সাক্ষাৎকার

'একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাবেন, আমি তার অপেক্ষায়'—অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী

ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশের প্রকৌশল জগতে সবার পরিচিত নাম। একাধারে গবেষক, শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী জামিলুর রেজা চৌধুরী জন্মেছিলেন ১৯৪৩ সালে, সিলেটে। সেই ছোট্টবেলাতেই পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে তাঁর পরিচয় ছিল প্রকৌশলী বাড়ির ছেলে হিসেবে। কারণ, তাঁর বাবা ও ভাইসহ পরিবারের অনেক সদস্যই ছিলেন প্রকৌশলী। বড় হয়ে তাঁর বাবা ও ভাইদের মতো তিনিও বেছে নেন এই পেশা। স্বাধীনতার পর এ দেশে যত বড় বড় ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই তিনি কোনো না কোনোভাবে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে। পদ্মা সেতু নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞেও ছিল তাঁর অবদান। ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল এই বিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন।

বিজ্ঞানচিন্তাকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন তাঁর জীবন, ছেলেবেলা, কর্মজীবনসহ গণিত ও বিজ্ঞানময় নিজের ভুবন নিয়ে। সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। সঙ্গে ছিলেন আলিমুজ্জামান। আর ছবি তুলেছেন আবদুস সালাম

ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশের প্রকৌশল জগতে সবার পরিচিত নাম। একাধারে গবেষক, শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী জামিলুর রেজা চৌধুরী জন্মেছিলেন ১৯৪৩ সালে, সিলেটে। সেই ছোট্টবেলাতেই পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে তাঁর পরিচয় ছিল প্রকৌশলী বাড়ির ছেলে হিসেবে। কারণ, তাঁর বাবা ও ভাইসহ পরিবারের অনেক সদস্যই ছিলেন প্রকৌশলী। বড় হয়ে তাঁর বাবা ও ভাইদের মতো তিনিও বেছে নেন এই পেশা। স্বাধীনতার পর এ দেশে যত বড় বড় ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই তিনি কোনো না কোনোভাবে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে। পদ্মা সেতু নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞেও ছিল তাঁর অবদান। একসময় যুক্তরাষ্ট্রে কাজের ডাক পেয়েছিলেন বিখ্যাত আরেক বাংলাদেশি প্রকৌশলী এফ আর খানের কাছ থেকে।

দেশে-বিদেশে বিভিন্ন অবদানের জন্য সমাদৃত জামিলুর রেজা চৌধুরীর ৬৯টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার আর সম্মাননা। এর মধ্যে যেমন আছে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট স্বর্ণপদক, তেমনি আছে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে পাওয়া সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি। একসময় বুয়েটে অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পেয়েছিলেন ১৯৯৬-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও। উপাচার্য ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য হিসেবে কর্মরত। এ ছাড়া বাংলাদেশে আর্থকোয়েক সোসাইটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন অনেক দিন ধরেই। বিজ্ঞানচিন্তাকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন তাঁর জীবন, ছেলেবেলা, কর্মজীবনসহ গণিত ও বিজ্ঞানময় নিজের ভুবন নিয়ে।

২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে বাংলাদেশে বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর নাম অমর হয়ে থাকবে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

রাস্তায় যানজটে আটকা পড়ে সবাই যখন বিরক্ত, তখন আপনি নাকি সামনের থেমে থাকা একের পর এক গাড়ির নম্বর নিয়ে সেগুলোকে দুটি সংখ্যার বর্গের বিয়োগফল হিসেবে প্রকাশ করে অপার আনন্দে বিভোর থাকেন?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: আরে হ্যাঁ। আমি তো প্রায়ই সেটা করি। আমি অনেক সময় গাড়ির নম্বর কিংবা যেকোনো সংখ্যা দেখলেই সেটার গুণক বের করার চেষ্টা করি। যদি গুণক না পাই, তাহলে সেটি একটি মৌলিক সংখ্যা। আর যদি গুণক পাই তাহলে মনে মনে চিন্তা করে দুটি সংখ্যার বর্গের বিয়োগফল হিসেবে প্রকাশ করে ফেলি। এভাবেই মূলত আমি চেষ্টা করে যাই, যতটা পারি নিজের মস্তিষ্ককে সজাগ রাখার। চারপাশের জগত্টাকে যতটা সম্ভব নিজের জ্ঞানের পরিধির মাঝে ব্যাখ্যা করার।

বিজ্ঞানচিন্তা:

কৌশলটি কী?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: এর পেছনে একটা মজার গল্প আছে। ১৯৫৩ সাল। আমি তখন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিস হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের গণিতের শিক্ষক আমাকে একটি সমীকরণের সমাধান করতে দিলেন। তিনি ছিলেন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের একজন। তিনিই আমাকে প্রথম বীজগণিতের হাতেখড়ি দিয়েছিলেন। তখন আমি সবে বীজগণিতের প্রাথমিক সূত্রগুলো শিখছি। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, আমি ওটা খুব সহজেই করতে পারব। কিন্তু সেদিন আমি অনেক সময় নিয়েও সেই সমীকরণের সমাধান করতে পারিনি। আমার অপারগতায় তিনি মনে মনে বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন উনি আমার খাতায় নিজের হাতে বড় বড় করে লিখে অঙ্কটি করে দিয়েছিলেন। সমস্যাটি ছিল, দুটি সংখ্যার গুণফলকে অপর দুটি সংখ্যার বর্গের বিয়োগফল হিসেবে প্রকাশ করার পদ্ধতির বিষয়ে।

ছোটবেলা থেকেই চেষ্টা করতাম, চোখের সামনে যে সংখ্যাই দেখি না কেন, সেটাকে এ রকম গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করার। এখন অবশ্য আরেকটি বিষয় নিয়ে ভাবি। মৌলিক সংখ্যা আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জগতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কমিপউটার যোগাযোগব্যবস্থা, তথ্য আদান-প্রদান এবং নিরাপদ সাইবার জগত্ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে ক্রিপ্টোগ্রাফি বা এনক্রিপশন সিস্টেম। সে ক্ষেত্রে ‘এনক্রিপশন কি’ হিসেবে ব্যবহার করা হয় বড় বড় মানের মৌলিক সংখ্যা। তাই সাইবার নিরাপত্তাসহ গাণিতিকভাবেও সবচেয়ে বড় ও জটিল মৌলিক সংখ্যা খুঁজে বের করা বেশ জরুরি ব্যাপার।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার সংখ্যার প্রতি ভালোবাসার গল্পটা জানতে চাই।

জামিলুর রেজা চৌধুরী: সংখ্যার প্রতি এই আকর্ষণ আসলে একদিনে গড়ে ওঠেনি। স্কুলজীবন থেকেই গণিতের প্রতি আমার একটা আলাদা ধরনের আকর্ষণ ছিল। আমার বড় বোন গণিতের ছাত্রী। বাবাও ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। পাশাপাশি বাড়ির সবাই মিলে একসঙ্গে হলে কিংবা রাতে খাবার টেবিলে খেতে বসে গণিত নিয়ে প্রায়ই কথা হতো আমাদের। সেখান থেকেই একটু একটু করে নিজের মাঝে গণিতের জন্য একটা আলাদা জায়গা তৈরি করতে পেরেছি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

শুনেছি, খুব সকালে আপনি সুডোকু, ক্রসওয়ার্ড এ ধরনের ধাঁধার সমাধান করেন। এখনো কি এই অভ্যাস ধরে রেখেছেন?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমাদের বাড়িতে খুব সকালে দৈনিক পত্রিকা দিয়ে যেত। তখন নিয়মিত সকালে আসত দৈনিক আজাদ ও পাকিস্তান অবজারভার আর বিকেলে আসত কলকাতা থেকে প্রকাশিত স্টেটসম্যান। এই পত্রিকার সবগুলোতেই ছোটদের জন্য আলাদা পাতা ছিল। যেমন: দৈনিক আজাদ-এ ছিল ‘মুকুলের মহফিল’, পাকিস্তান অবজারভার-এ ছিল ‘আঙ্কল কিম’, স্টেটসম্যান-এ ছিল ‘বেনজি লিগ’। আমি সেগুলোর সদস্য ছিলাম। প্রতি সংখ্যাতেই কমবেশি বিভিন্ন ধাঁধা, গাণিতিক সমস্যা থাকত। আমি সেগুলো সমাধান করে পাঠাতাম। এ ছাড়া কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক শিশুসাথী ও শুকতারায় যে ধাঁধাগুলো থাকত, তা সমাধানের চেষ্টা করতাম। তখনকার সময়ের তরুণ-তরুণীদের আরেকটি জনপ্রিয় সাময়িকী ছিল মাসিক ইয়ং পাকিস্তান। ওই পত্রিকার কুইজ অংশ থেকেই আমি প্রথম ক্রসওয়ার্ড শিখি। সুডোকু মিলানো শিখেছি আরও পরে বিদেশি দৈনিক পত্রিকা পড়ে।

এখন প্লেনে ভ্রমণের সময়ও আমি আমার সময় কাটাই বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িকীগুলোর ধাঁধা সমাধান করেই। এখন অবশ্য কোডওয়ার্ড নামে নতুন একধরনের ধাঁধা তৈরি হয়েছে। এনক্রিপশন সিস্টেমের সঙ্গে মিল রেখে মূলত এই ধাঁধার নকশা করা হয়েছে। আমাদের ঢাকা থেকে প্রকাশিত দ্য ট্রিবিউন-এ এই ধাঁধা ছাপা হয়। তবে অনেক পত্রিকাতেই এখন এ ধরনের কুইজ বা ‘Mind Games’ দেখে ভালো লাগে যে আমাদের অনেকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম এগুলোতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এখন সকালে উঠে নাশতার পর চা খেতে খেতে এগুলো মিলিয়েই দিন শুরু করি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি নাকি ১৯৫০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলা/পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় যাঁরা ফার্স্ট হয়েছিলেন, তাঁদের নাম, এখন তাঁরা কে কোথায় আছেন, সব বলতে পারেন? আপনার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: এই ব্যাপারটা কিছুটা ঠিক। আমি বিগত শতকের মাঝামাঝি সময়ের প্রায় ১৩ বছরের ম্যাট্রিকে (এখন এসএসসি) সারা প্রদেশে যাঁরা প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন, তাঁদের নাম, স্কুলের নাম ও পরবর্তীতে কোথায় পড়েছেন এবং কোথায় চাকরি করেছেন তা বলতে পারি। অনেক পুরোনো কিছু ঘটনার স্থান-কাল-পাত্রের কথা আমার মাথায় গেঁথে যায়। কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের অনেক সহপাঠীর নাম তাদের রোল নম্বরসহ চেহারা মনে থাকে। অনেক সময় দেখা হলে আমি তাদের রোল নম্বর ধরে ডাকি। ওরা অবাক হয়ে যায়। কারণ, ওদের নিজেদেরই রোল নম্বর হয়তো মনে ছিল না। আমি বলে দিলে তখন তাদের মনে পড়ে। ঢাকা কলেজে আইএসসি ক্লাসে আমরা ২২১ জন ছিলাম। তার ভেতর প্রায় ৫০-৬০ জনের রোল, নাম, তারা কে কোথায় কী করছে—সব মনে আছে আমার।

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী।
বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানীদের মতে, এ রকম প্রখর স্মৃতির পেছনে কাজ করে বিশেষ কোনো ব্যায়াম বা অনুশীলন। আপনি কি এ ধরনের কিছু করেন?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমি সাধারণত সেভাবে ব্যায়াম করি না। তবে ঘুমাতে গেলে যদি কখনো ঘুম না আসে তাহলে সংখ্যা নিয়ে ভাবি, পুরোনো বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত মানুষের কথা ভাবি। বিভিন্ন লোকের মধ্যে আত্মীয়তা বের করার চেষ্টা করি। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ব্যাপারটাকে একটু অন্যভাবেই দেখি। এত তথ্য আমাদের মস্তিষ্কে জমা থাকাটা আসলে ঠিক কি না। এতে অপ্রয়োজনীয় তথ্যের ফলে মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে এটা মনে রাখা ভালো যে তথ্যটি কোথায় পাওয়া যাবে। তবে কিছু তথ্য মনে রাখাটাও জরুরি। শিক্ষাজীবনের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কিছু কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয় মনে রাখা উচিত। আমরা ছোটবেলায় বিভিন্ন সংখ্যাভিত্তিক নামতা মুখস্থ করতাম। যার ফলে পরবর্তীকালে অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান সহজে অল্প সময়ে করতে পারতাম। পশ্চিমা দেশগুলোতে এই ধরনের নামতাগুলো তাদের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দিলেও এখন আবার সেগুলো যোগ করা হচ্ছে। কারণ, ওদের দেশের ছেলেমেয়েরা খুব বেশি পরিমাণে ক্যালকুলেটর-নির্ভর হয়ে পড়ছে। আমাদের এখানে তো এখনো অনেক পরীক্ষায় ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। তাই আমার মনে হয়, প্রারম্ভিক বিষয়গুলো নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত চর্চার মাধ্যমে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে মনেও রাখা উচিত।

বিজ্ঞানচিন্তা:

গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে যুক্ত আছেন। কীভাবে শুরু করলেন এত বড় কাজ?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: গণিত অলিম্পিয়াড শুরু হয় ২০০১ সালে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং বুয়েটের মোহাম্মদ কায়কোবাদ মিলে প্রাথমিকভাবে নিউরনে-অনুরণন নামে প্রথম আলোতে একটি পাতা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যেখানে বিভিন্ন রকম সমস্যা দেওয়া হতো। পাঠকেরা সমাধান করে পাঠালে তাদের উপহার দেওয়া হতো। তাতে এই পাতাতে বেশ সাড়া পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে ২০০৩ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ গণিত সমিতি আয়োজিত বার্ষিক সম্মেলনের পাশাপাশি সারা দেশের প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য ছোট পরিসরে গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন করা হয় ও আমাকে এই প্রতিযোগিতার সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ২০০৩ সাল থেকে প্রথম আলোই এই গণিত অলিম্পিয়াডের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছিল। তখন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান আমাদের নিয়ে যান ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে। তাঁকে সব ব্যাপার খুলে বলায় তিনি আমাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সেই সময়ে আমাদের প্রয়োজন ছিল প্রায় ১৫ লাখ টাকা। পরে প্রতিবছর আমাদের সঙ্গে থেকেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এবং প্রথম আলো। সব মিলিয়ে মহাপ্রাণের উত্সবে মেতে ওঠে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উত্সব।

অন্যান্য দেশে এটা প্রতিযোগিতার মতো হলেও আমরা চেষ্টা করেছিলাম সব বয়সের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মাঝে গণিতের এই প্রাণ ছড়িয়ে দিতে। প্রতিবছর প্রতিযোগিতা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড আয়োজনের উদ্দেশ্যে আমরা বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি প্রতিষ্ঠা করি। ২০০৪ সাল থেকে আমরা আঞ্চলিকভাবে প্রতিযোগিতা ও গণিত উত্সব আয়োজন শুরু করি। সেবার সমাপনী পর্বের আয়োজন করা হয় ঢাকার নটর ডেম কলেজে। সেখান থেকেই আমরা বিজয়ী শিক্ষার্থীদের নিয়ে গণিত ক্যাম্পের আয়োজন করি। ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের সদস্যপদ গ্রহণের জন্য সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসানকে এথেন্স পাঠানো হয়। ২০০৫ সাল থেকে আমরা নিয়মিত আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়ে আসছি। গণিত অলিম্পিয়াডের পরিধি দিন দিন বেড়েই চলেছে। শেষ আয়োজনেও এ বছর আমরা প্রায় ২৪টি অঞ্চলে গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন করেছি। গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজনের পেছনে দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রথম আলো বন্ধুসভা আর একাডেমিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে গণিত অলিম্পিয়াডের ভলান্টিয়ার। ওদের আমি নাম দিয়েছি ‘মুভারস’ (MOVERS)। অর্থাত্ ‘ম্যাথমেটিক্স অলিম্পিয়াড ভলান্টিয়ারস’।

প্রতিবছর আমরা আগের থেকে ভালো করছি। শেষ আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে আমাদের স্কোর ছিল ১১২। দক্ষিণ এশিয়াতে আমরা এখন সবচেয়ে ভালো করছি গণিতে। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা অনেক দ্রুত দক্ষতা লাভ করেছি। আমাদের দেশ থেকে যারা আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ভালো করছে, তারা বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহজেই ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। ভবিষ্যতে আমরা হয়তো গোটা বিশ্বের মাঝে নিজেদের শুধু গণিত নয়, বিজ্ঞানের আরও বিভিন্ন শাখায় সম্মানের সঙ্গে উপস্থাপন করতে পারব।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি তো প্রায়ই বলেন একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাবেনই। ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কাছে বিজ্ঞান নিয়ে আপনার চাওয়া কী?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: সেটা আমার স্বপ্ন। ২০০৪ সালে নটর ডেম কলেজে গণিত উত্সবের সমাপনী পর্বে আমি আমার তিনটি স্বপ্নের কথা বলেছিলাম। আমার প্রথম স্বপ্ন ছিল, ২০১০ সালের ভেতর আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের কেউ পদক পাবে। যে স্বপ্ন আমরা অনেক আগেই পূরণ করেছি। গণিতে অবদান রাখার জন্য ৪০-অনূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিকে কানাডার আন্তর্জাতিক গণিত ইউনিয়ন প্রতি চার বছর পরপর ‘ফিল্ডস মেডেল’ নামে একটি পদক দেয়, যাকে গণিতের নোবেল পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমার দ্বিতীয় স্বপ্ন, ২০২২ সালের ভেতর কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তি এই মেডেল পাবেন। আর আমার তৃতীয় স্বপ্ন, ২০৩০ সালের ভেতরে কোনো একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানের যেকোনো শাখায় নোবেল পদক পাবেন। আমরা গৌরবান্বিত যে ২০০৬ সালে ড. মোহাম্মদ ইউনূস প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কাছে আমি আশা করি, তারা বিজ্ঞানের যে তিনটি বিষয়ের (পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন অথবা ফিজিওলজি/মেডিসিন) একটিতে নোবেল পুরস্কার লাভের মাধ্যমে এসব স্বপ্ন পূরণ করে আমাদের দেশকে উন্নতির এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি মূলত একজন পুরকৌশলী। কিন্তু বাংলাদেশে আপনিই প্রথম কম্পিউটারভিত্তিক পড়াশোনা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কীভাবে সেটা হলো?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: এ ধরনের কাজ করার অনুপ্রেরণা আসলে আমি আমার নিজের পড়াশোনার মাঝেই পেয়েছিলাম। ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি বার্মা ওয়েল কোম্পানির বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যাই। সেখানকার সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে আমি প্রথমেই পিএইচডি শুরু না করে একটা মাস্টার্স কোর্স করি Advanced Structural Engineering-এ। সপ্তাহে এক দিন কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের ক্লাস হতো। তখন ব্যবহার করা হতো দ্বিতীয় প্রজন্মের মেন ফ্রেম কম্পিউটার, ফেরান্টি পেগাসাস। সেটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম কম্পিউটার দেখা ও ব্যবহার করা।

গত আগস্ট মাসে আমি লন্ডন গিয়েছিলাম। ওখানে সারা বছর কিছু না কিছুর প্রদর্শনী, উত্সব চলে। এবার গিয়ে দেখি একটা জাদুঘরে (Victoria and Albert Museum) ‘ওয়ার্ল্ড অব ইঞ্জিনিয়ারিং’ শিরোনামে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে দেখি, বিখ্যাত প্রকৌশলী Ove Arup (সিডনির অপেরা হাউসের Structural Designer) সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ফেরান্টি পেগাসাস কম্পিউটার ব্যবহার করেছিলেন এই জটিল স্থাপনা ডিজাইন করার সময়। ওই কম্পিউটারটি প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। এটা প্রায় ৫০ বছর পরে দেখে আমার খুব ভালো লাগল। কারণ, এই কম্পিউটারেই আমার কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের হাতেখড়ি।

আমি নিজে ডিজাইনে কম্পিউটার ব্যবহার করি প্রথম ১৯৬৫ সালে আমার এমএসসি প্রজেক্টের অংশ হিসেবে একটি এয়ারপোর্টের হ্যাঙ্গার ডিজাইন করার জন্য। সেই সময়েই আমি ভেবেছিলাম, কম্পিউটারকে কীভাবে প্রকৌশলের অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়। ১৯৬৫ সালের দিকে আমি যখন আমার পিএইচডির থিসিস নিয়ে কাজ শুরু করি, তখন আমার গবেষণার বিষয় ছিল, কম্পিউটারের সাহায্যে উঁচু ইমারত নির্মাণের নকশা প্রস্তুতকরণ। ১৯৬৫ সালে আমি ঠিক করে ফেলি যে আমি আমার থিসিসের মূল বিষয় হবে কম্পিউটার ব্যবহার করে কীভাবে জটিল ডিজাইনগুলোর হিসাব করা যায়। আমার গোটা থিসিসের বেশির ভাগ সময় লেগেছিল সমীকরণগুলো বের করা এবং হাজার হাজার সমীকরণ সমাধান করার জন্য কয়েক হাজার লাইনের প্রোগ্রামের মাধ্যমে কম্পিউটারকে উঁচু ইমারত ডিজাইনে কাজে লাগানো। ব্যাপারটা সেই সময়ে বেশ জটিল ছিল। কারণ, আমার তৈরি করা কম্পিউটার প্রোগ্রামে যে ফলাফল আসত, সেটাকে আবার laboratory-তে মডেল টেস্টের ফলাফলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হতো। গোটা পৃথিবীতে তখন সবে বিভিন্ন কাজে তথ্য বিশ্লেষণের কাজে কম্পিউটার ব্যবহার শুরু হয়েছে।

১৯৬৮ সালে আমি দেশে ফিরে আসি। তখন আমাদের ঢাকায় তিন-চারটি দ্বিতীয় প্রজন্মের মেইন ফ্রেম কম্পিউটার ছিল। অ্যাটমিক এনার্জি, ঢাকা সেন্টার আর কিছু বেসরকারি ব্যাংকের এসব আইবিএম ১৬২০ বা আইসিএল কম্পিউটার পরিচালিত হতো। তখন বুয়েটের সিলেবাসে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ছিল না। সেখানে আমাদের শিক্ষক (পরে উপাচার্য) প্রফেসর আবদুল মতিন পাটোয়ারী ও আমার উদ্যোগে কম্পিউটারভিত্তিক সিলেবাস প্রণয়ন করা হল। আমিই সেখানে প্রথম দায়িত্ব পাই ছাত্রদের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখানো এবং এর মাধ্যমে প্রকৌশল সমস্যা সমাধানের সঙ্গে পরিচিত করানোর। তখন বিষয়টা বেশ কঠিন ছিল। কারণ, অ্যাটমিক এনার্জির সেন্টারের মাত্র একটি কম্পিউটার দিয়ে এত ছাত্রকে শেখাতে হতো। আবার হয়তো প্রোগাম শেখার পর সেটা চালানোর সুযোগ ছিল সীমিত, যা ছিল প্রায় পুকুর ছাড়া সাঁতার শেখানোর মতো। তাই আমরা চেষ্টা করছিলাম যেন বুয়েটে নিজস্ব একটা কম্পিউটারের ব্যবস্থা করা যায়। অনেক প্রচেষ্টার পর ১৯৭৯ সালে প্রায় এক কোটি টাকা খরচ করে সেই সময়ের সবচেয়ে আধুনিক কম্পিউটার তৃতীয় প্রজন্মের মেইন ফ্রেম আইবিএম ৩৭০-১১৫ কিনে আনা হয় বুয়েটের জন্য। এরপর প্রায় এক দশক সময় আমি সেটির পরিচালনার দায়িত্ব পাই।

আমরা সে সময়ে বুয়েটের ছাত্র-শিক্ষক ছাড়াও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের বিনা মূল্যে কম্পিউটার ব্যবহার করতে দিতাম। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক শিক্ষার্থী তাদের থিসিস কিংবা গবেষণার কাজে আমাদের কাছে আসত। তাদেরও বিনা মূল্যে কম্পিউটার সেবা দিয়েছি আমরা। তবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো এই সেবা পেত পরিমিত অর্থের বিনিময়ে। এই অর্থ দিয়ে প্রায় ছয়-সাত বছর পরে বুয়েট সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে আরেকটি কম্পিউটার, আইবিএম ৪৩৩১ কিনতে সক্ষম হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতার কয়েক বছর আগে একটি কম্পিউটার বিদেশ থেকে আনালেও দুর্ভাগ্যবশত সাত-আট দিনের মাথায় সেটি বিকল হয়ে যায়। মূলত নিজের প্রকৌশলজ্ঞানকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগানো এবং আমাদের দেশের মেধাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম কম্পিউটারের মাধ্যমে। কারণ, সেই সময়েই শুরু হয়েছিল কম্পিউটার-নির্ভর জ্ঞানচর্চা।

বিজ্ঞানচিন্তা:

ছোটবেলায় আপনি আইসক্রিমের লোভে আইসস্ক্রিম ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতে এবং হ্যাট পরে সাহেবদের মতো ট্রলিতে চড়তে চাইতেন, সেসব দিনের গল্পগুলো বলবেন?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: সেসব দিনের স্মৃতি অসাধারণ ছিল। আমার বয়স তখন সাত-আট বছর। আমি তখন ময়মনসিংহ শহরে থাকতাম। সে সময় দুই ধরনের আইসক্রিম পাওয়া যেত। একটা ছিল শুধু বরফ আর চিনি দিয়ে বানানো। আরেকটা ছিল দুধ মেশানো, যার দাম ছিল একটু বেশি। আমার এক সহপাঠীর বাবার আইসক্রিমের কারখানা ছিল। আমি সেখানে বেড়াতে গেলে আমার বন্ধুর বাবা আমাকে বললেন, আমি যত ইচ্ছা আইসক্রিম সেখান থেকে খেতে পারি। সেদিন মনে হয়েছিল, আমি বড় হয়ে আইসক্রিম কারখানায় কাজ করব। তাহলে সহজেই অনেক অনেক আইসক্রিম খেতে পারব। ডাক্তারের বারণ থাকা সত্ত্বেও এখনো আইসক্রিম খেতে অনেক পছন্দ করি।

আমার বাবার এক বন্ধু রেল কর্তৃপক্ষের সিনিয়র প্রকৌশলী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিবারের ট্রেনের বিশেষ সেলুন কোচে করে ভ্রমণের সুযোগ হয়। আমরা তখন অভ্যস্ত রেলের ইন্টারক্লাস বা সেকেন্ড ক্লাসে যাতায়াত করার। বিভিন্ন আসবাব নিয়ে সাজানো সেলুন কোচের অভ্যন্তর অনেক আকর্ষণীয় মনে হলো। এ ছাড়া রেল লাইনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পরিদর্শনের জন্য বাবার সেই বন্ধু মাঝে মাঝে হ্যাট পরে ট্রলি করে ভ্রমণ করতেন। তাই দেখে আমার রেলের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার শখ হয়।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানচিন্তা:

অনেক বাবা-মা মনে করেন বাচ্চাদের ছোট থেকেই গড়ে তুলতে হয়। যেমন: ভালো সাময়িকী, অভিধান কিংবা কিংবা উঁচু স্তরের বই। আপনার কি মনে হয় এ ধরনের বই ছোট থেকেই বাচ্চাদের পড়ানো হলে সেটা তাদের মানসিক পরিবর্তন করতে পারে? এ ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা কী?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমার বাবা এ ব্যাপারে বেশ সহযোগিতা করতেন। এই জাতীয় বই পড়তে তিনি কখনো না করতেন না। তিনি নিজেও অনেক বই ও সাময়িকী পড়তেন। তিনি রম্য রচনা পড়তে অনেক বেশি পছন্দ করতেন। আমাদের সময়ে তো বেশির ভাগই ছিল যৌথ পরিবার। দেখা যেত, আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন আমার বড় বোন ও চাচাতো ভাইয়েরা উচ্চমাধ্যমিকের বা স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। তারা বিভিন্ন রকম সাময়িকী কিনে আনলে আমরাও সেটা পড়তাম। অনেক সময় তারা কিনে এনে লুকিয়ে রাখলেও আমরা বাসার ছোটরা সেগুলো খুঁজে বের করে পড়তাম।

১৯৫৪ সালের দিকে আমরা যখন ঢাকায় চলে আসি, তখন আমার বই পড়ার আরেকটা জায়গা হয়ে ওঠে নিউমার্কেট। তখনকার সময়ে ‘নলেজ হোম’ নামে বেশ বড় একটা বইয়ের দোকান ছিল। আমি মাঝে মাঝেই গিয়ে শেলফ থেকে বিভিন্ন বই, সাময়িকী নামিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম। একদিন দোকানের মালিক আমার উত্সাহ দেখে তাঁর দোকানের চিলেকোঠায় চেয়ারে বসে আমাকে বই পড়ার সুযোগ করে দেন। সেখানেই আমি দেশ-বিদেশের নানা রকম সাময়িকী, বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়তে শুরু করি। আবার ১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমি সদ্য নির্মিত পাবলিক লাইব্রেরিতে (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি) গিয়ে বই পড়া শুরু করি। সকালে নাশতা খেয়ে ওখানে যেতাম। দুপুরে বাসায় ফিরে খেয়ে আবার যেতাম। সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরতাম। পরীক্ষার ছুটির ওই দু-তিন মাস আমার এভাবেই কেটে গেছে। পাশাপাশি আমাদের নানাবাড়ি-দাদাবাড়ি দুই জায়গাতেই লাইব্রেরি ছিল। সেখানে গেলেই বেশ কিছু সময় কাটত সেই লাইব্রেরিতে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বর্তমান সময়ে যারা আপনার মতো প্রকৌশলী বা বিজ্ঞানী হতে চায়, তাদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: শুধু পড়াশোনা করলেই যে আসলে স্বপ্নপূরণ করা সম্ভব এমনটা নয়। বরং আমি কিন্তু আমার অনেক সহপাঠীর চেয়ে কম সময় ক্লাসের পড়াশোনা করেছি। বাবার সরকারি চাকরির কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় থেকেছি। কোনো নতুন পাড়ায় গেলেই এলাকার সব ছেলেকে নিয়ে ক্লাব থাকলে সেখানে যোগ দিতাম আর না থাকলে খেলাধুলার ক্লাব খুলে ফেলতাম। ময়মনসিংহে থাকতে ওখানকার সমবয়সী ছেলেদের নিয়ে ফুটবল খেলার জন্য চালু করি ইস্ট বেঙ্গল বয়েজ ক্লাব। বাসার গ্যারেজের ওপরের রুমে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছিলাম ক্লাবের। ঢাকায় আসার পর ফুটবল ছাড়াও ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলার সঙ্গে পরিচিত হই। বন্ধুদের সঙ্গে ঢাকা স্টেডিয়ামে বা আশপাশের মাঠে প্রায়ই খেলা দেখতে চলে যেতাম। ১৯৫৩ সালে সেন্ট গ্রেগরিজে ভর্তির পর খেলার তালিকায় যোগ হলো টেবিল টেনিস ও হ্যান্ডবল। সেই সময় খেলার স্কোর কার্ড, খেলোয়াড়দের ছবি কেটে কেটে সংগ্রহ করতাম।

আমি তরুণদের বলি, সব বিষয়ে জানার চেষ্টা করতে হবে। শুধু আমি বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ব বলে যে আমাকে শুধু বিজ্ঞানের বই পড়তে হব, এ রকমটা নয়। বরং চারপাশের সব বিষয়ে জানতে হবে। এখন তো কোনো কিছু শেখা আরও অনেক সহজ। আমাদের হাতের কাছেই আছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও তাদের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। গোটা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম, ইতিহাস, পরিবর্তনের রূপরেখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বই রয়েছে এখানে। আর তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে সবকিছুই আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। আজ কেউ কিছু শিখতে চাইলে শুধু প্রয়োজন হয় একটা কম্পিউটার (বা smart phone) আর ইন্টারনেট সংযোগ। এমনকি সব বিষয়ে নিজের জ্ঞানকে পর্যাপ্ত করাও কিন্তু বিজ্ঞানের জন্যই প্রয়োজন। কেননা বর্তমান সময়ের উত্কর্ষতায় বিজ্ঞান একটা মিশ্র অবস্থানে রয়েছে। একজন বিজ্ঞানীকে যেমন পরিবেশ নিয়ে জানতে হবে, তেমন পরিবেশের প্রতি মানুষের মনোভাবের ওপর ভরসা করেই বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। ভবিষ্যতের বিজ্ঞান হবে ন্যানো-টেকনোলজি, বায়ো-টেকনোলজি এবং কমিপউটারের সংমিশ্রণে তৈরি এক উন্নত পৃথিবীর সংকল্পে ব্যবহূত অংশ। যেখানে একজন বিজ্ঞানীকে সব বিষয় চিন্তা করেই বিজ্ঞান দিয়ে মানবকল্যাণে কাজ করতে হবে। সব সময় পড়াশোনার মাঝে ডুবে না থেকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে না-হচ্ছে সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। এমনকি রাজনীতির ব্যাপারেও জানতে হবে। আর সফলতার জন্য কখনো মরিয়া হওয়া চলবে না। নিজের বিবেকের কাছে সব সময় সত্ থেকে নিয়মিত নিজ অবস্থান থেকে অনুশীলন করতে হবে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

স্বনামধন্য প্রকৌশলী এফ আর খান স্যারের সঙ্গে আপনার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল...।

জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমি যখন ১৯৬৫ সালে আমার পিএইচডি থিসিস নিয়ে কাজ করছি, তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে, অনেক উঁচু ইমারত নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। সেগুলোর বেশ কিছুর নকশা তৈরি করেছিলেন এফ আর খান। তিনি বাংলাদেশের সন্তান হলেও বেশির ভাগ পেশাগত কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে আমি যখন আমার গবেষণা শুরু করি, তখন আমার থিসিসের সুপারভাইজার ছিলেন যে অধ্যাপক, তিনি আমাকে এফ আর খানের কিছু গবেষণাপত্র পড়তে দিয়েছিলেন। এর প্রায় দেড় বছর পর ১৯৬৭ সালে তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি দেখা করার সুযোগ হয়। ওই বছর সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক উচ্চ ইমারত নির্মাণ-বিষয়ক সম্মেলন আয়োজন করা হয়। সেখানে এফ আর খান এসেছিলেন তাঁর একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করতে। আমি অন্য কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে অংশগ্রহণকারীদের নিবন্ধনের কাজ করছিলাম। ভিড়ের মাঝে আমাদের দেশি চেহারার মানুষ দেখে আমি প্রথমেই চিনতে পেরেছিলাম তাঁকে। সেদিন তাঁর স্ত্রী Lisolette Khan-এর সঙ্গেও পরিচয় হয় আমার। সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ‘পাকিস্তান স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা দিই। এরপর তাঁর সঙ্গে আমার আবার দেখা হয় ১৯৬৮ সালে। আমার এক ভারতীয় বন্ধু তাঁর পিএইচডি থিসিসের শেষ পর্যায়ে এফ আর খানের ফার্মে চাকরির দরখাস্ত করেছিল। এফ আর খান আমার বন্ধুকে বলেন যে তিনি শিকাগো থেকে জার্মানি যাওয়ার পথে লন্ডন এয়ারপোর্টে থামবেন এবং সেখানেই তিনি আমার ওই বন্ধুর সাক্ষাত্কার নেবেন। আমার বন্ধুর অনুরোধে আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে সেখানে যাই। তিনি আমাকে দেখে চিনতে পারেন।

আমার তখন ‘আমেরিকান কংক্রিট জার্নালে’ দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে। উনি আমার গবেষণার প্রশংসা করেন। তাঁর কাছেই জানতে পারি, প্রকাশকেরা তাঁর কাছেই আমার গবেষণাপত্র দুটি রিভিউ করতে দিয়েছিলেন। সে কারণেই তিনি আমার গবেষণার ব্যাপারে বিস্তারিত জানেন। এরপর তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু আমি জানাই যে দেশে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি আছে এবং আমি ছুটি নিয়ে ইংল্যান্ডে এসেছি। তাই আমাকে ফিরতে হবে। ১৯৭৪ সালের ব্যাংককে টল বিল্ডিং কনফারেন্সে আমি একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করি। সেখানেও তিনি আমাকে উত্সাহ দেন। পরের দিন আমরা সারা দিন একসঙ্গেই ছিলাম। ব্যাংককের বাইরে বিভিন্ন জায়াগাতে আমরা একসঙ্গে ঘুরেছি। তিনি আমায় বলেছিলেন, তিনি দেশে ফিরে দেশের সমস্যা নিয়ে কাজ করতে চান। আমাদের দুর্ভাগ্য খুব অল্প বয়সে তিনি মারা গেলেন। তাই হয়তো আর তাঁর দেশে ফেরা হয়নি। ১৯৮২ সালে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে এফ আর খান মারা যান। তিনি স্বাধীনতার পর বুয়েটে কয়েকবার এসেছিলেন লেকচার দিতে। তিনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অন্য সব প্রকৌশলীর মতো ছিলেন না। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেই তিনি লেকচার দিতেন। শিকাগোতে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি শনিবার পড়াতেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রকৌশলী, শিক্ষার্থীর গবেষণা তিনি সুপারভাইজ করতেন। শিকাগো শহরের Art Institute-এ এখনো তাঁর গবেষণার কাগজপত্রগুলো ও অন্যান্য ব্যক্তিগত নথিপত্র সংরক্ষিত রাখা আছে। আমি একবার গিয়ে অনেকগুলো দেখেছি। সেখানে এফ আর খানের কাছে লেখা আমার কিছু চিঠিও আছে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিশ্ববিদ্যালয় পাস করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চ থেকে একবারে শিক্ষকের মঞ্চে দাঁড়ালেন। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমাদের সময়ে তো ফলাফল বের হতো বিকেলের দিকে আর তা টাঙিয়ে দেওয়া হতো নোটিশ বোর্ডে। ১৯৬৩ সালের অক্টোবরের এক সন্ধ্যায় দেখি নোটিশ বোর্ডে আমার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে এবং ফলাফল বেশ ভালো। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে অনার্স পেয়েছিলাম। পরের দিন সকালে উঠেই গেলাম আমার বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে। উনি আমাকে অভিনন্দন জানান। কারণ, প্রায় নয় বছর পর পুরকৌশল বিভাগের কোনো শিক্ষার্থী এত ভালো ফল করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি আমাকে বললেন, এখন কথা বলার বেশি সময় নেই। আমাদের একজন শিক্ষক আজ অনুপস্থিত। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে বসে আছে। তিনি পিয়নকে ডেকে আমার হাতে চক-ডাস্টার ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও, ওদের ক্লাসটা নিয়ে এসো।’ আমি ক্লাসে গিয়ে দেখি ছাত্রদের অনেকেই আমার পূর্বপরিচিত। কেউ কেউ ছিল আমার সহপাঠী। হয়তো কোনো কারণে তাদের দুই বছর লস হওয়ায় সেদিন তারাও সেই ক্লাসে ছিল। এখান থেকেই আমার শিক্ষকতা জীবনের শুরু। ১৯৬৩ সালের অক্টোবরে আমাদের ফলাফলের পর থেকেই আমি শিক্ষকতা শুরু করি। পরবর্তীকালে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাত্কারের পর আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন আসলে রেওয়াজ ছিল, যারা প্রথম, দ্বিতীয় হতো, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবেই থাকতেন। দুই-তিনজন ছাড়া বেশির ভাগই শিক্ষকতা করতেন। আমার ক্ষেত্রে শুধু শিক্ষাজীবন আর শিক্ষকজীবনের মাঝে সময়ের পার্থক্য কম ছিল।

আরও পড়ুন