ব্যাঙ নিয়ে যত কল্পকথা

সভ্যতার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাঙ নিয়ে নানা কল্পকাহিনি, লোককথা ও কুসংস্কার প্রচলিত আছে। এগুলোকে প্রথাগত জ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রথাগত জ্ঞান থেকে অনেক বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের উত্তরও জানা সম্ভব। সে রকম কিছু মজার ঘটনা নিয়েই আজকের আলোচনা।

আপনি কি জানেন, ব্যাঙের মাধ্যমে দুধ সংরক্ষণ করা যায়? শুনতে বিশ্রী লাগলেও ঘটনা সত্যি। প্রাচীনকালে রুশরা দুধ সংরক্ষণের জন্য ব্যাঙ ব্যবহার করত। তখন ফ্রিজ বা আধুনিক কোনো সংরক্ষণ পদ্ধতি ছিল না। রাশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় দুধ রাখার পাত্রে রাখা হতো ব্যাঙ। প্রথাটি বিজ্ঞানসম্মতও বটে। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যাঙের ত্বক থেকে নির্গত কিছু রাসায়নিক উপাদানের কারণে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক বাড়তে পারে না। ফলে দুধ অনেকদিন টাটকা থাকে।

ব্যাঙের ত্বক থেকে নির্গত কিছু রাসায়নিক উপাদানের কারণে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক বাড়তে পারে না
ছবি: ডিজেন

ব্যাঙ নিয়ে কল্পগাথা অনেক। এর নামের পেছনেও আছে নানা বিষয়। ইংরেজি ফ্রগ (Frog) মানে ব্যাঙ। ফ্রগ শব্দটার উৎপত্তি হলো কীভাবে? ইংরেজি ‘frogge’ থেকে এসেছে ‘Frog’ শব্দটি। ১ হাজার সাল থেকে ১ হাজার ৪০০ সাল পর্যন্ত এটি প্রচলিত ছিল। তার আগে ৬০০ থেকে ১ হাজার সাল পর্যন্ত এই শব্দটি ‘frogga’ নামে প্রচলিত ছিল। ইংরেজি ভাষা থেকে উৎপত্তির আগে শব্দটি এসেছে প্রাচীন নর্স (Old Norse) ভাষা থেকে। সে ভাষায় শব্দটি ছিল ‘frauki’ বা ‘froskr’। এ ছাড়া শব্দটি পুরাতন জার্মান ভাষায় ‘frosk’ নামেও পরিচিত ছিল।

উভচর প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত প্রাণী ব্যাঙ। এরা জীবনের প্রথম ভাগে, অর্থাৎ ডিম থেকে ব্যাঙাচি (Tadpole) হওয়া পর্যন্ত পানিতে থাকে। এরপর রূপান্তর প্রক্রিয়ায় প্রাপ্তবয়স্ক হয়। এ জন্য ব্যাঙের জীবনে জলজ ও স্থলজ—দুই ধরনের পরিবেশই প্রয়োজন। ব্যাঙের শরীর সাধারণত মসৃণ এবং পিচ্ছিল হয়। অন্যদিকে টোডও একধরনের ব্যাঙ, কিন্তু এদের দেহ খসখসে, আঁচিল আছে।

আরও পড়ুন

অনেক পৌরাণিক কাহিনিতে আবার ব্যাঙকে মনে করা হয় প্রাণের উৎস। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বিভিন্ন লোকাচার ও পৌরাণিক কাহিনীতে ব্যাঙকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মানুষ দীর্ঘদিন বিশ্বাস করত, ব্যাঙের জন্ম মাটি ও পানি থেকে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এরা বেঁচে থাকতে পারে। ব্যাঙ কয়েক হাজার করে ডিম দিতে পারে। এ ব্যাপারটা তারা ‘উর্বরতার প্রতীক’ বলে মনে করত। মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিকে এক লাখ বোঝাতে একটা ব্যাঙাচির চিহ্ন ব্যবহৃত হতো।

১ লাখ বোঝাতে একটা ব্যাঙাচির চিহ্ন ব্যবহৃত হতো মিশরে
ছবি: উইকিমিডিয়া

ব্যাঙের রূপান্তর প্রক্রিয়া নিয়েও আছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি ও রূপকথা। প্রাচীন মিশরে অর্থনীতির কেন্দ্র ছিল নীল নদ। সেখানে প্রচুর ব্যাঙ ছিল বলে ধারণা করা হয়। মিশরীয়রা ব্যাঙকে উর্বরতা এবং প্রসবের দেবী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। প্রাচীন মিশরের ভাস্কর্য, মূর্তি ও সমাধিগুলোতে ব্যাঙের ছবি খোদাই করা অবস্থায় পাওয়া গেছে। রোমানরা তাদের দেবী ভেনাসকে ব্যাঙের সঙ্গে তুলনা করত।

উনিশ শতকের বেশির ভাগ প্রাকৃতিক ইতিহাসের বই অনুসারে, ব্যাঙ শতাব্দীর পর শতাব্দী পাথরে আবদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে। রোমান যোদ্ধা, প্রকৃতিবিদ, লেখক প্লিনি এবং আরেক রোমান লেখক আইলিয়ানের সময় থেকে ব্যাঙ বিষাক্ত প্রাণী হিসেবে বিবেচিত।

পনের শতকের এই ছবিতে একটি জীবন্ত ব্যাঙ থেকে টোডস্টোন আলাদা করা হচ্ছে
ছবি: উইকিমিডিয়া

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের রিচার্ড থ্রি বইয়ে দুষ্ট বাদশাহকে বলা হয়েছে ‘বিষাক্ত ব্যাঙ’। তাদের বিশ্বাস ছিল, এসব ব্যাঙের মাথার ভেতরে মূল্যবান পাথর থাকে, যা টোডস্টোন নামে পরিচিত। অ্যালকেমিস্ট বা অপরসায়নবিদেরা জাদুর ক্ষমতা পাওয়ার জন্য এবং বিষ নিষ্ক্রিয় করতে এসব পাথর খুঁজত। আসলে টোডস্টোন বলতে কিছু ছিল না। বরং তখনকার দিনে মানুষ Lepidotes sp. নামে একটি বিলুপ্ত মাছের জীবাশ্মের দাঁতকে মনে করত টোডস্টোন।

প্রাচীন চীনে সবুজ ব্যাঙকে মনে করা হতো দেবী। তাদের মতে, এই ব্যাঙ শুধু খাওয়া, মদ্যপান এবং অভিনয় পছন্দ করত। চীনে বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যাঙের খোদাই করা ছবি ব্যবহৃত হতো। যেমন বধিরতা দূর করতে। তারা ব্যাঙকে ‘হ্যাভেনলি চিকেন’ নামে আখ্যায়িত করেছিল। ভাবত, ব্যাঙ বৃষ্টির মাধ্যমে স্বর্গ থেকে ভূপতিত হয় এবং ধন-সম্পদসহ কল্যাণ নিয়ে আসে। চীনের কিছু এলাকায় ব্যাঙের মন্দিরও নির্মিত হয়েছিল।

Lepidotes sp. এর জীবাশ্ম
ছবি: উইকিমিডিয়া

এ সব মন্দিরে পূজা করে মানুষ দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু করত। চীনে বিছা (Scorpion), সেন্টিপিড বা শতপদী (Centipede), মাকড়সা (Spider) এবং সাপের (Snake) পাশাপাশি ব্যাঙকেও বিষাক্ত প্রাণী বলে মনে করত।

আরও পড়ুন

চীনে তিন পা-ওয়ালা টোড বা ব্যাঙাচি ‘মানি টোড’ বা ‘মানি ফ্রগ’ বা ‘চান’ নামে পরিচিত। চাইনিজ মিথোলজি অনুসারে, লিউ হাই নামে এক ব্যক্তির তিন পা-ওয়ালা টোড ছিল। তিনি বিষাক্ত সরীসৃপ থেকে একটি জলাশয় রক্ষা করতে এসব টোড ব্যবহার করেছিলেন। জলাশয়ের পাশে একটা সোনার চেইনের সাহায্যে টোড রেখে দেন। তারপর স্বর্ণের লোভে সরীসৃপটি ওপরে উঠে আসে এবং লিউ হাই সেটি হত্যা করেন।  এভাবে লিউ হাই প্রতিষ্ঠা করেন ‘লোভের শাস্তি মৃত্যু’।

মানি টোড
ছবি: উইকিমিডিয়া

জাপানে প্রতি বছর ৭ জুলাই জাওডো মন্দিরে ব্যাঙ উৎসব পালন করা হয়। জাপানিজ মিথোলজি অনুসারে, এক যুবক একজন বৌদ্ধ পুরোহিতকে খারাপ কথা বলায় তাকে ব্যাঙে রুপান্তর করা হয়েছিল। ব্যাঙকে বৃষ্টি এবং বর্ষাকালের পূর্বাভাস হিসেবে জাপান ও ভিয়েতনামে দেখা হয়। এ ছাড়া জাপানের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাঙকে অধ্যবসায় ও শক্তির উৎস বলে মনে করা হয়।

আরব জ্যোতিষীরা দুটি তারকার নামকরণ করেছেন ব্যাঙের নামে। একটি ‘আল দিফদি আল আউয়াল’ (Al Difdi al Awwal) বা দ্য ফার্স্ট ফ্রগ এবং অপরটি ‘আল দিফদি আস সানি’ (Al Difdi al Thani) বা দ্য সেকেন্ড ফ্রগ। আধুনিক নক্ষত্রশাস্ত্র অনুসারে এদের নামকরণ করা হয়েছে যথাক্রমে ‘Alpha Piscis Austrini’ বা ‘Famalhaut’ এবং ‘Rana Secunda’। Famalhaut সবচেয়ে উজ্জ্বল বিশটি নক্ষত্রের একটি।

আরও পড়ুন

লেখক: প্রভাষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ (বন্যপ্রাণী), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: ১. এনসাইক্লোপিডিয়া অব সুপারস্টিশনস, ফোকলোর, অ্যান্ড দ্য অকাল্ট সায়েন্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড

২. হোয়াট ক্যান দ্য মিথিকাল ফ্রগ টেল আস? দ্য সিমবলিজম অ্যান্ড রোল অব দ্য ফ্রগ ইন হিস্ট্রি অ্যান্ড মডারনিটি