মহাজাগতিক রশ্মি

মহাজাগতিক রশ্মি। দূর মহাকাশের বিভিন্ন মহাজাগতিক ঘটনায় এর জন্ম, কিন্তু আবিষ্কারের কাহিনিটি বেশ মজার। প্রথমে একে মনে করা হচ্ছিল নিছক আলোকরশ্মি বা বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গ। কিন্তু পরে দেখা গেল, এর প্রায় সবটুকুই কণা দিয়ে তৈরি।

১৮৯৫ সালে এক্স-রে আবিষ্কৃত হওয়ার পরবর্তী এক দশকের মধ্যেই পদার্থবিজ্ঞানের জগৎ নতুন নতুন তথ্য, তত্ত্ব, কণা ও রশ্মিতে ভরে উঠতে লাগল। পরের বছরই আবিষ্কৃত হলো তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বা রেডিও–অ্যাকটিভিটি। ঠিক তার পরের বছর ১৮৯৭ সালে জানা গেল, ইলেকট্রন হলো পদার্থের সবচেয়ে মৌলিক কণা। যদিও ইলেকট্রন যে নেগেটিভ চার্জ বহন করে, তা কয়েক শ বছর আগে থেকেই জানা ছিল, কিন্তু তার অন্য ধর্মগুলো সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তখন মাত্র হাতে এসেছে। দৃশ্যমান আলো সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারণা কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই আছে। সেই ধারণাকে সুনির্দিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রে রূপ দেওয়া হয়ে গেছে তত দিনে। দৃশ্যমান আলো যে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গ বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ, তা বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক্স-রে আবিষ্কারের ৩০ বছর আগে। কিন্তু অদৃশ্য এক্স-রে কিংবা গামা-রের শক্তি এবং গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জানার তখনই শুরু। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের জগৎ অজানা রশ্মি ও কণাময় হয়ে উঠল। এই অদৃশ্য রশ্মিগুলোর শক্তি বিকিরণের তীব্রতা দেখে অবাক হলেন বিজ্ঞানীরা। এমনকি যে পদ্ধতিতে এরা বিভিন্ন পদার্থের দেয়াল ভেদ করে অনায়াসে চলে যাচ্ছে, সেটাও বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এই বৈজ্ঞানিক রহস্য আবিষ্কারের জন্য অধীর হয়ে উঠলেন পৃথিবীর পদার্থবিজ্ঞানীরা। আমাদের উপমহাদেশের বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুও ছিলেন সেই বিজ্ঞানীদের দলে।

তখন নতুন নতুন রশ্মি ও কণা আবিষ্কারের ধুম লেগে গেছে। কিছুদিন পরপরই বিজ্ঞানীদের মনে হচ্ছে, আরও নতুন কোনো রশ্মির সন্ধান পাওয়া গেছে, কিন্তু কেউ একজন ঘোষণা দিলেই তো আর আবিষ্কার হয়ে যায় না। একজন কোনো কিছু আবিষ্কার করলে কী পদ্ধতিতে আবিষ্কার করেছেন, তা জানাতে হয়। একই পদ্ধতিতে অন্যরাও যদি সেই আবিষ্কারের ফল পান, তবেই বলা যায় যে এটি সঠিক আবিষ্কার। ১৯০৩ সালে ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী প্রসপার ব্লন্ডলট ঘোষণা দিলেন, তিনি নতুন একধরনের রশ্মি আবিষ্কার করেছেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি বেশ কয়েকটি পেপার লিখে ফেললেন। কীভাবে তিনি এই নতুন রশ্মির বিকিরণ আবিষ্কার করেছেন, তা নিয়ে। পাঁচ বছর আগে মেরি কুরি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করে নিজের জন্মভূমির নামে নামকরণ করেছিলেন পোলোনিয়াম। প্রসপার ব্লন্ডলটও সেভাবে ফ্রান্সের যে শহরে তিনি জন্মেছেন, সেই শহরের নামে তাঁর রশ্মির নাম দিলেন ন্যান্সি রশ্মি বা এন–রে। তাঁর শহরে হইচই পড়ে গেল। ফ্রেঞ্জ একাডেমি অব সায়েন্স তাঁকে ৫০ হাজার ফ্রাঙ্ক পুরস্কার দিয়ে ফেলল। দ্রুত বিখ্যাত হয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল যখন এন–রে নিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার বিজ্ঞানীরাও কাজ শুরু করলেন। ব্লন্ডলট যে পদ্ধতিতে এন–রে আবিষ্কার করেছেন বলে দাবি করেছেন তাঁর গবেষণাপত্রে, অন্য বিজ্ঞানীরা একই পদ্ধতি বারবার ব্যবহার করেও এন-রের অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন না। স্বাভাবিকভাবেই এন–রের দাবি বাতিল হয়ে গেল। তবু ন্যান্সি শহরের অনেকেই বিশ্বাস করতে থাকলেন, তাঁদের বিজ্ঞানী আবিষ্কার ঠিকই করেছেন, অন্য বিজ্ঞানীরা ষড়যন্ত্র করে তাঁর স্বীকৃতি দিতে চাইছেন না।

যে বিষয় নিয়ে তিনি গবেষণা করেছিলেন বা যে তত্ত্বের জন্য তিনি বিশ্বখ্যাতি পেয়েছেন, সেটি এতই দুর্বোধ্য, জটিল আর বিমূর্ত যে বিজ্ঞানের ছাত্রদের পক্ষেও এর মর্মার্থ উপলব্ধি করা কঠিন

এক্স-রে, গামা–রে নিয়ে তখন প্রচুর গবেষণা চলছে পৃথিবীজুড়ে। গোল্ড-লিফ ইলেকট্রোস্কোপ বা স্বর্ণপাত তড়িৎবীক্ষণযন্ত্র ব্যবহার করে চার্জিত কণার অস্তিত্ব এবং পরিমাণ নির্ণয় করা তখন নিয়মিত ব্যাপার। স্কটিশ বিজ্ঞানী চার্লস উইলসন তখন প্রচুর গবেষণা করছেন কীভাবে অদৃশ্য বিকিরণ ও চার্জ শনাক্ত করা যায়। উইলসন ছিলেন ইলেকট্রন আবিষ্কারক জোসেফ জন টমসনের (জে জে টমসন) ছাত্র। ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে কাজ করার সময় তিনি খেয়াল করলেন, তাঁর স্বর্ণপাত তড়িৎবীক্ষণযন্ত্র মাঝেমধ্যে কিছু চার্জ শনাক্ত করছে। অথচ আশপাশে কোনো চার্জিত বস্তু কিংবা তেজস্ক্রিয় পদার্থ নেই, যেখান থেকে চার্জ কিংবা বিকিরণ নির্গত হতে পারে। অনেক খুঁজেও এর কারণ বের করতে পারলেন না উইলসন। এ ঘটনা আরও অনেক ল্যাবেই দেখা গেল। বৈদ্যুতিক চার্জগুলো যে কুলম্বের সূত্র মেনে চলে, সেই চার্লস কুলম্বও শতাধিক বছর আগে এ রকম রহস্যময় কিছু লক্ষ করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, তাঁর চার্জিত গোলক কোনো কারণ ছাড়াই চার্জ হারাচ্ছে। রহস্যময় এই ঘটনার কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধান করা যায়নি। তবে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি ধরে নিয়েছেন, পৃথিবী নিজেই যেহেতু তেজস্ক্রিয় নক্ষত্র থেকে উৎপন্ন হয়েছে, তাই ৪৫০ কোটি বছর ধরে বিকিরণের পরও এখনো কিছুটা তেজস্ক্রিয়তা রয়ে গেছে এর ভেতরে। সেই বিকিরণই মাঝেমধ্যে ধরা দিচ্ছে তড়িৎবীক্ষণযন্ত্রে।

অস্ট্রিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী ভিক্টর হেস
উইকিমিডিয়া

কিন্তু ধোঁয়াশা ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট থাকা বিজ্ঞানীদের ধর্ম নয়। এই রহস্য উন্মোচনে কাজ করছিলেন অনেকেই। তত দিনে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মৌলিক ধর্ম সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জেনে গেছেন। তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে দূরে গিয়ে তেজস্ক্রিয়তা মাপলে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ কমে যায়। কোনো জায়গায় তেজস্ক্রিয় বস্তু রেখে তার ১ মিটার দূরে ডিটেক্টর রাখলে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া যাবে, দুই মিটার দূরে রেখে মাপলে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ হবে চার ভাগের এক ভাগ। তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ দূরত্বের বর্গফলের বিপরীত অনুপাত। পৃথিবীর ভেতরের তেজস্ক্রিয়তার অস্তিত্বই যদি তড়িৎ–বীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়ে, তাহলে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে যত ওপরের দিকে এই তড়িৎ–বীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে যাওয়া হবে, তেজস্ক্রিয়তা তত কমে যাবে। তড়িৎ–বীক্ষণযন্ত্র ভূমির সমতলে যে পাঠ দেবে, ভূমি থেকে ওপরে তার চেয়ে কম পাঠ দেবে। বিভিন্নভাবে এই পরীক্ষা করে দেখা হলো, কিন্তু উচ্চতার কারণে পাঠের কোনো পার্থক্য দেখা গেল না। তখন ভাবা হলো, সামান্য দূরত্বের পার্থক্যে কিছু হবে না। দূরত্ব বাড়াতে হবে। ১৯১০ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী থিওডর বুলফ আইফেল টাওয়ারের ওপরে উঠে পরীক্ষা চালালেন। ফল হলো উল্টো। দেখা গেল, আইফেল টাওয়ারের নিচে তড়িৎ–বীক্ষণযন্ত্রে যে পাঠ পাওয়া গেল, ৩০০ মিটার ওপরে আইফেল টাওয়ারের চূড়ায় সেই বিকিরণের পরিমাণ অনেক বেশি। তাহলে এটা নিশ্চিত হলো, এই তেজস্ক্রিয়তার উৎপত্তি পৃথিবীতে নয়, পৃথিবীর বাইরে। কিন্তু কোথায়?

অস্ট্রিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী ভিক্টর হেস তখন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক। তিনি ঠিক করলেন, আরও অনেক উঁচুতে উঠে পরীক্ষা চালাবেন। এ জন্য ব্যবহার করলেন বেলুন। বেশ কিছু বেলুন পরীক্ষা করলেন বেলুনে চড়ে। ৪৫০ মিটার উচ্চতা থেকে শুরু করে পাঠ নিতে নিতে তিনি উঠলেন ৫ কিলোমিটারের বেশি উচ্চতায়। দেখলেন, যতই ওপরের দিকে উঠছেন, তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ ততই বাড়ছে। তার মানে, এই তেজস্ক্রিয়তা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে আসছে পৃথিবীর বাইরে থেকে। তবে কি সূর্য থেকে আসছে? তাহলে দিনের বেলার পাঠ আর রাতের বেলার পাঠে পার্থক্য থাকবে। ভিক্টর হেস রাতের বেলায়ও পরীক্ষা চালালেন। অন্ধকারে যখন সূর্যের আলো বেলুনের আশপাশে কোথাও নেই, তখনো দেখা গেল তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ একটুও কমছে না। ঘটনা কী? তবে কি সূর্যও নয়, আরও দূরের কোনো নক্ষত্র থেকে আসছে এই তেজস্ক্রিয়তা? সূর্যগ্রহণের ফলে কোনো তারতম্য দেখা যায় কি না, পরীক্ষা করার জন্য ১৯১২ সালের ১৭ এপ্রিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় বেলুনে চড়ে তড়িৎ–বীক্ষণযন্ত্রের পাঠ নিলেন ভিক্টর হেস। কিন্তু ফলাফলে কোনো তারতম্য দেখা গেল না। ১৯১৩ সাল নাগাদ বিজ্ঞানীরা মেনে নিলেন যে পৃথিবীর বাইরে, এমনকি সূর্যের থেকেও দূরে মহাকাশের গভীর নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বর্ম ভেদ করে চলে আসছে এই আশ্চর্য রশ্মি। আরও প্রায় ১২ বছর পর ১৯২৫ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিক্যান এই রশ্মির নাম দিলেন কসমিক রে। বাংলায় আমরা একে মহাজাগতিক রশ্মি বলছি। ১৯৩৬ সালে মহাজাগতিক রশ্মির আবিষ্কারক হিসেবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন ভিক্টর হেস।

রবার্ট মিলিক্যান যতই বলুন যে কসমিক রে আসলেই রে—মানে আলোকরশ্মির মতো বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গের অংশ, এতে বিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। কসমিক রে এক্স-রে কিংবা গামা–রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী এবং এদের ভেদনক্ষমতাও অনেক বেশি। মিলিক্যান বললেন, কসমিক রে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গেরই বড় ভাই। এদের কম্পাঙ্ক এক্স-রে ও গামা–রের কম্পাঙ্কের চেয়ে বেশি, আর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এক্স-রে ও গামা–রের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে কম। মিলিক্যান বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী, ইলেকট্রনের চার্জ সঠিকভাবে মেপে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯২৩ সালে। তাঁর কথা অনেকেই মেনে নেবেন, এটা ঠিক। কিন্তু বিজ্ঞানে প্রমাণ ছাড়া কারও কথা কেউ মেনে নেয় না। মিলিক্যানের কথাও অনেক বিজ্ঞানীর বিশ্বাস হলো না। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন কসমিক রে আসলেই রশ্মি, নাকি মহাকাশ থেকে ছুটে আসা কোনো চার্জিত কণা।

তত দিনে ইলেকট্রন ও প্রোটন সম্পর্কে সবাই জেনে গেছেন। নিউট্রন তখনো স্বীকৃতি পায়নি। কসমিক রে যদি মহাকাশ থেকে ছুটে আসা রশ্মি হয়, আলোকরশ্মির অংশ হয়, তাহলে এর ফোটন কণা পৃথিবীর সব জায়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ার কথা। কারণ, ফোটন যেহেতু চার্জহীন, সেহেতু এরা কোনো ধরনের বিদ্যুৎক্ষেত্র কিংবা চুম্বকক্ষেত্র দ্বারা বিক্ষিপ্ত হবে না। কিন্তু যদি এরা চার্জিত কণা হয়, তাহলে পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্রের প্রভাব তাদের গতির ওপর অবশ্যই পড়বে। তাহলে দেখা যাবে, পৃথিবীর মেরুর দিকে কসমিক রে বেশি ধরা পড়বে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
নোবেলজয়ী মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী আর্থার কম্পটন প্রমাণ করলেন যে কসমিক রে আসলে রে নয়, পার্টিকেল বা কণা

ঠিক তা–ই হলো। অনেক বিজ্ঞানীই এই পরীক্ষা করলেন। নোবেলজয়ী মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী আর্থার কম্পটন প্রমাণ করলেন যে কসমিক রে আসলে রে নয়, পার্টিকেল বা কণা। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে প্রচুর গবেষণা হয়েছে কসমিক রের বিকিরণ নিয়ে। প্রমাণিত হয়েছে, কসমিক রের ৯০ শতাংশ কণাই হলো প্রোটন, আর সঙ্গে কিছু (৯%) আলফা পার্টিকেল বা হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। বাকি এক ভাগ বেটা পার্টিকেল বা ইলেকট্রন। সুতরাং এদের মহাজাগতিক রশ্মি না বলে মহাজাগতিক কণা বলা উচিত। কিন্তু কসমিক রে নামটা তত দিনে প্রচলিত হয়ে গেছে বলে তা আর বদলানো হলো না।

কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ চার্জিত কণার উৎস কোথায়? আমাদের কাছের নক্ষত্র সূর্যই যে একমাত্র উৎস নয়, তা প্রমাণিত হয়ে গেছে অনেক আগেই। এই মহাজাগতিক কণাগুলোর উৎস সন্ধান করতে গিয়ে খুলে গেছে মহাকাশ গবেষণার আরও অনেক নতুন নতুন দিক। মহাকাশের অতল গহ্বরে কোটি আলোকর্ষ দূরে ঘটে যাওয়া সুপারনোভা বিস্ফোরণ, ব্ল্যাকহোলের উৎপত্তি এসব মহাজাগতিক ঘটনা থেকে উৎপন্ন মহাজাগতিক কণাগুলোর অংশবিশেষ আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছাচ্ছে। এদের কিছু কিছু কণার শক্তি লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে উৎপন্ন সবচেয়ে শক্তিশালী কণার চেয়ে বেশি শক্তিসম্পন্ন। এদের উৎপত্তির রহস্যের কিনারা এখনো করা যায়নি। কসমিক রে আবিষ্কারের পর ১০০ বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে, এখনো এর আদ্যোপান্ত জানা যায়নি।

২০১৭ সালে নাসা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে আইস-ক্রিম (ISS-CREAM বা International Space Station—Cosmic Ray Energies and Mass) পরীক্ষা চালিয়েছে তিন বছর ধরে। মহাকাশ স্টেশন থেকে চালানো এই পরীক্ষায় দেখতে চেয়েছে সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকেই বেশির ভাগ কসমিক রের উৎপত্তি কি না, আর কসমিক রের সব শক্তির বর্ণালি কোনো একটি নির্দিষ্ট নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় কি না। তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ এখনো চলমান। মহাকাশের রহস্য উন্মোচনে কসমিক রের ভূমিকা ক্রমে বাড়ছে।

কিন্তু পৃথিবীতে যেসব কসমিক রে প্রতিনিয়ত আসছে, তাদের ফলে আমাদের শরীরের কী ক্ষতি হচ্ছে? পৃথিবীতে আমরা প্রতিবছর গড়ে ৫ মিলিসিভার্ট বিকিরণ শোষণ করি। তার মধ্যে মাত্র দশমিক ৪ মিলিসিভার্ট আসে মহাজাগতিক কণা থেকে। আলাদাভাবে এই কণাগুলো আমাদের শরীরের তেমন কোনো ক্ষতি করে না। কারণ, এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলোর শক্তি অত্যন্ত বেশি বলে এরা আমাদের শরীরের একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে যায় প্রায় আলোর গতিতে। তাই পৃথিবীপৃষ্ঠে এগুলো থেকে ক্ষতির আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই চলে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

সূত্র: টুডুর স্টানেভ, হাই এনার্জি কসমিক রেজ, স্প্রিংগার (২০১০);

বব বারম্যান, ঝ্যাপ্‌ড, লিটল ব্রাউন কোম্পানি (২০১৭);

আইজাক আসিমভ, আন্ডারস্ট্যান্ডিং ফিজিকস, বার্নিস অ্যান্ড নোবেল (১৯৬৬)