অমর একুশে মহান শহীদ দিবস আজ। আমরা প্রতিবছর ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। পাশাপাশি দেশকে আরও এগিয়ে নেওয়ার শপথ নিই। এখন তো একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়।
ইউনিসেফ ও জাতিসংঘ যে মাতৃভাষাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ভূষিত করেছে, তার পেছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। প্রতিটি জাতির জ্ঞানবিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়ার একটি পূর্বশর্ত হলো, যার যার মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন। বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, মাতৃভাষায় সুন্দরভাবে পড়তে পারে, এমন শিশুর সংখ্যা ১০ শতাংশ বাড়াতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি হিসাব।
মাতৃভাষার সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়া ও সেই সঙ্গে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধনের নিবিড় সম্পর্কের বিষয়টি আগে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলেও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা তা উপলব্ধি করেছি। আর সে জন্যই প্রায় ৭৫ বছর আগে মাতৃভাষা বাংলার জন্য, বাংলায় কথা বলার অধিকার সংরক্ষণের জন্য, তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের জন্য আমরা রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছি। আমরা মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অর্জন করেছি।
ভাষাবিদদের গবেষণায় আজ এটা প্রতিষ্ঠিত যে মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারলে অন্তত তিনটি বিদেশি ভাষা সহজে শেখা যায়। আর আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে দু-তিনটি বিদেশি ভাষায় দক্ষতা না থাকলে টিকে থাকা কঠিন। এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা। এর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা হলো, শিশু জন্মের পর থেকেই মায়ের হাসি, কথা বলার ভঙ্গি, মনের ভাব প্রকাশের পদ্ধতি দেখে শেখে। কথা বলতে শেখার আগে থেকেই স্বপ্ন দেখা শেখে। তাই মায়ের ভাষা শিশুর মনোজগতের বিকাশে বিশেষ অবদান রাখে। মা ও শিশুর মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এভাবে মাতৃভাষা মানুষের মেধা শাণিত করে।
ভাষা মানে শুধু কিছু শব্দ নয়। আবেগ-অনুভূতি, চিন্তাভাবনা, স্বপ্ন-কল্পনা প্রভৃতি ভাষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভাষা না থাকলে মানুষ কল্পনা করতে পারত না এবং সেই অর্থে মানুষ কিন্তু মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতেও পারত না।
শুধু মানুষই কথা বলতে পারে
আমরা জানি, প্রাণিজগতে একমাত্র মানুষই কথা বলতে পারে। ভাষা জানে। মনের ভাব প্রকাশ করার এই ক্ষমতা আর কোনো প্রাণীর নেই। কেন নেই? কারণ, তাদের স্বরযন্ত্র থাকলেও মস্তিষ্কের যে অংশ চিন্তাভাবনার কাজ সম্পন্ন করে, তার সঙ্গে এর সংযোগ নেই। মানুষের আছে। তাই মানুষ কথা বলতে পারে। ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। এ বিষয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক কার্ল জিমার তাঁর একটি লেখায় (৯ ডিসেম্বর ২০১৬) চমৎকার একটি বিষয় উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন, একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করে জানিয়েছেন, বানর বা এ–জাতীয় প্রাইমেটগুলোর মানুষের মতোই স্বরযন্ত্রে কথা বলার মতো সব রকম ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু তা–ও কথা বলতে পারে না। কারণ, সেগুলোর মস্তিষ্কে সঠিক সংযোগ (রাইট ওয়্যারিং) সাধনের ব্যবস্থা নেই। ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনার বিজ্ঞানী ডব্লিউ টেকুমেশ ফিচ মানুষের চেতনা নিয়ে কাজ করেন (কগনিটিভ সায়েন্টিস্ট)। নতুন অনুসন্ধানমূলক পর্যবেক্ষণের সহপ্রণেতা এই বিজ্ঞানী বলেন, বানরের স্বরতন্ত্র শত শত বা হাজার হাজার শব্দ তৈরির জন্য খুবই উপযুক্ত। কিন্তু তারপরও কথা বলতে না পারার কারণ স্বরযন্ত্রের সঙ্গে মস্তিষ্কের সংযোগব্যবস্থার অভাব।
এই সংযোগ সাধন মানুষের থাকলেও কথা বলা বা ভাষা আয়ত্ত করা কিন্তু এক দিনে সম্ভব হয়নি। মানুষ আদিম যুগে পাহাড়ের গুহায় থাকত। সেখানে গুহাচিত্র এঁকে দলের অন্য সদস্যদের বুঝিয়ে দিত, শিকারের সময় কে কোথায় থাকবে, কার ভূমিকা কী হবে ইত্যাদি। তখনো মানুষ ভাষা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি।
পটলচেরা চোখ সৌন্দর্যের প্রতীক কেন?
আদি যুগে মানুষ দল বেঁধে শিকারে গেলে নিঃশব্দে যেতে হতো, তা না হলে তো শিকার পালিয়ে যাবে। এ অবস্থায় তারা তাদের নেতাকে অনুসরণ করত। যার চোখ একটু বড় ও চোখের মণি কালো ও চারপাশ সাদা, তাকেই নেতৃত্ব দিতে হতো। কারণ, দূর থেকে নেতার চোখের ইঙ্গিত সহজে বোঝা যায় বলে কখন কার কী করতে হবে, সেটা চোখের ইঙ্গিতেই সবাই বুঝে নিত। এ জন্যই বড় চোখ ও সাদা–কালোর বৈপরীত্যের দারুণ চাহিদা ছিল। এখান থেকেই পটলচেরা চোখ সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। মানুষ, বানর বা গরিলার চোখের মধ্যে এটা একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। ওদের চোখের মণি সাধারণত কালো আর চারপাশটা কালোর কাছাকাছি বা ধূসর। কিন্তু মানুষের বেলায় দেখা যায়, চোখের মণির চারপাশের বেশ বড় অংশ সাদা। মানুষের বিকাশে বিশেষ ভূমিকার কারণেই চোখের ভেতরের একটি বড় অংশ সাদা রঙে সজ্জিত।
একটি ঘরে একই সঙ্গে দেড় বছরের মানবশিশু ও কিছু প্রাণী নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। ঘরের ভেতর একজন বিজ্ঞানী আলাদাভাবে দুজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তারপর মাথা বা শরীর না ঘুরিয়ে শুধু চোখ ঘুরিয়ে ছাদের দিকে তাকান। দেখা গেল, মানবশিশু সেই বিজ্ঞানীর চোখ অনুসরণ করে ছাদের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু অন্য প্রাণীরা নির্বিকার। তাদের কাছে পরীক্ষকের চোখের নড়াচড়া কোনো মনোযোগের বিষয় নয়। কিন্তু পরীক্ষক মাথা নাড়ালে বা হাত-পা নাড়ালে অন্য প্রাণীরা ওই নড়াচড়া লক্ষ করে এবং সে অনুযায়ী তার চোখ বা মাথা ঘুরিয়ে দেখে। এ থেকে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে একজন মানুষ কোন দিকে মনোযোগ দিচ্ছে বা তাকাচ্ছে, সেটা আরেকজন মানুষ বা এমনকি মানবশিশুর কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বানর বা প্রাণীদের কাছে ততটা নয়। মানুষের বিকাশ সাধন হয়েছে সামাজিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া মানুষের পক্ষে সভ্য সমাজ গড়া সম্ভব ছিল না। সে জন্যই একজন মানুষ কী পর্যবেক্ষণ করছে, সেটা অপর মানুষ ভালোভাবে লক্ষ করে। তাই সর্বাগ্রে অন্য লোকজনের চোখের দিকে লক্ষ রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। চোখ যেন অপরের কাছে সহজে লক্ষণীয় হয়, সে জন্য মানুষের চোখের মণির চারপাশের বড় অংশ সাদা হয়ে উঠেছে, যেন কালো মণির পাশে সাদা অংশ সহজে দৃশ্যমান হয়। কিন্তু বৈরী প্রকৃতিতে পশুপাখির টিকে থাকার জন্য সবার প্রথম প্রয়োজন হয় প্রতিযোগিতা, সহযোগিতা নয়। সে জন্য তার চোখের মণি রঙের আড়ালে ঢেকে রাখার ব্যবস্থা, যেন অন্যরা বুঝতে না পারে, সে কোন শিকারের দিকে নজর দিচ্ছে।
ভাষা আবিষ্কারের আগে থেকেই মানুষ কীভাবে সামাজিক সহযোগিতায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, এটা তার একটি প্রমাণ।
আগুনের আবিষ্কার
আদিম মানুষ প্রথম দিকে শিকার করা পশুপাখির কাঁচা মাংস চিবিয়ে খেত। ফলে দিনের প্রায় বেশির ভাগ সময়ই তাকে চোয়াল চালাতে হতো। এ জন্য আদিম যুগের মানুষের চোয়াল ছিল বেশ বড় ও মাথার অংশ ছোট। সেখানে মস্তিষ্কের আকারও হতো ছোট। পরে আগুন আবিষ্কারের ফলে মাংস পুড়িয়ে খাওয়া সম্ভব হলো। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চোয়াল ছোট ও মাথার অংশ বড় হলো। সেখানে মস্তিষ্কের আকার বড় হলো। মস্তিষ্কের সঙ্গে গলার স্বরযন্ত্রের সংযোগ থাকায় ধীরে ধীরে মানুষের শব্দ উচ্চারণ ও ভাষায় মতবিনিময় করার সুযোগ আরও বাড়ল।
ভাষা ও বিজ্ঞান
আমরা অনেক সময় মনে করি, ভাষা আর বিজ্ঞান আলাদা বিষয়। সেটা এক অর্থে ঠিক। কিন্তু ভাষার সঙ্গে বিজ্ঞান অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। যেমন অনেক প্রবাদ–প্রবচন ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। বেশ কিছু প্রবাদের অর্থ বের করতে গেলে বিজ্ঞানের আশ্রয় নিতে হয়। যেমন একটা প্রচলিত প্রবাদ হলো ‘কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো’। কিল দিলে যে কাঁঠাল পাকে, সেটা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। কিন্তু আঘাতে কাঁঠাল পাকে কেন? এর কারণ হলো কিছুটা কাঁচা কাঁঠাল গাছ থেকে পেড়ে তাকে আচ্ছা করে কিল বা আঘাত দিলে কাঁঠালের ভেতর একটি সংকেত যায় যে তাড়াতাড়ি কাঁঠাল পাকানোর ব্যবস্থা করতে হবে, না হলে কাঁচা কাঁঠালের কোষগুলো বের হয়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে নষ্ট হবে। তাই সে দ্রুত ইথিলিন গ্যাস নিঃসৃত হয়, যেন দ্রুত কাঁঠাল পাকে। কারণ, পাকা কাঁঠালের বীজ থেকে নতুন চারা গজাবে, তাহলেই তার বংশবিস্তার করা সম্ভব। বংশবিস্তার করা সম্ভব হলেই তো গাছের জীবন সার্থক! এই বৈজ্ঞানিক বিষয়টি বোঝার জন্য কাউকে বিজ্ঞান বই পড়তে হয়নি। অভিজ্ঞতা থেকেই শিখেছে। প্রায় সময় পাকা কাঁঠাল গাছ থেকে নামিয়ে বোঁটার গোড়ায় একটা গজাল ঢুকিয়ে দু–তিন দিনেই কাঁঠাল পাকানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেখান থেকেই ‘কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো’র প্রবাদ।
আবার আমরা বলি, ‘ফাঁপা কলস বাজে বেশি’। এর পেছনেও রয়েছে বিজ্ঞান। কারণ, অভিজ্ঞতায় জানি, পানি ভরা কলসে টোকা দিলে শব্দ কম হয়, কিন্তু ফাঁপা থাকলে টোকা দিলেই বেশ জোরে শব্দ শোনা যায়। কারও জ্ঞানের অন্তঃসারশূন্যতা প্রকাশ করতে এই প্রবাদ সাধারণত ব্যবহার করা হয়।
আরেকটি মজার ব্যাপার লক্ষ করার মতো। স্কুলে ব্যাকরণে আমরা পড়ি, ‘পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির’। এখানে ‘পাতায় পাতায়’ শব্দযুগলের কারক হলো অধিকরণে পঞ্চমী বিভক্তি। অথচ ‘য়’ সাধারণত সপ্তমী বিভক্তি। কোথায় পড়ে? পাতায় পড়ে। এখানে তো অধিকরণে সপ্তমী বিভক্তি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বিভক্তি কেন ‘পঞ্চমী’ হলো? এর ব্যাখ্যাটা বেশ জটিল বিজ্ঞানের বিষয়। নিশীথ রাতের শিশির আকাশ থেকে পড়ে না, বরং শীতের ঠান্ডায় বাতাসের অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প পানির বিন্দু হিসেবে পাতায় জমে এবং এরপর ওপরের পাতা থেকে নিচের পাতায় ফোঁটার আকারে পড়ে। তাই শিশির ‘পাতা হইতে পাতায়’ পড়ে। ‘হইতে’ শব্দটি উহ্য থাকে, কিন্তু প্রক্রিয়াটির কারণে সেটা অধিকরণে ‘পঞ্চমী’ বিভক্তি, সপ্তমী নয়।
লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
