নিজের ভেতর দিয়ে যেতে পারে না এমন জ্যামিতিক আকৃতি প্রথমবার খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা
আপনার হাতে যদি দুটো ছক্কা বা ডাইস দেওয়া হয় এবং বলা হয় একটার ভেতর দিয়ে একটা টানেল বা গর্ত করে অন্যটাকে গলিয়ে দিন। পারবেন? সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হবে অসম্ভব। সমান সাইজের দুটো জিনিসের একটাকে আরেকটার ভেতর দিয়ে কীভাবে ঢোকানো যায়?
কিন্তু গণিতের জগৎ সাধারণ বুদ্ধির ধার ধারে না। ১৬০০ সালের শেষের দিকে প্রিন্স রুপার্ট নামের এক ভদ্রলোক বাজি ধরেছিলেন যে এটা সম্ভব। এবং তিনি জিতেও গিয়েছিলেন! গণিতবিদ জন ওয়ালিস ১৬৯৩ সালে প্রমাণ দেখান, আপনি যদি একটা কিউব বা ঘনকের কোণা বরাবর গর্ত করেন, তাহলে সেই গর্ত দিয়ে একই সাইজের এমনকি সামান্য বড় আরেকটা কিউবও গলিয়ে দেওয়া সম্ভব। সামান্য বড় মানে সর্বোচ্চ ৪ ভাগ বড় বস্তু ঢোকানো যাবে!
এই অদ্ভুত জাদুকরি ক্ষমতার নাম দেওয়া হয় রুপার্ট প্রপার্টি। তবে এখানেই থেমে থাকেননি গণিতবিদেরা। কিউবের পর তাঁরা খুঁজতে শুরু করলেন, আর কোন কোন আকৃতির এই ক্ষমতা আছে? ১৯৬৮ সালে ক্রিস্টোফ স্ক্রিবা প্রমাণ করেন, টেট্রাহেড্রন (চার তলবিশিষ্ট পিরামিড) এবং অক্টাহেড্রনেরও (আট তল) এই ক্ষমতা আছে। এরপর গত এক দশকে গণিতবিদেরা ডোডেকাহেড্রন (১২ তল), আইকোসাহেড্রন (২০ তল), এমনকি ফুটবলের মতো দেখতে আকৃতির ভেতর দিয়েও টানেল বানাতে সক্ষম হলেন।
অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, গণিতবিদেরা ভাবতে শুরু করলেন—সম্ভবত সব কনভেক্স পলিহেড্রারই এই রুপার্ট প্রপার্টি আছে। জটিল এই শব্দটার মানে যেসব তলগুলো সমতল এবং কোনো গর্ত বা খাঁজ নেই। অর্থাৎ, যেকোনো আকৃতির ভেতর দিয়েই তার সমান আরেকটা কপি গলিয়ে দেওয়া সম্ভব।
গণিতবিদেরা ভাবতে শুরু করলেন—সম্ভবত সব কনভেক্স পলিহেড্রারই এই রুপার্ট প্রপার্টি আছে। জটিল এই শব্দটার মানে যেসব তলগুলো সমতল এবং কোনো গর্ত বা খাঁজ নেই।
কিন্তু এই ধারণা ভুল প্রমাণ করতে সময় লাগল প্রায় ৩৫০ বছর। অবশেষে ২০২৪ সালের আগস্টে দুই তরুণ গণিতবিদ জ্যাকব স্টেইনিংগার এবং সার্গেই ইউরকেভিচ এমন এক আকৃতি খুঁজে পান, যা এই নিয়মের ধার ধারে না।
অস্ট্রিয়ার এই দুই বন্ধু মিলে এমন এক আকৃতি বা শেপ তৈরি করেছেন, যার নাম দিয়েছেন নো-পার্টহেড্রন। নামটা এসেছে রুপার্ট এবং না বা নোপ (Nope) মিলিয়ে। অর্থাৎ, এই আকৃতিটি সোজা নিজের মধ্য দিয়ে যেতে পারে না!
নো-পার্টহেড্রন দেখতে অনেকটা মোটা ফুলদানী বা ক্রিস্টাল ভাসের মতো। এর ৯০টি কোণা এবং ১৫২টি তল আছে। এর ওপর ও নিচের দিকটা চওড়া, মাঝখানটা একটু ফোলা।
স্টেইনিংগার এবং ইউরকেভিচ প্রমাণ করেছেন, আপনি এই আকৃতিটিকে যেভাবেই ঘোরান না কেন, বা যে দিক দিয়েই গর্ত করার চেষ্টা করুন না কেন, এর ভেতর দিয়ে দ্বিতীয় কোনো নো-পার্টহেড্রন গলানো অসম্ভব।
কিন্তু কীভাবে প্রমাণ করলেন? প্রমাণ করার জন্য তাঁরা ব্যবহার করেছেন ছায়া বা শ্যাডো টেকনিক। ধরুন, আপনি একটা কিউবকে টেবিলের ওপর ধরে আছেন। আলো পড়লে নিচে একটা ছায়া পড়ে। যদি আপনি কিউবটা সোজা ধরেন, ছায়াটা হয় চারকোনা, মানে বর্গাকার। কিন্তু যদি কোণাটা ওপরের দিকে তুলে ধরেন, ছায়াটা হয়ে যায় ষড়ভুজাকার। ওয়ালিস দেখিয়েছিলেন যে, ওই ষড়ভুজের ভেতরে একটা বর্গ এঁটে যায়। মানে গর্ত করার জায়গা আছে।
অস্ট্রিয়ার দুই বন্ধু জ্যাকব স্টেইনিংগার এবং সার্গেই ইউরকেভিচ মিলে এমন এক আকৃতি বা শেপ তৈরি করেছেন, যার নাম দিয়েছেন নো-পার্টহেড্রন। নামটা এসেছে রুপার্ট এবং না বা নোপ মিলিয়ে।
কিন্তু নো-পার্টহেড্রনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা ১ কোটি ৮০ লাখ বার একে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ছায়া পরীক্ষা করেছেন। সুপারকম্পিউটার ব্যবহার করে তাঁরা দেখেছেন, কোনোভাবেই একটার ছায়া আরেকটার ভেতরে পুরোপুরি আঁটে না। সব সময় একটু না একটু অংশ বাইরে বেরিয়ে থাকে।
এখানে বলে রাখা ভালো, এই ধরনের জ্যামিতিক প্রবলেমগুলো কিন্তু শুধু খাতা-কলমের খেলা নয়। ক্রিস্টালোগ্রাফি বা কেলাস গঠন এবং রোবোটিকসের পাথ-ফাইন্ডিং অ্যালগরিদমে এর বিশাল প্রয়োগ আছে।
প্রমাণের জন্য তাঁরা দুটো বিশেষ সূত্র ব্যবহার করেছেন। ১. গ্লোবাল থিওরেম: যদি দ্বিতীয় আকৃতির ছায়া প্রথমটার চেয়ে অনেক বেশি বাইরে বেরিয়ে থাকে, তবে ওই পজিশন এবং তার আশেপাশের সব পজিশন বাতিল। ২. লোকাল থিওরেম: যদি ছায়াটা খুব সামান্য বেরিয়ে থাকে, তবে তাঁরা ছায়ার বাউন্ডারিতে বিশেষ তিনটি কোণা খুঁজে বের করেছেন। যদি এই তিনটি কোণা মিলে ছায়ার কেন্দ্রবিন্দুকে ঘিরে থাকে, তবে প্রমাণ করা যায় যে, সামান্য ঘোরালে ছায়াটা আরও বাইরে বেরিয়ে যাবে, ভেতরে ঢুকবে না।
নো-পার্টহেড্রন হলো এমন এক আকৃতি, যার প্রতিটি পজিশন বা ওরিয়েন্টেশন এই দুই থিওরেমের কোনো না কোনোটিতে ধরা পড়ে যায়। ফলে পালানোর বা ফিট করার কোনো পথই খোলা থাকে না।
এই গবেষণার পেছনে গুগলের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার টম মারফির অবদানও কম নয়। তিনি অবসর সময়ে শখের বশে লাখ লাখ আকৃতি নিয়ে পরীক্ষা করতেন। তিনিই প্রথম নোপার্ট শব্দটি চালু করেন এবং সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, এমন আকৃতি থাকা সম্ভব। তার কাজ স্টেইনিংগার ও ইউরকেভিচকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
গণিতের জগতটা বড় অদ্ভুত। ৩৫০ বছর ধরে সবাই ভেবেছিল সব আকৃতিই বুঝি নিজের ভেতর দিয়ে গলে যেতে পারে। কিন্তু নো-পার্টহেড্রন এসে সেই অহংকার ভেঙে দিল!