ঠিক কখন মাতৃভাষার শব্দগুলোকে আলাদাভাবে বুঝতে শুরু করেছিলেন, কিংবা কোন কোন বৈশিষ্ট্যের সাহায্যে প্রথম চিনেছিলেন মাতৃভাষার কোনো বর্ণকে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে স্মৃতির অতলে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে হবে। অবশ্য তাতেও হয়তো সঠিক উত্তর মিলবে না। কারণ, মাতৃভাষাকে অবচেতনভাবেই আমরা মস্তিষ্কে পুরে নিই—মাতৃগর্ভে থাকার সময় থেকেই, তাই পরে সচেতনভাবেও তাকে আর ভোলা যায় না। কিন্তু দ্বিতীয় ভাষার কথা মাথায় এলে স্বাভাবিকভাবেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একগাদা বিচিত্র অথচ দুর্বোধ্য শব্দ, ব্যাকরণের গোলকধাঁধা আর তাতে পথ হারিয়ে পাওয়া নানা জটিল অভিজ্ঞতা। এত সব ঝক্কি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত অনেকেই আয়ত্ত করে ফেলেন কোনো নতুন ভাষা। আর এ চেষ্টায় আমাদের সহায়ক হলো মস্তিষ্ক। যেকোনো নতুন জিনিস শেখা, নিদেনপক্ষে চেষ্টা করা—এসব মূলত নিজের মস্তিষ্ককে আরেকটু ক্ষুরধার করিয়ে নেওয়ারই প্রক্রিয়া। আর এর উপহার মস্তিষ্ক আমাদের দেয় কাজকর্মে আরেকটু বেশি সক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে। তবে নতুন ভাষা শেখার ক্ষেত্রে চেষ্টার মতোই ব্যাপক হয় তার ফলাফলটা।
আমাদের মস্তিষ্কের দক্ষতার মানদণ্ড কিন্তু নমনীয়তা, কেতাবি ভাষায় যাকে বলা হয় নিউরোপ্লাস্টিসিটি।
একটি নতুন ভাষা মস্তিষ্কে আসলে কী ঘটায় সেটা বোঝার জন্য আগে দুটো জনপ্রিয় সায়েন্টিফিক টার্মের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। ইলাস্টিসিটি বা স্থিতিস্থাপকতা আর প্লাস্টিসিটি বা নমনীয়তা। প্রতিদিনের কাজে ব্যবহৃত জিনিসগুলোর ক্ষেত্রে স্থিতিস্থাপকতাকেই আমরা বেশি গুরুত্ব দিই, সেটা তাদের উপযোগিতার জন্যই। তবে আমাদের মস্তিষ্কের দক্ষতার মানদণ্ড কিন্তু নমনীয়তা, কেতাবি ভাষায় যাকে বলা হয় নিউরোপ্লাস্টিসিটি। কারণ, পরিস্থিতি অনুযায়ী নতুন পথ খুঁজে নিয়ে এগোনোই যেকোনো বুদ্ধিমান প্রাণের টিকে থাকার উপায়। এমন নতুন নতুন সৃজনশীল উপায় যিনি সহজে খুঁজে নিতে পারবেন, তিনি সব ক্ষেত্রেই বেশি এগিয়ে থাকবে—সেটাই নিয়ম। আর এই জরুরি দক্ষতাটির নির্দেশক হলো নিউরোপ্লাস্টিসিটি। এটা তৈরি হয় নিউরনগুলোর নিয়ত পুনর্বিন্যাস এবং নতুন নতুন সিন্যাপস গঠনের মাধ্যমে।
এটা সত্য যে নিউরোপ্লাস্টিসিটি বয়সের সঙ্গে কিছুটা কমতে থাকে। তবে শৈশবের পরে যে তা একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে—এ কথাই চালু ছিল একসময়। এখন সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। চর্চার মাধ্যমে বাড়ানোও যায়। এর একটি চমৎকার উপায় হলো কোনো নতুন ভাষার চর্চা।
সুইডিশ আর্মড ফোর্সেস ইন্টারপ্রেটার একাডেমিতে পরিচালিত একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, মাত্র তিন মাসের একটি নতুন ভাষাশিক্ষা কোর্সের পরে প্রশিক্ষণার্থীদের সেরেব্রাল কর্টেক্সের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। বিশেষ করে বাক্শক্তি নিয়ন্ত্রণকারী অংশগুলোর আকার ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। প্রমাণ মেলে নতুন নতুন নিউরাল পাথওয়ে তৈরির।
সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপার হলো, ভাষার চর্চা বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কমায় মস্তিষ্কের নানা রকম সমস্যার ঝুঁকি তৈরি করা।
তবে এই নতুন নিউরাল নেটওয়ার্ক যে শুধু ভাষা–সম্পর্কিত ক্ষেত্রেই মানুষের মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা বাড়াবে, এমন নয়। কারণ, মস্তিষ্কের এই অংশগুলো একই সঙ্গে পরিকল্পনা, আচরণ, বিশ্লেষণ ও সব মিলিয়ে গুছিয়ে কাজ করার দক্ষতাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই ভাষার সঙ্গে বাড়ে ভাবনার দক্ষতাও। তবে শুধু প্র্যাকটিক্যাল ইন্টেলিজেন্স নয়, একাধিক ভাষার চর্চা বাড়ায় ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সও—এমন ফলই উঠে এসেছে ‘থিওরি অব মাইন্ড’ নিয়ে পরিচালিত নানা গবেষণায়।
সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপার হলো, ভাষার চর্চা বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কমায় মস্তিষ্কের নানা রকম সমস্যার ঝুঁকি তৈরি করা। যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্টিস্ট জন গ্রান্ডি বহুদিন ধরে বহুভাষিকতা ও তার সঙ্গে মস্তিষ্কের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করছেন। এক গবেষণায় তিনি দেখতে পান, যাঁরা একাধিক ভাষা জানেন, স্মৃতিভ্রংশের মতো সমস্যা তাঁদের কমই হয়। একাধিক ভাষা চর্চার মাধ্যমে এসব বিলম্বিত করা যায় ছয় বছর পর্যন্ত। অন্যদিকে ওষুধের মাধ্যমে তা বিলম্বিত করার রেকর্ড সর্বোচ্চ ১ বছরের।
কাজেই যাঁরা দীর্ঘদিন থেকে জার্মান শেখার ইচ্ছা বয়ে বেড়াচ্ছেন, যাঁরা রুশ সাহিত্য পড়তে চেয়েছেন রুশ ভাষায় কিংবা কেবল আনন্দের জন্যই শিখতে চেয়েছেন পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তের কোনো এক মায়ের মুখের ভাষা—তাঁরা কিন্তু সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে কাজে নেমে পড়তে পারেন এই বেলা। নিউরনে নিউরনে চলুক কিছুটা ভাঙচুর—ক্ষতি কী!