ব্রি’র বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী সাফল্য বিএলবি ও ব্লাস্টমুক্ত ধান

গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (গাকৃবি) বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত সুগন্ধিযুক্ত ও জিংকসমৃদ্ধ নতুন  জাতের ধান জিএইউ ধান-৩ছবি: বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে

ধান চাষে কৃষকেরা প্রধানত জৈবিক ও পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন হন। বায়োটিক সমস্যাগুলো হলো ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও ভাইরাসজনিত রোগ; যেমন ব্লাস্ট, টুংরো, ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্লাইট বা বিএলবি, বাদামি দাগ, খোলপোড়া, খোলপচা ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন পোকামাকড়ও বায়োটিক সমস্যার অন্তর্ভুক্ত। এসবের আক্রমণে বোরো মৌসুমে ধানের ফলন ১৫ শতাংশ, আউশে ২৪ শতাংশ এবং আমনে ১৮ শতাংশ কমে যায়।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা FAO-এর মতে, বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত ধান নষ্ট হয়। বাংলাদেশে রোগ ও পোকামাকড়ের কারণে তিন মৌসুম মিলিয়ে ধানের ফলন গড়ে প্রায় ১৮ শতাংশ হ্রাস পায়। তবে নির্দিষ্ট কিছু রোগের তীব্র আক্রমণে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বাড়তে পারে। দেশে ধানের শনাক্তকৃত ৩২টি রোগের মধ্যে ১০টিই প্রধান। রোগ হলে ধানের গুণগত মান ও ফলন উভয়ই কমে যায়।

অন্যদিকে অজৈবিক সমস্যাগুলো হলো বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, উচ্চ ও নিম্ন তাপমাত্রা। এগুলো ধানগাছের বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ক্রমাগত জলবায়ু পরিবর্তন এই সমস্যাগুলোকে আরও তীব্র করছে। ফলে টেকসই ফলন নিশ্চিত করতে সঠিক ব্যবস্থাপনা জরুরি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এখন পর্যন্ত লবণাক্ততা, খরা, জলমগ্নতা, ঠান্ডা ও জোয়ার-ভাটা সহনশীল ৩৭টি জাত উদ্ভাবন করেছে। দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ২০ ভাগ আসে এসব জাত থেকে। খাদ্য নিরাপত্তায় প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন জলবায়ু অভিঘাত সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে বেশ সফলতা পেলেও বালাই সহনশীল ও বালাই প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনে এতদিন দেশের বিজ্ঞানীরা কিছুটা পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রি বালাই প্রতিরোধী ও সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে দারুণ সাফল্য অর্জন করেছে।

আরও পড়ুন
বিএলবি প্রতিরোধী জাত ব্রি ধান১০১ একটি উচ্চফলনশীল জাত। এর ডিগ পাতা খাড়া, প্রশস্ত ও লম্বা। পাতার রং গাঢ় সবুজ। গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৭.৭২ টন।

সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভাবিত ‘ব্রি ধান১০১’ ও ‘ব্রি ধান১১৪’ তেমনি দুটি বালাই প্রতিরোধী জাত। ব্রি ধান১০১ বোরো মৌসুমের ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া রোগ প্রতিরোধী। পাতা পোড়া বা বিএলবি বোরো মৌসুমের একটি মারাত্মক রোগ। এ রোগ হয় Xanthomonas campestris pv. oryzae নামে ব্যাকটেরিয়ার কারণে। এতে আক্রান্ত হলে ধানের পাতায় হলদেটে দাগ তৈরি হয়। পরে সেটা বাদামি হয়ে শুকিয়ে যায়, অনেকটা পোড়া দাগের মতো। ফলে ফলন ব্যাপকভাবে কমে যায়। এ রোগ বোরো ধানের বীজ, সেচের পানি বা বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়।

বিএলবি প্রতিরোধী জাত ব্রি ধান১০১ একটি উচ্চফলনশীল জাত। এর ডিগ পাতা খাড়া, প্রশস্ত ও লম্বা। পাতার রং গাঢ় সবুজ। গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৭.৭২ টন। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে হেক্টরপ্রতি ৯ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। এ জাতের দানা লম্বা, চিকন ও সোনালি বর্ণের। গড় জীবনকাল ১৪২ দিন, যা বোরো মৌসুমের জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান৫৮-এর চেয়ে ৪ দিন আগাম। এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ২৩.১ গ্রাম। ধানের দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৫.০ শতাংশ এবং প্রোটিনের পরিমাণ ৯.৮ শতাংশ। ভাত ঝরঝরে ও খেতে বেশ সুস্বাদু।

জাতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এতে ব্যাকটেরিয়াজনিত পোড়া রোগ প্রতিরোধী প্রকট জিন Xa21, Xa4 ও Xa7 রয়েছে। কৃত্রিম ইনোকুলেশনে জাতটি উচ্চমাত্রার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা (স্কোর-১) প্রদর্শন করেছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা মাঠে পরপর তিন বছর ফলন পরীক্ষা করার পর বোরো ২০২০ মৌসুমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের মাঠে আঞ্চলিকভাবে এ জাতের উপযোগিতা যাচাই করা হয়। জীবনকাল ব্রি ধান৫৮-এর চেয়ে আগাম এবং ফলন বেশি হওয়ায় এটি প্রস্তাবিত জাত হিসেবে নির্বাচিত হয়। এরপর জাতীয় বীজ বোর্ডের মাঠ মূল্যায়ন দল বোরো ২০২১ মৌসুমে কৃষকের মাঠে প্রস্তাবিত জাতের ফলন পরীক্ষা সম্পন্ন করে। কৃষকের মাঠে ফলন পরীক্ষা সন্তোষজনক এবং মাঠপর্যায়ে ব্যাকটেরিয়াজনিত পোড়া রোগ প্রতিরোধী বলে প্রমাণিত হওয়ায় ২০২২ সালে জাতটি চূড়ান্তভাবে অবমুক্ত করা হয়। বিএলবিপ্রবণ এলাকার কৃষকদের মধ্যে ইতিমধ্যে জাতটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

আরও পড়ুন
বিগত কয়েক বছর মাঠপর্যায়ে গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ২০২৫ সালের মে মাসে ব্রি ধান১১৪-কে মাঠপর্যায়ে চাষাবাদের অনুমোদন দেয় জাতীয় বীজ বোর্ড। উদ্ভাবিত জাতটিতে আধুনিক উফশী ধানের সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

২.

ধানের ব্লাস্ট আরেকটি মারাত্মক ক্ষতিকর রোগ। বলা যায়, বোরো মৌসুমে এটিই প্রধান রোগ। এটি হয় Pyricularia grisea বা Pyricularia oryzae নামে ছত্রাকের কারণে। চারা অবস্থা থেকে শুরু করে ধান পাকার আগপর্যন্ত যেকোনো সময় এ রোগ দেখা দিতে পারে। ছত্রাকটি পাতা, গিঁট ও শীষে আক্রমণ করে। আক্রমণের স্থানের ভিত্তিতে একে পাতা ব্লাস্ট, গিঁট ব্লাস্ট ও শীষ ব্লাস্ট নামে কৃষকেরা চেনেন।

এই রোগ প্রতিরোধের জন্য ব্রি’র বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন ‘ব্রি ধান১১৪’। বাংলাদেশে ধানের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী এটাই প্রথম জাত। ব্লাস্ট রোগ ধানের পাতা, গিঁট এবং শীষের গোড়ায় আক্রমণ করে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। বিশেষত ফুল আসার সময় বা তার পরে শীষের গোড়ায় যে আক্রমণ হয়, তা থেকে ধান রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব। এ রোগ দমনে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো রোগ প্রতিরোধী ধানের জাত ব্যবহার করা। ব্লাস্ট রোগ হলে কৃষক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন; কোনো কোনো ক্ষেত্রে শতভাগ ফসল নষ্ট হয়। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে ব্রি বিগত কয়েক বছর গবেষণা করে চলতি বছর ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী এ জাত অবমুক্ত করেছে। গবেষণার মাধ্যমে এ জাতে ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জিনের (Pi9) অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে।

বিগত কয়েক বছর মাঠপর্যায়ে গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ২০২৫ সালের মে মাসে ব্রি ধান১১৪-কে মাঠপর্যায়ে চাষাবাদের অনুমোদন দেয় জাতীয় বীজ বোর্ড। উদ্ভাবিত জাতটিতে আধুনিক উফশী ধানের সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর গড় জীবনকাল ১৫৪ দিন, যা বোরো মৌসুমের আরেকটি জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান৮৯-এর মতো। আবার ব্রি ধান২৯ থেকে এটি ৪-৫ দিন আগাম। এ জাতের ডিগ পাতা লম্বা, খাড়া ও প্রশস্ত। গাছের কাণ্ড শক্ত এবং হেলে পড়ে না। পাতার রং গাঢ় সবুজ। চালের আকার-আকৃতি মাঝারি মোটা, রং সাদা, ভাত ঝরঝরে এবং খেতে সুস্বাদু। দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৭.০ শতাংশ এবং প্রোটিনের পরিমাণ ৭.৭ শতাংশ। ব্রি ধান১১৪-এর গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৮.২ টন। সময়মতো রোপণ করলে এবং উপযুক্ত পরিচর্যায় হেক্টরপ্রতি ১০.২৩ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। বিঘায় প্রায় ৩৩-৩৫ মণ ফলন হয়।

জাতটি উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ব্রি’র উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান তাহমিদ হোসেন আনছারী। সহযোগিতায় ছিলেন ব্রি’র উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের বিজ্ঞানীরা। এ গবেষণায় অর্থায়ন করেছে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন।

আরও পড়ুন
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘বালাইনাশকের ঝুঁকি নিরসন’ শীর্ষক এক সেমিনারের তথ্যানুসারে, দেশে বালাইনাশকের বর্তমান বাজার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার।

তাহমিদ হোসেন আনছারী জানান, ‘মার্কার অ্যাসিস্টেড সিলেকশন পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্রি ধান২৯ জাতের সঙ্গে জিরকাসের সরবরাহকৃত ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী একটি লাইনের সংকরায়ণের মাধ্যমে নতুন জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী হওয়ায় উৎপাদন পর্যায়ে এ রোগের জন্য কোনো ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা লাগে না। মাঠপর্যায়ে এ জাত চাষাবাদ করে কৃষক ব্রি ধান৮৯ এবং ব্রি ধান২৯-এর চেয়ে কিছুটা বেশি ফলন পাবেন।’

মাঠে কৃষক যখন ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত শীষ শনাক্ত করেন, ততক্ষণে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়। তখন বা এর পরে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে আর লাভ হয় না। নতুন উদ্ভাবিত জাতের চাষাবাদে কৃষক ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধে নিশ্চিন্ত থাকবেন এবং ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা লাগবে না। এতে নিশ্চিত ফসল সুরক্ষাসহ কৃষকের আর্থিক সাশ্রয় হবে। প্রতিবছর বোরো মৌসুমে ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে মাঠপর্যায়ে ব্যবহৃত হাজার কোটি টাকার ছত্রাকনাশকের প্রয়োজন পড়বে না। এতে পরিবেশগত বিপর্যয় থেকেও দেশ রক্ষা পাবে।

সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘বালাইনাশকের ঝুঁকি নিরসন’ শীর্ষক এক সেমিনারের তথ্যানুসারে, দেশে বালাইনাশকের বর্তমান বাজার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার। শুধু গত ৫ বছরেই ব্যবহার বেড়েছে ৮১.৫ শতাংশ। ১৯৭২ সালে বালাইনাশক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার মেট্রিক টন; সেখানে ২০২২-২৩ সালে তা বেড়ে ৪০ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। ধান যেহেতু আমাদের প্রধান ফসল, তাই এর উৎপাদনেই বেশিরভাগ বালাইনাশক ব্যবহৃত হয়। ফলে এই ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। ভাতনির্ভর বাঙালি জনগোষ্ঠীর জনস্বাস্থ্যের জন্য এটি মারাত্মক হুমকি। এক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত বিএলবি ও ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত ‘ব্রি ধান১০১’ এবং ‘ব্রি ধান১১৪’ একটি বিরাট মাইলফলক। সরকারের উচিত বালাই প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়ন কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা এবং এ খাতে গবেষণার বরাদ্দ যথাসম্ভব বৃদ্ধি করা।

 

লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), গাজীপুর

আরও পড়ুন