ফাইনম্যান টেকনিক: যেকোনো কিছু সহজে শেখার উপায়
রিচার্ড ফাইনম্যান নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী। তবে বিজ্ঞানীর বাইরে তাঁর অন্য একটি পরিচয় আছে। তিনি যেকোনো কঠিন বিষয় খুব সহজে বোঝাতে পারতেন। কথিত আছে, একবার একজন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনি এত কঠিন জিনিস সহজ ভাষায় বোঝান কীভাবে?’ উত্তরে ফাইনম্যান বলেছিলেন, ‘তুমি যদি কোনো বিষয় সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারো, তার মানে তুমি নিজেই সেটা ভালোভাবে বোঝনি।’ তবে আসলেই ফাইনম্যান এমন কোনো কথা বলেছিলেন কিনা, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ, সেরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তবে ফাইনম্যানের কথিত এই উক্তি থেকেই জন্ম নিয়েছে ফাইনম্যান টেকনিক। এটা কোনো জাদুকরী কৌশল নয়। খুব সাধারণ, কিন্তু দারুণ কার্যকরী উপায়।
কেন এই পদ্ধতি জরুরি
ধরুন, সামনে আপনার পরীক্ষা। বই পড়ে মুখস্থ করে ফেললেন। পরীক্ষায়ও পেলেন ভালো নম্বর। কিন্তু কিছুদিন পরে যখন কেউ একই বিষয়ে প্রশ্ন করল, তখন আর উত্তর দিতে পারলেন না। অথবা উত্তর দিলেন আধো আধো, মানে ঠিক সন্তুষ্ট হওয়া যায় না সেই উত্তরে। কেন এমন হলো? কারণ, আপনি বিষয়টি শেখনি, শুধু পরীক্ষার জন্য মুখস্ত করেছেন। সেই মুখস্ত বিদ্যা দিয়ে পরীক্ষায় উৎরে গেছেন ঠিকই, কিন্তু পরে আর তা মনে রাখতে পারেননি। তাই কোনো কিছু এমনভাবে শিখতে হবে, যাতে সেটা পরে নিজের ভাষায় অন্যকে বোঝাতে পারেন। এখানেই কাজে লাগে ফাইনম্যান টেকনিক। চলুন, সেই টেকনিক সম্পর্কে জানা যাক।
ফাইনম্যানের টেকনিকের মোট চারটি ধাপ। সেগুলো একে একে বলছি।
ধাপ ১: বিষয়টা পড়ে বোঝার চেষ্টা করুন
প্রথমেই আপনাকে ঠিক করতে হবে, আপনি কী শিখতে চান। হতে পারে সেটা ইংরেজির কোনো গ্রামার, নিউটনের সূত্র বা অফিসের কোনো নতুন সফটওয়্যার। যা-ই হোক না কেন, সেটা নিয়ে পড়তে শুরু করুন। বই, আর্টিকেল বা ভিডিও থেকে ধারণা নিন।
এরপর সবচেয়ে জরুরি কাজটি হলো, যা কিছু বুঝলেন তা নিজের ভাষায় একটি সাদা কাগজে বা নোটবুকে লিখুন। বইয়ের ভাষায় নয়, একেবারে নিজের মতো করে। মনে করুন, আপনি অন্য কাউকে বোঝানোর জন্য একটা নোট তৈরি করছেন। বিষয়টাকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিলে আরও সুবিধা হবে।
ধাপ ২: অন্যকে শেখান
এবার আপনার কাজ হলো, যা শিখলেন তা কাউকে শেখানো। আপনার বন্ধু, ছোট ভাইবোন বা এমন কাউকে খুঁজে বের করুন, যিনি বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। যদি কাউকে নাও পান, ক্ষতি নেই। একটা খালি চেয়ারকে ছাত্র বানিয়ে বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই বোঝাতে শুরু করুন।
এই শেখাতে গিয়েই আসল মজা টের পাবেন। হয়তো হঠাৎ খেয়াল করবেন, কোনো একটি জায়গায় ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারছেন না। অথবা কোনো ধারণা ঠিক মিলছে না। যেখানেই আপনি আটকে যাবেন বা বলতে গিয়ে তোতলাবেন, বুঝে নেবেন সেখানে আপনার আরও শিখতে হবে।
ধাপ ৩: ফাঁকফোকর পূরণ করুন
দ্বিতীয় ধাপে আপনি নিজের দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছেন। এবার আবার বই বা আপনার পড়ার উপকরণ নিয়ে বসুন। ঠিক যে যে জায়গায় আপনি আটকে গিয়েছিলেন, সেই অংশগুলো আবার মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। যতক্ষণ না পর্যন্ত বিষয়টা পানির মতো পরিষ্কার হচ্ছে, ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যান।
ধরা যাক, আপনি কাউকে Present Perfect Tense বোঝাতে গিয়ে এর ব্যবহারের নিয়ম নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন। এবার শুধু ওই নিয়মটাই আবার ভালো করে পড়ুন। সঙ্গে কয়েকটি সহজ উদাহরণ দেখুন। দেখবেন, আগেরবারের চেয়ে অনেক সহজে বিষয়টা মাথায় ঢুকে যাচ্ছে।
ধাপ ৪: সহজভাবে বলুন
এখন আপনি বিষয়টির খুঁটিনাটি সবই জানেন। আপনার সব দুর্বলতা দূর হয়ে গেছে। এবার পুরো বিষয়টা আবার কাউকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। তবে শর্ত হলো, ভাষা হতে হবে আরও সহজ।
ভাবুন, একটা দশ বছরের শিশুকে আপনি বিষয়টা কীভাবে বোঝাবেন? কোনো কঠিন শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, জটিল কোনো উপমা দেওয়া চলবে না। একেবারে সাধারণ জীবনের উদাহরণ দিয়ে, গল্পের ছলে পুরো বিষয়টা বলতে হবে।
আপনি একটি কঠিন বিষয়কে যখন সহজ করে বলতে পারবেন, তখনই বুঝবেন আপনার বিষয়টি শুধু মুখস্থ হয়নি, তা গভীরভাবে আত্মস্থ করেছেন।
কেন এই কৌশল কার্যকরী
এই পদ্ধতি আমাদের শুধু তথ্য মনে রাখতে সাহায্য করে না, বরং তথ্যের পেছনের মূল ধারণাটিকে বুঝতে সাহায্য করে। যখন আমরা কোনো কিছু অন্যকে শেখানোর জন্য প্রস্তুতি নিই, তখন আমাদের মস্তিষ্ক সেই তথ্যগুলোকে আরও ভালোভাবে সাজিয়ে নেয়। ফলে সুন্দরভাবে শেখা হয়। পুরো বিষয়টা আমাদের মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে থেকে যায়।