কেরানির যে প্রশ্নে ফেঁসে গেলেন সম্রাট সিজার

রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার বেশ বিচলিতছবি: এআই আর্ট

রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার বেশ বিচলিত। কারণ তাঁকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাঁকে উচ্ছেদের কথা ভাবছে কোনো কোনো সিনেটর। ক্যাসিয়াসও জড়িয়ে আছেন এই ষড়যন্ত্রে। শোনা যাচ্ছে, তাঁর প্রিয়পাত্র ব্রুটাসও এতে জড়িত। এ কথা সিজারের বিশ্বাস হয় না। তিনি ব্রুটাসকে ভালো করেই চেনেন। তাঁর বিশ্বস্ততা আর বন্ধুত্ব নিয়ে সন্দেহ করা বোকামি। আসলে ব্রুটাস যে তাঁর প্রিয়পাত্র, এটা অনেকেই সহ্য করতে পারে না। ব্রুটাসকে হিংসে করে, তাঁর কাছে এসে ব্রুটাসের নামে কান-ভাঙানি দেয়। তিনি বরং সেসব লোকদের সন্দেহের চোখে দেখেন, যারা ব্রুটাসকে দোষারোপ করতে চায়। আপতত সিজার একটা বিশেষ কাজে মনোযোগ দিয়েছেন। তাঁর নামে নাকি বই লেখা হচ্ছে। বই বলতে তখন কাপড় বা চামড়ার স্ক্রল ছিল। পাথরেও কেউ কেউ লেখেন। দরবারে আস্ত একটা লাইব্রেরি আছে। সেখানে আছে প্রচুর বই। এর কিছু কিছু অবশ্য তাঁর কিংবা তাঁর পরিবারকে নিয়ে ভক্তিমূলক বই।

এর বাইরেও তাঁকে নিয়ে লেখা অনেক বই আছে। সেগুলো লাইব্রেরিতে নেই। বেশিরভাগই তাঁর স্তুতিমূলক বা প্রশংসাসূচক বই। এগুলো নিয়ে সিজারের খুব বেশি আগ্রহ নেই। তিনি জানেন, কিছু ধান্দাবাজ লোক প্রশংসা করে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। এদের মূল উদ্দেশ্য সম্রাটের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়া।

তাঁর আগ্রহ হলো, যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে লিখছেন, তাঁদের মনোভাব জানা। সেজন্য তিনি গুপ্তচরদের নির্দেশ দিলেন, তাঁর সাম্রাজ্যে যত বই আছে, সবগুলোর একটি করে কপি সংগ্রহ করতে। বেশ কাজে দিল ফন্দিটা। কয়েক মাসের মধ্যে কয়েক লাখ বই জমা পড়ল। লাইব্রেরির আয়তন বাড়াতে হলো কয়েকগুণ।

আরও পড়ুন
জুলিয়াস সিজারের আগ্রহ হলো, যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে লিখছেন, তাঁদের মনোভাব জানা। সেজন্য তিনি গুপ্তচরদের নির্দেশ দিলেন, তাঁর সাম্রাজ্যে যত বই আছে, সবগুলোর একটি করে কপি সংগ্রহ করতে।

দুই

সিজার নির্দেশ দিলেন পুরো লাইব্রেরিটা দুই কামরায় ভাগ করতে। এরপর তিনি লাইব্রেরির কেরানিদের ডাকলেন। তিনি বললেন, লাইব্রেরিতে যত বই আছে, তার মধ্যে যেগুলো তাঁকে নিয়ে লেখা নয়, সেগুলোর একটি তালিকা করতে। আর যেগুলো তাঁকে নিয়ে লেখা, সেগুলোরও একটি আলাদা তালিকা করতে। কেরানিরা কয়েক সপ্তাহ খেটে দুটো তালিকা বানিয়ে ফেলল। মুশকিল হলো, তালিকা অনেক লম্বা। শুকনো চামড়ায় লিখে সেগুলো বাঁধাই করে দুটো বই বানানো হলো। একটি বইয়ে সিজারকে নিয়ে লেখা সব বইয়ের নাম আছে। অন্যটিতে আছে সিজারকে নিয়ে লেখা নয় এমন বইয়ের তালিকা।

তালিকা শেষ হলে সিজার বললেন, বইগুলো দুই ভাগ করে দুটি কামরায় রাখতে। প্রথম কামরায় শুধু সিজারকে নিয়ে লেখা বই থাকবে। দ্বিতীয় কামরায় থাকবে, যেগুলো তাঁকে নিয়ে লেখা নয়। কেরানি আর শ্রমিকরা মিলে দুদিন ধরে বইগুলো সম্রাটের নির্দেশমতো দুটি ঘরে রাখলেন। কিন্তু গোল বাঁধল ওই দুটি বইয়ের তালিকা নিয়ে।

প্রধান কেরানি বই দুটো ভয়ে নিয়ে ঢুকলেন সম্রাটের দরবারে। কিছু বলতে সাহস পাচ্ছেন না তিনি। কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সিজারের দৃষ্টি আকর্ষণ করল ব্যাপারটা। তিনি বললেন, ‘বলো কেরানি, বইগুলো সব ঠিকঠাক দুই কামরায় সাজিয়েছ?’

জবাবে কেরানি বললেন, ‘জি মহামান্য।

সিজার বললেন, ‘তাহলে আবার কীসের আর্জি? তোমার হাতে ও দুটি কী?’

কেরানি বললেন, ‘মহামান্য সম্রাট, এই দুটি হলো সেই তালিকার বই। একটিতে আপনাকে নিয়ে লেখা সব বইয়ের তালিকা আছে। অন্যটিতে আপনাকে নিয়ে লেখা নয়, এমন বইয়ের তালিকা রয়েছে।

আরও পড়ুন
সিজার বললেন, বইগুলো দুই ভাগ করে দুটি কামরায় রাখতে। প্রথম কামরায় শুধু সিজারকে নিয়ে লেখা বই থাকবে। দ্বিতীয় কামরায় থাকবে, যেগুলো তাঁকে নিয়ে লেখা নয়।

এগুলো নিয়ে কী করতে চাও?’, জিজ্ঞেস করলে সিজার।

কেরানি বললেন, ‘এগুলোর কোনটা কোথায় রাখব, তা যদি জানাতেন মহামান্য...’

সিজার বললেন, ‘এ তো সোজা হিসাব। যে বইটায় আমাকে নিয়ে লেখা বইয়ের তালিকা রয়েছে, সেটা প্রথম কক্ষে রাখো। আর যেটাতে আমাকে নিয়ে লেখা নয়, সেটা দ্বিতীয় কক্ষে রাখো।

কিন্তু সম্রাটের নির্দেশের পরও কেরানি দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর মুখে রাজ্যের দুশ্চিন্তা। সিজার তখন বললেন, ‘কী হলো কেরানি, কোনো সমস্যা?’

কেরানি বললেন, ‘মহামান্য, যদি অভয় দেন তো বলি।

নির্ভয়ে বলো।

কেরানি বললেন, ‘প্রথম বইটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। ওটা প্রথম কক্ষেই রাখা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো দ্বিতীয় বইটা নিয়ে। ওটা কি দ্বিতীয় ঘরে রাখা যায়?’

কেন যাবে না?’

মহামান্য, দ্বিতীয় বইটা কিন্তু আপনাকে নিয়েই লেখা।

সিজার তখনো জট পাঁকানো ব্যাপারটা বোঝেননি। তিনি বললেন, ‘ব্যাপারটা একটু খুলে বলো তো।

মহামান্য, দ্বিতীয় ঘরে আমরা সেই সব বই রাখছি, যেগুলো আপনাকে নিয়ে লেখা নয়।

আরও পড়ুন
কেরানি বললেন, ‘প্রথম বইটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। ওটা প্রথম কক্ষেই রাখা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো দ্বিতীয় বইটা নিয়ে। ওটা কি দ্বিতীয় ঘরে রাখা যায়?’

সিজার বললেন, ‘দ্বিতীয় বইটা তো সেসব বইয়েরই তালিকাই, তাই না?’

হ্যাঁ, তা বটে। কিন্তু এই বইটার নাম কী দিয়েছি দেখুন: ‘যেসব বই সিজারকে নিয়ে লেখা নয়

হ্যাঁ, ঠিকই তো আছে।

তাহলে কি এটা মহামান্য সম্রাটকে নিয়ে লেখা বই হয়ে যায় না? যেহেতু এটার নামেও মহামান্য সম্রাটের নাম উল্লেখ আছে।

সম্রাট এবার গোলমালটা বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমিই ঠিক। এই বইটা পরোক্ষভাবে হলেও আমাকে নিয়েই লেখা। তাই এটাকে দ্বিতীয় কক্ষে রাখা যায় না। আবার প্রথম কক্ষেও রাখা যায় না, কারণ এই বইয়ের ভেতরে সেইসব বইয়ের তালিকা রয়েছে, যেগুলো আমাকে নিয়ে লেখা নয়। তাহলে উপায়?

সিজার ভাবনায় ডুবে গেলেন, কিন্তু সমস্যার সমাধান আর হলো না।

 

টীকা: গল্পটা ঐতিহাসিক মনে হলেও পুরোটাই কাল্পনিক। এটি সিজার প্যারাডক্সবোঝানোর জন্য লেখা হয়েছে। ধাঁধাটি বিখ্যাত রাসেলস প্যারাডক্সবা নাপিতের ধাঁধার মতোই একটি যৌক্তিক ও স্ব-বিরোধী সমস্যা।

আরও পড়ুন