পৃথিবীর গভীরতর অসুখ এখন

আদিম যুগের শিকারি জীবনের একাকিত্ব ঘোচাতে মানুষের তরে মানুষের এগিয়ে আসার কোনো বিকল্প ছিল না। সে জন্য দরকার ছিল পারস্পরিক বোঝাপড়া, অনুভবের গভীরতা, জীবন নিয়ে আরও বড় পরিসরে ভাবা। তা করতে গিয়ে মানবজাতির প্রয়োজন ছিল খাদ্যের নিশ্চয়তা। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে গুহাচিত্রগুলো যে পথ নির্দেশনা দিয়েছিল—অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ, ভবিষ্যতের রূপরেখা, বিমূর্তায়নে চিন্তার জাল বিস্তার করা—সম্ভবত এর একটা পথ খাদ্যের সেই নিশ্চয়তা এনে দিয়েছিল। তৈরি হয়েছিল মহাজাগতিক অভিযানের পথ, উদ্বুদ্ধ করেছিল বহির্জাগতিক বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান। কিন্তু সেই আশা যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। প্রাযুক্তিক আত্মধ্বংসের কড়া নাড়ার শব্দ যেন আমাদের বলছে, কৃষি উদ্ভাবনে ঘর আর পথের ভাবনায় যে দূরযাত্রার প্রস্তুতি ছিল, সেখানে মারাত্মক কোনো বিচ্যুতি ঘটেছে। ইতিহাসের শুরু থেকে ছুটে চলা মানুষ এখন যেন থমকে গেছে। এমনকি ইন্দোনেশিয়ার বেনগাও নদীর তীরে গাছ থেকে নেমে আসার সময়ও তাদের পূর্বসূরিরা ছুটে চলেছে। তাহলে যাযাবর জীবন থেকে কেন মানুষ সরে আসতে চাইছে?

ইউভ্যাল নোয়াহ হারারি তাঁর সেপিয়েন্স বইয়ে একটা কথা লিখেছেন। প্রথমে তা মজাই লেগেছে, কিন্তু পরে মারাত্মক হয়ে কানে বেজেছে। মানুষ কি ধান, গম গার্হস্থ্যকরণ করেছে, নাকি ধান, গম মানুষকে বেঁধে ফেলেছে? কৃষি উদ্ভাবনে যে নিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা সৃজনশীলতার পথে বাধা, নাকি শুধু নিজ অস্তিত্বের চিরকালীন অবস্থানের রেশ স্থবির করে দেয়? প্রথমটি ঠিক মানা যায় না, আবার উড়িয়ে দেওয়া যায় না দ্বিতীয়টাকে। তাহলে নির্ভাবনার আশ্রয়ের লোভ কানা গলিতে নিয়ে ফেলছে না তো?

সমাজবিজ্ঞানী ও জীববিজ্ঞানীরাও তা স্বীকার করেন। আমাদের সেই প্রজাতির ভাইবোনেরা এখন আর নেই, যাদের সঙ্গে মিশে নিজেদের অভিজ্ঞতার পরিসর বাড়াব। এমনকি আমাদের রেখে আসা প্রস্তরযুগের স্মৃতি যাচাইয়ের শেষ ভরসা বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘হাই টেক’, অর্থাৎ উন্নত প্রযুক্তি।

আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, নানা ধরনের ত্রুটির মধ্য দিয়ে নদীর বাঁকে বাঁকে ব্লু মুন বা লিওনিডস উল্কাবৃষ্টির আয়োজনগুলো বলে, মহাজাগতিক সাগরের বেলাভূমি এই জনপদ নয়। পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চল এই বেলাভূমি থেকে মহাশূন্যের সাগরে কেবল পদচারণা শুরু করেছে। যদিও খুব স্পষ্ট নয়, তবে জাগতিক বা মহাজাগতিক কর্মকাণ্ড বলছে, আমরা একটা ভ্রমণের মধ্যে আছি। আমাদের তা জানতে হলে অন্তত প্রজাতি হিসেব নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন। পরিহাস হচ্ছে, নিজেদের এই টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে আমরা যাত্রাপথে সহোদর প্রজাতিগুলোকে ধ্বংস করেছি। মানবজাতি থেকে পরিণত হয়েছি প্রজাতিতে!

আমাদের এই টিকে থাকাকে কি আরেকটু শান্তিপূর্ণ বা সহনশীল করা যেত? নিয়ে যাওয়া যেত কি নমনীয়তার মধ্য দিয়ে? যদিও দ্বিজেন শর্মা বলতেন, ‘অস্বাভাবিক পুঁজির কেন্দ্রীকরণ ছাড়া মহাজাগতিক অভিযানগুলো সম্ভব ছিল না।’

আরও পড়ুন

ওদিকে নিউরোলজিস্ট পল ডি ম্যাকলিনের প্রভোকেটিভ ইনসাইট তত্ত্ব অনুসারে, মস্তিষ্ক বিকাশের অসংগতি পুঁজিকেন্দ্রীক এই ব্যবস্থাকে সমাজের প্রবৃত্তিগত রূপ দিয়েছে। এটি আমাদের অধঃপতিত সমাজের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের যাত্রাপথে শুধু টিকে থাকার জন্য নয়, কাছের প্রজাতিগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষভাবে বোঝাপড়ার অভাবে, শ্রেষ্ঠত্বের লোভে একে অপরকে ধ্বংস করেছি, করছি। এখন আমরা নিজেদের মধ্যে শিক্ষা থেকে শুরু করে সব কাঠামোয় এটার বিস্তার ঘটিয়েছি। সমাজবিজ্ঞানী ও জীববিজ্ঞানীরাও তা স্বীকার করেন। আমাদের সেই প্রজাতির ভাইবোনেরা এখন আর নেই, যাদের সঙ্গে মিশে নিজেদের অভিজ্ঞতার পরিসর বাড়াব। এমনকি আমাদের রেখে আসা প্রস্তরযুগের স্মৃতি যাচাইয়ের শেষ ভরসা বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘হাই টেক’, অর্থাৎ উন্নত প্রযুক্তি। এখনো কৈশোরকালীন বা বায়োলজিক্যাল বয়সন্ধিকালকে সামর্থ্য নিয়ে মোকাবেলা করতে পারছি না। ফলে নতুন এই বিপদ পরস্পরকে মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে তুলছে।

এআই
ছবি: রয়টার্স

সোলার ইকানোমি বইয়ের লেখক হারম্যান শিয়ারের মতো অনেকে মনে করেন, জীবাশ্ম শক্তি থেকে সৌরশক্তিতে পদার্পণের ওপর এই বিষয়টা অনেকটা নির্ভর করে। এমনকি এই শতাব্দীর শুরুতে অনেক খ্যাতনামা পত্রিকাই দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে পৃথিবী রয়েছে বলে লিখত। অথচ সেসব ভুলে হঠাৎ চতুর্থ বিপ্লব বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জয়গান শুরু হলো, যাকে নিয়ে মারাত্মক আশঙ্কার কথা স্টিফেন হকিং নিজেই বলেছিলেন। অথচ সৌরশক্তির ব্যবহারে ব্যাপক পুঁজির দরকার নেই। বরং দরকার অগুনতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগ এবং ছোট ছোট মাপের স্থাপনা। এভাবে প্রত্যেক মানুষের অংশগ্রহণে সৌরশক্তির ব্যাপক ব্যবহার সম্ভব। তাই রাজধানীকেন্দ্রিক মনোযোগ এখানে অচল এবং প্রাযুক্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলো করতে বড় ট্রানজিশনাল বিজনেস গ্রুপ বা মেগা সিটির প্রয়োজন পড়বে না, বরং ছোট ও মধ্যম আকারের ফার্ম এবং পল্লি অঞ্চলেই তা সম্পন্ন করা সম্ভব। স্বভাবগত বিকেন্দ্রিক চরিত্রের ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হলে বিকেন্দ্রিকতা ত্বরান্বিত হবে।

আরও সর্বনাশা দিক হলো, বিজ্ঞানের তথ্যগুলোকে প্রত্যেকে তার গোপন সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করছে। যেখানে সহনশীলতা, নমনীয়তাই টিকে থাকার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, তা অর্জিত হতে পারে গণতান্ত্রিক চর্চায়।

সবচেয়ে বড় কথা, কম বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে শক্তির এই প্রাপ্যতাকে সভ্যতার উন্নয়ন বলে বিবেচনা করাই ছিল ভীষণ যৌক্তিক। কিছু হিসেব বলছে, অন্তত ৩০ বছর আগেই নিশ্চিতভাবে এটা সম্ভব ছিল। আর্থার সি ক্লার্কের মতো মানুষেরাও তাই ভেবেছেন। কিন্তু ক্ষমতার লোভ আর পুঁজিকেন্দ্রকতা যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, বারবারই তাঁদের নিজস্ব কৌশল বিষয়টা পিছিয়ে দিচ্ছে। বাণিজ্যিক প্রবণতার ধারকেরা হয়ে উঠছেন সমাজের নায়ক।

আমাদের জীবনযাপন ব্যবস্থায় এমন সব ভোগ্যপণ্যের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করছি, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সেগুলো এমন প্রভাব বিস্তার করছে এবং গণমাধ্যমগুলো দিয়ে আমাদের উদ্দেশে উপদেশ বিতরণ করে চলেছে—কীভাবে নদী-নালা, জীবজগৎ, এমনকি স্বাস্থ্য ধ্বংস করে সুখের স্বর্গ গড়ে তুলতে পারি। বাস্তুসংস্থান নীতিগুলো ঠিক না করে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মাধ্যমে করোনাকে পরাজিত করার স্লোগান দিয়ে কতটা লাভ হবে? দুই বছরেও করোনা আমাদের শেখাতে পারেনি, ভাইরাস আমাদের আক্রমণ করেনি, বরং তাদের জায়গা আমরা দখল করেছি। আমাদের অনিয়ন্ত্রিত, ভারসাম্যহীন জীবনযাপনের সুযোগ নিয়ে ওরা আমাদের ভেতর প্রবেশ করেছে।

আরও পড়ুন

সঠিকভাবে স্কুলিং হচ্ছে না, সামাজিক পটভূমি তৈরি হচ্ছে না। ফলে হায়ারার্কি বা ক্ষমতার সংস্কৃতির বিপক্ষে দাঁড়াতে শিখছে না আমাদের শিক্ষার্থীরা। সত্যি বলতে, কোনোকিছুই এর বিপক্ষে দাঁড়াতে পারছে না। অথচ পৃথিবীতে এক সময় প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা ছিল না। এটা ডকুমেন্টেশন এবং নানা ধরনের সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য ছিল সুবিধাজনক। কিন্তু নতুন নতুন চিন্তা ও ধারণার উদ্ভব ঘটাতে প্রাতিষ্ঠানিকতার পাশাপাশি অপ্রাতিষ্ঠানিক চর্চাকে বন্ধ করাটা মোটেও ঠিক নয়। কেননা এটা বন্ধ হলে এক সময় নতুন চিন্তার উদ্ভব ও উত্তরণের পথ হারিয়ে ফেলব আমরা, বারবার ধাক্কা খাব একই গোলক ধাঁধায়। তাই প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নিজস্ব ধারার চর্চার পাশাপাশি অপ্রাতিষ্ঠানিক চর্চার সংযোগ সেতু তৈরি করা। এটা নমনীয়তা, সহনশীলতার পাশাপাশি বোঝাপড়ার বিস্তার ঘটায়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকতার দৃঢ় কাঠামোর বেড়াজালে, অপ্রাতিষ্ঠানিক তথা গণমানুষের চর্চাকে অবহেলার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় কথা, কম বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে শক্তির এই প্রাপ্যতাকে সভ্যতার উন্নয়ন বলে বিবেচনা করাই ছিল ভীষণ যৌক্তিক। কিছু হিসেব বলছে, অন্তত ৩০ বছর আগেই নিশ্চিতভাবে এটা সম্ভব ছিল। আর্থার সি ক্লার্কের মতো মানুষেরাও তাই ভেবেছেন।

আরও সর্বনাশা দিক হলো, বিজ্ঞানের তথ্যগুলোকে প্রত্যেকে তার গোপন সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করছে। যেখানে সহনশীলতা, নমনীয়তাই টিকে থাকার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, তা অর্জিত হতে পারে গণতান্ত্রিক চর্চায়। এই চর্চাই বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কেননা বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ মেনে চলে। বিজ্ঞান অর্থ যুক্তিবোধ, বিজ্ঞান মানে প্রত্যেক জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে তথ্যের বিনিময়। তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো—অর্থাৎ গণতান্ত্রিকতা, স্বচ্ছতা এবং সামগ্রিকভাবে প্রাকৃতিক সত্যকে উদ্‌ঘাটন করা।

দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, বর্তমানে বিশ্বের ব্যবসায়ীরাই হচ্ছেন আইন প্রণেতা। তাই জীবনানন্দ দাশের মতো কবিরাও বলেছেন, পৃথিবীর গভীরতর অসুখ এখন।

লেখক: বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত

আরও পড়ুন