সবকিছুর তত্ত্বের খোঁজে
ষাট ও সত্তরের দশক ছিল কণাপদার্থবিদদের স্বর্ণযুগ। সে সময় নিয়মিত বিরতিতে খোঁজ মিলছিল নতুন সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার। এসব কণার অনেকগুলোর মধ্যে বেশ কিছু অদ্ভুতুড়ে বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেন বিজ্ঞানীরা। সেই সঙ্গে খুঁজে পান এদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নিবিড় আন্তসম্পর্ক। তবে ক্রমেই ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কণার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় একরকম ঝামেলায়ই পড়ে যান বিজ্ঞানীরা। কণাদের জগতে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলতা। ফলে কণাদের শ্রেণিবিভাগ করতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েন বিজ্ঞানীরা। জন্ম হয় স্ট্যান্ডার্ড মডেলের। পদার্থবিদেরা নিশ্চিত হন, খুঁজে পাওয়া কণাদের অধিকাংশই আসলে মৌলিক কণা নয়। এদের অধিকাংশই কোয়ার্ক, ইলেকট্রনের মতো সত্যিকারের মৌলিক কণাদের ভিন্ন ভিন্ন সমন্বয়ে তৈরি। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের তথ্যকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা অনাবিষ্কৃত কণাদের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার সক্ষমতা অর্জন করেন। ঠিকঠাক মিলেও যায় সেগুলো। এভাবেই খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তিনটি আপ কোয়ার্কের সমন্বয়ে তৈরি কণা ওমেগা টু প্লাসকে। তবে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের কারিশমা এখানেই শেষ নয়। এর মাধ্যমে কণাদের সঙ্গে সঙ্গে শৃঙ্খলা আসে বলের জগতেও। মহাকর্ষ বাদে বাকি মৌলিক বলগুলো কীভাবে বোসন কণাদের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল থাকে, তা পরিপূর্ণভাবে নির্দেশিত হয়।
মোট চারটি মৌলিক বল প্রকৃতির সব কণার মিথস্ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এরা হলো মহাকর্ষ বল, তড়িৎ চৌম্বক বল, সবল নিউক্লিয়ার বল এবং দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। এই চারটি বলের মধ্যেও নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। যেমন যত উচ্চতর শক্তিঘনত্বে পৌঁছানো যাবে, ততই একই রকম আচরণ করা শুরু করবে তড়িৎ চৌম্বক বল ও দুর্বল বল। একসময় তারা একীভূত হয়ে যাবে, পাওয়া যাবে তড়িৎ দুর্বল বল। এ ঘটনার নাম ইলেকট্রো উইক ইউনিফিকেশন। তবে চাইলেই এমন অবস্থায় পৌঁছানো যাবে না। শেষবার এমনটা হয়েছিল বিগ ব্যাং সংঘটিত হওয়ার সামান্য কিছু সময় পর। পরে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা হওয়ায় আলাদা পথচলা শুরু করে তড়িৎ চৌম্বক বল ও দুর্বল বল। অনেকটা একই রকম ঘটনা ঘটার কথা সবল নিউক্লিয়ার বলের বেলায়ও। এদের একীভূত হয়ে যাওয়ার কথা তড়িৎ দুর্বল বলের সঙ্গে। অর্থাৎ বিগ ব্যাংয়ের পরপর খুব সম্ভবত সব কটি মৌলিক বলই একীভূত অবস্থায় ছিল। এই একীভূত তত্ত্বের নাম দেওয়া হয়েছে ‘গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন থিওরি’। তবে পদার্থবিদেরা এখন পর্যন্ত এর স্বপক্ষে নিশ্চিত প্রমাণ খুঁজে পাননি।
মোট চারটি মৌলিক বল প্রকৃতির সব কণার মিথস্ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এরা হলো মহাকর্ষ বল, তড়িৎ চৌম্বক বল, সবল নিউক্লিয়ার বল এবং দুর্বল নিউক্লিয়ার বল।
২.
মহাবিশ্বের সব কণা ও চারটি মৌলিক বলকে একই ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা প্রত্যেক পদার্থবিদের বহু দিনের লালিত স্বপ্ন। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন ‘থিওরি অব এভরিথিং’। অবশ্য স্বপ্ন পূরণের পথে এখনো খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেননি তাঁরা। কারণটা সহজেই অনুমেয়। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মাধ্যমে কেবল তিনটি মৌলিক বলের সঙ্গে কণাদের মিথস্ক্রিয়ার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। গ্র্যাভিটির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া এখন পর্যন্ত অজানা। এর মধ্যেই বিগত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুতে এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। কোয়ার্কদের ভেতর ক্রমাগত বিনিময় হতে থাকা গ্লুওন কণাদের মিথস্ক্রিয়ার গাণিতিক সমীকরণ নিয়ে কাজ করার সময় তাত্ত্বিক পদার্থবিদেরা অদ্ভুত এক জিনিস লক্ষ করেন। যদি মৌলিক কণাদের কোয়ান্টাম বিন্দুর পরিবর্তে একধরনের কোয়ান্টাম রেখা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে বেশ অদ্ভুতুড়ে ফলাফল পাওয়া যায়।
কোয়ান্টাম রেখাগুলো দুই ধরনের হতে পারে। বদ্ধ প্রান্তবিশিষ্ট অথবা মুক্ত প্রান্তবিশিষ্ট। বদ্ধ প্রান্তের রেখাগুলো তৈরি করতে পারে হরেক রকম আকৃতির ছোট ছোট লুপ। আর মুক্ত প্রান্তের রেখাগুলো আন্দোলিত হতে পারে এদের খোলা অংশ বরাবর। উভয় ধরনের রেখাই যেকোনো কম্পাঙ্কে স্পন্দিত হতে পারে। তাত্ত্বিক পদার্থবিদেরা এসব কোয়ান্টাম রেখার নাম দেন স্ট্রিং।
স্ট্রিং তত্ত্ব অনুসারে, স্ট্রিংগুলো ভিন্ন ভিন্নভাবে কম্পিত হতে পারে। এদের একেক ধরনের স্পন্দনের জন্য পাওয়া যায় একেক ধরনের মৌলিক কণা। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের ওপর ভিত্তি করে এরা কখনো হতে পারে ইলেকট্রন, আবার কখনো হতে পারে ফোটন। হতে পারে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের যেকোনো মৌলিক কণা। এমনকি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক সাপেক্ষে এরা হতে পারে এখন পর্যন্ত খুঁজে না পাওয়া মহাকর্ষ বলবাহী প্রস্তাবিত বোসন কণা গ্র্যাভিটন। এভাবে স্ট্রিংয়ের মাধ্যমে একসুতায় গেঁথে ফেলা সম্ভব মহাবিশ্বের সব কণা এবং চারটি মৌলিক বলকে। ফলে সৃষ্টি হয় বহুল প্রত্যাশিত থিওরি অব এভরিথিং খুঁজে পাওয়ার অমিত সম্ভাবনার।
বদ্ধ প্রান্তের রেখাগুলো তৈরি করতে পারে হরেক রকম আকৃতির ছোট ছোট লুপ। আর মুক্ত প্রান্তের রেখাগুলো আন্দোলিত হতে পারে এদের খোলা অংশ বরাবর।
৩.
স্ট্রিং তত্ত্ব প্রচণ্ড সম্ভাবনাময় হলেও এর ভেতর লুকিয়ে আছে বিশাল এক শর্ত। এই তত্ত্ব কাজ করতে হলে স্থান-কালকে অবশ্যই হতে হবে দশ মাত্রিক!১ এর কম হলে চলবে না, আবার বেশি হলেও না। দশটি মাত্রার মধ্যে একটি মাত্রা হবে সময়ের এবং বাকি নয়টি নির্দেশ করবে স্থানকে। অথচ এমন শর্ত আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে একদম মেলে না। আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বে স্থান-কাল চতুর্মাত্রিক। একটি মাত্রা নির্দেশ করে সময়কে এবং বাকি তিনটি স্থানকে। তাহলে কি স্ট্রিং তত্ত্ব ভুল?
বেশ কিছু ক্ষেত্রে স্ট্রিং তত্ত্ব এত নিখুঁত কাজ করে যে চট করে একে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া খুব কঠিন। এমনকি ১০টি মাত্রার মতো প্রায় অসম্ভব শর্ত থাকার পরও। তাই পদার্থবিদেরা হাল ছাড়লেন না। ১০টি মাত্রাসহই পথ খুঁজতে থাকলেন তত্ত্বটিকে বাঁচানোর। একসময় খুঁজে পাওয়া গেল সম্ভাব্য এক সমাধান। সেটি অনুসারে, স্ট্রিং তত্ত্বের বাড়তি মাত্রাগুলোকে হতে হবে খুব ছোট। খালি চোখে দেখতে না পাওয়ার মতো ছোট। এমনটা হলে বাড়তি মাত্রার অস্তিত্ব থাকলেও কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, তারা লুকিয়ে থাকবে লোকচক্ষুর অন্তরালে।
বাড়তি মাত্রাগুলো কীভাবে লুকিয়ে থাকতে পারে, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বাগানে পানি দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা লম্বা পাইপগুলো দেখেছেন কখনো? সেগুলো দেখতে অনেকটা লম্বা টিউবের মতো। ধরুন তেমনি একটি পাইপের ভেতর ছোট্ট একটি পিঁপড়া ঢুকে বসে আছে। পাইপের ভেতর পিঁপড়াটি দুটো অভিমুখে চলাচল করতে পারে। এক, হয় পাইপের দৈর্ঘ্য বরাবর সোজা সামনের দিকে, অথবা পাইপের পরিধি বরাবর চারপাশে। বুঝতে অসুবিধা হলে নিচের ছবিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। মোট কথা, পিঁপড়ার কাছে পাইপটি দ্বিমাত্রিক হিসেবে ধরা দেবে। এবার চিন্তা করুন, প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন কেউ একজন অনেক দূর থেকে এই পাইপকে দেখতে পেলেন। তার কাছে পাইপটির আকৃতির কেমন মনে হবে? নিঃসন্দেহে শুধু একটি রেখার মতো। দূরত্বের কারণে পাইপের প্রস্থ বরাবর অংশটি তার কাছে অদৃশ্য থাকবে। ফলে সামগ্রিকভাবে পাইপটিকে একমাত্রিক মনে হবে তার।
দূরত্বের কারণে পাইপের ভেতর লুকিয়ে থাকা মাত্রা
ওপরের উদাহরণে দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠবিশিষ্ট পাইপের একটি মাত্রা অন্যটির চেয়ে অপেক্ষাকৃত বড়। যদি সূক্ষ্মভাবে দেখার সক্ষমতা না থাকে, তাহলে দৃশ্যমান হবে কেবল বৃহৎ মাত্রাটি। আড়ালে থেকে যাবে ক্ষুদ্র মাত্রার অস্তিত্ব। ঠিক এভাবেই স্ট্রিং তত্ত্বের বাড়তি মাত্রাগুলো ব্যাখ্যা করেন পদার্থবিদেরা। স্থানের ৯টি মাত্রার মধ্যে কেবল ৩টি আকারে বড় হওয়ায় আমাদের কাছে দৃশ্যমান। বাকিগুলো এত ছোট যে আমাদের চোখের সামনে থেকেও অদৃশ্য। আর সে জন্য দশমাত্রিক মহাবিশ্বকে আমরা চতুর্মাত্রিক হিসেবে দেখি।
স্ট্রিং তত্ত্ব প্রচণ্ড সম্ভাবনাময় হলেও এর ভেতর লুকিয়ে আছে বিশাল এক শর্ত। এই তত্ত্ব কাজ করতে হলে স্থান-কালকে অবশ্যই হতে হবে দশ মাত্রিক!১ এর কম হলে চলবে না, আবার বেশি হলেও না।
৪.
ঠিক কতটুকু ক্ষুদ্রাকৃতির হতে পারে বাড়তি মাত্রাগুলো? অনেক পদার্থবিদের মতে, এদের আকার হতে পারে প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্যের কাছাকাছি। অর্থাৎ প্রায় ১০-৩৫ মিটারের কাছাকাছি! এত ক্ষুদ্র মাত্রায় বিচরণ করতে হলে কণাদের অচিন্ত্যনীয় শক্তিসম্পন্ন হতে হবে। তাই আমাদের বর্তমান প্রযুক্তির কণাত্বরক যন্ত্রে বাড়তি মাত্রার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। অবশ্য সব পদার্থবিদ এমন ধারণার সঙ্গে একমত নন। তাঁদের মতে, বাড়তি মাত্রারা পরমাণুর আকারের তুলনায় অনেক ছোট হলেও প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্যের মতো এতখানি ছোট হবে না।
স্ট্রিং থিওরির বাড়তি মাত্রাগুলো আরেকটি বড় ধরনের ঝামেলা তৈরি করে। যদি ক্ষুদ্রাকৃতির বাড়তি মাত্রার সংখ্যা মাত্র একটি হতো, তাহলে কেবল একটি উপায়ে সেটি লুকিয়ে থাকতে পারত। যেমনটা আমরা দেখেছি পাইপের উদাহরণে। কিন্তু বাড়তি মাত্রার সংখ্যা ছয়টি হলে বিকল্প সম্ভাবনার সংখ্যা হবে অগণিত। এই সাংখ্যিক মান দেখলে যে কারও পিলে চমকে যাবে। বাড়তি ছয়টি মাত্রা ১০৫০০ টিরও বেশি ভিন্ন উপায়ে লুকিয়ে থাকতে পারে। আর প্রতিটি সম্ভাবনার জন্য সম্পূর্ণ আলাদাভাবে তৈরি হবে মহাবিশ্ব। থাকবে ভিন্ন ধরনের কণাদের অস্তিত্ব। এই অগণিত সম্ভাবনার মধ্যে হয়তো যেকোনো একটি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবে আমাদের মহাবিশ্বকে। আবার না–ও করতে পারে। কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়। হয়তো সুদূর ভবিষ্যতে পদার্থবিদেরা স্ট্রিং থিওরির রহস্য ভেদ করতে পারবেন। তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ত্রিশ বছর আগে স্ট্রিং থিওরি যেখানে ছিল, বর্তমানেও প্রায় সেখানেই আছে। খুব একটা বেশি দূরে এগোতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।