বস্তুর মৌলিক কণা আসলে কী

বস্তুর মৌলিক কণা আসলে কী? ১৭টি মৌলিক কণার কথা জানি আমরা, অথচ এর মধ্যে ৯টি কী কাজে লাগে, কেউ জানে না। মৌলিক কণাদের পরিচয়, তারা কী কাজে লাগে, আমরা কত দূর জানি…

ধরা যাক, কোনো এক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে গেল মানবসভ্যতা। নিমেষেই হারিয়ে গেল এতকাল ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা আমাদের সব জ্ঞান, গরিমা। তবে তার আগে পাওয়া গেল বিশেষ এক সুযোগ। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ছোট্ট একটি বাক্য লিখে রেখে যেতে পারব আমরা। কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য। তাহলে কোন তথ্য বা বাক্যটা রেখে যাওয়া উচিত? সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়েই হয়তো একদিন সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের ওপর আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে পরের প্রজন্ম। কী হবে সেই তথ্য? কোন বাক্য?

উত্তরটা দিয়েছিলেন মার্কিন পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান। তাঁর মতে, সেই তথ্য হওয়া উচিত পারমাণবিক তত্ত্ব নিয়ে, মানে ‘সবকিছু পরমাণু দিয়ে তৈরি’। বাক্যটা ছোট, কিন্তু এতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ তথ্য। সেটা বোঝার জন্য দরকার একটুখানি কল্পনা আর চিন্তাশক্তি। মোটাদাগে বললে, পরমাণু তথা বস্তুজগৎ সম্পর্কে আজ আমাদের প্রায় কোনো কিছুই জানা বাকি নেই। এই জ্ঞান অর্জন করতে মানবজাতিকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। নিঃসন্দেহে তার শুরুটা হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিককালে।

আদিমকালের কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। তবু ধরে নেওয়া যায়, সেকালেও বিজ্ঞানী ছিলেন। নিঃসন্দেহে অন্য আর সব জ্ঞান অনুসন্ধানের মতো বস্তুকণা নিয়েও চিন্তাভাবনার শুরু হয় সে যুগে। আদিম গুহাবাসী পদার্থবিদদেরও পৃথিবী, আকাশ-বাতাস কিংবা মহাবিশ্ব নিয়ে নিজস্ব ধারণা ছিল। হোক সেটা আদিম পর্যায়ের কিংবা ভুল। তবু ছিল। মহাবিশ্ব কী দিয়ে তৈরি, এমন প্রশ্নে তাঁরা হয়তো পারিপার্শ্বিক একগাদা বস্তুর তালিকা হাতে ধরিয়ে দিতেন। তার মধ্যে তাঁদের হাতের পাথুরে অস্ত্র থেকে শুরু করে গাছপালা, পাহাড়-নদী বা গৃহপালিত পশুপাখিও বাদ যেত না। কিন্তু সেটা অসম্পূর্ণ চিত্র। কারণ, এর মাধ্যমে কোনো মৌলিক বা অন্তর্জ্ঞানমূলক ধারণা পাওয়া যায় না। লিখিত ইতিহাস অনুযায়ী প্রাচীন গ্রিক পণ্ডিতদের ধারণা ছিল, মহাবিশ্ব পানি, মাটি, বাতাস ও আগুন দিয়ে তৈরি। আর ভারতের পণ্ডিতেরা বলতেন পঞ্চভূতের কথা। তাঁদের ধারণা ছিল, ক্ষিতি, অপ, তেজঃ, মরুৎ, ব্যোম—এই পাঁচ মৌলিক পদার্থ দিয়ে মহাবিশ্বের সবকিছু গঠিত। এখন আমরা জানি, এই দুই সভ্যতার পণ্ডিতদের ধারণাও ভুল। তবে এটুকু বলা যায়, মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যার জন্য সহজ একটা পথে হাঁটার চেষ্টা অন্তত তাঁরা করেছিলেন।

আপ, ডাউন, চার্ম, স্ট্রেঞ্জ, টপ ও বটম কোয়ার্ক। অন্যদিকে লেপটনের মধ্যে রয়েছে ইলেকট্রন, ইলেকট্রন-নিউট্রিনো, মিওয়ন-নিউট্রিনো, টাউ-নিউট্রিনো, মিওয়ন এবং টাউ

আরও পরে আমরা মৌলের ধারণা পেলাম। তখন ভাবা হতো ইট, কাঠ, বালু, পাথর, পানিসহ পৃথিবীর সবকিছুই পরমাণু নামক অবিভাজ্য কণা দিয়ে গঠিত। এ ধারণাও গ্রিক পণ্ডিতদের কাছ থেকে পাওয়া। বস্তুর সবচেয়ে ছোট একক হিসেবে ‘অ্যাটম’ নামে একটি কণা কল্পনা করেছিলেন গ্রিকরা। তাঁদের কল্পনায় অ্যাটম ছিল অবিভাজ্য। অবশ্য গ্রিকদের পরমাণুর ধারণা আর আধুনিক পরমাণুর ধারণার মধ্যে তফাত আকাশ-পাতাল। প্রায় সমসাময়িক কালে ভারতীয় পণ্ডিতেরাও বস্তুর ক্ষুদ্রতম একককে বললেন ‘পরমাণু’। দীর্ঘ বিরতির পর উনিশ শতকের দিকে ধারণাটা আবারও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তত দিনে বেশ কিছু মৌলিক পদার্থ আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কিছু প্যাটার্ন খেয়াল করেন বিজ্ঞানীরা। এভাবে মৌলগুলোকে প্যাটার্ন অনুযায়ী সাজিয়ে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী নিজের মতো করে পর্যায় সারণি বানানোর চেষ্টা করেন। তাঁদের মধ্যে রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণি কয়েকটি কারণে জনপ্রিয় হয়। সেটা দেখতে অনেকটা ১ নম্বর ছবির মতো। ছবিটা একটু খেয়াল করলে কিছু মজার ব্যাপার ধরা পড়বে।

আরও পড়ুন
বস্তুর সবচেয়ে ছোট একক হিসেবে ‘অ্যাটম’ নামে একটি কণা কল্পনা করেছিলেন গ্রিকরা। তাঁদের কল্পনায় অ্যাটম ছিল অবিভাজ্য।

১ নম্বর ছবিতে দেখা যাবে, সারণির এক পাশের মৌলগুলো খুবই সক্রিয়। অন্য পাশের মৌলগুলো একেবারে নিষ্ক্রিয়। আবার বিভিন্ন গ্রুপের পাশ্ব৴বর্তী মৌলগুলোর ধর্মে বেশ মিল পাওয়া যায়। কিন্তু এই পর্যায় সারণি দেখে বিজ্ঞানীরা একসময় বুঝতে পারলেন, তাঁরা কিছুতেই মহাবিশ্বের মৌলিক বিবরণ হতে পারে না। অবশ্যই এর চেয়ে গভীর কোনো ব্যাপার রয়েছে।

কোনো পরিবারে ভাইবোনদের কথা ধরা যাক। তাদের প্রত্যেকের সত্তা আলাদা। কিন্তু তাদের সাধারণ কিছু দোষ-গুণ থাকে। থাকে অমিলও। তবু দুজনকে দেখলে বোঝা যায়, তারা একই মাতা-পিতার সন্তান। কারণ, তাদের চেহারা বা আচার-আচরণে সেটা প্রকাশ পায়। একইভাবে পর্যায় সারণির মৌলগুলোর প্যাটার্ন ভালোমতো খেয়াল করে একদিন ভ্রু কুঁচকে গেল বিজ্ঞানীদের। অনেক চেষ্টায়ও একটা হিসাব মেলানো গেল না। প্রশ্নও উঠল, তাঁরা কি প্রকৃতির কোনো একটা কিছু বুঝতে পারছেন না? কিছু কি বাদ পড়ে গেল?

সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রকৃতির মৌলিক কিছু দিক আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। এভাবেই বিশ শতকের গোড়ায় পরমাণুর ধারণা আমূল পাল্টে গেল। এ সময় কণাপদার্থবিজ্ঞানীরা পরমাণুর একেবারে গহিনে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। তখন জানা গেল, গ্রিকদের ধারণার মতো পরমাণু আসলে অবিভাজ্য নয়। পরমাণুকেও ভাঙা সম্ভব। একে একে আবিষ্কৃত হলো পরমাণুর ভেতরের ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন কণা। অতি পারমাণবিক এসব কণা দিয়ে গঠিত হয় একেকটি পরমাণু। সেগুলো দেখে বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, প্রোটন ও নিউট্রন হলো বস্তুর মৌলিক কণা।

এখন আমরা জানি, পর্যায় সারণির এ রকম হওয়ার কারণ পরমাণুতে ইলেকট্রনের কক্ষপথের সজ্জা। এ সারণির প্রতিটি ঘরে একটা করে মৌল রয়েছে। এসব মৌলের কোনো কোনোটা অন্যগুলোর তুলনায় বেশ বিরল। সেগুলোর তেজস্ক্রিয় ক্ষয়প্রক্রিয়া এর পেছনে দায়ী। তবে নির্দিষ্টসংখ্যক প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন একত্র করে তাত্ত্বিকভাবে প্রতিটি মৌল পাওয়া সম্ভব।

কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক মিলছিল না। বিজ্ঞানীরা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে লাগলেন। নতুন নতুন অতিপারমাণবিক কণা আবিষ্কৃত হতে লাগল। অচিরেই আরেক দফা পরিবর্তনের হাওয়া লাগল কণার ধারণায়। ১৯৬৪ সালে জানা গেল, প্রোটন আর নিউট্রনই শেষ কথা নয়, আরও ছোট কণা আছে। এগুলো ভেঙে আরও ছোট মৌলিক কণা পাওয়া যায়। অতি ক্ষুদ্র এসব কণার নাম দেওয়া হলো কোয়ার্ক।

কণাগুলোর প্রজন্মের মধ্যকার প্যাটার্ন

কোয়ার্ক মডেলের প্রস্তাব দেন মার্কিন পদার্থবিদ মারে গেল-মান। একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বস্তুর মৌলিক কণা হিসেবে প্রমাণিত হলো কোয়ার্ক। এখন পর্যন্ত কণা পদার্থবিজ্ঞানে মোট ১২টি বস্তুকণা আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর ছয়টি কোয়ার্ক ও ছয়টি লেপটন। কোয়ার্ক ছয় ধরনের, যেগুলোকে ফ্লেভার বলা হয়। সেগুলো হলো আপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ, চার্ম, বটম ও টপ। অন্যদিকে লেপটনের মধ্যে রয়েছে ইলেকট্রন, ইলেকট্রন-নিউট্রিনো, মিওয়ন, মিওয়ন-নিউট্রিনো, টাউ এবং টাউ-নিউট্রিনো। এ ছাড়া আছে আরও পাঁচটি কণা। এর মধ্যে গ্লুয়ন, ফোটন, জেড-বোসন, ডব্লিউ-বোসন বলবাহী কণা। আর আছে হিগস বোসন, যার কাজ কণাগুলোর ভর জোগানো। সব মিলে মৌলিক কণার সংখ্যা ১৭।

আরও পড়ুন
১৯৬৪ সালে জানা গেল, প্রোটন আর নিউট্রনই শেষ কথা নয়, আরও ছোট কণা আছে। এগুলো ভেঙে আরও ছোট মৌলিক কণা পাওয়া যায়। অতি ক্ষুদ্র এসব কণার নাম দেওয়া হলো কোয়ার্ক।

প্রায় ১০০ বছর ধরে বিশেষ পদ্ধতিতে পরমাণু ভেঙে যে ১২টি বস্তুকণা পাওয়া গেছে, সেগুলোকে একটা তালিকায় সাজিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তালিকাটা দেখতে অনেকটা ওপরের ছবির মতো।

মজাটা এখানেই। দেখতেই পাচ্ছেন মৌলিক কণার সংখ্যা ডজনখানেক। কিন্তু আমাদের পরিচিত বস্তু তৈরির জন্য মাত্রটি তিনটি কণাই যথেষ্ট। সেগুলো হলো আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক এবং ইলেকট্রন (লেপটন কণা)। পরমাণুর কেন্দ্রীয় অংশের প্রোটন তৈরিতে দুটি আপ কোয়ার্ক আর একটি ডাউন কোয়ার্ক লাগে। অন্যদিকে দুটি ডাউন কোয়ার্ক আর একটা আপ কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত হয় নিউট্রন। কাজেই যেকোনো পরমাণু তৈরি করতে দুটি কোয়ার্ক ও একটা লেপটনই যথেষ্ট। এই পরমাণু দিয়ে গঠিত হয় বিভিন্ন অণু। আর বিভিন্ন অণু দিয়ে গঠিত হয় আমাদের দৈনন্দিন জটিল সব বস্তু। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, বাকি ৯টি মৌলিক কণার (৪টি কোয়ার্ক ও ৫টি লেপটন) দরকারটা কী?

এর উত্তরটা মজার নাকি রহস্যময়, সে–ও আরেক প্রশ্ন। কারণ, এর কোনো জবাব আধুনিক, অত্যাধুনিক বা উত্তরাধুনিক বিজ্ঞানের কাছে নেই। এটা এখন বড় এক অমীমাংসিত ও অস্বস্তিকর ধাঁধার মতো ঝুলে আছে বিজ্ঞানীদের মাথায়।

মৌলিক কণার ভরের তালিকা

বিষয়টা আরেকটু সহজ করি। ধরুন, আপনি একটা কেক বানাতে চান। সে জন্য এক কেক বিশেষজ্ঞ আপনাকে ১২টি উপকরণ এবং রেসিপি দিলেন। রেসিপি অনুযায়ী কেক বানিয়ে, সেটা বেক করে, সাজসজ্জা দিয়ে খেয়েদেয়ে শেষও করে ফেললেন। খাবার পর তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, বিশেষজ্ঞের দেওয়া উপকরণগুলোর মধ্যে মাত্র তিনটি দিয়েই কেকটা বানিয়েছেন আপনি। বাকি ৯টি উপকরণ কোনো কাজেই লাগেনি। সেগুলো স্রেফ পড়ে রয়েছে। তাহলে ঘটনা কী দাঁড়াল? কোনো কাজেই যদি না লাগল, কেক বিশেষজ্ঞ ওসব উপকরণ পাঠালেন কেন? ধাঁধার এখানেই শেষ নয়। আরও আছে।

গত দুই হাজার বছরের প্রচেষ্টায় তিলে তিলে বস্তুজগৎ সম্পর্কে প্রায় অনেক কিছুই জানতে পেরেছেন পদার্থবিদেরা। সেকালের জ্ঞানকে সংঘবদ্ধ করে এবং তা নিয়ে সতর্কভাবে গবেষণা করে সেটা সম্ভব হয়েছে। এভাবে একসময় কণাজগতের একটা নিদিষ্ট প্যাটার্ন আবিষ্কৃত হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, এতে কোন কোন টুকরা অনুপস্থিত, তা–ও আন্দাজ করা গেল। এর মাধ্যমে সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে এবং মহাবিশ্ব কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি করতে পারেন বিজ্ঞানীরা।

মৌলিক পদার্থের কণাগুলোর (কোয়ার্ক, লেপটনসহ) তালিকাকে একত্রে সাজাতে বিশ শতকের প্রায় পুরোটা সময় লেগে গেছে। এখন এসব কণাকে বলা হয় মৌলিক। ইংরেজিতে বলে ফান্ডামেন্টাল (Fundamental)। ইংরেজি শব্দটির মধ্যে ‘ফান’ রয়েছে। কণাগুলো খুব ফানি বা মজার বলে এমন নামকরণ করা হয়েছে ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। এগুলো আরও ছোট কোনো কণা দিয়ে তৈরি কি না, তা আমরা জানি না। অর্থাৎ কোয়ার্ক বা লেপটনকে আদৌ ভাঙা সম্ভব কি না, তা-ও কারও জানা নেই। আবার এরাই মহাবিশ্বের মৌলিক কণার একক কি না, নেই তারও কোনো প্রমাণ। কিন্তু এখন পর্যন্ত এরাই আমাদের জানা সবচেয়ে ক্ষুদ্র কণা।

আরও পড়ুন
পরমাণুর কেন্দ্রীয় অংশের প্রোটন তৈরিতে দুটি আপ কোয়ার্ক আর একটি ডাউন কোয়ার্ক লাগে। অন্যদিকে দুটি ডাউন কোয়ার্ক আর একটা আপ কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত হয় নিউট্রন।

কণার তালিকায় নজর বোলালে কিছু মজার প্যাটার্ন চোখে পড়তে পারে। প্রথমত, এখানে দেখা যাচ্ছে দুই ধরনের বস্তুকণা রয়েছে। কোয়ার্ক ও লেপটন। আমরা জানি, তারা আলাদা। কারণ, কোয়ার্ক শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল অনুভব করে। কিন্তু এ বলকে তোয়াক্কা করে না লেপটন। আমাদের চারপাশের দৈনন্দিন বস্তুগুলো যেসব কণা দিয়ে তৈরি, তার সব কটি রয়েছে প্রথম কলামে। আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক ও ইলেকট্রন। প্রথম কলামে রয়েছে আরেকটি কণা—ইলেকট্রন-নিউট্রিনো। মহাবিশ্বের ভেতর এর গতি অনেকটাই ভুতুড়ে। কারণ, এগুলো প্রায় কারও সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে না। প্রতি সেকেন্ডে আমাদের দেহের ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন ইলেকট্রন-নিউট্রিনো। কিন্তু তার কিছুই আমরা বুঝতে পারছি না।

এই চারটি কণা ছাড়া আরও কণা রয়েছে। সেগুলোর জন্যও আলাদা আলাদা কলাম রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, এ দুটি কলামও প্রায় প্রথম কলামের মতোই। এগুলোর চার্জ ও বলের মিথস্ক্রিয়া প্রায় একই রকম। ব্যতিক্রম শুধু সেগুলোর ভর। প্রতিটি কলামকে বলা হয় একেকটি জেনারেশন বা প্রজন্ম। এ পর্যন্ত এ রকম তিনটি প্রজন্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। কণাগুলোর এই তালিকা দেখে প্রশ্ন আসতে পারে, এসব কণার কাজ কী? এগুলোর ভরের মধ্যে কি বিশেষ কোনো প্যাটার্ন আছে? ১/৩ বৈদ্যুতিক চার্জ কেন? এ রকম আরও কোনো কণার অস্তিত্ব আছে কি?

এখন এসব কণা কিসের জন্য—সেই প্রশ্ন নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। আমরা অন্তত একটা বিষয় জানি, কণাগুলোর তিনটি প্রজন্ম আছে। ২০১২ সালে হিগস-বোসন কণার আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে চতুর্থ প্রজন্মের কণার অস্তিত্ব থাকার প্রশ্নটি বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু এর মানে আসলে কী? তিন কি মহাবিশ্বের কোনো মৌলিক সংখ্যা? এ ব্যাপারে আসলে আমরা কিছুই জানি না। কিছু ধর্মের কাছে তিন বেশ গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। কিন্তু গণিতবিদ বা তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীদের কাছে তা নয়। তার চেয়ে শূন্য, এক, পাই (π) এবং ই (e) তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে এই তিন প্রজন্মের অর্থ কী? এর মধ্যে বিশেষ কোনো তাৎপর্য এখনো খুঁজে পাননি বিজ্ঞানীরা। কণাগুলোর প্রজন্ম নিয়েও নেই কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা। এমনও হতে পারে, প্রকৃতির গভীর কোনো নিয়মের বহিঃপ্রকাশ এটি। অনেকটা মৌলের পর্যায় সারণির কোনো প্যাটার্নের মতো। আজ থেকে শত শত বছর পরের বিজ্ঞানীরা হয়তো ভাববেন, আমাদের ঠিক চোখের সামনেই এর সূত্র ঝুলে ছিল। কিন্তু আমরা তা দেখতে পাইনি। সে কারণে এটি এখনো এক রহস্য। ভালো কথা, আপনার কাছে যদি এর কোনো ভালো ব্যাখ্যা থাকে, তাহলে অতিসত্বর স্থানীয় কণাপদার্থবিদের দরজায় ঠকঠক করার অনুরোধ রইল।

এবার আসা যাক কণাগুলোর ভরের প্যাটার্নের কথায়। মৌলিক পদার্থের পর্যায় সারণিতে পরমাণুর ভরের কারণে যে প্যাটার্ন পাওয়া যায়, তা থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাওয়া যায়। ভরের প্যাটার্ন থেকে অনুমান করা যায়, প্রতিটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নির্দিষ্টসংখ্যক প্রোটন ও নিউট্রন থাকে। (পারমাণবিক সংখ্যা—নিউক্লিয়াসের ধনাত্মক চার্জ বা প্রোটন সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা হয়। আর ভর সংখ্যা—প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা হয়।)

আরও পড়ুন
পারমাণবিক সংখ্যা—নিউক্লিয়াসের ধনাত্মক চার্জ বা প্রোটন সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা হয়। আর ভর সংখ্যা—প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা হয়।

কিন্তু এসব মৌলিক কণার ভরে কোনো প্যাটার্ন পাওয়া যায়নি। নিচের ছবিতে প্রতিটি কণার ভরের মান দেওয়া হয়েছে। এদের সাধারণ প্রবণতা হলো, উচ্চতর প্রজন্মের ভর তুলনামূলক বেশি। কিন্তু এসব মানের মধ্যে আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি না, আমরা জানি না। তালিকায় সবচেয়ে ভারী টপ কোয়ার্কের দিকে তাকান। এর ভর ১৭৫টি প্রোটনের ভরের সমান। অর্থাৎ একটা স্বর্ণপরমাণুর নিউক্লিয়াসের প্রায় সমান। কিন্তু কেন? আমরা জানি না।

১/৩ বৈদ্যুতিক চার্জ নিয়ে এবার দু-চারটি কথা বলা যাক। কোয়ার্কগুলো শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল অনুভব করে। এগুলোর বৈদ্যুতিক চার্জও বিদঘুটে। পূর্ণ সংখ্যা নয়, ভগ্নাংশ (+২/৩ ও -১/৩)। যদি আপ ও ডাউন কোয়ার্কগুলোকে ঠিকভাবে একসঙ্গে ঘুঁটে দিতে পারেন, তাহলে আপনি প্রোটন ও নিউট্রন বানাতে পারবেন। প্রোটন বানাতে লাগবে দুটি আপ ও একটা ডাউন কোয়ার্ক। এগুলোর চার্জ হবে ২/৩+২/৩-১/৩=+১। আর নিউট্রিন বানাতে লাগবে একটি আপ ও দুটি ডাউন কোয়ার্ক। এগুলোর চার্জ হবে ২/৩-১/৩-১/৩=০। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সৌভাগ্যেরও বটে। কারণ, ইলেকট্রনের চার্জ শুধু -১ হতে পারে। কোয়ার্কের চার্জ যদি এর চেয়ে বেশি বা কম হতো, তাহলে তা ইলেকট্রনের ঋণাত্মক চার্জকে পুরোপুরি বাতিল করতে পারত না। তাতে স্থিতিশীল চার্জনিরপেক্ষ পরমাণুও গঠিত হতে পারত না কখনো। আর সুষম -১/৩ ও +২/৩ চার্জ না থাকলে এই মহাবিশ্বে আমাদের অস্তিত্বই থাকত না। কোনো রসায়ন, জীববিদ্যা, প্রাণ বা বুদ্ধিমত্তা বলতে থাকত না কিছুই।

বর্তমান তত্ত্ব অনুসারে কণাগুলোর চার্জ ইচ্ছেমতো যা কিছু হতে পারে। তত্ত্বটি কণাগুলোর যেকোনো চার্জে মানের সঙ্গেই বেশ ভালোভাবে কাজ করে। আমাদের জানামতে, এসব চার্জ সুষমভাবে পরস্পরের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে। একে কাকতালীয় ঘটনা বলা যায়?

মৌলিক কণার মধ্যে প্রোটন ও ইলেকট্রনের চার্জ হুবহু একই, কিন্তু বিপরীতধর্মী। তবে এর কারণটা কী, তা কেউ জানে না। এ সম্পর্কে সেরা তত্ত্বটি অনুসারে, এই চার্জের মান যেকোনো কিছুই হতে পারে। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে এরা সুষমভাবে বাতিল করতে পারে পরস্পরের চার্জকে। ইলেকট্রন ও কোয়ার্কের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপারে এর মানে কী? তার উত্তর আমাদের কাছে নেই।

হুবহু একই, কিন্তু বিপরীত বৈদ্যুতিক চার্জ এসব কণার ভেতর লুকিয়ে থাকা গভীর কিছুর ইঙ্গিতও হতে পারে। কিংবা কে জানে, এই দুই ধরনের কণা আসলে একই মুদ্রার দুই পিঠ অথবা আরও ছোট কোনো কণার টুকরা থেকে গঠিত হয়েছে।

প্রশ্ন আসে, মৌলিক কণার তালিকা কি সম্পূর্ণ? আর কোনো কণার অস্তিত্ব কি আছে? আগের তালিকায় আমরা ১২টি বস্তুকণা দেখেছি (প্রতিকণাগুলোকে হিসাবে রাখা হয়নি)। এর ছয়টি কোয়ার্ক ও ছয়টি লেপটন। এ ছাড়া আরও কণা আছে, যেগুলো বলবাহী। যেমন বিদ্যুৎচৌম্বকীয় মিথস্ক্রিয়া পরিবাহিত হয় ফোটনের মাধ্যমে। দুটি ইলেকট্রন যখন একে অন্যকে বিকর্ষণ করে, তারা আসলে ফোটন বিনিময় করে। গাণিতিকভাবে সঠিক না হলেও আপনি ভেবে নিতে পারেন, একটা ইলেকট্রন ফোটন ছুড়ে আরেকটিকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। বলবাহী কণা পাঁচটি। ফোটন ছাড়া রয়েছে ডব্লিউ ও জেড বোসন, যারা দুর্বল নিউক্লিয়ার বল বহন করে। রয়েছে গ্লুয়ন, যারা শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের বাহক। এ ছাড়া আছে হিগস–বোসন, যারা হিগস ফিল্ডের বলবাহী। সেগুলো নিচের তালিকায় দেখে নিন।

আগের তালিকার ১২টি বস্তুকণার সঙ্গে এই তালিকা একত্র করলে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত কণার পরিপূর্ণ তালিকা পাওয়া যাবে। কিন্তু এটাই আসলে পরিপূর্ণ তালিকা কি না, তা অনিশ্চিত। কারণ, তাত্ত্বিকভাবে কণার সংখ্যার কোনো সীমা নেই। তাই মোট কণা ১৭টিও হতে পারে, আবার ১০০, ১০০০ কিংবা ১০ লাখও হতে পারে। আমরা জানি, কোয়ার্ক ও লেপটনের এই তিনটির বেশি আর কোনো প্রজন্ম নেই। কিন্তু অন্য কোনো ধরনের কণার অস্তিত্ব থাকাটা অসম্ভব নয়। সেটা সত্যি হলে সেগুলোর সংখ্যা কত হবে? আমরা তার কিছুই জানি না।

আরও পড়ুন
তাত্ত্বিকভাবে কণার সংখ্যার কোনো সীমা নেই। তাই মোট কণা ১৭টিও হতে পারে, আবার ১০০, ১০০০ কিংবা ১০ লাখও হতে পারে।

এসব কণার অস্তিত্ব থাকার কারণ কী? কিছু কণা বেশ কাজের। সেগুলো দিয়েই গঠিত হয়েছে বাড়িগাড়ি, ঘরদোর, বইখাতা, ফোনসহ দৈনন্দিন সব কিছু। কিন্তু বাকিগুলোর কাজ কী?

এমনও হতে পারে, এসব কণাই মহাবিশ্বের সবচেয়ে মৌলিক পদার্থ। হয়তো কণার সংখ্যা এমন হওয়ার পেছনে বিশেষ কোনো কারণ নেই। কিংবা হয়তো আরও মহাবিশ্ব আছে, যেখানে এ রকম ভিন্ন ভিন্ন কণা রয়েছে। কিন্তু সেটা দেখা বা প্রমাণের জন্য আমরা কখনো সেখানে যেতে পারব না। কিংবা কণাগুলো হয়তো মহাবিশ্বের সবচেয়ে মৌলিক কণা নয়। সেগুলো হয়তো আরও সরল ও ছোট কোনো কণা দিয়ে গঠিত। আমরা হয়তো সেসব সরল কণা এখনো আবিষ্কার করতে পারিনি। কথাটা সত্য হোক বা মিথ্যা, এর কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।

মানুষের জ্ঞানের গরিমা সারশূন্য হয়ে যায় ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জির প্রসঙ্গ এলে। অনেকেই জানেন, মহাবিশ্বের সিংহভাগ গঠিত রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি দিয়ে, বাংলায় যাকে বলে গুপ্ত বস্তু ও গুপ্ত শক্তি। মাত্র চার ভাগের মতো আমাদের চেনা কণা দিয়ে তৈরি। মহাবিশ্ব সম্পর্কে তাই আমাদের জ্ঞান মাত্র চার ভাগ। বাকি সিংহভাগ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। পুরোপুরি অন্ধকারে মানুষ। এতক্ষণ যে বস্তুকণার কথা বললাম, সেগুলো এই চার ভাগের মধ্যে পড়ে। মহাবিশ্বের এই যে চার ভাগের সঙ্গে আমরা পরিচিত, এটুকু সম্পর্কে অনেক কিছুই আমরা এখনো জানার ও বোঝার চেষ্টা করছি। এ–সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েও এখনো সঠিক উত্তরগুলো খুঁজে পাইনি। আমাদের কাছে বস্তুকণার একটা তালিকা আছে এখন, যেগুলো দিয়ে মহাবিশ্ব গঠিত। কিন্তু এই তালিকাই যে পরিপূর্ণ, তা নিয়ে ১০০ ভাগ নিশ্চিত হতে পারিনি।

আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক আর ইলেকট্রন মিলে তৈরি করে মহাবিশ্বের সব বস্তু। বাকি কণাগুলোর কোনো কাজ খুঁজে পাওয়া যায়নি

কণার এই তালিকাকে পদার্থবিদেরা বলেন স্ট্যান্ডার্ড মডেল। এ তালিকার প্যাটার্নের কোনো ব্যাখ্যা না–ও থাকতে পারে। আবার এখানে অর্থহীন কণাও রয়েছে। কিন্তু বাস্তব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এটি গড়ে তোলা হয়েছে। এটিকে আমরা মহাবিশ্বের প্রকৃত কাজগুলো আবিষ্কার করার ক্ষেত্রে মানচিত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু কখনো যদি নতুন কণা আবিষ্কৃত হয়, তবে সেটা খুবই উত্তেজক ঘটনা হবে। এর অর্থ দাঁড়াবে, মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের মানচিত্রটি প্রসারিত হলো।

আসলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে মৌলিক এসব প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের পরিচিত কণাগুলোর যতটা সম্ভব গভীরে ঢুকতে হবে। এই পথে আমরা হয়তো এমন কোনো কণা বা পরিঘটনা আবিষ্কার করে বসব, যা প্রতিদিনের বস্তুগুলোয় কোনো ভূমিকা রাখে না। কিন্তু এর ফলে মহাবিশ্বের অনেক অব্যাখ্যাত বিষয় জানা যাবে। এসব প্রশ্নের জবাব পেলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেতে পারে। সেটি হবে কি হবে না, তার সবটাই নির্ভর করছে আগামী দিনের কোনো বিজ্ঞানীর ওপর। ভবিষ্যতের সেই বিজ্ঞানীর দিকেই এখন তাকিয়ে আছেন বিশ্বের তাবৎ পদার্থবিদেরা। সে বিজ্ঞানী হতে পারেন আপনিও!

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: উই হ্যাভ নো আইডিয়া, উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন