অসীমের পথে যাত্রা শুরুর আগে একটু গা গরম করে নেওয়া যাক। এখানে একটা সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে আমরা আলোচনা করব। এই কৌশলের সাহায্যে হয়তো অসীম পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে। একটু বীজগণিতের ব্যবহারও করতে হবে, তবে তা জটিল মনে হবে না। তাহলে চলো, মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলোকে একটু জাগিয়ে তোলা যাক।
আমাদের কৌশলটা খুব সহজ। ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুনতে কত সময় লাগবে? ধরো, স্বাভাবিকভাবে তোমার ৮ সেকেন্ড সময় লাগে। এরপর বললাম একটু দ্রুত গণনা করতে। পরেরবার ১১-২০ পর্যন্ত গুনতে তোমার ৪ সেকেন্ড লাগল। পরের দশটি সংখ্যা অর্থাৎ ২১-৩০ পর্যন্ত গুণতে লাগল ২ সেকেন্ড। এভাবে প্রতিবার যখন আমি আরও ১০টি সংখ্যা গণনা করি, তখন আগের ১০টি সংখ্যার তুলনায় সময় অর্ধেক হয়ে যায়। মানে প্রথমে ৮ সেকেন্ড, পরে ৪ সেকেন্ড এবং এরপর ২ সেকেন্ড…। এভাবে চলতে থাকলে, অসীম সংখ্যক সংখ্যা গুনতে আমার কত সময় লাগবে?
একটু সাজিয়ে সংখ্যাগুলো যোগ করি। তাহলে সংখ্যাগুলো হবে:
৮ + ৪ + ২ + ১ + ১/২ + ১/৪ + ১/৮ + ....
এটাকে একটু অন্যভাবেও লেখা যায়। বোঝার সুবিধার্তে ১/২-এর পরিবর্তে আমরা ০.৫ আকারে লিখতে পারি। তাহলে ধারাটি হবে:
৮ + ৪ + ২ + ১ + ০.৫ + ০.২৫ + ০.১২৫ + ....
চাইলে এই ধারাটি তুমি আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারো। কিন্তু যতই সামনের দিকে যাও না কেন, ধারার শেষ হবে না। অর্থাৎ, এটা অসীম সংখ্যক সংখ্যা! তাহলে এই অসীম সংখ্যক সংখ্যা যোগ করতে কি অসীম সময় লাগবে? আর এর যোগফলও কি অসীম হবে?
এখানে আমাদের একটু বুদ্ধির খেলা খেলতে হবে। শুরুতে যে কৌশলের কথা বলেছিলাম, এখন সেই কৌশল ব্যবহার করতে হবে। এতে অসীম পরিমাণ গণনা ঝামেলায় যেতে হবে না। আমরা ধরে নিই, ওপরের অসীম যোগফলের উত্তর ‘N’। ‘N’ অসীমও হতে পারে, আবার অন্য কোনো সংখ্যাও হতে পারে। কিন্তু যাই হোক না কেন, এই উত্তরের নাম দেব ‘N’।
তাহলে,
N = ৮ + ৪ + ২ + ১ + ০.৫ + ০.২৫ + ০.১২৫ +...
এবার N-কে ২ দিয়ে গুণ করি। তাহলে,
2 × N = ২ × (৮ + ৪ + ২ + ১ + ০.৫ + ০.২৫ + ০.১২৫ +...)
অর্থাৎ, 2N = ২×৮ + ২×৪ + ২×২ + ২×১ + ২×০.৫ + ২×০.২৫ + ২×০.১২৫ +...
= ১৬ + ৮ + ৪ + ২ + ১ + ০.৫ + ০.২৫ +...
এবার, 2N থেকে N বিয়োগ করলে পাই, 2N - N = N।
অর্থাৎ, N = ১৬ + ৮ + ৪ + ২ + ১ + ০.৫ + ০.২৫ +... -(৮ + ৪ + ২ + ১ + ০.৫ + ০.২৫ + ০.১২৫ +...)
= ১৬ + ৮ + ৪ + ২ + ১ + ০.৫ + ০.২৫ +... - ৮ - ৪ - ২ - ১ - ০.৫ - ০.২৫ - ০.১২৫ +...
= ১৬
তাহলে আমরা উত্তর N = ১৬ পেলাম। কিন্তু কেন ১৬ হলো? কারণ, প্রথম লাইনের বাকি সব অংশ দ্বিতীয় লাইনের অংশের সঙ্গে বিয়োগ হয়ে বাদ পড়ে গেছে। অবশিষ্ট ছিল শুধু ১৬। সুতরাং, আমরা N-এর মান বের করেছি ১৬। তার মানে, এই কৌশল ব্যবহার করে অসীম পর্যন্ত গণনা করতে সময় লাগবে মাত্র ১৬ সেকেন্ড!
কিন্তু বাস্তবে কি তা সম্ভব? হয়তো ১-১০০ পর্যন্ত গুণতেই আমাদের ১৬ সেকেন্ড সময় লেগে যাবে। তাহলে এই অল্প সম্পয়ে কীভাবে অসীম পর্যন্ত গোনা যাবে? আসলে যাবে না। কারণ এই সময়ের মধ্যে অসীম পর্যন্ত গুনতে হলে মুখ চলতে হবে আলোর গতির চেয়েও বেশি গতিতে। কিন্তু আলোর তো একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে, সেই সীমা পার হওয়া যাবে না। সোজা কথায়, এই পদ্ধতিতে অসীম পর্যন্ত গোনা সম্ভব নয়।
তাহলে উপায়? এগোতে হবে নতুন পদ্ধতিতে। আদিবাসীদের থেকে একটা কৌশল আমরা ধার করতে পারি। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের সংখ্যা গণনার ধারণা একটু ভিন্ন। অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের ভাষায় ৫-এর বেশি সংখ্যার কোনো নাম নেই। যেমন কেপ ইয়র্কের আঙ্গকামুথি উপজাতি এভাবে গণনা করে: ইপিম (১), উধিমা (২) এবং উচামা (৩)। এরপর ৩-এর বেশি যেকোনো সংখ্যাকে তাঁরা বলে মাকিয়ান (অনেক)।
আঙ্গকামুথিদের জন্য মাকিয়ান মানে অসীম। যে সংখ্যা তাঁরা গুণে বলতে পারে না, তাকেই বলে মাকিয়ান। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ৩-এর বেশি গুণতে না পারলেও তাঁরা বুঝতে পারে কোনটি বড় মাকিয়ান। মানে কোনটি বড় তা তাঁরা নিজস্ব কৌশলে বুঝতে পারে।
একটা উদাহরণ দিই। ধরো, তোমার কাছে দুই ঝুড়ি ফল আছে। এক ঝুড়িতে আম, অন্যটিতে কমলা। দুই ঝুড়িতেই আছে অনেক ফল। কোন ঝুড়িতে বেশি ফল আছে, তা বোঝার জন্য আঙ্গকামুথি উপজাতির যেকোনো মানুষ দুটি ঝুড়ি থেকেই একটা করে ফল নেবে। এভাবে যতক্ষণ এক ঝুড়ির ফল শেষ হবে না, ততক্ষণ ফল নিতেই থাকবে। এখন এক ঝুড়ির ফল শেষ হয়ে যাবে, তখন বুঝতে হবে অন্য ঝুড়িতে বেশি ফল আছে।
আরেকটু বুঝিয়ে বলি। ধরো, দুটি ঝুড়িতে যথাক্রমে ১০০ ও ১২০টি ফল আছে। প্রতি ঝুড়ি থেকে একটা করে ফল নিয়ে, ১০০ ফল নেওয়ার পর এক ঝুড়ির ফল শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তখনও অন্য ঝুড়িতে ২০টি ফল থেকে যাবে। তখন আদিবাসি মানুষটি বুঝতে পারবে, যে ঝুড়ির ফলে এখনো শেষ হয়নি, ওই ঝুড়িতে ফল বেশি আছে। আর যদি দুই ঝুড়ির ফল একসঙ্গে শেষ হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে উভয় ঝুড়িতে সমান সংখ্যক ফল ছিল।
ধারণা করা হয়, প্রাণীরাও একই কৌশল ব্যবহার করে। প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য সংখ্যার কিছু ধারণা থাকতে হয়। ধরো, একটা পাখি জানে ওর বাসায় কয়টি ডিম আছে। সেখান থেকে একটা ডিম হারিয়ে গেলে পাখিটি টের পায়। তখন পাখিটি বুঝতে পারে, বাসার হয়তো কোনো বিপদ আছে। আবার বানরের দুটি দলের মধ্যে যদি দ্বন্দ্ব লাগে, তাহলে ওরা প্রথমে বুঝতে চেষ্টা করে, কোন দলে বেশি বানর আছে। সাধারণত যে দলে কম বানর থাকে, সেই দল যুদ্ধ না করে পালিয়ে যায়। প্রাণীদেরও হয়তো সংখ্যার কোনো নাম নেই (আসলে আমাদের জানা নেই, এমনিতে নাম থাকতে পারে)। সেক্ষেত্রে প্রাণীরাও হয়তো আঙ্গকামুথিদের মতো একইভাবে গণনা করে।
আমরাও হয়তো একটি জায়গায় গিয়ে প্রাণী বা আঙ্গকামুথিদের মতো গণনা করি। বিষয়টা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন জার্মান গণিতবিদ জর্জ ক্যান্টর। আমরা সব সসীম সংখ্যার নাম জানি। যেমন ৪৫৮ সংখ্যাটিকে বলি চার শ আটান্ন, আবার ১৫২-কে বলি এক শ বাহান্ন। এরকম যত বড় সসীম সংখ্যাই হোক না কেন, আমাদের কাছে সেগুলোর প্রত্যেকটার নাম আছে। কিন্তু যে সংখ্যার শেষ নেই, সেই সংখ্যার জন্য আমাদের কাছে শুধু একটাই নাম আছে—ইনফিনিটি বা অসীম।
কিন্তু ক্যান্টর দেখালেন, অসীম মানে এই নয় যে সব অসীম সমান! বরং, হতে পারে একটার চেয়ে অন্যটা বড়। আর যদি আমরা কোনোভাবে এক অসীমের প্রতিটি জিনিসকে অন্য অসীমের প্রতিটি জিনিসের সঙ্গে জোড়া লাগাতে পারি, তাহলে বোঝা যাবে তারা সমান, নাকি ছোট বা বড়!
