‘গণিতের নোবেল’ আবেল পুরস্কার পেলেন জাপানি গণিতবিদ

২০২৫ সালে গণিতের নোবেল খ্যাত আবেল পুরস্কার পেয়েছেন জাপানি গণিতবিদ মাসাকি কাশিওয়ারার। বীজগাণিতিক বিশ্লেষণ নামে গণিতের একটি নতুন শাখা প্রতিষ্ঠা এবং সেই শাখায় ৫০ বছরের বেশি সময় অবদানের জন্য তাঁকে ২০২৫ সালের আবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। কী এই শাখা, কে এই গণিতবিদ? তাঁর আবিষ্কারের গুরুত্ব কী?

২০২৫ সালে আবেলজয়ী মাসাকি কাশিওয়ারারছবি: দ্য আবেল প্রাইজ

এ বছর গণিতের নোবেল খ্যাত আবেল পুরস্কার পেয়েছেন জাপানি গণিতবিদ মাসাকি কাশিওয়ারার। গত ২৬ মার্চ নরওয়েজিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স অ্যান্ড লেটারস এই সম্মানজনক পুরস্কারের জন্য মাসাকির নাম ঘোষণা করেছে। অ্যালজেব্রিক অ্যানালাইসিস বা বীজগাণিতিক বিশ্লেষণ নামে গণিতের একটি নতুন শাখা প্রতিষ্ঠা এবং সেই শাখায় ৫০ বছরের বেশি সময় অবদানের জন্য তাঁকে ২০২৫ সালের আবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

নরওয়েজিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স অ্যান্ড লেটারসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “কাশিওয়ারা এমন একটা নতুন ‘গণিতের বাক্স’ তৈরি করেছেন, যা দিয়ে প্রকৃতির অনেক রহস্য ব্যাখ্যা করা যায়! তিনি এমন সব অসাধারণ উপপাদ্য প্রমাণ করেছেন, যা কেউ আগে ভাবতেও পারেনি। তিনি সত্যিকারের একজন দূরদর্শী গণিতবিদ।”

কাশিওয়ারার গাণিতিক বিষয়টা একটু সহজে বোঝা যাক। সিলেটের জাফলংয়ে সাদা পাথর বলে একটা জায়গা আছে। সেখানকার পাথরগুলো এমনভাবে বসানো আছে যে ওগুলোর ওপর দিয়ে দিব্যি হেঁটে যাওয়া যায়। ওই পাথরের পাশ দিয়ে যখন পানি বয়ে যায়, তখন ছোট ছোট ঘূর্ণি তৈরি হয়। মানে পানি ও পাথরগুলোকে ঘিরে পাক খায়। পানির এই প্রবাহকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে সহজে ব্যাখ্যা করা যায় না। এর জন্য অনেক কঠিন সমীকরণ সমাধান করতে হয়। সমীকরণগুলো শতশত বছর ধরে থাকলেও কেউ সেগুলোর সমাধান করতে পারেননি। সেগুলো এতদিন রহস্যই রয়ে গিয়েছিল। এই সমস্যার সমাধান করেছেন কাশিওয়ারা। ১৯৭০-এর দশকেই তিনি এমন কিছু নতুন সরঞ্জাম তৈরি করেছিলেন, যা দিয়ে ওই কঠিন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

সিলেটের সাদা পাথর

কাশিওয়ারার এই নতুন সরঞ্জাম হলো বীজগাণিতিক বিশ্লেষণ। ১৯৭০-এর দশকে তিনি গণিতের দুটি শাখা, বীজগণিত ও বিশ্লেষণ মিলিয়ে বীজগাণিতিক বিশ্লেষণ নামে একটি নতুন শাখা তৈরি করেন। বিশ্লেষণ হলো ক্যালকুলাসের মূল ভিত্তি। গণিতের এই শাখায় ফাংশন, সীমা এবং অন্যান্য গাণিতিক ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হয়। 

আরও পড়ুন

কাশিওয়ারা বিংশ শতাব্দীর শুরুতে গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্টের একটা কঠিন সমস্যাও সমাধান করেছিলেন। সেই সুফল এখন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ব্যাপারে একটু পরে আসছি। এখন বরং কাশিওয়ারার গণিতবিদ হওয়ার গল্পটা জেনে নিই।

কাশিওয়ারার জন্ম ১৯৪৭ সালে, জাপানের টোকিওতে। শৈশবেই গণিতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল। জাপানের ঐতিহ্যবাহী ধাঁধা সুরুকামেজান (tsurukamezan) সমাধান করতে তিনি খুব পছন্দ করতেন। এই ধাঁধায় কিছু সারস আর কচ্ছপের মাথা ও পা দিয়ে হিসেব করে বের করতে হয়, কয়টি সারস আছে আর কয়টি কচ্ছপ। একটা উদাহরণ দেই। একটা মুরগির দুটো পা আর একটা কচ্ছপের চারটা পা। যদি মোট ১৬টা পা আর ৫টা মাথা দেখা যায়, তাহলে সেখানে কয়টি মুরগি আর কয়টি কচ্ছপ আছে? এ ধরণের ধাঁধাকেই বলা হয় সরুকামেজান। কাশিওয়ারার বাবা-মা গণিতের এই জটিল বিষয়গুলো তেমন বুঝতেন না। কিন্তু ছোট্ট মাসাকি বীজগণিতের নিয়ম ব্যবহার করে এই ধাঁধা সমাধান করতে খুব মজা পেতেন।

২০২৫ সালে আবেলজয়ী মাসাকি কাশিওয়ারার
ছবি: কিয়াটো প্রাইজ

কাশিওয়ারা বুঝতে পারলেন, এই ধরনের প্রশ্নগুলোকে আরও সাধারণভাবে চিন্তা করতে তিনি ভালোবাসেন। স্কুলে তিনি গণিতের ভালো শিক্ষার্থী ছিলেন। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিখ্যাত গণিতবিদ মিকিও সাতোরের সংস্পর্শে আসেন। তখন তিনি এই ধরনের সমস্যা সমাধানে আরও বেশি মনোযোগ দেন। সাতো তখন বীজগণিত আর বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করছিলেন। কাশিওয়ারা ঠিক তখন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন। মানে একদম সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় ছিলেন তিনি। 

কাশিওয়ারা তাঁর শিক্ষকের সঙ্গে মিলে ডিফারেনশিয়াল বা অন্তরকলন সমীকরণ নিয়ে কাজ শুরু করেন। এই সমীকরণের সাহায্যে পৃথিবীতে ঘটা পরিবর্তনগুলো বোঝা যায়। একটু সহজ ভাষায় বললে, আমাদের পৃথিবীতে সবকিছুই গতিশীল। কোনো কিছুই চিরকাল স্থির থাকে না। এমনকি হিমালয়ের মতো বিশাল পর্বতও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে বা কমে। নদীর প্রবাহ বা চাঁদের গতিও কিন্তু বাড়ে-কমে। আর এই গতি বুঝতে ব্যবহৃত হয় ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ। 

আরও পড়ুন

এই সমীকরণ দেখতে খুব সহজ হলেও সমাধান করা অনেক কঠিন। অনেক সময় বোঝাই যায় না যে আদৌ সমাধান সম্ভব কি না! এই জটিলতা সমাধান করতে সাতোর দল একটু ভিন্নভাবে কাজ শুরু করেন। তাঁরা বিশ্লেষণ থেকে সরে গিয়ে বীজগণিতের সাহায্যে এই সমস্যাগুলোর সমাধানের চেষ্টা করেন। বোঝার চেষ্টা করছিলেন যে, বীজগণিত দিয়ে সমস্যাগুলো ব্যাখ্যা করা যায় কি না। আর সেই গবেষণার মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন কাশিওয়ারা। 

১৯৭০ সালে সাতোর অধীনে মাস্টার্স থিসিস শুরু করেন কাশিওয়ারা। তাঁর কাজ ছিল বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া জিনিসগুলো তদন্ত করার জন্য বীজগাণিতিক সরঞ্জাম তৈরি করা। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩ বছর। সেই থিসিসে কাশিওয়ারা ‘ডি-মডিউল’ নামে একটা নতুন গাণিতিক কাঠামোর ধারণা দেন। এই মডিউলের সাহায্যে বোঝা যায়, ডিফারেনশিয়াল সমীকরণের কোন কোন সমাধানগুলো আশপাশে কেমন আচরণ করে বা সমাধানের সংখ্যা কেমন হতে পারে। বর্তমানে এই ডি-মডিউল হয়ে উঠেছে অ্যালজেব্রিক অ্যানালাইসিসের মূলভিত্তি। তিনি প্রথমে এটি লিখেছিলেন জাপানি ভাষায়। কিন্তু থিসিসটা ইংরেজিতে অনুবাদ হয় আরও ২৫ বছর পর। ততদিনে তাঁর কাজ রীতিমতো এক নতুন শাখার জন্ম দিয়ে ফেলেছে।

স্নাতক শেষ হওয়ার পর কাশিওয়ারা কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। যেখানে সাতোর সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি পিএইচডি করেন। ধীরে ধীরে তাঁর ডি-মডিউল আরও উন্নত করেন। এরপর জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে। সেখানে এক বছর গবেষণা করে ১৯৭৮ সালে জাপানে ফিরে আসেন। অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

আরও পড়ুন

এবার ফেরা যাক শুরুতে আলোচনা করা জার্মান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্টের সেই সমস্যায়। সমস্যাটি হিলবার্ট ১৯০০ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক গণিতবিদদের কংগ্রেসে তাঁর বিখ্যাত শতবর্ষী বক্তৃতায় তুলে ধরেছিলেন। হিলবার্টের ২৩টি যুগান্তকারী সমস্যার মধ্যে ২১তমটি সমাধান করেছিলেন কাশিওয়ারা। সমস্যাটি ছিল ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ নিয়ে। এই জার্মান গণিতবিদ জানতে চেয়েছিলেন, এমন একটা অন্তরকলন সমীকরণ খুঁজে পাওয়া কি সম্ভব, যার সমাধানে কোনো নির্দিষ্ট বাঁকানো পৃষ্ঠে বিশেষ বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটি পাওয়া যাবে? 

বিষয়টা বোধহয় একটু জটিল হয়ে গেল। আরও একটু সহজভাবে বলি। ধরুন, আপনি একটা কাগজের ওপর কিছু বক্ররেখা মানে আঁকাবাঁকা লাইন এঁকেছেন।

হিলবার্টের প্রশ্ন ছিল, যদি নির্দিষ্ট কিছু বিন্দুতে সিঙ্গুলারিটি থাকে—তাহলে এমন কোনো ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ লেখা কি সম্ভব, যার সমাধানে ঠিক ওই বিন্দুগুলোতে অসীম বা আচমকা পরিবর্তন দেখা যাবে?

এসবের পাশাপাশি রিপ্রেজেন্টেশন থিওরি ও কোয়ান্টাম গ্রুপ নিয়েও তিনি কাজ করেছেন। কোয়ান্টাম গ্রুপ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি ক্রিস্টাল বেস নামে একটি কাঠামো তৈরি করেন।

কাশিওয়ারা প্রমাণ করেন, নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে এরকম সমীকরণ লেখা সম্ভব। 

কাশিওয়ারার এই ডি-মডিউল গণিতের পাশাপাশি পদার্থবিজ্ঞানেও ভূমিকা রাখছে। ২০২৩ সালে জার্মানির লিপজিগের ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ম্যাথমেটিক্স ইন দ্য সায়েন্সেসের গণিতবিদ আনা-লরা সাটেলবার্গার এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা ডি-মডিউল ব্যবহার করে পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটরে সংঘটিত কণার সংঘর্ষের হিসাব করেছেন। মানে কণা ত্বরকযন্ত্রে যখন দুটি প্রোটন সংঘর্ষিত হয়, তখন কী কী প্রক্রিয়া ঘটে এবং কীভাবে নতুন কণার সৃষ্টি হয়, তা বের করেছেন। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের সহায়তা করেছে কাশিওয়ারার পদ্ধতি। 

এসবের পাশাপাশি রিপ্রেজেন্টেশন থিওরি ও কোয়ান্টাম গ্রুপ নিয়েও তিনি কাজ করেছেন। কোয়ান্টাম গ্রুপ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি ক্রিস্টাল বেস নামে একটি কাঠামো তৈরি করেন। এতে জটিল রিপ্রেজেন্টেশন থিওরিকেও সাধারণ কম্বিনেটরিক্স বা বিন্যাসের সাহায্যে বোঝা যায়। এই আবিষ্কার গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান গবেষণায় বিপ্লব ঘটিয়েছে।

আরও পড়ুন

৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মাসাকি কাশিওয়ারা বীজগাণিতিক বিশ্লেষণ এবং রিপ্রেজেন্টেশন থিওরিকে নতুন আকার দিয়েছেন। সমৃদ্ধ করেছেন গণিতকে। এই দীর্ঘ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আবেল পুরস্কারের সম্মানের পাশাপাশি তিনি পাবেন প্রায় ৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকার বেশি। 

৭৮ বছর বয়সী এই শিক্ষক এখনো শিক্ষকতা থেকে অবসর নেননি। তিনি এখনো নিয়মিত নতুন গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন এবং গণিতকে আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

হেনরিক আবেলের শততম জন্মদিন উপলক্ষে গণিতবিদ সোফাস লাই ১৮৯৯ সালে প্রথম আবেল পুরস্কার প্রস্তাব করেন। তবে প্রথম আবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ২০০৩ সালে, হেনরিখ আবেলের ২০০তম জন্মদিনে। এখন পর্যন্ত মোট ৩০ জন আবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান, নিউ সায়েন্টিস্ট ও নরওয়েজিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স অ্যান্ড লেটার্স