এক টুকরো কাগজ ও ৫০ বছরের পুরোনো ধাঁধার সমাধান

যে কাগজের ভেতর বা বাহির বলে কিছু নেই, তার নামই মোবিয়াস স্ট্রিপছবি: গেটি ইমেজ

একটা কাগজ হাতে নিন। কাগজটা হবে ফিতার মতো। এবার কাগজের ফিতাটা একবার পেঁচিয়ে দুই মাথা জোড়া লাগিয়ে দিন। দেখবেন, এমন এক অদ্ভুত জিনিস তৈরি হলো যার আছে শুধু একটা দিক! মানে কাগজটা ১৮০ ডিগ্রি উল্টে দিতে হবে। পাশের ছবিটা মতো। এখন খেয়াল করলে দেখবেন, এই কাগজের ভেতর বা বাহির বলে কিছু নেই। এই সহজ জিনিসটার নাম মোবিয়াস স্ট্রিপ।

শুনে খুব সহজ মনে হচ্ছে, তাই না? কিন্তু এই সহজ জিনিসটা নিয়ে গণিতবিদরা ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মাথা ঘামাচ্ছেন। কারণ, তাঁরা একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না বহু বছর ধরে। প্রশ্নটাও খুব সাধারণ। মোবিয়াস স্ট্রিপ কতটা ছোট আর চওড়া হতে পারে, যাতে সেটা নিজের ভেতরে জট পাকিয়ে না যায়।

মোবিয়াস স্ট্রিপের অ্যানিমেশন
ছবি: স্কেচপ্ল্যানেশনস

তবে এখানে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। আমরা যে কাগজের কথা বলছি, সেটাকে টানা যাবে না, ছেঁড়া যাবে না বা চুপসে দেওয়া যাবে না। মানে রাবারের মতো বস্তু দিয়ে মোবিয়াস স্ট্রিপ বানানো যাবে না। হুবহু যেমন ছিল তেমনি থাকতে হবে। গণিতের ভাষায় একে বলে ডেভেলপেবল সারফেস। মানে সমতল থেকে তৈরি করা একটা জিনিস। 

এই নিয়মটা বুঝে নিলে আসল ধাঁধাটা পরিষ্কার হয়। আপনি চাইলে কাগজ ভাঁজ করে ছোট বানিয়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু সেটা তো প্রতারণা হয়ে যায়! আমাদের চাই মসৃণ ও সুন্দর একটা মোবিয়াস স্ট্রিপ।

আরও পড়ুন
আপনি পিঁপড়ে হয়ে হাঁটছেন এই ফিতার ওপর দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখবেন, আপনি যেখান থেকে হাঁটা শুরু করেছিলেন, সেখানেই ফিরে এসেছেন। এর মাঝে কখনো কোনো বাঁধা পার হতে হয়নি।

১৯৭৭ সালে চার্লস ওয়েভার আর বেঞ্জামিন হালপার্ন নামে দুই গণিতবিদ প্রথম এই প্রশ্নটা তুলেছিলেন। তারপর থেকে সবাই চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন উত্তর খুঁজে পেতে। সেই উত্তর এত দিনে মিলেছে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির রিচার্ড শোয়ার্টজ নামে একজন গণিতবিদ দাবি করেন, তিনি এর সমাধান খুঁজে পেয়েছেন!

ধাঁধার সমাধান সহজে বুঝতে চাইলে নিজেকে কিছু সময়ের জন্য একটা পিঁপড়া ভাবতে পারেন। এবার আপনি পিঁপড়ে হয়ে হাঁটছেন এই ফিতার ওপর দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখবেন, আপনি যেখান থেকে হাঁটা শুরু করেছিলেন, সেখানেই ফিরে এসেছেন। এর মাঝে কখনো কোনো বাঁধা পার হতে হয়নি। মানে, ওপর-নিচ বলে আসলে কিছু নেই এখানে।

এই অসাধারণ জিনিসটা ১৮৫৮ সালে প্রায় একই সময়ে দুই জার্মান গণিতবিদ আবিষ্কার করেছিলেন। একজনের নাম আগস্ট ফার্ডিনান্ড মোবিয়াস, আরেকজন জোহান বেনেডিক্ট লিস্টিং। যদিও নামটা রয়ে গেছে মোবিয়াসের নামে, কিন্তু দুজনেই জিনিসটা আবিষ্কার করেছিলেন। এর একটা তল আছে, কিন্তু সেই তলের কোনো শেষ নেই।

ওহ! ধাঁধার সমাধান তো এখনো দেওয়া হলো না। রিচার্ড শোয়ার্টজ প্রায় চার বছর আগে এই সমস্যাটা শুনে পুরো মগ্ন হয়ে যান। রাতের ঘুম উড়ে গেছে, দিনের পর দিন চিন্তা করেছেন। অবশেষে ২০২৩ সালের আগস্টে তিনি তাঁর সমাধান প্রকাশ করলেন।

আরও পড়ুন
এই অসাধারণ জিনিসটা ১৮৫৮ সালে প্রায় একই সময়ে দুই জার্মান গণিতবিদ আবিষ্কার করেছিলেন। একজনের নাম আগস্ট ফার্ডিনান্ড মোবিয়াস, আরেকজন জোহান বেনেডিক্ট লিস্টিং।

উত্তরটা কী? একটা মোবিয়াস স্ট্রিপের দৈর্ঘ্য আর প্রস্থের অনুপাত হতে হবে রুট √৩-এর বেশি। মানে প্রায় ১.৭৩। সহজ করে বললে, আপনার ফিতা যদি ১ সেন্টিমিটার চওড়া হয়, তাহলে সেটা কমপক্ষে ১.৭৩ সেন্টিমিটার লম্বা হতে হবে। না হলে সেটা নিজের ভেতরেই কুঁচকে যাবে।

শোয়ার্টজ নিজেই বলেছেন, ‘এই উত্তরটা পাওয়ার পর আমি হতবাক হয়ে গেলাম। পরের তিন দিন প্রায় ঘুমাইনি, শুধু এটা লিখে যাচ্ছিলাম।’

কাগজ এবং আঠালো টেপ দিয়ে তৈরি একটি মোবিয়াস স্ট্রিপ
ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

আপনি হয়তো ভাবছেন, এসব তো শুধুই গণিতের খেলা। এটা জেনে আপনার কি লাভ? লাভ আছে। ইঞ্জিনিয়াররা মোবিয়াস স্ট্রিপের মতো করে কনভেয়র বেল্ট বানান। কলকারখানায় বা এয়ারপোর্টে যে কনভেয়ার বেল্ট থাকে, সেগুলো অনেক সময় মবিয়াস স্ট্রিপের কায়দায় বানানো হয়।

এতে বেল্টের দুই পিঠই সমানভাবে ব্যবহৃত হয়। ফলে বেল্ট টেকে অনেক দিন। কারণ এতে বেল্ট ক্ষয় হয় সমানভাবে। ইলেকট্রনিক্সেও আছে এর ব্যবহার। প্লাস্টিকের বোতল বা ক্যানের গায়ে যে তিন তীরের রিসাইক্লিং চিহ্নটা দেখেন, ওটাও আসলে একটা মবিয়াস স্ট্রিপ!

আরও পড়ুন
শোয়ার্টজ নিজেই বলেছেন, ‘এই উত্তরটা পাওয়ার পর আমি হতবাক হয়ে গেলাম। পরের তিন দিন প্রায় ঘুমাইনি, শুধু এটা লিখে যাচ্ছিলাম।’

গণিতে এর অবদান আরও বেশি। টপোলজি বলে গণিতের একটা শাখা আছে। সেখানে জিনিসের আকৃতি পাল্টে গেলেও তার মূল ধর্ম ঠিক থাকে। যেমন, একটা কফির মগ আর একটা ডোনাট গণিতের চোখে একই জিনিস! কারণ, দুটোতেই একটা করে ছিদ্র আছে। মোবিয়াস স্ট্রিপ এই টপোলজিতে বিপ্লব এনে দিয়েছে।

একটা মগ ধীরে ধীরে ডোনাটে বদলে যাচ্ছে
ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

কিন্তু গণিতের জগতে একটা সমস্যার সমাধান মানেই আরেকটা নতুন সমস্যার শুরু। সাধারণ মোবিয়াস স্ট্রিপের হিসাব তো মিলল। কিন্তু কাগজটা যদি তিনবার মুচড়ে জোড়া লাগানো হয়? তখন সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্য কত হবে? শোয়ার্টজ এবার সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছেন। তার সহযোগী ব্রিয়েন ব্রাউনের সঙ্গে মিলে তিনি দুটো সম্ভাব্য মডেল খুঁজে পেয়েছেন। তাদের ধারণা, এটার অনুপাত হবে ৩ এর বেশি। তবে এটা এখনো নিশ্চিত নয়। 

গণিত আসলে এমনই। একটা প্রশ্নের উত্তর মিললে সেখানে আরও হাজারটা নতুন প্রশ্ন জন্ম নেয়। আর এই নতুনের খোঁজেই মানুষ এগিয়ে যায়। এরপর হয়তো কেউ টিনের জায়গায় পাঁচবার বা সাতবার কাগজটা মুচড়ে দেখতে চাইবে। আসলে এমন প্রশ্নের শেষ নেই, ঠিক যেমন মোবিয়াস স্ট্রিপের তলের শেষ নেই।

সূত্র: জেডএমই সায়েন্স

আরও পড়ুন