সব ভূমিকম্পের পর সুনামি হয় না কেন

সুনামি হলো সাগরের বিশাল ঢেউয়ের সিরিজ, যা পানির নিচের বড় ধরনের নড়াচড়ার কারণে তৈরি হয়

গত ২০ জুলাই ২০২৫, রোববার রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপের উপকূলে মাত্র ৩২ মিনিটের ব্যবধানে পরপর তিনটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে জানায়, এই তিনটি ভূমিকম্পের মধ্যে একটি ছিল ৭.৪ মাত্রার, বাকি দুটি ৬.৭ ও ৫ মাত্রার। একের পর এক ভূমিকম্পের ঘটনায় সুনামির আশঙ্কায় উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে সতর্কতা জারি করা হয়।

বাংলাদেশে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়, কিন্তু সুনামির সতর্কতা জারি করা হয় না। প্রশ্ন হলো, কেন? ভূমিকম্পের পর কখন সুনামির সতর্কতা দেওয়া হয়? কিছু ভূমিকম্পের কারণে সুনামি হলেও সব ভূমিকম্পে কেন হয় না? ভূমিকম্প ও সুনামির মধ্যে সম্পর্ক কী?

ভূমিকম্পের পর সুনামি হবে কি না, তা কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। প্রথমত, ভূমিকম্পের শক্তি কতটা। সাধারণত খুব শক্তিশালী ভূমিকম্পের কারণে সুনামি হয়। দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্পের গতি। ভূপৃষ্ঠের কতটা নিচে ভূমিকম্প হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে এর গতি।

সুনামি হলো সাগরের বিশাল ঢেউয়ের সিরিজ, যা পানির নিচের বড় ধরনের নড়াচড়ার কারণে তৈরি হয়। বেশির ভাগ সময় সাগরতলে বা তার কাছাকাছি বড় ভূমিকম্প হয় সুনামির কারণে।

তবে আরও ভালোভাবে বুঝতে হলে জানতে হবে ভূমিকম্প ও সুনামি কখন হয়। ভূমিকম্প হলে ভূপৃষ্ঠের নির্দিষ্ট অঞ্চলের মাটি কেঁপে ওঠে। কেঁপে ওঠার কারণ, ভূপৃষ্ঠের নিচে বিশাল টেকটোনিক প্লেট। এই প্লেটগুলো সব সময় ধীরে ধীরে নড়ছে। যখন এই প্লেটগুলো পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খায় কিংবা একটি আরেকটির নিচে চলে যায়, তখন প্লেটগুলোর সংযোগস্থলে চাপ সৃষ্টি হয়। সেখানে শক্তি জমা হতে থাকে।

আরও পড়ুন

এই শক্তি যখন বেরিয়ে আসে, তখন আমাদের পায়ের নিচের মাটি কয়েক সেকেন্ডের জন্য কেঁপে ওঠে। এই কম্পন তরঙ্গ আকারে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী এই কম্পনকেই আমরা ভূমিকম্প হিসেবে অনুভব করি। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল মাটির যত গভীরে হয়, এর প্রভাব তত কম হয়। আবার উৎপত্তিস্থল যদি ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি হয়, তাহলে কম্পন হয় তীব্র।

বেশির ভাগ বড় ভূমিকম্পের উৎসই প্রশান্ত মহাসাগর

সুনামি হলো সাগরের বিশাল ঢেউয়ের সিরিজ, যা পানির নিচের বড় ধরনের নড়াচড়ার কারণে তৈরি হয়। বেশির ভাগ সময় সাগরতলে বা তার কাছাকাছি বড় ভূমিকম্প হয় সুনামির কারণে। সুনামি ঘটার জন্য ভূমিকম্পকে অবশ্যই সাগরের তলদেশে বা সাগরের কাছাকাছি ভূখণ্ডে হতে হবে। কেননা, ভূমিকম্পের ফলে যখন ফল্ট লাইন বা ভূত্বকের ফাটল বরাবর মাটি হঠাৎ ওপরে বা নিচে সরে যায়, সাধারণত তখন সুনামি তৈরি হয়। স্থলভাগে ঘটা ভূমিকম্প সাধারণত সুনামি তৈরি করে না। এছাড়াও, ভূমিকম্প যত অগভীর হয়, সুনামি ঘটার সম্ভাবনা তত বেশি থাকে। যদি ভূমিকম্প অনেক গভীরে হয়, তাহলে এর শক্তি সাগরের তলদেশে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুর্বল হয়ে যায়। ফলে সাগরের পানিকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না। তবে ভূমিধস, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, কিছু নির্দিষ্ট আবহাওয়ার পরিস্থিতি, এমনকি উল্কাপিণ্ডের আঘাতেও সুনামি হতে পারে।

ভূমিকম্পের পর যেসব অঞ্চলে সুনামির সতর্কতা জারি করা হয়, তার বেশির ভাগই উপকূলীয় এলাকা বা সমুদ্রের কাছাকাছি ঘটা শক্তিশালী ভূমিকম্পের পরেই দেওয়া হয়।

বেশির ভাগ বড় ভূমিকম্পের উৎসই প্রশান্ত মহাসাগর। প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি বড় ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয় প্রশান্ত মহাসাগরের ‘রিং অব ফায়ার’ নামে একটি অঞ্চলে। এ অঞ্চলে প্যাসিফিক বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাত আশপাশের অন্য পাতগুলোর নিচে তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এটিই মূলত এসব ভূমিকম্পের উৎপত্তির কারণ বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।

আরও পড়ুন

ভূমিকম্পের পর যেসব অঞ্চলে সুনামির সতর্কতা জারি করা হয়, তার বেশির ভাগই উপকূলীয় এলাকা বা সমুদ্রের কাছাকাছি ঘটা শক্তিশালী ভূমিকম্পের পরেই দেওয়া হয়। যেমনটা সম্প্রতি ঘটেছে রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপে। এই এলাকায় ১ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বাস করে। তাই বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের মাত্রা, গভীরতা এবং উৎপত্তিস্থল বিশ্লেষণ করে দ্রুত এ ধরনের সতর্কতা জারি করেন। এতে উপকূলীয় এলাকার মানুষ নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারে এবং ক্ষয়ক্ষতি কমে।

২০১০ সালের জানুয়ারিতে হাইতিতে যে ভূমিকম্প হয়েছিল, তা ছোট ছোট কিছু স্থানীয় সুনামির জন্ম দিয়েছিল

ভূমিকম্পের পর সুনামি হবে কি না, তা আরেকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ভূমিকম্পের তীব্রতা। ভূমিকম্পের সময় রেকর্ড করা সবচেয়ে বড় কম্পন তরঙ্গের পরিমাপ হলো তীব্রতা। সুনামি তৈরির জন্য এই তীব্রতাকে একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতে হয়।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপের জাতীয় ভূমিকম্প তথ্যকেন্দ্রের ভূ-পদার্থবিদ ডন ব্লেকম্যান এ সম্পর্কে বলেন, ‘সাধারণত ৭.৫ বা ৭-এর নিচের ভূমিকম্পগুলো সুনামি সৃষ্টি করে না। তবে মাঝেমধ্যে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পও স্থানীয়ভাবে ছোট এবং কম ধ্বংসাত্মক সুনামির কারণ হতে পারে।’

বাংলাদেশ যেহেতু বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত, তাই ভারত মহাসাগরের তলদেশে বা ইন্দোনেশিয়া-আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশে সুনামির ঝুঁকি থাকে।

সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে হাইতিতে যে ভূমিকম্প হয়েছিল, তা ছোট ছোট কিছু স্থানীয় সুনামির জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিকাল সার্ভের মুখপাত্র বব কিমেল এই ব্যাপারে বলেন, ‘সেই ভূমিকম্পের পরবর্তী কম্পনগুলো ৫.৩ মাত্রার বেশি না হওয়ায়, সেগুলো আর বড় সুনামি তৈরির জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না।’

আরও পড়ুন

এখন আসা যাক বাংলাদেশের ভূমিকম্প ও সুনামির বিষয়ে। বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। কারণ ভারতীয়, ইউরেশীয় ও মায়ানমার টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশ। এই প্লেটগুলোর ক্রমাগত নড়াচড়া এবং সংঘর্ষের কারণে বাংলাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত
ছবি: গুগল ম্যাপ

বাংলাদেশে যেসব ভূমিকম্প হয়, তার বেশির ভাগই হয় স্থলভাগে। অর্থাৎ, এই ভূমিকম্পগুলোর উৎপত্তিস্থল সমুদ্রের নিচে নয়, ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি বা মাটির গভীরে। এ কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হওয়া বেশির ভাগ ভূমিকম্পের কারণে সরাসরি সুনামি হয় না।

ভূমিকম্পের পর সুনামি হবে কি না, তা আরেকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ভূমিকম্পের তীব্রতা। ভূমিকম্পের সময় রেকর্ড করা সবচেয়ে বড় কম্পন তরঙ্গের পরিমাপ হলো তীব্রতা।

তবে বাংলাদেশ যেহেতু বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত, তাই ভারত মহাসাগরের তলদেশে বা ইন্দোনেশিয়া-আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশে সুনামির ঝুঁকি থাকে। জাপানের মতো বাংলাদেশে একসঙ্গে ভূমিকম্প ও সুনামি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। জাপানের ইতিহাসে বেশ কয়েকটি বড় সুনামির ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প ও এর ফলে সৃষ্ট সুনামি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, ডিসকভার ম্যাগাজিনে, হাউ স্টাফ ওয়ার্কস

আরও পড়ুন