাবীদের নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটা নিবেদিত ও বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট থাকা দরকার।

আরও পড়ুন

একনজরে

জন্ম: ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯

বাবা: আব্দুল মোমেন

মা: শাহনাজ মোমেন

সন্তান: দুই মেয়ে

প্রিয় মুভি: দ্য ইউজুয়াল সাসপেক্টস

প্রিয় গান: ৯০ দশকের রক গান

প্রিয় রং: সবুজ

প্রিয় লেখক: বিষয় দেখে লেখক নির্বাচন করা হয়

বিজ্ঞানচিন্তা:

১০ বছর পর বাংলাদেশের বিজ্ঞান গবেষণাকে কোন পর্যায়ে দেখতে চান?

আরশাদ মোমেন: আমি বেশি দূর যেতে চাই না। হার্ভার্ড আর এমআইটিকে ধরতে চাই না। যদি এশিয়ার পরিমণ্ডলে দেখি বা চিন্তা করি, ভারতের কাছাকাছি এলেই আপাতত অত্যন্ত খুশি হব।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বর্তমানে বাংলাদেশের গবেষণা কোন পর্যায়ে আছে?

মৌলিক গবেষণা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার এই গবেষক যদি ভাবেন যে স্ট্রিং থিওরি ছাড়া আর কিছু নেই, তাহলে তো এটা অনেক দুর্ভাগ্যজনক একটা ব্যাপার

আরশাদ মোমেন: এটা বলা অত্যন্ত মুশকিল। কারণ, আমি শুধু আমার পরিমণ্ডলের বিষয়গুলোই জানি। আমাদের একটা সমস্যা আছে যে কেউ মৌলিক গবেষণা করতে চায় না। করলে আবার সেটা স্ট্রিং থিওরি ছাড়া অন্য কিছু নয়। বাঙালিরা আমরা এ রকম যে হয় মোটা চালের ভাত অথবা বাসমতী চালের ভাত পছন্দ করি। মাঝামাঝি যে আরও কত ধরনের চাল আছে (সেগুলোর কথা ভাবি না)! আর সেগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই বোধশক্তি আমাদের নেই।

মৌলিক গবেষণা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার এই গবেষক যদি ভাবেন যে স্ট্রিং থিওরি ছাড়া আর কিছু নেই, তাহলে তো এটা অনেক দুর্ভাগ্যজনক একটা ব্যাপার। কারণ, সাদা ও কালোর মাঝখানে যে ২৫৬টি ধূসর রং থাকে, সেটা তো আমাদের জানতে হবে।

প্রাইভেট বা পাবলিক যেটাই বলি, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী হতাশায় ভোগে। এখন সেই হতাশা অনেক রকম। যেমন অর্থনৈতিকভাবে হয়, মানসিক কারণে হয়। আমি আসলে প্রেম-ভালোবাসার কথা বলছি না। তারা বোঝে না, তাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী? কোথায় যাচ্ছি? কোথায় পড়ছি? আমি মনে করি, শিল্পী-সাহিত্যিকদের একটা বড় কাজ হচ্ছে, মানুষকে হতাশা থেকে দূরে রাখা।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানী মানেই কি আইনস্টাইনের মতো খামখেয়ালি?

আরশাদ মোমেন: খামখেয়ালি হলেই কিন্তু কেউ আইনস্টাইন হয় না। আমি যেমন অনেক সময় কোনো জায়গায় যাওয়ার সময় চশমা নিতে ভুলে যাই, কলম নিতে ভুলে যাই, ঘড়ি পরতে ভুলে যাই। তাই বলে কিন্তু খামখেয়ালি বলেই আইনস্টাইন হয়ে যাইনি। আইনস্টাইনের খামখেয়ালি বিষয়গুলো অনেকে খেয়াল করেন। আইনস্টাইন যখন আবিষ্কারগুলো করলেন, তখন ফটোগ্রাফ, ভিডিওগ্রাফ—এগুলোর প্রচলন শুরু হয়েছে। অনেকভাবে অনেক দিক থেকে তাঁর ছবি আছে। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন যে অঙ্ক করতে গিয়ে তিনি ভুল করেননি। অর্থাৎ তাঁর এত ভুলোমন হওয়ার কথা নয়। আইনস্টাইন অনেক বুদ্ধিমান ছিলেন এবং তাঁর সহকর্মীরাও সবাই অনেক বুদ্ধিমান। অর্থাৎ যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

ভৌতবিজ্ঞানের শেষ গন্তব্য বলে কি কিছু আছে?

আরশাদ মোমেন: না নেই। আমি মনে করি না (শেষ আছে)। মানে পদার্থবিজ্ঞানের কাজ কী? এটার সংজ্ঞা কিন্তু পাল্টাচ্ছে। এই যে আমি কিছুক্ষণ আগেই বলছিলাম, আগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ছিল না। সেটা এখন চলে এসেছে। এখানে একটা দার্শনিক ব্যাপার আছে। আমরা রিডাকশনিজমে বিশ্বাসী। মানে আমি একটা অণু নিলাম, সেটাকে টুকরা করে পেলাম ইলেকট্রন; ইলেকট্রনকে টুকরা করতে পারলে টুকরা করলাম, নিউক্লিয়াসকে টুকরা করলাম। এটা কিন্তু খুব খারাপ একটা অভ্যাস।

অনেকেই বলেন, পদার্থবিজ্ঞান শেষ। আসলে পদার্থবিজ্ঞান খুব সাধারণ একটা বিষয়। পদার্থবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় কী বলা আছে? (সেই সংজ্ঞা অনুসারে এর আসলে কোনো শেষ নেই। তবে আমরা ভাবি যে) আমি যদি ভেঙে কোনো কিছু টুকরা করতে পারি, এই যে ভেঙে টুকরা করার বিষয়, এটা সঠিক নয়। কারণ, তাদের মাঝখানে কোনো না কোনো যোগসূত্র আছে। (সেটা জানতে হবে) যেমন প্রোটন, নিউট্রন, ইলেকট্রনের সংখ্যা জানলে অণুটা কী, তা আমি জানতে পারি। ধরুন, আপনাকে যদি একটা সমস্যা দিই যে একটি সুপারকম্পিউটারে দেওয়া আছে হাইড্রোজেনের দুটো পরমাণু আর অক্সিজেনের একটা পরমাণুু। এখন আমাকে বলুন, পানির স্ফুটনাঙ্ক কত? আপনি সব মূল জিনিস জানেন। আর তো কিছু নেই এর চেয়ে বেশি। বের করতে পারব এখন স্ফুটনাঙ্ক কত? বা পানি কেন ৪ ডিগ্রিতে সবচেয়ে বেশি ঘন হয়? আমার মনে হয়, এসব ক্ষুদ্র চিন্তাভাবনা থেকে যদি আমরা বের হতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে নানা সমস্যা তৈরি হবে।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানচিন্তা:

যারা ভবিষ্যতে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে চায়, তাদের জন্য আপনার বিশেষ কোনো পরামর্শ আছে কি?

আরশাদ মোমেন: প্রথম কথা হচ্ছে, গণিতটা ভালোভাবে শিখতে হবে। সূত্র আমরা মুখস্থ করব না। আমরা যেন একদম মূল জায়গা থেকে জিনিসটা বুঝতে পারি। দ্বিতীয়ত, নিরাশ হওয়া চলবে না। কারণ, নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা অনেক অস্থির হয়ে গেছি ইদানীং। আমি খেয়াল করেছি, ফেসবুকে কোনো পোস্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটার সাড়া পাওয়ার জন্য আমরা অস্থির হয়ে যাই। এই ধারা থেকে আমাদের বের হতে হবে। ধৈর্য না থাকলেও কোনো একটা জিনিস নিয়ে চিন্তা করতে গেলে সময় লাগে। অন্তত সময়টা দিতে হবে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

অবসরে আপনি কী করেন?

আরশাদ মোমেন: আমি গাছের পরিচর্যা করি। সঙ্গে আমার স্ত্রীও গাছের পরিচর্যা করে। এই একটা কাজ আছে, যেটা আমি স্ত্রীর সঙ্গে মিলে করি। ভাগ্যিস, আমি টিকটক দেখি না। কিন্তু আমি ইউটিউবে ভিডিও দেখি। বিজ্ঞানবিষয়ক চমৎকার যেসব ঘটনা, সেসব বিষয়ের ভিডিও আমি ইউটিউবে দেখি।

আমি বই পড়ার চেষ্টা করি। গণিতের বই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বিছানায় গিয়ে যখনই পড়তে যাই, তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। ফিকশন পড়ি না তেমন, বরাবরই আমি নন-ফিকশন পড়তে পছন্দ করি। একেবারে ছোটবেলায় আমি ফিকশন পড়েছি। দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির সময়গুলোয় আমি আবদুল্লাহ আল-মুতীর লেখা সব বই পড়েছি। তারপর হুমায়ূন আহমেদের দু-একটা বই পড়েছি। তোমাদের জন্য ভালোবাসা যে বইটা, ওর মধ্যে ফিহার কথা আছে। চতুর্মাত্রিক সমীকরণ যে ছিল ওতে, সেটা থেকে ধীরে ধীরে আমার আপেক্ষিকতার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। আর মুহম্মদ জাফর ইকবালের কপোট্রনিক সুখ দুঃখ; স্বপন কুমার গায়েনের লেখাও একটা বই আছে, পড়েছিলাম সপ্তম শ্রেণিতে থাকতে। ফিকশনের এই তিনটা বই আমার পড়া। এর পর আমি আর সায়েন্স ফিকশনের বই পড়িনি।

অনেকেই আমাকে বলেন যে পদার্থবিজ্ঞান একটা রসকষহীন বিষয়। এটা আসলে রুচির ব্যাপার। যে এই রুচিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, যে গণিতের মজাটা বোঝে, সে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান কখনো ভুলবে না।

একদিন ক্লাসে হুমায়ূন আহমেদ থার্মোডায়নামিকস পড়ানোর সময় অতি উৎসাহের সঙ্গে আমাদের বলে ফেলেছিলেন যে এনট্রপি কখনো কমে না।
বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি হুমায়ূন আহমেদ স্যারের ক্লাস করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের ক্লাসের অভিজ্ঞতাটা যদি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতেন!

আরশাদ মোমেন: এটা বলাটা একটু কঠিন; কারণ, স্যার তো এখন বেঁচে নেই। স্যার আমাদের ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি ক্লাস নিতেন। একদিন ক্লাসে তিনি থার্মোডায়নামিকস পড়ানোর সময় অতি উৎসাহের সঙ্গে আমাদের থার্মোডায়নামিকসের সূত্রগুলো বলতে গিয়ে বলে ফেলেছিলেন যে এনট্রপি কখনো কমে না।

আমি ক্লাসের পেছনে বসা, হাত তুললাম। হাত তুলে স্যারকে বললাম, স্যার আপনার কথাটা ঠিক নয়।

স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কেন?

আমি বললাম, এই বিষয়টা কেমিক্যাল থার্মোডায়নামিকসে প্রমাণ করার জন্য ইলিয়া প্রিগোজিন (Ilya Prigogine) নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৭ সালে।

স্যারকে আমি থামিয়ে দিয়েছি, এ জন্য তিনি আমার ওপর খেপে গেলেন। বললেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে তর্ক করো!’ এই বলে তিনি আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দিলেন। আমি ভদ্র ছেলের মতো ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলাম। পরদিন আমি ক্লাসে গিয়েছি, স্যার আমাকে ডেকে বললেন, ‘আসো এদিকে। তোমার কথাটা ঠিক, কিন্তু এটা আমি আসলে অন্যদের জন্য বলে ফেলেছিলাম। তুমি ক্লাসে এগুলো নিয়ে আর বেশি কথাবার্তা বোলো না।’

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার মতে কোন বইটা তরুণ প্রজন্মের সবার একবার হলেও পড়া উচিত?

আরশাদ মোমেন: বেশ কঠিন একটা প্রশ্ন। অবশ্যই আমি যে বইয়ের কথা বলব, সেটা আমার পড়া একটা বইয়ের মধ্যে। আমি এখন যে বইয়ের নাম বলব, বইটা পড়ার জন্য বলব না, দেখার জন্য বলব। সেটা হচ্ছে লুডভিগ ভিটজেনস্টাইনের লেখা ট্র্যাকট্যাটাস লজিকো ফিলোসোফিকাস।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানচিন্তার পাঠক তো বেশির ভাগ কিশোর-তরুণ। তাদের জন্য যদি অনুপ্রেরণামূলক কিছু বলেন...

আরশাদ মোমেন: আমার মনে হয়, জগৎটাকে গাণিতিকভাবে দেখা শুরু করা উচিত। বিশেষ করে আমরা যে যুগের দিকে যাচ্ছি, এখনকার শিক্ষার্থীরা গাণিতিক বিষয়গুলো ঝামেলার মতো করে দেখে। কিন্তু গাণিতিক বিষয়গুলো যে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অনুষঙ্গ, সেটা তারা বুঝতে পারছে না।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আমাদের এতটা সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আরশাদ মোমেন: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ।

অনুলিখন: মুশফিকুর প্রিয়, শিক্ষার্থী, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত