বিশাল বিশাল সব জাহাজ ভেসে চলে পানিতে। মানুষকে বয়ে নেয় দেশ থেকে দেশান্তরে। অথচ এত বিশাল কিছুর তো পানিতে ভেসে থাকার কথা না। ঘটনা কী?
ঘটনা বোধ হয় অনেকেই জানেন। গ্রিক দার্শনিক আর্কিমিডিসের সেই ‘ইউরেকা’ মূহূর্ত—রাজার স্বর্ণমুকুটের খাদের রহস্য ভেদ করে সেই যে নগ্ন আর্কিমিডিস ইউরেকা বলে চিৎকার করতে করতে ছুট দিলেন, এ এক অমর গল্প। খ্রিস্টপূর্ব ২৪৬ সালের কথা। গল্পের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে বটে, তবে আর্কিমিডিস তাঁর সূত্র সে সময়ই আবিষ্কার করেন। তাঁর এই সূত্রের ওপর ভর করে মানুষ জাহাজে উঠে পড়েছে নির্ভয়ে, আবিষ্কার করেছে কত নতুন দেশ-মহাদেশ! ভাবলে আশ্চর্য লাগে না?
এখানে অবশ্য একটা ‘কিন্তু’ আছে। বড়সড় ‘কিন্তু’। আর্কিমিডিসের সূত্রের মাধ্যমে জাহাজ কীভাবে ভেসে থাকে, তা ব্যাখ্যা করা যায় বটে। তবে জাহাজ নির্মাণের সূত্রপাত কিন্তু এর মাধ্যমে হয়নি। অক্সিজেন আবিষ্কারের আগেও মানুষ যেমন শ্বাস নিত, তেমনি এই সূত্র আবিষ্কারের আগেও জাহাজ, নৌকা বা ভেলা ভাসিয়েছিল মানুষ পানিতে। যদিও তারা ঠিকভাবে হয়তো জানত না, এটা কেন বা কীভাবে কাজ করে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, প্রথম বিশালাকার জাহাজের সন্ধান মেলে প্রাচীন মিসরে। সেটা খ্রিস্টপূর্ব ৬ হাজার সালের দিকের কথা। আরও প্রায় ২ হাজার বছর আগেই মানুষ ভেলা ভাসিয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ইতিহাসের সবচেয়ে পুরাতন এই ভেলা কিন্তু মিসর বা গ্রিস নয়, পাওয়া গেছে আজকের নেদারল্যান্ডসে। দেশটির ডেরেন্স প্রদেশের ‘পেসে’ গাঁয়ে পাওয়া এই ভেলার নাম রাখা হয়েছে ‘পেসে ক্যানু’ বা পেসে ভেলা।
কানায় কানায় ভরা একটা বালতি। একটা ভারী খালি বাক্স এনে এতে ভাসিয়ে দিলে কী হবে? কিছুটা পানি উপচে পড়বে। বাক্সটার ওজন আছে। নিজের ওজনের সমান পানিকে সরিয়ে দিয়ে সেই জায়গা নিয়েছে এটি। তারপর?
যাই হোক, এবার আসল প্রশ্নে ফেরা যাক। আর্কিমিডিসের সূত্র আসলে কী বলে? কীভাবে ভেসে থাকে জাহাজ? বোঝার জন্য এমন একটা দৃশ্য ভাবা যাক, যেটা আমরা বাসায় পরীক্ষা করতে পারব।
কানায় কানায় ভরা একটা বালতি। একটা ভারী খালি বাক্স এনে এতে ভাসিয়ে দিলে কী হবে? কিছুটা পানি উপচে পড়বে। বাক্সটার ওজন আছে। নিজের ওজনের সমান পানিকে সরিয়ে দিয়ে সেই জায়গা নিয়েছে এটি। তারপর? বাক্সটা কিন্তু ডুবে যাবে না, ভেসে থাকবে। কেন? কারণ, পানি একে ওপরের দিকে ঠেলছে। পানি যদি বাক্সটাকে ওপরের দিকে ধাক্কা না দিত, তবে বাক্সটা তলিয়ে যেত। গিয়ে পৌঁছাত একদম বালতির নিচে। এই যে পানি বাক্সটাকে ওপরের দিকে ঠেলছে, এর ওপর ঊর্ধ্বমুখী বল প্রয়োগ করছে, যার ফলে বাক্সটা ভেসে আছে। ইংরেজিতে এই পুরো ঘটনাটাকে বলে বুয়েন্সি। বাংলায় বলে প্লবতা। আর যে বলে পানি বাক্সটাকে ওপরের দিকে ঠেলছে, তার নাম প্লবতা বল (বুয়েন্ট ফোর্স)।
এখানে ঘটনাটা কী ঘটছে আসলে? বাক্সটার ভেতরটা খালি। অর্থাৎ বাতাসপূর্ণ। প্রতি একক আয়তনে বাক্সের ঘনত্ব পানির ঘনত্বের চেয়ে কম। এককথায় বললে, বাক্সটা পানির চেয়ে হালকা। সে জন্যই এটা ভাসছে।
দুর্ঘটনাক্রমে কোনোভাবে জাহাজের খোল ফেটে গেলে ভেতরে পানি ঢুকে পড়ে। তখন জাহাজের ভেতরের ঘনত্ব আর বাইরের পানির ঘনত্ব সমান হয়ে যেতে থাকে।
কিন্তু জাহাজ তো হালকা না! টনকে টন ওজন। তাহলে? মনে রাখতে হবে, ভারী হওয়ার পাশাপাশি জাহাজ আকারে অনেক বড়। এর খোলের ভেতরে যথেষ্ট জায়গা রাখা হয়। সবটা থাকে বাতাসে ভরা। আকার অনুযায়ী বিশাল জায়গাজুড়ে এটি বসে থাকে পানির ওপরে। যে পরিমাণ জায়গা এটা পানির ওপরে দখল করে আছে, প্রতি একক আয়তনে এর ঘনত্ব পানির চেয়ে কম। সে জন্যই জাহাজ ভেসে থাকতে পারে।
তাহলে, জাহাজ ডুবির যে ঘটনা ঘটে, সেটা কেন হয়?
দুর্ঘটনাক্রমে কোনোভাবে জাহাজের খোল ফেটে গেলে ভেতরে পানি ঢুকে পড়ে। তখন জাহাজের ভেতরের ঘনত্ব (বাতাসের জায়গা দখল করে নেওয়া পানি) আর বাইরের পানির ঘনত্ব সমান হয়ে যেতে থাকে। ঘনত্বের পার্থক্য যত কমে, জাহাজ তত তলিয়ে যায়। জাহাজের ভেতরের বাতাসের জায়গা ধীরে ধীরে দখল করে পানি। এখন যে খোল, মালপত্র আছে, এগুলোর ভেতরে আর বাতাস নেই। এগুলো আর পানির চেয়ে হালকা না, ভারী। তাই এগুলো তলিয়ে যায়।
