পৃথিবীর সব লাইট বাল্ব একসঙ্গে জ্বালালে কী হবে

পৃথিবীর সব মানুষ যদি একসঙ্গে সব লাইট বাল্ব জ্বালায়, তাহলে কী হবে? সহজ উত্তর হলো, বিদ্যুতের চাহিদার ওপর প্রভাব পড়বে। বিদ্যুৎ এক ধরনের শক্তি, যা আমাদের চারপাশের বৈদ্যুতিক সবকিছুকে সচল রাখে। বিদ্যুৎ তৈরি হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রে। কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, ইউরেনিয়াম, পানি, বাতাস এবং সূর্যের আলোর মতো বিভিন্ন উৎস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এরপর এই বিদ্যুৎ পাওয়ার গ্রিড নামে একটি বিশাল তারের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমাদের বাড়িঘর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেওয়া হয়।

বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ঠিক ততটুকুই বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যতটুকু সেই সময়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাওয়ার গ্রিড স্থিতিশীল রাখতে হলে বিদ্যুতের সরবরাহ এবং চাহিদার মধ্যে সব সময় ভারসাম্য থাকা জরুরি। আলো জ্বালালে গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। ঠিক সেই মুহূর্তেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি জেনারেটরকে তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হয় সমপরিমাণ। যদি সরবরাহ এবং চাহিদার মধ্যে এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য নষ্ট হয়, এমনকি কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও পুরো সিস্টেমটি ভেঙে পড়তে পারে।

পাওয়ার গ্রিড পরিচালনা করা কঠিন কাজ। কারণ, বিদ্যুতের চাহিদা সব সময় ওঠানামা করে। এই চাহিদা দিন ও রাতের বিভিন্ন সময় এবং ঋতু অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। যেমন, গ্রীষ্মকালে চাহিদা ও লোড শীতকাল থেকে বেশি থাকে। সিস্টেম অপারেটররা এই কাজটি করার জন্য সেন্সর এবং অত্যাধুনিক কম্পিউটার ব্যবহার করেন। তারা সবসময় লোড পর্যবেক্ষণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ায় বা কমায়। ফলে সরবরাহ এবং চাহিদা সবসময় সমান থাকে।

আরও পড়ুন
প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লে বা কমলে অনেক কাজ শুরু করতে পারে। এ কারণে যখন বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হয়, যেমন গ্রীষ্মকালে দুপুরে এসি চালানোর সময় এগুলো কাজে লাগানো হয়।

সারা বিশ্বের সবাই যদি একবারে লাইট বালব জ্বালায়, তাহলে বিদ্যুতের জন্য হঠাৎ বিশাল চাহিদা তৈরি হবে। সিস্টেম ক্র্যাশ বা ব্ল্যাকআউট এড়াতে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে খুব দ্রুত উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে এভাবে দ্রুত কাজ করা সম্ভব নয়।

কয়লা এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এরা প্রায় ২৪ ঘন্টা প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু এদের কিছু দুর্বলতাও আছে। এরা বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লে বা কমলে দ্রুত কাজ করতে পারে না। এছাড়াও, কোনো কারণে যদি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে পুনরায় চালু করে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করতে অনেক সময় লাগে। কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিনও লাগতে পারে।

প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লে বা কমলে অনেক কাজ শুরু করতে পারে। এ কারণে যখন বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হয়, যেমন গ্রীষ্মকালে দুপুরে এসি চালানোর সময় এগুলো কাজে লাগানো হয়। অন্যদিকে সৌরশক্তি, বায়ু এবং জলবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য উৎসগুলো কম দূষণ তৈরি করে। কিন্তু এগুলোকে এত সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কারণ, বাতাস সবসময় একই গতিতে প্রবাহিত হয় না। আবার রোদও প্রতিদিন সমানভাবে থাকে না। এজন্য হঠাৎ বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লে এগুলোর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা কঠিন।

বিদ্যুতের চাহিদা যখন হঠাৎ বাড়ে বা কমে, তখন পাওয়ার গ্রিডের প্রবাহের ভারসাম্য সমান রাখতে গ্রিড ম্যানেজাররা বড় ব্যাটারি ব্যবহার করেন। কিন্তু একটি পুরো শহর চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে সংরক্ষণ করা এখনো সম্ভব হয়নি। কারণ, এমন বিশাল ব্যাটারি সিস্টেম তৈরি করতে অনেক খরচ এবং এগুলো খুব দ্রুত চার্জ ধরে রাখার ক্ষমতা হারাতে শুরু করে।

আরও পড়ুন
তবে পৃথিবীর সব মানুষ একবারে তাদের আলো সুইচ জ্বালালেও চিন্তার কোনো কারণ নেই। কেননা এতে বিশ্বজুড়ে ব্ল্যাকআউট হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই একসঙ্গে।

বিদ্যুতের চাহিদা যখন কম থাকে, তখন কিছু জলবিদ্যুৎকেন্দ্র হ্রদের পানি পাম্প করে ওপরে তুলে রাখে। এরপর যখন বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়, তখন সেই সঞ্চিত পানি ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়। এভাবে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো একদিকে বিদ্যুৎ সঞ্চয় করে এবং অন্যদিকে চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে।

তবে পৃথিবীর সব মানুষ একবারে তাদের আলো সুইচ জ্বালালেও চিন্তার কোনো কারণ নেই। কেননা এতে বিশ্বজুড়ে ব্ল্যাকআউট হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই একসঙ্গে। এর কারণ হলো, পৃথিবীর সব দেশ একটি একক পাওয়ার গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত নয়। বরং বেশিরভাগ দেশের নিজস্ব গ্রিড রয়েছে, অথবা একটি দেশের ভেতরেই একাধিক আঞ্চলিক গ্রিড কাজ করে। তাই কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের গ্রিড বিদ্যুতের হঠাৎ চাপ সামলাতে ব্যর্থ হয়, তাহলেও সেই অঞ্চলের মধ্যেই ব্ল্যাকআউট সীমাবদ্ধ থাকবে। পুরো বিশ্বে এর প্রভাব পড়বে না।

যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর বিদ্যুৎ গ্রিডগুলো সংযুক্ত। এতে তারা নিজেদের মধ্যে সহজে বিদ্যুৎ আদান-প্রদান করতে পারে। কিন্তু এই গ্রিডগুলো প্রয়োজনে দ্রুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে।  ফলে যদি কোনো একটি গ্রিডে বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে, তবে তা সব গ্রিডে ছড়িয়ে পড়ে না। ফলে সেই নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে। এতে করে একসঙ্গে সব গ্রিড বিকল হওয়ার আশঙ্কা কমে।

গত ২০ বছরে এলইডি (LED) লাইট পুরনো বৈদ্যুতিক বাল্বগুলোকে সরিয়ে দিয়েছে। এলইডি লাইটগুলো সাধারণ বাল্বের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে কাজ করে। অনেক কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বেশি আলো দেয়। এর ফলে বিদ্যুতের মোট চাহিদা অনেক কমেছে। মার্কিন জ্বালানি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এলইডি বাল্ব ব্যবহার করে গড়ে বছরে প্রায় ২২৫ ডলার সাশ্রয় হয়। এটি শুধু ব্যক্তিগত খরচই কমায় না, বরং পাওয়ার গ্রিডের ওপর চাপ কমাতেও সাহায্য করে। ২০২০ সাল পর্যন্ত আমেরিকার প্রায় অর্ধেক বাড়িতেই প্রধানত এলইডি লাইট ব্যবহার করা হয়।

আরও পড়ুন
আলো নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। কারণ এটি গাড়ির জানালা বা কংক্রিটের মতো উজ্জ্বল পৃষ্ঠ থেকেও প্রতিফলিত হয়।

আলো জ্বালানোর বাইরেও, এসব আলো কোথায় যাবে তা নিয়ে চিন্তা করা গুরুত্বপূর্ণ। আলো জ্বালানোর একটি বড় প্রভাব হলো আলোক দূষণ অনেক বেড়ে যাবে। আলো যখন বাতাসে থাকা ধোঁয়াশা এবং ধূলিকণার ওপর প্রতিফলিত হয়, তখন রাতের আকাশে এক ধরনের অস্বস্তিকর আভা তৈরি হয়, যাকে আলোক দূষণ বলা হয়।

এই আলো নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। কারণ এটি গাড়ির জানালা বা কংক্রিটের মতো উজ্জ্বল পৃষ্ঠ থেকেও প্রতিফলিত হয়। আলোক দূষণের ফলে অনেক সমস্যা তৈরি হয়। এর কারণে শহর ও হাইওয়েগুলো মহাকাশ থেকে উজ্জ্বল দেখায় এবং পৃথিবী থেকে রাতের আকাশে আর কোনো তারা দেখা যায় না। এই দূষণ আমাদের দেহের স্বাভাবিক ঘড়িকে নষ্ট করে। এতে ঘুমচক্রের ব্যাঘাত ঘটায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়াও, এটি পোকামাকড়, পাখি এবং সামুদ্রিক কচ্ছপের মতো বন্যপ্রাণীদেরও বিভ্রান্ত করতে পারে।

সুতরাং, যদি বিশ্বব্যাপী মানুষ একবারে তাদের আলো জ্বালায়, তাহলে আমরা বিদ্যুতের খরচে সামান্য বৃদ্ধি দেখতে পাব। কিন্তু আকাশের আলো অনেক বেড়ে যাবে এবং রাতের আকাশে কোনো তারা থাকবে না। যেটা দেখতে কোনো সুন্দর দৃশ্য হবে না, বরং প্রকৃতির জন্য একটি খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করবে।

সূত্র: সায়েন্স এলার্ট

আরও পড়ুন