অ্যান্টার্কটিকার রক্তঝরনা রহস্য! রূপকথা নাকি সত্যি

বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, টেলর হিমবাহের গভীরে প্রায় ৫ মিলিয়ন বছরের পুরনো এক লবণাক্ত পানির নদী আছে

অনেক অনেক দূরে, পৃথিবীর দক্ষিণ প্রান্তে আছে বরফে মোড়ানো এক রাজ্য, নাম অ্যান্টার্কটিকা। এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম মহাদেশ এবং ইউরোপ মহাদেশের তুলনায় ৪০ শতাংশ বড়। সেখানকার দিন মানে ঠান্ডা, আর রাত মানে আরও ঠান্ডা! গাছ নেই, ফুল নেই, নেই পাখিদের কিচিরমিচির। তবু সে রাজ্যে লুকিয়ে আছে এক অবাক করা রহস্য। একদিন কয়েকজন বিজ্ঞানী বরফের মাঝখানে হেঁটে হেঁটে এক আশ্চর্য জায়গায় পৌঁছালেন। হঠাৎ তাঁরা দেখলেন, সাদা বরফের গা বেয়ে নিচের দিকে লাল পানি গড়িয়ে পড়ছে। ঠিক যেন রক্তের মতো দেখতে! তারা বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘আরেহ এটা কী!’ তা আসলে বরফে ঢাকা অ্যান্টার্কটিকার হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা এক বিস্ময়কর প্রাকৃতিক দৃশ্য। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিলেন ব্লাড ফলস বা রক্তের ঝরনা।

রক্তের ঝরনা প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯১১ সালে। অস্ট্রেলিয়ান ভূতত্ত্ববিদ থমাস গ্রিফিথ টেলর এটি আবিষ্কার করেন। তিনি প্রথমে লালচে আস্তরণসহ একটি হিমবাহ আবিষ্কার করেন। তাঁর নামানুসারেই হিমবাহটির নাম রাখা হয় টেলর গ্লেসিয়ার। ব্লাড ফলস মূলত অ্যান্টার্কটিকার টেলর গ্লেসিয়ারের চূড়ায় অবস্থিত রহস্যময় লাল রঙের জলপ্রপাত। এটি টেলর হিমবাহের একটি অংশ থেকে উৎসারিত হয়ে পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার ভিক্টোরিয়া ল্যান্ডের ম্যাকমার্ডো শুষ্ক উপত্যকায় অবস্থিত ওয়েষ্ট লেক বোনির বরফে আবৃত পৃষ্ঠে গিয়ে পড়ে। এই ঝরনাটি যেন কোনো ভূতুড়ে রূপকথার অংশ। সেখানে সাদা বরফের বুক চিরে প্রতিনিয়ত ঝরে পড়ছে রক্তের মতো লাল রঙের পানি।

বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, টেলর হিমবাহের গভীরে প্রায় ৫ মিলিয়ন বছরের পুরনো এক লবণাক্ত পানির নদী আছে। সেই লবণাক্ত পানিতে রয়েছে প্রচুর লোহার কণা। গ্লেসিয়ারের নীচে অনেকদিন ধরে তা আটকে ছিল।

প্রথম দর্শনে মনে হবে যেন বরফে ঢেকে থাকা এক ঘুমন্ত রাজ্যের মাঝে কোনো রাক্ষস ছড়িয়ে দিয়েছে রক্তের বন্যা। কিন্তু এটা সত্যি রক্ত নয়। তাহলে কেন এই রং? প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞানীরা এ লাল রঙের কারণ হিসেবে দায়ী করেন লাল শৈবালকে। এই শৈবালগুলো বরফের নিচে থাকে এবং পানিতে লাল রং ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু পরে এই অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়। বিজ্ঞানীরা পরে খুঁজে পান, পানি এমন লাল হচ্ছে লোহা বা আয়রন অক্সাইডের কারণে!

আরও পড়ুন

বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, টেলর হিমবাহের গভীরে প্রায় ৫ মিলিয়ন বছরের পুরনো এক লবণাক্ত পানির নদী আছে। সেই লবণাক্ত পানিতে রয়েছে প্রচুর লোহার কণা। গ্লেসিয়ারের নীচে অনেকদিন ধরে তা আটকে ছিল। এই রক্তের ঝরনার পানির নমুনায় থাকা কঠিন পদার্থগুলো পরীক্ষা করেন জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, কেন লিভি। তিনি দেখতে পান, এই পানিতে প্রচুর আয়রন-সমৃদ্ধ ন্যানোকণা। অর্থাৎ, অতিক্ষুদ্র গোলাকার কণা রয়েছে।  এই অতিক্ষুদ্র কণাগুলো মানুষের লোহিত রক্তকণিকার চেয়েও ১০০ গুণ ছোট। এগুলোর প্রধান উপাদান হলো লৌহ, সিলিকা, ক্যালসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম এবং সোডিয়াম। বিজ্ঞানী লিয়ন্স এবং তাঁর দল বলেন, হিমবাহের নিচে থাকা উপহ্রদে বসবাসকারী অণুজীবরা আলো-বাতাসহীন কঠিন পরিবেশে বেঁচে থাকে এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে এই আয়রন-সমৃদ্ধ ন্যানোকণা তৈরি করে। হিমবাহের নিচে উচ্চচাপে আটকে থাকা এই কণাগুলো বরফ ফেটে পানির সঙ্গে ওপরে উঠে আসে এবং প্রথম বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে। তখন সেটি বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে এবং লোহার অক্সিডেশন ঘটায়। এর ফলে তৈরি হয় গাঢ় লালচে রঙের একধরনের আয়রন অক্সাইড। তা দেখতে একেবারে রক্তের মতো। রাসায়নিক বিক্রিয়া হলো: 2Fe₃O₄ (black) + ½ O₂ → 3Fe₂O₃ (red)।

অ্যান্টার্কটিকার রক্তের ঝরনা শুধু একটি বিস্ময়কর প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, এটি ভূতত্ত্ব, রসায়ন এবং অণুজীববিজ্ঞানের এক অভূতপূর্ব মিলনস্থল

আরও মজার ব্যাপার হলো, রক্তের ঝরনা শুধু একটি ভৌতিক সৌন্দর্যের নিদর্শনই নয়, বরং এটি বিজ্ঞানীদের কাছে এক রহস্যময় জীবন্ত পরীক্ষাগার। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্লাড ফলসের নিচে অবস্থিত এই লবণাক্ত লালচে পানিতে কিছু অণুজীব (ছোট্ট প্রাণী) লুকিয়ে আছে। গবেষক জিল মিকুকি ও তার সহকর্মীরা পানির নমুনা বিশ্লেষণ করে কমপক্ষে ১৭ প্রকারের অটোট্রফিক ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করেন। সেগুলো চোখে দেখা যায় না! রোদ বা অক্সিজেন ছাড়াই বাঁচতে পারে। পাশাপাশি এরা সূর্যালোক ছাড়াই আয়রন এবং সালফেট দিয়ে নিজের খাবার নিজে তৈরি করে জীবনধারণ করতে পারে।

আরও পড়ুন
রক্তের ঝরনা প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯১১ সালে। অস্ট্রেলিয়ান ভূতত্ত্ববিদ থমাস গ্রিফিথ টেলর এটি আবিষ্কার করেন। তিনি প্রথমে লালচে আস্তরণসহ একটি হিমবাহ আবিষ্কার করেন।

এই গল্প এখানেই শেষ নয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, যদি পৃথিবীর এত কঠিন জায়গায় প্রাণ থাকতে পারে, তাহলে হয়তো অন্য গ্রহেও এমন অদ্ভুত প্রাণী থাকতে পারে। বিশেষ করে মঙ্গল গ্রহ এবং বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ ইউরোপা ও এনসেলাডাসে। সেখানে বরফের নিচে লবণাক্ত পানির অস্তিত্ব থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অ্যান্টার্কটিকার রক্তের ঝরনা শুধু একটি বিস্ময়কর প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, এটি ভূতত্ত্ব, রসায়ন এবং অণুজীববিজ্ঞানের এক অভূতপূর্ব মিলনস্থল। অ্যান্টার্কটিকার এই বরফময় নীরবতা ভেদ করে রক্তরাঙা ঝরনার প্রতিটি ধারা যেন ভবিষ্যতের পৃথিবী ও মহাকাশ গবেষণার দরজাগুলো একটু একটু করে খুলে দিচ্ছে। তাই বরফের দেশে লুকিয়ে আছে রূপকথার মতো এক গল্প। সেখানে রক্তের মতো ঝরনা বয়ে চলে। ছোট ছোট প্রাণীরা লুকিয়ে আছে বরফের নিচে। তা আমাদের চোখে নতুন করে তুলে ধরে পৃথিবীর সৌন্দর্য। রূপকথা শুধু বইতেই থাকে না, প্রকৃতিতেও লুকিয়ে থাকতে পারে! যেমন অ্যান্টার্কটিকার রক্তের ঝরনা।

লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এনআইবি

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি

আরও পড়ুন