পারস্পরিক নির্ভরশীল পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেবেন কীভাবে

ধরুন, আপনি এবং আপনার বন্ধুদুজনেই কিছু একটা করে পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছেন। সোজা হাজতে না পুরে দিয়ে পুলিশ আপনাদের নিয়ে গেল জিজ্ঞাসাবাদ করতে। কঠিন ইন্টারোগেশন!

পুলিশের গোয়েন্দা চালাক মানুষ। বললেন, ‘তোমাকে বাঁচার একটা উপায় বলে দিচ্ছি, মনযোগ দিয়ে শোন। তোমার বন্ধু এবং তুমিদুজনেই যদি মুখ বন্ধ রাখো, তাহলে দুজনেরই এক বছর করে জেল হবে। কিন্তু তুমি যদি তোমার বন্ধুর অন্যান্য অপরাধ ফাঁস করে দাও, আর ও যদি তোমার ব্যাপারে কিছু না বলে, তাহলে তুমি মুক্তি পেয়ে যাবে। আর ওর ৫ বছরের জেল হবে। কিন্তু যদি তোমরা দুজনেই দুজনের অন্যান্য অপরাধ ফাঁস করে দাও, তাহলে প্রত্যেকে দুই বছরের জেল খাটবে।

এখন আপনি কী করবেন? চুপ করে থাকবেন, এবং আশা করবেন, বন্ধু যেহেতু, সে-ও চুপ করে থাকবে? নাকি তার অপরাধ ফাঁস করে দেবেন? মাথা ঠান্ডা করে ভাবুন। হিসাব করলে দেখবেন, চুপ করে থাকাটা ভালো; কিন্তু সে যদি মুখ খোলে, আপনাকে ৫ বছর ধরে জেলের ভাত খেতে হবে। আর আপনি মুখ খুললে, সে না মুখ খুললে তো মুক্তিই পেয়ে যাবেন, আর সে মুখ খুললেও আপনার সাজা হবে কেবল দুই বছর।

এখন আপনি কী করবেন? চুপ করে থাকবেন, এবং আশা করবেন, বন্ধু যেহেতু, সে-ও চুপ করে থাকবে? নাকি তার অপরাধ ফাঁস করে দেবেন? মাথা ঠান্ডা করে ভাবুন। হিসাব করলে দেখবেন, চুপ করে থাকাটা ভালো; কিন্তু সে যদি মুখ খোলে, আপনাকে ৫ বছর ধরে জেলের ভাত খেতে হবে

এই যে হিসাব-নিকাশ, একে অন্যের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল পরিস্থিতিতে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াএর পেছনে আছে মজার এক গাণিতিক তত্ত্ব। গেম থিওরি। না, গেম খেলার থিওরি না এটা। বাস্তব দুনিয়ায় পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, অর্থাৎ একজনের প্রতি আরেকজনের আচরণ বা প্রতিক্রিয়াই এখানে একেকটি গেম। আর গেমের মোট ফলাফল স্বাধীন হয় না। অর্থাৎ শুধু আপনি মুখ খুললেন, নাকি বন্ধ রাখলেন, তাতে হবে না। আপনার বন্ধু, অর্থাৎ অন্যদের আচরণও মোট ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলে।

গেম থিওরি বলে, আপনি যদি নিজের ভালোটার জন্য কাজ করেন, এবং ধরে নেন যে অন্যজনও নিজের ভালোটার জন্যই কাজ করবে, তাহলে মোট ফলাফলটা সবার জন্যই ভালো হবে

গেম থিওরি বলে, আপনি যদি নিজের ভালোটার জন্য কাজ করেন, এবং ধরে নেন যে অন্যজনও নিজের ভালোটার জন্যই কাজ করবে, তাহলে মোট ফলাফলটা সবার জন্যই ভালো হবে। ওপরের উদাহরণের কথাই ধরুন। এই উদাহরণে দেখা যাচ্ছে, আপনি যদি আপনার বন্ধু নিজের ভালোটা চাইবে’, অর্থাৎ মুখ খুলবেধরে নিয়ে নিজেও মুখ খোলেন, তাহলে দুজনেই সর্বোচ্চ ২ বছর জেল খাটবেন। নাহয় একজন মুক্তি পেয়ে যাবে, কিন্তু আরেকজনকে জেল খাটতে হবে ৫ বছর। সেটা নিশ্চয়ই তার (বা আপনার) জন্য ভালো হবে না।

আরেকটা সহজ উদাহরণ হিসাবে কাঁচাবাজারের কথা ভাবুন। আপনি বাজারে গেলেন। একজন বিক্রেতা ১০০ গ্রাম কাঁচামরিচের দাম চাইলেন ৫ টাকা। আরেকজন যদি ৩ টাকায় সমপরিমাণ কাঁচামরিচ দেয়, তাহলে তার লাভ হবে কম। আবার তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আগের বিক্রেতা যদি নিজের মরিচের দাম কমায়, তাহলে তারও লাভ কমবে। আবার দাম যদি তারটা বেশি থাকে, তাহলে বিক্রি যাবে কমে। কিন্তু দুজনেই যদি ৫ টাকায় বিক্রি করে, তাহলে কারোই লাভ বা বিক্রি কমবে না। এই যে সাম্যাবস্থা, যেখানে আরেকজন যা-ই করুক, নিজের জন্য সর্বোচ্চ ভালোটা করলেও আপনার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, এটাকে গেম থিওরিতে বলা হয় ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম। বাংলায় বলা যায়, ন্যাশ সাম্যাবস্থা।

মার্কিন গণিতবিদ জন ফোর্বস ন্যাশ জুনিয়র
ছবি: কৃতজ্ঞতা

১৯৪০-এর দশকে গেম থিওরি আবিষ্কার করেন গণিতবিদ জন ভন নিউম্যান এবং অস্কার মর্গেনেস্টার্ন। তাঁরা দেখান, ব্যবসায়ীক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন পক্ষ কী কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সেগুলোর ফলাফল কেমন হতে পারে। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফলাফলটা পাওয়ার উপায় কী? সেটা দেখান মার্কিন গণিতবিদ জন ফোর্বস ন্যাশ জুনিয়র, ১৯৫০ সালে তাঁর মাস্টার্সের থিসিসে। জন ন্যাশকে নিয়ে বানানো মুভি আ বিউটিফুল মাইন্ড-এ তাঁর এই আবিষ্কারটা চিত্রিত করা হয়েছে। সেটা আর এখানে বলে স্পয়লার দিলাম না, আগ্রহীরা মুভিটা দেখতে পারেন।

বোঝার সুবিধার্থে আরেকটা উদাহরণ দিই। ধরুন, দুই বন্ধু মিলে পিজ্জা খাচ্ছেন। আরেকটা টুকরাই বাকি আছে। বন্ধু সেই টুকরাটা না নিলে আপনি খাবেন, কিন্তু সে নেবে কি না, বুঝতে পারছেন না। আপনার বন্ধুও একই দ্বিধায় ভুগছে। দুজনেই যদি হাত বাড়িয়ে পিজ্জাটা নিতে চান, তাহলে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি হবে। আর যদি কেউই না নেন, তাহলে ওটা পড়ে থাকবে। এ ক্ষেত্রে ন্যাশ সাম্যাবস্থা হলো, দুজনেই যদি আলাপ করে টুকরাটা ভাগ করে নেন, তাহলে কেউ বিব্রতও হবেন না; টুকরাটাও পড়ে থাকবে না, দুজনের ইচ্ছাও পূর্ণ হবে।

গেম থিওরির ব্যবহার আছে প্রায় সবখানে; প্রতীকী ছবি
কৃতজ্ঞতা: গেম থিওরি ডট অনলাইন
আরও পড়ুন

এখন সবচেয়ে বড় কথা, এই থিওরির প্রয়োগ কি বাস্তব দুনিয়ায় হয়? আসলে, এর ব্যবহার আছে প্রায় সবখানে। যেমন ফাস্টফুডের দোকান বা নতুন পণ্য বাজারজাত করার সময় কেউ যদি ভাবে, আমি দাম কমিয়ে রেখে বাজার দখল করব, সেটা হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তব চিন্তা হবে না। খরচ উঠবে না ঠিকভাবে। তারচেয়ে অন্যদের কাছাকাছি দাম রেখে ভালো পণ্য বাজারে ছাড়লে সেটাই সবার জন্য ভালো হবে। শুধু ব্যবসা-ই নয়, রাজনীতি, যুদ্ধ, এমনকি প্রকৃতিতেও দেখা যায় গেম থিওরির প্রয়োগ। প্রকৃতিতে অনেক প্রাণীই খাবার নিয়ে লড়াই না করে ভাগাভাগি করে নেয়। এভাবেই তারা এমন এক পরিবেশ গড়ে তোলে, যাতে কাউকে না খেয়ে কষ্ট পেতে না হয়; বরং সবাই খাবার পায়। বড় দেশগুলো যখন কোনো মহামারির টিকা তৈরি করে, তখন স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে এই টিকা বিনামূল্যে বা অল্প মূল্যে সরবরাহ করে। করোনার সময় এভাবেই টিকা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এর কারণটা সহজ। বাংলাদেশ বা কোনো স্বল্প আয়ের দেশের মানুষ টিকা না নিলে তাতে ঝুঁকিতে পড়বে বড় দেশগুলোও। এটাই গেম থিওরি।

পরেরবার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই তত্ত্ব মাথায় রাখতে পারেন। আশা করা যায়, ঠকবেন না।

 

সূত্র: স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া, ইনভেস্টোপিডিয়া, উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন