কণাদের চিড়িয়াখানা

স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে বলা যায় মৌলিক কণাদের চিড়িয়াখানা। মৌলদের জন্য পর্যায় সারণি যা, কণাদের জন্য স্ট্যান্ডার্ড মডেল ঠিক তা-ই। সেই চিড়িয়াখানায় একটু ঢুঁ দেওয়া যাক। দেখা যাক, কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

ঠিক কবে কণা পদার্থবিদরা একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারবেন? যে দিন মহাবিশ্ব গঠনে অংশ নেওয়া সবগুলো কণার খোঁজ পাবেন। সেই সঙ্গে জানতে পারবেন কণাদের সব হাঁড়ির খবর। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা দুই শটিরও বেশি অতিপারমাণবিক কণার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এ কণাদের বেশিরভাগই অবশ্য মৌলিক কণা নয়। তাই বলে মহাবিশ্ব গঠনে এদের ভূমিকা মোটেই হেলাফেলা করার মতো নয়। প্রতিকণাদের যদি হিসাবের বাইরে রাখা হয়, তাহলে এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে খুঁজে পাওয়া মৌলিক কণাদের সংখ্যা ১৭। এদের নিয়েই তৈরি আমাদের গোটা বিশ্বজগত।

পদার্থবিদরা মৌলিক কণাগুলোর সবাইকে একসঙ্গে ঠাঁই দিয়েছেন ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ নামের চিড়িয়াখানায়। যেমন করে মৌলদের স্থান দেওয়া হয়েছে পর্যায় সারণিতে, সেরকম। আমাদের আজকের গন্তব্য মৌলিক কণাদের চিড়িয়াখানা। দেখা যাক, কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

ফার্মিওন বনাম বোসন

স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সবগুলো কণাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগের কণাদের সাধারণ নাম ফার্মিওন। চাইলে এদের বস্তু কণা নামেও ডাকা যায়। এদের সবার স্পিন অর্ধ পূর্ণ সংখ্যা। প্রত্যেকে মেনে চলে ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান। অন্যদিকে, দ্বিতীয় ভাগের কণাগুলোর সাধারণ নাম বোসন। এদের স্পিন পূর্ণ সংখ্যা। তাই এরা মেনে চলে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান। এই পরিসংখ্যানের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে কিংবদন্তী বাংলাদেশি পদার্থবিদ সত্যেন বোসের নাম।

মহাবিশ্ব গঠনে ফার্মিওন এবং বোসনদের ভূমিকা আলাদা। উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক। ‘লেগো’ নামে ছোট বাচ্চাদের খেলনাগুলো দেখেছেন কখনো? এগুলোতে বিশেষভাবে তৈরি অনেকগুলো ছোট ছোট ব্লক থাকে। এদেরকে একে অন্যের সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা যায় নানা আকৃতির বস্তু। এই ব্লকগুলো খাপে খাপে না বসালে একসঙ্গে জোড়া লাগানো যায় না।

ফার্মিওন কণারা এই ব্লকগুলোর মতো। এদের সংযোগে তৈরি হয় মহাবিশ্বের যেকোনো বস্তু। অন্যদিকে ফার্মিওনরা যেন একে অন্যের সঙ্গে জোড়া লাগতে পারে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বোসনদের। অর্থাৎ ফার্মিওনরা মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেয় বোসনদের মাধ্যমে। ফার্মিওনদের মাঝে ক্রমাগত বিনিময় হতে থাকে বোসন কণারা। আর এই বোসনদের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল থাকে মৌলিক বলগুলো। তাই অনেক সময় এদের বলবাহী কণা নামেও ডাকা হয়।

পদার্থের কণা কোয়ার্ক ও লেপটনরা হলো ফার্মিওন (বাঁয়ে), আর বলবাহী কণারা হলো বোসন (ডানে); তবে হিগস বোসনরা সব কণাদের ভর দেয়
কোয়ার্কি কোয়ার্ক: এ কার্টুন গাইড টু দ্য ফ্যাসিনেটিং রেলম অব ফিজিকস

কোয়ার্ক এবং লেপটনদের গল্প

এবারে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ফার্মিওনদের সম্পর্কে দু-এক কথা জেনে নেওয়া যাক। প্রথমেই ওপরের ছবিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিন। ছবির বাম পাশে ফার্মিওন কণা এবং ডান পাশে বোসন কণাদের অবস্থান। ফার্মিওনদের ভাগ করা হয় দুটি শ্রেণিতে। কোয়ার্ক ও লেপটন। মোট ছয় রকম কোয়ার্কের অস্তিত্ব রয়েছে মহাবিশ্বে। আপ, ডাউন, চার্ম, স্ট্রেঞ্জ, টপ ও বটম। অন্যদিকে লেপটন শ্রেণির সদস্যরা হলো ইলেকট্রন, মিউওন, টাউ এবং নিউট্রিনো। নিউট্রিনো আবার হতে পারে তিন রকম। ইলেকট্রন নিউট্রিনো, টাউ নিউট্রিনো এবং মিউওন নিউট্রিনো। লেপটনগুলোর মাঝে এক দল চার্জযুক্ত এবং অন্যরা পুরোপুরি নিরপেক্ষ। তিন ধরনের নিউট্রিনোই চার্জ নিরপেক্ষ। আর বাকি সব লেপটনের চার্জের মান -১।

ছবির বাম দিকের প্রথম কলামে থাকা সবগুলোকে (আপ ও ডাউন কোয়ার্ক, ইলেকট্রন ও ইলেকট্রন নিউট্রিনো) বলা হয় প্রথম প্রজন্মের মৌলিক কণা। এরা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয় মহাবিশ্বের সব ধরনের বস্তুকণা তৈরিতে। আমরা জানি, মহাবিশ্বের সব কিছু তৈরি পরমাণু দিয়ে। আর পরমাণুর ভেতরে থাকে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। এই তিনটির মধ্যে কেবল ইলেকট্রনই মৌলিক কণা। বাকি দুটিকে ভেঙ্গে ফেললে পাওয়া যায় আপ কোয়ার্ক ও ডাউন কোয়ার্কের অস্তিত্ব। তাই কোয়ার্ক ও ইলেকট্রন-ই পরমাণু তথা মহাবিশ্বের প্রকৃত গাঠনিক উপাদান।

ওপরের ছবিতে থাকা ফার্মিওনদের বাকি দুটি কলামের কণাদের যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের মৌলিক কণা বলা হয়। এরা সবাই প্রথম প্রজন্মের কণাদের মতো একই বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় কেবল ভরে। এদের ভর প্রথম প্রজন্মের কণাদের চেয়ে বেশি হয়। ক্ষয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এরা পরিণত হয় কম ভরের মৌলিক কণাতে।

এইট ফোল্ড ওয়ে কেন কাজ করে, তার উত্তর খোঁজা শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। সেখান থেকেই উঠে আসে আরও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মৌলিক কণার অস্তিত্ব থাকার বিষয়টি। যাদের দিয়ে তৈরি প্রায় সিংহভাগ অতিপারমাণবিক কণা।

কোয়ার্কের ধারণা কীভাবে এল

কোয়ার্ক অনেকের কাছে খুব রহস্যময় এক নাম। কারণ আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বইপত্রে এদের নিয়ে খুব একটা আলোচনা করা হয় না। মহাবিশ্বের গাঠনিক উপাদান হিসেবে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করা হয় প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রনদের। তাই জ্ঞানপিপাসুদের একটা বড় অংশ কোয়ার্কের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে এক রকম অন্ধকারেই থেকে যান। কথা না বাড়িয়ে চলুন, জেনে নেওয়া যাক কীভাবে বিজ্ঞানীরা এদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানলেন।

অর্ধ শতাব্দী আগেও কণা পদার্থবিজ্ঞান আজকের মতো এত গোছান ছিল না। ছিল না ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ নামে কোনো কিছুর অস্তিত্ব। সে সময় বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েক ডজন অতিপারমাণবিক কণার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন। তবে এরা কী দিয়ে তৈরি বা মহাবিশ্বে এদের ভূমিকা কী, তার বিন্দু-বিসর্গও জানতেন না পদার্থবিদরা। এদের অদ্ভুত আচরণেরও কোনো ব্যাখ্যা ছিল না তাঁদের কাছে। প্রথমদিকে তাঁরা মহাবিশ্বের গাঠনিক উপাদান হিসেবে পরমাণুর ভেতরে থাকা ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন নিয়েই তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে পরমাণুর ভেতরে আরও সূক্ষ্মভাবে দেখার সক্ষমতা অর্জন করেন তারা। তখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাদের মাঝে সরাসরি সংঘর্ষ ঘটানোর মাধ্যমে করা হয় সেটি। ফলে ক্রমেই লুকিয়ে থাকা নতুন কণাদের খোঁজ পাওয়া শুরু হয়।

১৯৫০ এর দশকে খুঁজে পাওয়া নতুন কণাদের নিয়ে গবেষণা করার সময় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতে আসে বিজ্ঞানীদের। যেমন অনেক কণার আচরণই আমাদের অতি পরিচিত প্রোটন ও নিউট্রনের সঙ্গে অনেকখানি মিলে যায়। তবে একেবারেই মেলে না ইলেকট্রন বা ফোটনের সঙ্গে। আবার, কিছু কণার মাঝে নিবিড় আন্তঃসম্পর্ক খুঁজে পান বিজ্ঞানীরা। উদাহরণ হিসেবে পাই মেসন বা পাইওন (এরা তৈরি একটি কোয়ার্ক এবং একটি প্রতিকোয়ার্কের সমন্বয়ে) এর কথা বলা যেতে পারে। ১৯৩৫ সালে জাপানি পদার্থবিদ হিদেকি ইউকাওয়া তাত্ত্বিকভাবে এদের অস্তিত্বের কথা বলেন। পরে ১৯৪৭ সালে সত্যি সত্যি খুঁজে পাওয়া যায় এদেরকে।

প্রকৃতিতে তিন ধরনের পাইওনের অস্তিত্ব রয়েছে। ধনাত্মক, ঋণাত্মক ও চার্জ নিরপেক্ষ। কণা পদার্থবিদরা এদের সবাইকে একবারে খুঁজে পাননি। প্রথম পাইওন কণা খুঁজে পাওয়ার কিছু সময় পরে তারা আলাদাভাবে প্রায় একই বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নতুন আরেকটি কণার অস্তিত্ব খুঁজে পান। পাইওন কণাদের সঙ্গে এদের পার্থক্য ছিল কেবল তড়িৎ আধানে। এরা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত আধান বিশিষ্ট। পরে একই বৈশিষ্ট্যের তৃতীয় আরেকটি কণা খুঁজে পাওয়া যায়। এই কণাটি আবার চার্জ শূন্য। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন সময় খুঁজে পাওয়া কণাদের মাঝে নিবিড় আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি চোখে পড়ে বিজ্ঞানীদের। আবার, অতিপারমাণবিক কণা নিয়ে গবেষণা করার সময় কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের কণাদেরও খোঁজ পাওয়া যায়। কণা-ত্বরকযন্ত্রের মধ্য দিয়ে পথ চলার সময় এই কণাগুলো অদ্ভুতুড়ে পথ অনুসরণ করে। এমন বৈশিষ্ট্যের নাম দেওয়া হয় স্ট্রেঞ্জনেস (Strangeness)। কেন কিছু কণা এমন বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে, তার কোনো ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল না। তবে এই বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে তারা অতিপারমাণবিক কণাদের দুই দলে ভাগ করে ফেলেন। যাদের এই বৈশিষ্ট্য আছে, তারা এক দলে আর বাকিরা অন্য দলে।            

এভাবে নানা বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে কণা পদার্থবিদরা অতিপারমাণবিক কণাদের সাজানোর চেষ্টা শুরু করেন। হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন এদের মাঝে লুকানো আন্তঃসম্পর্ক। বিষয়টি অনেকটা কণাদের জন্য পর্যায় সারণি তৈরি করার মতো। ১৯৬১ সালে মার্কিন পদার্থবিদ মারে গেল-মান কণাগুলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে কয়েকটি গ্রুপে সাজানোর উপায় খুঁজে বের করেন। এই গ্রুপগুলোর সবগুলোতে সমান সংখ্যক সদস্য ছিল না। তবে সিংহ ভাগ গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ছিল ৮। তাই এই বিশেষ পদ্ধতির নাম দেওয়া হয় ‘এইট ফোল্ড ওয়ে’। এই পদ্ধতির অন্যতম বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, এভাবে সাজালে বিগত দশকে অন্যান্য পদার্থবিদদের করা কণাদের গ্রুপিংয়ের অনেকগুলোই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সন্নিবেশিত হয়ে যেত।

এইট ফোল্ড ওয়ে

এইট ফোল্ড ওয়েতে তৈরি করা কিছু গ্রুপ ছিল অসম্পূর্ণ। যদি স্ট্রেঞ্জনেসের ওপর ভিত্তি করে কিছু কণাকে গ্রুপিং করা হয়, তাহলে সদস্য সংখ্যা হওয়ার কথা দশ। কিন্তু তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছিলেন নয়টি কণা। অর্থাৎ, একটি কণার হদিস নেই। পরে ১৯৬৪ সালে মারে গেল-মানের মডেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে খুঁজে পাওয়া যায় সেই কণাটি। এমন সাফল্যে বিজ্ঞানীরা অচিরেই বুঝতে পারেন, অবশেষে মহাবিশ্বের গাঠনিক উপাদানের খোঁজে সঠিক পথের সন্ধান মিলেছে। এইট ফোল্ড ওয়ে কেন কাজ করে, তার উত্তর খোঁজা শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। সেখান থেকেই উঠে আসে আরও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মৌলিক কণার অস্তিত্ব থাকার বিষয়টি। যাদের দিয়ে তৈরি প্রায় সিংহভাগ অতিপারমাণবিক কণা। ১৯৬৪ সালের দিকে আলাদাভাবে এমন উপসংহারে পৌঁছান পদার্থবিদ জর্জ জেওইগ, আন্দ্রে পিটারসেন এবং গেল-মান। পিটারসেন এই নতুন কণাদের নাম দেন স্পিনর। অন্যদিকে, জেওইগ এদের নামকরণ করেন এইসেস (Aces)। তবে শেষ পর্যন্ত টিকে যায় গেল-মানের দেওয়া নাম—কোয়ার্ক।

মাত্র তিন ধরনের কোয়ার্কের (আপ, ডাউন এবং স্ট্রেঞ্জ) সমন্বয়ে তখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবগুলো অতিপারমাণবিক কণার গঠন ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। অবশ্যই এই তালিকাতে লেপটনরা পড়বে না। এদের কোনো সদস্যই কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি না। এরা নিজেরাই কোয়ার্কের মতো মৌলিক কণা। যা-ই হোক, কোয়ার্কদের বেশ কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন এদের তড়িৎ আধানের মান ভগ্নাংশ। আপ কোয়ার্কদের আধানের মান +২/৩ এবং ডাউন ও স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক, দুটোরই আধানের মান -১/৩। প্রকৃতির অন্য কোনো কণার মাঝে এমন ভগ্নাংশ আধানের অস্তিত্ব দেখা যায় না। কোয়ার্কদের আরেকটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, এরা সব সময় জোট বেঁধে থাকে। দুটি বা তিনটি মিলে একসঙ্গে অবস্থান করে। এদের কোনোভাবেই আলাদা করা যায় না। প্রকৃতিতে একক কোয়ার্কের অস্তিত্ব নেই।

কোয়ার্কদের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য থেকে নিউট্রনদের চার্জ শূন্য হওয়া এবং প্রোটনদের একক ধনাত্মক আধান বিশিষ্ট হওয়ার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়। নিউট্রনে থাকে দুটি ডাউন কোয়ার্ক ও একটি আপ কোয়ার্ক। তাই সামগ্রিকভাবে এদের আধান হয় শূন্য। একইভাবে দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্কের সমন্বয়ে তৈরি প্রোটনদের চার্জের মান হয় +১।

অদ্ভুত সব বৈশিষ্ট্য থাকার পরেও বিজ্ঞানীদের চুলচেরা বিশ্লেষণে তাত্ত্বিকভাবে কোয়ার্ক মডেলটি বেশ ভালোভাবেই টিকে যায়। অবশেষে ১৯৬৮ এবং ১৯৭৪ সালে আলাদা এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে কোয়ার্ক মডেলের স্বপক্ষে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৬৮ সালের পরীক্ষাটি করা হয়েছিল স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার এক্সিলারেটরে। এতে ইলেকট্রনদের তীব্র বেগে ছুঁড়ে মারা হয়েছিল প্রোটনের দিকে। ইলেকট্রনগুলোর ধাক্কা খেয়ে বিভিন্ন দিকে ছিটকে পড়ার প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন কোয়ার্কদের অস্তিত্ব সম্পর্কে। কারণ প্রোটনরা যদি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার সমন্বয়ে গঠিত না হতো, তাহলে ইলেকট্রনদের ধাক্কা খেয়ে বিভিন্ন দিকে ছিটকে পড়ার প্যাটার্ন অবশ্যই ভিন্ন রকম হতো। অন্যদিকে, ১৯৭৪ সালে দুটি ভিন্ন পরীক্ষগারে করা একই এক্সপেরিমেন্ট থেকে বিজ্ঞানীরা নতুন আরেক ধরনের কোয়ার্কের সন্ধান পান। এদের নাম দেওয়া হয় চার্ম কোয়ার্ক। অন্যদিকে, বটম কোয়ার্ক ও টপ কোয়ার্কের নিশ্চিত খোঁজ মেলে যথাক্রমে ১৯৭৭ সালে ও ১৯৯৫ সালে। এই ছয় কোয়ার্কের সঙ্গে লেপটনরা মিলে তৈরি হয় আমাদের চিরচেনা মহাবিশ্ব।

কোয়ার্কের চার্জ থেকে প্রোটনের ধনাত্মক আধান ও নিউট্রনের চার্জশূন্যতার বিষয়টি বোঝা যায়

স্ট্যান্ডার্ড মডেলে মৌলিক বল

প্রকৃতিতে নানান ধরনের বলের অস্তিত্ব দেখা যায়। বেশ খটমটে শব্দ ব্যবহার করে এদের অনেকের বাহারি নামকরণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। এদের বেশিরভাগই কিন্তু মৌলিক বল নয়। অন্য কোনো বল থেকে এদের উৎপত্তি।

প্রকৃতিতে মাত্র চারটি মৌলিক বলের অস্তিত্ব রয়েছে। অন্য সব বলের উৎপত্তি এদের কোনো একটি থেকে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে মহাকর্ষ বল ছাড়া অন্য তিনটি মৌলিক বল—তড়িৎ চৌম্বক বল, সবল নিউক্লীয় বল এবং দুর্বল নিউক্লীয় বলের দেখা পাওয়া যায়। একটি মৌলিক বলের অনুপস্থিতি স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অন্যতম এক সীমাবদ্ধতা। অবশ্য আপাতত একে নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। কারণ, মৌলিক কণাগুলোর ওপরে মহাকর্ষ বলের প্রভাব নগন্য। নেই বললেই চলে।

যা-ই হোক, স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ফার্মিওনগুলোর সবাই তিন ধরনের মৌলিক বলের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না। কারণ প্রত্যেক ফার্মিওন আলাদা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। আর এদের ওপর নির্ভর করে মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার বিষয়টি। উদাহরণ দেওয়া যাক। তড়িৎ চৌম্বক বলের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবে কেবল সেই সব ফার্মিওনরা, যাদের মধ্যে তড়িৎ আধান বা চার্জের অস্তিত্ব আছে। নিউট্রিনোর মতো চার্জশূন্য ফার্মিওনদের ওপর তড়িৎ চৌম্বক বলের কোনো প্রভাব নেই। আবার সবল নিউক্লীয় বলের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিতে হলে ফার্মিওনদের সম্পূর্ণ আলাদা আরেকটি বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন কালার চার্জ। কোয়ার্কদের মাঝে অস্তিত্ব থাকে এদের। তাই কোয়ার্ক ছাড়া অন্য ফার্মিওনরা অংশ নিতে পারে না সবল বলের মিথস্ক্রিয়ায়।

এবারে দৃষ্টি দেওয়া যাক দুর্বল বলের দিকে। সব ফার্মিওনরা এই বলের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। বিশেষ করে যে সব মৌলিক কণাগুলো তড়িৎ চার্জ বা কালার চার্জ বহন করে না, তাদের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার এক মাত্র উপায় এটি। যেমন নিউট্রিনো।

স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মৌলিক বলগুলো মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেয় বোসন কণাদের মাধ্যমে। সেজন্য এদেরকে বলবাহী কণা নামেও অভিহিত করা হয়। মোট চার ধরনের বোসনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে প্রকৃতিতে। ফোটন, ডব্লিউ ও জেড বোসন, গ্লুওন এবং হিগস বোসন। ফোটনরা তড়িৎ চৌম্বক বলের বাহক। এরা ভরহীন ও চার্জশূন্য কণা। এ কারণে তড়িৎ চৌম্বক বলের পাল্লা অসীম। অর্থাৎ, দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এদের প্রভাব কমতে থাকলেও কখনো শূন্য হয় না। ডব্লিউ ও জেড বোসনরা ফোটনদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। এরা মোটেও ভরহীন নয়। বরং বেশ ভারী। দুর্বল নিউক্লীয় বল ক্রিয়াশীল থাকে এদের মাধ্যমে। এ ধরনের বোসনরা ভারী হওয়ায় সব মৌলিক বলের মধ্যে দুর্বল বলের পাল্লা সবচেয়ে কম। ১০-১৮ মিটারের কাছাকাছি। সবল বলের পাল্লাও বেশ কম। মাত্র ১০-১৫ মিটারের কাছাকাছি। এদের বহনকারী বোসনদের নাম গ্লুওন। ভরশূন্য হলেও গ্লুওনরা কালার চার্জ বহনের দরুন খুব কম জায়গা জুড়ে ক্রিয়াশীল থাকে সবল নিউক্লীয় বল।

বোসনদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজনের নাম হিগস বোসন। অন্যান্য বোসনদের সঙ্গে এদের আকাশ পাতাল পার্থক্য। অন্য সব বোসনদের স্পিনের মান ১ হলেও এদের মান ০। এরা কোনো মৌলিক বলকেও প্রতিনিধিত্ব করে না। তবে মহাবিশ্ব গঠনে এদের ভূমিকা অনন্য। এরা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সব কণাকে ভর প্রদান করে।

এই হলো মোটামুটি মৌলিক কণাদের স্ট্যান্ডার্ড মডেল। কণাদের চিড়িয়াখানায় ভ্রমণ আজ এই পর্যন্তই থাক।

লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)

সূত্র: বেঞ্জামিন ভার, বরিস লেমার রিনা পিকোলোর কোয়ার্কি কোয়ার্ক: কার্টুন গাইড টু দ্য ফ্যাসিনেটিং রেলম অব ফিজিকস অবলম্বনে

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন