কখনো কি ভেবে দেখেছেন, জুসে যে বরফের কিউবগুলো দেওয়া হয়, সেগুলো গলে যায় কেন? কিংবা কেতলিতে তাপ দিলে পানি ফুটতে শুরু করে কেন? একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে বলতে হবে, এর কারণ হলো এনট্রপি।
এখন প্রশ্ন হলো, এটা কী? কী করে এটা দিয়ে? চলুন, কিছু উদাহরণের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি, এনট্রপি আসলে কী।
আপনার শোবার ঘরের কথা চিন্তা করুন। এটাকে গুছিয়ে সুন্দরমতো রাখতে হলে আপনাকে কিছু কাজ করতে হবে। কাপড়গুলোকে ভাঁজ করে আলমারিতে রাখতে হবে, বইগুলো শেলফে তুলে রাখতে হবে, অন্যান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে হবে জায়গামতো। এজন্য কিন্তু আপনাকে বেশ ভালোই খাটতে হবে। আর এভাবে ঘর গুছাতে গিয়ে আমরা কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারি। সেটা কী?
জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখার চেয়ে এলোমেলো করে রাখা অনেক সহজ। অর্থাৎ কোনো কিছু বিশৃঙ্খল অবস্থায় রাখা সহজ। আর এই যে যে অগোছালো প্রবণতা বা এলোমেলো অবস্থা কিংবা বিশৃঙ্খলার ধারণার, এর মাধ্যমেই আমরা পরিচিত হতে পারি এনট্রপির সঙ্গে। কারণ এনট্রপি বিশৃঙ্খলা পছন্দ করে। কোথাও যত বেশি বিশৃঙ্খলা বা ডিসঅর্ডার থাকবে, সেখানে এনট্রপিও তত বেশি। অর্থাৎ এনট্রপি হলো বিশৃঙ্খলার পরিমাপ।
আমরা যখন একটা ঘর এলোমেলো দেখি, তখন ঘরটির বিশৃঙ্খলা খুব সহজেই দেখতে পারি। 'এলোমেলো' বিষয়টি আমাদের চোখে এক নজরেই ধরা দেয়। কিন্তু সবক্ষেত্রে এমন নাও হতে পারে। সব বস্তুর অগোছালো অবস্থা বা বিশৃঙ্খলা আমাদের চোখের সামনে সরাসরি দৃশ্যমান হয় না। যেমন ধরুন আপনার সামনে দুটি গ্লাস রাখা হলো। তাদের একটিতে কিছু বরফের টুকরো ও অন্যটিতে কিছু পরিমাণ পানি রাখা হলো। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, দুটোর মধ্যে কোনটি বেশি বিশৃঙ্খল, তাহলে হয়ত অনেকে লাফিয়ে উঠে বলবে বরফ। কিন্তু সত্যিকার অর্থে পানি বেশি বিশৃঙ্খল।
আমরা যদি দুটো গ্লাসকে মাইক্রোস্কোপে জুম বা বিবর্ধিত করে দেখি, তাহলে দেখতে পাব, বরফের অণুগুলো মোটামুটি একটি দৃঢ় কাঠামোতে স্থির হয়ে আছে। অন্যদিকে পানির অণুগুলো তুলনামূলক স্বাধীন, ফলে এদিক ওদিক বিচরণ করতে পারছে। বিশৃঙ্খলভাবে সজ্জিত হতে পারছে বিভিন্ন বিন্যাসে। আবার চায়ের কেতলি থেকে যে বাষ্প বের হয়, তার অণুগুলো আরও স্বাধীনভাবে চলতে পারে, তাই তার বিশৃঙ্খলা আরও বেশি। আর যার বিশৃঙ্খলা যত বেশি, তার এনট্রপিও তত বেশি। তাহলে সেই নিয়ম অনুসারে এনট্রপির ক্রম হবে— বরফ < পানি < বাষ্প।
এখন কথা হচ্ছে, এনট্রপি কেন বিশৃঙ্খলা পছন্দ করে? এটা আসলে সজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনার ওপর নির্ভরশীল। চিন্তা করে দেখুন, আপনার ঘরটি গুছিয়ে রাখার অনেকগুলো উপায় আছে, কিন্তু তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি উপায় আছে তাদের এলোমেলো বা বিশৃঙ্খলভাবে রাখার। আমাদের এই মহাবিশ্বে আছে অসংখ্য অণু। আর তাদের যথা সম্ভব বেশিভাবে সজ্জিত বা বিন্যস্ত হওয়ার প্রবণতা আছে। তাই তারা বিশৃঙ্খল থাকতে পছন্দ করে। তাই বস্তুর এনট্রপিও বিশৃঙ্খলার কথা বলে।
একটি গ্যাসীয় সিস্টেমের এনট্রপি নির্ভর করে তার তাপমাত্রা ও আয়তনের ওপর। আলাদা পাত্রের দুরকম গ্যাসের মিশ্রণ ঘটলেও বদলাতে পারে তাদের প্রত্যেকের এনট্রপি। তরল কিংবা কঠিন পদার্থের এনট্রপি নির্ভরশীল তাদের তাপমাত্রা ও অভ্যন্তরীন গঠনের ওপর।
স্টেট ফাংশনের ধারনা ও এনট্রপি
এনট্রপি মূলত কোনো সিস্টেমের একটা স্টেট ফাংশন (স্টেট ফাংশন মানে চাপ, তাপমাত্রা কিংবা আয়তনের মতো রাশি, যা দিয়ে বোঝা যায় ওই সিস্টেম কী অবস্থায় আছে। স্টেট ফাংশন প্রক্রিয়ার পথের ওপর নির্ভর করে না)। একটি গ্যাসীয় সিস্টেমের এনট্রপি নির্ভর করে তার তাপমাত্রা ও আয়তনের ওপর। আলাদা পাত্রের দুরকম গ্যাসের মিশ্রণ ঘটলেও বদলাতে পারে তাদের প্রত্যেকের এনট্রপি। তরল কিংবা কঠিন পদার্থের এনট্রপি নির্ভরশীল তাদের তাপমাত্রা ও অভ্যন্তরীন গঠনের ওপর। একেবারে ক্ষুদ্র আণবিক পর্যায়ের আলোচনা ও তার সঙ্গে পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করেই এনট্রপি হয়ে ওঠে প্রকৃত এনট্রপি, শৃংখলা ও বিশৃংখলার নির্ধারক।
চলুন এবার এই এনট্রপিকে আরেকটু স্পষ্টভাবে দেখার জন্য তিনটি নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হই। এরা হলো, ম্যাক্রোস্টেট (Macrostate), মাইক্রোস্টেট (Microstate) ও মাল্টিপ্লিসিটি (Multiplicity)। এগুলো বুঝতে আমরা খুবই সাধাসিধে দুটো লুডুর ছক্কা বা ডাইসকে সিস্টেম ধরে বিষয়গুলোকে বোঝার চেষ্টা করব।
আমরা যদি দুটো ছক্কা ছুড়ে মারি, তবে যতগুলো ফলাফল আসা সম্ভব, তার সব এই ছবিটাতে দেখানো হয়েছে। যদি ছক্কা দুটোর গায়ে থাকা সংখ্যাগুলোর সম্ভাব্য যোগফল নিয়ে আমরা চিন্তা করি, তবে দেখতে পাব এই যোগফল ২ (যখন ছক্কা দুটোর প্রত্যেকের গায়ে ১ করে থাকে) থেকে ১২ (যখন দুটোর গায়েই ৬) পর্যন্ত, মোট ১১ ধরনের হতে পারে। এই যে ১১ ধরনের যোগফল আমরা পেতে পারি, এই যোগফলগুলোর প্রত্যেকটি একেকটি ম্যাক্রোস্টেট নির্দেশ করে। মানে, যখন যোগফল ৭ পাব (সেটা হতে পারে ১+৬, ২+৫, ৩+৪, ৪+৩, ৫+২ বা ৬+১), সেটা এক ধরনের ম্যাক্রোস্টেট। আবার যখন যোগফল ১০ পাব, সেটা হবে আরেক ধরনের ম্যাক্রোস্টেট। ম্যাক্রো কথাটার অর্থ 'বড়'। সুতরাং, আমরা যখন ম্যাক্রোস্টেট নিয়ে কথা বলছি, তখন আমরা এই দুই ছক্কা দিয়ে গঠিত সিস্টেমগুলোর প্রত্যেকটির সামগ্রিক (ছক্কাদের গায়ের সব সংখ্যার মোট যোগফল) অবস্থা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। এক্ষেত্রে কোন ছক্কাটার গায়ে কত লেখা আছে, কোনটি কত পিঠে নিয়ে ঘুরছে, তা আমাদের দেখার বিষয় নয়।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, একটা নির্দিষ্ট ম্যাক্রোস্টেটের মধ্যেও কিন্তু বিভিন্ন রকমফের হতে পারে, যদি আমরা আরেকটু ভেতরে গিয়ে ছক্কাগুলোর ধারণকৃত সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে আলোচনা করি। এই যেমন ৭ যোগফলবিশিষ্ট ম্যাক্রোস্টেট নিয়েই বলছিলাম, এই ম্যাক্রোস্টেট গঠন করা যায় ৬ টি ভিন্ন উপায়ে। একই ম্যাক্রোস্টেটে যতগুলো ভিন্ন ভিন্ন চিত্র আমরা পাই, তাদের প্রতিটি একেকটি মাইক্রোস্টেট। যেমন ৫+২ যে মাইক্রোস্টেট বোঝায়, ৩+৪ বা ২+৫ সম্পূর্ণ আলাদা দুটি মাইক্রোস্টেট নির্দেশ করে। এরা একই ম্যাক্রোস্টেটের অধীনে, কিন্তু প্রত্যেকে আলাদা সত্ত্বা। একটি ম্যাক্রোস্টেটে যতগুলো আলাদা আলাদা মাইক্রোস্টেট থাকতে পারে, তাদের সংখ্যাই হলো মাল্টিপ্লিসিটি। সোজা কথায়, মাইক্রোস্টেটের মোট সংখ্যাই মাল্টিপ্লিসিটি।
এখন আমরা এই জ্ঞানকে পুঁজি করে চলে যেতে পারি গ্যাসের অণুভর্তি একটা পাত্রে। এই পাত্রটা আমাদের সিস্টেম। আর তার অণুগুলো আমাদের ওই ছক্কার মতো। ছক্কার গায়ে থাকা ফোঁটার সংখ্যা যেমন তাদের পরিচয় ছিল, তেমনি ধরি এই অণুগুলোর পরিচয় তাদের গতিশক্তিতে। তাহলে সিস্টেমটা যত বেশি শক্তি ধারণ করে থাকবে, তার অণুগুলোও তেমন অসংখ্য উপায়ে নিজেদের মধ্যে গতিশক্তি ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ পাবে। ফলে আমরা নিঃসন্দেহে বলে দিতে পারি, বেশি শক্তিসম্পন্ন সিস্টেমের মাল্টিপ্লিসিটি বেশি হবে, আর কম শক্তির সিস্টেমের মাল্টিপ্লিসিটি হবে তুলনামূলক কম। আর মাল্টিপ্লিসিটি বেশি হওয়া মানে কিন্তু আপনারা বুঝতেই পারছেন—বিভিন্নভাবে ছোটাছুটি করে তাদের বিভিন্ন অবস্থান ধারণ করার প্রবণতা বেশি হওয়া। আর এর মানেই হলো বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাওয়া, তথা এনট্রপি বেড়ে যাওয়া।
আমরা যদি এই আইসক্রিমকে একটা আদর্শ বস্তু ধরি, তাহলে সেটাকে গলাতে যে পরিমাণ তাপ লেগেছে, আর তাকে ঠাণ্ডা করতে যে পরিমাণ তাপ লাগবে, দুটোর পরিমাণ সমান। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এই পুরো প্রক্রিয়াটাকে বলে প্রত্যাবর্তী প্রক্রিয়া। বাস্তবে সম্পূর্ণ প্রত্যাবর্তী প্রক্রিয়া পাওয়া যায় না। তবে কিছু কিছু এমন ঘটনা আছে, যাদেরকে প্রত্যাবর্তী প্রক্রিয়া বলা যায়।
এখন আমরা প্রত্যাবর্তী ও অপ্রত্যাবর্তী প্রক্রিয়া—এই দুটি কী বোঝায়, তা একটি ঘটনার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি। ধরুন আখলাক সাহেব সাধারণত ক্লাস শেষ করে সোজা বাসায় যান। কিন্তু আজকে একটু বাজারে গিয়ে এক লিটারের একটি আইসক্রিমের বাক্স কিনলেন।
আখলাক সাহেব সরকারি চুনিয়াপটল কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষক। তার বাড়িতে তার আট বছরের একটা মেয়ে আছে। মেয়েটির নাম মুকু। মুকু আইসক্রিম বেশ পছন্দ করে, তাই তিনি আজ আইসক্রিম কিনেছেন।
বাসায় যাওয়ার পর যখন আইসক্রিমের বাক্সটি তার মেয়েকে দিলেন, তখন মুকু অনেক খুশি হলো। কিন্তু যেই না সেই বক্সটি খোলা হলো, তাঁর মেয়ে কান্নাকাটি শুরু করল। কারণ পুরো আইসক্রিমটা একদম পানি হয়ে গেছে। মানে, রাস্তায় আসতে আসতে আইসক্রিম গলে গেছে।
আখলাক সাহেব তাঁর মেয়ের কান্না দেখে হাসতে হাসতে বললেন, 'মা, এটা কোনো ব্যাপারই না। ফ্রিজে রাখলে এটা কিছুক্ষন পর আবার আগের মতো হয়ে যাবে।'
চলুন, এবার আমরা ওপরের ঘটনাটিকে একটু বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। আপনারা জানেন, আইসক্রিম সবসময় জমে থাকা অবস্থায় বা কঠিন অবস্থায় খেতে দারুণ লাগে। কিন্তু যদি গলে যায়, তাহলে খুব একটা মজা লাগে না, তাই না?
ওপরে ঠিক এ ঘটনাই ঘটেছে। আখলাক সাহেব দোকান থেকে একটা জমে থাকা আইসক্রিম-ই কিনেছেন। কিন্তু রাস্তায় আসতে আসতে তা গলে গিয়েছিল। আর সেই গলে যাওয়া আইস্ক্রিম খেতে ভালো লাগবে না বলেই মুকু শুরু করেছিল কান্নাকাটি। কিন্তু আখলাক সাহেব তাকে আশার কথা শুনিয়ে বললেন, ফ্রিজে রাখলে সেটা আবার আগের মতো হয়ে যাবে বা জমে যাবে।
এখন বলুন তো, কীভাবে এই আইসক্রিম গলে গেল, আর সেটা ফ্রিজে রাখলে কীভাবে আগের অবস্থায় ফিরে আসবে?
আমি জানি, আপনারা বলবেন, আইসক্রিম প্রথমে পরিবেশ থেকে তাপ নিয়ে গরম হয়ে তরল হয়ে যাবে। তারপর ফ্রিজে রাখলে ফ্রিজ সেটাকে আবার ঠাণ্ডা করে—অর্থাৎ সেটা থেকে তাপ সরিয়ে নিয়ে আইসক্রিমটাকে আবার আগের মতো জমিয়ে দেবে।
আমরা যদি এই আইসক্রিমকে একটা আদর্শ বস্তু ধরি, তাহলে সেটাকে গলাতে যে পরিমাণ তাপ লেগেছে, আর তাকে ঠাণ্ডা করতে যে পরিমাণ তাপ লাগবে, দুটোর পরিমাণ সমান। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এই পুরো প্রক্রিয়াটাকে বলে প্রত্যাবর্তী প্রক্রিয়া।
বাস্তবে সম্পূর্ণ প্রত্যাবর্তী প্রক্রিয়া পাওয়া যায় না। তবে কিছু কিছু এমন ঘটনা আছে, যাদেরকে প্রত্যাবর্তী প্রক্রিয়া বলা যায়। এবার ধরুন, কোনো জায়গায় একটা বোমা বিস্ফোরণ ঘটল। অথবা দুটো গাড়ির সংঘর্ষে কোথাও আগুন লেগে গেল। এক্ষেত্রে যে ঘটনাগুলো হলো, সেক্ষেত্রে বিস্ফোরণ হওয়া বোমা কিংবা গাড়ি দুটি ঠিক আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না। এ ধরনের ঘটনাগুলোকে বলে অপ্রত্যাবর্তী প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াগুলো দ্রুত কিংবা হটাৎ সংঘটিত হয়।
এই হলো এনট্রপির প্রাথমিক ধারণা। তবে এখানে বিভিন্ন সমীকরণ ও গ্রাফে বিষয়গুলো কীভাবে তুলে ধরা হয়, সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়নি। পরের কোনো লেখায় এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, আইইউবি