রিঅ্যাক্টরের ইতিকথা
এক কিলোগ্রাম ইউরেনিয়ামের ওজন কত
পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয় নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর। এতে নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ায় প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন হয়, যা পরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। রিঅ্যাকটর কী, কীভাবে কাজ করে তা ছোটদের জন্য খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে ‘রিঅ্যাকটরের ইতিকথা’ বইয়ে। আলেক্সেই ক্রিলোভের লেখা এই বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন বিজয় পাল। মস্কোর ‘রাদুগা’ প্রকাশন থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে…
তুমি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং পারমাণবিক এঞ্জিন চালিত জাহাজের কথা শুনেছ? অবশ্যই শুনেছ ও পড়েছ। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিজলী উৎপাদন করে, আর পারমাণবিক বরফ-ভাঙা জাহাজগুলো মালবাহী জাহাজের কারাভানের পথ করে দেয় মেরু মহাসাগরের বরফের মধ্যে।
পরমাণুর শক্তি মানুষ ব্যবহার করতে শিখেছে খুব সম্প্রতি। বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) ওবনিন্স্ক শহরে, কালুগার কাছে। তা চালু হয় ১৯৫৪ সালে। আর প্রথম পারমাণবিক জাহাজগুলো দেখা দেয় আরও পরে।
কিন্তু দেখা গেল যে এই পরমাণু বা অ্যাটম কথাটি মানুষের জানা আছে স্মরণাতীত কাল থেকে।
২৩ শতাব্দী আগে প্রাচীন গ্রিসে ডেমোক্রিটাস নামে এক বিজ্ঞানী বাস করতেন। তিনি মানুষের পারিপার্শ্বিক প্রকৃতিকে নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করতেন। ডেমোক্রিটাস ভাবতেন, কী দিয়ে নির্মিত হয়েছে জিনিস ও বন্ধু, জল ও পাথর, গাছপালা, ফুল এবং জীবজন্তু। তাঁর কাছে জটিল কোন যন্ত্রপাতি ছিল না, যা আজ বিজ্ঞানীদের সাহায্য করছে। কিন্তু ডেমোক্রিটাসের মাথায় প্রতিভাদীপ্ত এক ধারণার উদয় হয়। তিনি কল্পনা করেন যে প্রকৃতিতে সবকিছু কণিকা দিয়ে গঠিত। যেমন, বাড়ি গঠিত ইট দিয়ে। এই সব প্রাকৃতিক ইট চোখে দেখা যায় না এবং তার চেয়ে ছোট কোনকিছু পৃথিবীতে নেই। তা বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করা একেবারেই অসম্ভব। ডেমোক্রিটাস তাঁর কণিকাগুলোকে নাম দেন ‘পরমাণু’। এর মানে ‘অবিভাজ্য’।
অনেক শতাব্দী বাদে বোঝা গেল যে প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞানী ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করছিলেন। প্রায় একশো বছর আগে ফরাসি পদার্থবিদ আঁরি বেকেরেল কাজের পর বাড়ি চলে যাওয়ার আগে তাঁর গবেষণাগারের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। তিনি আলমারিতে তুলে রাখলেন টেস্ট-টিউব আর ফ্ল্যাস্কগুলো। তাকে রাখলেন কালো কাগজ দিয়ে মোড়া ফোটোগ্রাফিক প্লেট। আবারও ঝকঝকে তকতকে টেবিলগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন। লক্ষ্য করলেন, একটি বস্তুর কয়েকটি টুকরো পড়ে আছে এক জায়গায়। বেকেরেল ওই বস্তুটির ধর্ম নিয়ে গবেষণা করছিলেন। বস্তুটির নাম ছিল ইউরেনিয়াম। বিজ্ঞানীর খুব তাড়া ছিল। তিনি টুকরোগুলো তুলে তাকের দিকে ছুড়ে ফেললেন। একটি টুকরো ফোটোগ্রাফিক প্লেটের প্যাকেটে গিয়ে পড়ল। বেকেরেল আলো নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন।
নিউক্লিয়াসও গঠিত পরস্পরের সঙ্গে জোরে চেপে-থাকা কণিকাসমূহ দিয়ে। এগুলোকে বলা হয় প্রোটন ও নিউট্রন। নিউক্লিয়াস হচ্ছে দড়ি দিয়ে শক্ত-করে-বাঁধা একটি স্প্রিংয়ের মতো এবং তা স্প্রিংয়েরই মতো প্রচন্ড শক্তির অধিকারী।
পরদিন বেকেরেল প্যাকেটের ওপর থেকে টুকরোটি ফেলে দিয়ে প্লেটে প্রয়োজনীয় ফোটো তুললেন এবং তা ডেভেলোপ করলেন। কিন্তু ফোটোগ্রাফিক প্লেটটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যেখানে পড়ে ছিল ইউরেনিয়ামের টুকরো সেখানে কালো একটি দাগ দেখা যাচ্ছিল। বিজ্ঞানী তো অবাক। ফের পরীক্ষা চালালেন। ব্যাপারটি কী বুঝতে হবে। আবার প্লেটে দেখতে পেলেন ইউরেনিয়ামের টুকরোটির উজ্জল প্রতিকৃতি।
এই রহস্যটি উদ্ঘাটনের কাজে মন দিলেন অন্য বিজ্ঞানীরা—মেরি ও পিয়ের কুরি। তাঁরা বিভিন্ন পদার্থ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন। বিজ্ঞানীরা রেডিয়াম আর পলোনিয়ামেরও অনুরূপ আচরণ লক্ষ্য করলেন। কিন্তু তার কারণটি কী? ব্যাখ্যা হতে পারে কেবল একটাই। ‘অবিভাজ্য’ পরমাণুর সবচেয়ে গভীর থেকে কীসব কণিকার স্রোত আসে। ওই সমস্ত কণিকাই ফোটোগ্রাফিক প্লেটগুলো নষ্ট বা এক্সপোজ করে। আর তার মানে দাঁড়াচ্ছে, পরমাণুই ক্ষুদ্রতম কণিকা নয়। তারও চেয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণিকা আছে।
আজ আমরা প্রায় সঠিকভাবে জানি পরমাণু কীভাবে গঠিত। মধুর একটা বড় ফোঁটার কথাই ধরো যার চারিদিকে ঘুরে ঘুরে উড়ছে অনেকগুলো মশা। মশারা ফোঁটাটির কাছে ভিড় করছে, তা কিছুতেই ছেড়ে যেতে পারছে না তারা। কোন বস্তুর পরমাণু যদি আমরা দেখতে পারতাম, তাহলে প্রায় অনুরূপ দৃশাই লক্ষ্য করা যেত। মাঝখানে ভারী একটা ‘ফোঁটা’—নিউক্লিয়াস। চারিদিকে হালকা, চটপটে ‘মশারা’—ইলেকট্রনগুলো। তা নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরছে যেন তার সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। তবে ইলেকট্রনসমূহ ঘুরছে মশাদের মতো বিশৃঙ্খলভাবে নয়, আপন আপন পথে নিজস্ব কক্ষ ধরে।
কিন্তু তা-ও সব নয়। দেখা গেল নিউক্লিয়াসও গঠিত পরস্পরের সঙ্গে জোরে চেপে-থাকা কণিকাসমূহ দিয়ে। এগুলোকে বলা হয় প্রোটন ও নিউট্রন। নিউক্লিয়াস হচ্ছে দড়ি দিয়ে শক্ত-করে-বাঁধা একটি স্প্রিংয়ের মতো এবং তা স্প্রিংয়েরই মতো প্রচন্ড শক্তির অধিকারী। দড়িটি কেটে দিলেই স্প্রিংটা সোজা হয়ে উঠবে এবং তার মধ্যে লুকায়িত শক্তি দান করবে। নিউক্লিয়াস যাতে শক্তি দেয় তার জন্য প্রয়োজন তা ধ্বংস করা, কণিকাসমূহকে জড়িয়ে রাখা অদৃশ্য সুতোগুলো ছিঁড়ে ফেলা। তখনই তা বিভক্ত হয়ে নিজের চারদিকে শক্তি ছড়িয়ে দেয়।
সবচেয়ে সহজে ধ্বংস হয় (আর বৈজ্ঞানিক ভাষায়—বিভক্ত হয়) ‘ভারী’ পদার্থগুলোর—অর্থাৎ ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়ামের নিউক্লিয়াস। এগুলোকে ভারী বলে অভিহিত করা হয়েছে এই জন্য যে তাদের নিউক্লিয়াসে আছে অনেক কণিকা। বিভাজনের পক্ষে নিউক্লিয়াসে একটা কণিকার আঘাতই যথেষ্ট। ব্যাপারটিকে তুলনা করা যায় নিশানায় গুলির আঘাতের সঙ্গে। দেখা গেল যে সবচেয়ে ভালো ‘গুলি’ হচ্ছে নিউট্রন। সেই নিউট্রনই, যা দিয়ে গঠিত নিউক্লিয়াস।
নিউট্রনসমূহের স্থায়ী ‘বাসস্থান’ হচ্ছে নিউক্লিয়াস। তবে ‘ঘরকুনো’ এই নিউট্রনদের মধ্যেও ভ্রমণবিলাসী থাকে। তারা নিউক্লিয়াস ত্যাগ করে চলে যায় এবং পর্যটকদের মতো ইউরেনিয়ামের টুকরোতে ইতস্ততভাবে ঘুরে বেড়ায়। আগে হোক পরে হোক, এরূপ ভ্রমণকারী অন্য কোনো নিউক্লিয়সের সঙ্গে ধাক্কা খায়। আঘাতের ফলে নিউক্লিয়াস ভেঙে যায় এবং তা থেকে দুটি নিউট্রন সৃষ্টি হয়। যেকোনো উপায়ে হোক, ওই নিউট্রনগুলো পরের দুটি নিউক্লিয়াসকে ভাঙাবেই। এবার ইউরেনিয়ামের টুকরোতে চারটি গুলি। ব্যস, চলল আর কি...। কুড়াল দিয়ে গাছ কাটার সময় যেমনটি হয় ঠিক তেমনিভাবে নিউক্লিয়াসগুলো একটির পর একটি চারিদিকে উড়তে থাকে এবং নিজেদের মধ্যে লুকায়িত শক্তি ছড়াতে থাকে। বেশি শক্তি বেশি তাপ। এক কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম থেকে যতটা তাপ পাওয়া যায় ঠিক ততটা তাপ মেলে দুই হাজার টন কয়লা জ্বালানোর পর।
ভারি মজার ব্যাপার, তাই না? ইউরেনিয়ামপূর্ণ সীসার একটি বা দুটি বাক্স নিয়ে এলেই যথেষ্ট—তা বড় কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পুরো একটি বছরের খোরাক। তাই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গড়া হয় সেই সব জায়গায় যেখানে কাছাকাছি কোথাও কয়লা, তেল কিংবা পীট নেই।
এরূপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সবচেয়ে প্রধান জিনিসটি হচ্ছে পারমাণবিক কিংবা, ঠিকভাবে বললে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর। এ হচ্ছে তলা ও ঢাকনীযুক্ত বিশাল এক ধাতব সিলিন্ডার। তা দেখতে অবিকল বড় ডেকচি কিংবা বয়লারের মতো। বয়লারের ভেতরে—ইউরেনিয়ামের কীলক এবং জলের পাইপ। বাইরে, রিঅ্যাক্টরের ঢাকনীতে—নানান রকমের যন্ত্রপাতি আর কলকব্জা। ইউরেনিয়ামের কীলকগুলোতে নিউক্লিয়সের বিভাজন চলতে থাকে, ‘জ্বলে’ নিউক্লিয়ার জ্বালানি এবং পানিকে ভীষণ গরম করে তোলে।
পাম্পগুলো উত্তপ্ত পানিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় স্টিম-জেনারেটরে, অর্থাৎ বাষ্প উৎপাদক যন্ত্রে।
স্টিম-জেনারেটরের গঠন পদ্ধতিটি খুব সহজ। পাইপের মধ্যে পাইপ। এটাই বলেন এঞ্জিনিয়াররা। ভেতরের পাইপ দিয়ে রিঅ্যাক্টর থেকে আসে গরম পানি। বাইরের পাইপ দিয়ে রেফ্রিজারেটর থেকে আসে ঠান্ডা পানি গরম পানির দিকে। রিঅ্যাক্টরের পানির তাপ পেয়ে ঠান্ডা পানি গরম হয়ে ওঠে, ফুটতে শুরু করে এবং পরে পরিণত হয় বাষ্পে। বাষ্প চাপ দেয় টার্বাইনের ব্লেডগুলোতে এবং টার্বাইন ঘুরতে আরম্ভ করে।
তাপ দেওয়ার পর রিঅ্যাক্টরের পানি ফের রিঅ্যাক্টরে চলে যায়, আবার তা গরম হয় এবং আবার যায় স্টিম-জেনারেটরে। যে-চক্রে পানি প্রবাহিত হয় তাকে বলা হয় প্রথম সার্কিট।
দ্বিতীয় সার্কিটের পানি কেন ফুটতে আরম্ভ করে এবং বাষ্পে পরিণত হয়? আর প্রথম সার্কিটে কেন বাষ্পই নেই?
আর বাষ্প টার্বাইন ঘুরিয়ে চলে যায় রেফ্রিজারেটরে। ওখানে তা শীতল হয়ে পানিতে পরিণত হয়। পানি ফের স্টিম-জেনারেটরে বইতে থাকে এবং আবার বাষ্পে পরিণত হয়... পানি ও বাষ্প সমেত এই দ্বিতীয় চক্রটির নাম দ্বিতীয় সার্কিট।
রেফ্রিজারেটর সমেত রিঅ্যাক্টর, স্টিম-জেনারেটর আর টার্বাইনের মিলিত নামটি হচ্ছে—পারমাণবিক শক্তি ব্যবস্থ্য। তা চালায় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র এবং মানুষ—অপারেটর।
এ ধরনের ব্যবস্থা কাজ করছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এবং বরফ-ভাঙা জাহাজে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে টার্বাইন পরমাণুর শক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে, আর বরফ-ভাঙা জাহাজের টার্বাইন পরমাণুর শক্তিকে রূপান্তরিত করে গতিতে। ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক শক্তি ব্যবস্থা বরফ-ভাঙা জাহাজগুলোকে সবচেয়ে পুরু বরফের মধ্য দিয়ে জাহাজের কারাভান নিয়ে যেতে সাহায্য করে। ১৯৭৭ সালের আগস্ট মাসে সোভিয়েত বরফ-ভাঙা জাহাজ আর্কটিকা বরফের রাজ্য অতিক্রম করে একেবারে উত্তর মেরুতে গিয়ে পৌঁছে। তার আগে আর কোনো বরফ-ভাঙা জাহাজের পক্ষেই তা করা সম্ভব হয়নি।
এ সবকিছু পড়ে তুমি যদি আমাদের দুটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস কর, তাহলে আমরা মোটেই অবাক হব না।
প্রথম প্রশ্ন, দ্বিতীয় সার্কিটের পানি কেন ফুটতে আরম্ভ করে এবং বাষ্পে পরিণত হয়? আর প্রথম সার্কিটে কেন বাষ্পই নেই?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, কীসের জন্য দুটি সার্কিট দরকার? সরাসরি রিঅ্যাক্টরেই কি বাষ্প পাওয়া যায় না? বাষ্প তৈরি করার মতো যথেষ্ট তাপ তো ওতে আছে।
প্রথম প্রশ্নটির উত্তর সহজেই দেওয়া যায়। প্রথম সার্কিটে পানি ফোটে না, কারণ পানি ওখানে থাকে ভীষণ চাপের মধ্যে। আর চাপ যত বেশি হয়, পানি তত বেশি গরম করা প্রয়োজন, যাতে তা ফুটতে আরম্ভ করে।
আর দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাব দিতে হলে আমাদের বেশ দূর থেকে শুরু করতে হবে।
ইউরেনিয়াম জ্বলে শান্তভাবে এবং তা মোটেই ভয়ানক নয়। তবে মানুষের পক্ষে ইউরেনিয়াম খুবই বিপজ্জনক। নিউক্লিয়াস বিভাজনের সময় অসংখ্য ‘টুকরো’ ও কণিকা সৃষ্টি হয় যা প্রবল গতিতে বিভিন্ন দিকে উড়তে থাকে। এই প্রবাহকে বলা হয় রেডিয়েশন। রেডিয়েশন জীবন্ত সবকিছুর পক্ষে ক্ষতিকর। সেই জন্য রিঅ্যাক্টরের চারদিকে সর্বদা গড়া হয় কংক্রিটের মোটা দেয়াল। ওগুলোকে বলা হয় জীবতাত্ত্বিক প্রতিরক্ষা।
পারমাণবিক শক্তি ব্যবস্থায় দুটি জলীয় সার্কিট থাকার উদ্দেশ্য হচ্ছে রেডিয়েশন থেকে আত্মরক্ষা করা। প্রথম সার্কিটের পানি রেডিয়েশন দ্বারা কলুষিত এবং ইউরেনিয়ামের মতো তা কণিকা ছড়ায়। আর এই কলুষিত, নোংরা পানিকে যদি বাষ্পে পরিণত করা হয়, তাহলে পাইপ, পাম্প এবং টার্বাইনও রেডিও-অ্যাক্টিভ বা তেজস্ক্রিয় হয়ে উঠবে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চারদিকে এমনকি হট-হাউসও গড়া হচ্ছে। ওখানে ফলানো হয় শাকসবজি আর ফুল। ফিন উপসাগরের কাছে নির্মিত লেনিনগ্রাদ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জেলেদের সাহায্য করে।
সে জন্য ঠিক করা হলো? রিঅ্যাক্টরের তেজস্ক্রিয় পানি ‘অন্য’ পানিকে গরম করুক। পাইপের দেয়ালগুলো ক্ষতিকর কণিকা প্রবাহকে খুব হ্রাস করে, ফলে দ্বিতীয় সার্কিটের পানি অমলিন বা প্রায় অমলিন থেকে যায়। টার্বাইন এবং রেফ্রিজারেটরের চারপাশে জীবতাত্ত্বিক প্রতিরক্ষা গড়ার প্রয়োজন নেই। লোকে ওগুলোর কাছে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারে।
নিজের দেহে রেডিয়েশনের ক্রিয়াকলাপ প্রথম পরীক্ষা করেন পিয়েরে কুরি। এই নির্ভীক লোকটি কয়েক ঘণ্টা ধরে তাঁর একটি হাত রাখেন এক টুকরো রেডিয়ামের ওপর। কিছুক্ষণ পরে তাঁর হাতে পোড়া আর ঘা দেখা দিল। পিয়েরে কুরি সেরে উঠলেন। তবে লোকে বুঝতে পারল যে রেডিয়াম আর ইউরেনিয়াম নিয়ে খেলা করা উচিত নয়।
এখন ইঞ্জিনিয়াররা ভালো প্রতিরক্ষা গড়তে শিখেছেন। তাই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহ মোটেই বিপজ্জনক নয়। তা নির্মাণ করা যায় সরাসরি শহরে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে অনেক বেশি পরিষ্কার এবং তা ধুলো, ছাই আর ধোঁয়া দিয়ে দূষিত করে না।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চারদিকে এমনকি হট-হাউসও গড়া হচ্ছে। ওখানে ফলানো হয় শাকসবজি আর ফুল। ফিন উপসাগরের কাছে নির্মিত লেনিনগ্রাদ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জেলেদের সাহায্য করে। টার্বাইনগুলোর ঠান্ডা পানি গিয়ে পড়ে উপসাগরে। ওই পানিতে প্রচুর শেওলা জন্মে।
তা হচ্ছে মাছের খাদ্য। আর যেখানে খাবার আছে, সেখানে মাছও আছে।
পারমাণবিক শক্তি আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে মানুষকে সাহায্য করবে। আজ পৃথিবীতে লবণহীন পানির পরিমাণ ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। আর লবণহীন পানিই আমরা খাই এবং তা দিয়েই আমরা স্নান করি। তা ফুরিয়ে যাচ্ছে এই জন্য নয় যে আমরা বেশি পানি খেতে আরম্ভ করেছি কিংবা ঘন ঘন স্নান করছি। ক্রমশই অধিক পানি ব্যবহার করছে আমাদের শিল্প। তা প্রয়োজন কাঁচা লোহা ঢালাইয়ের জন্য, তৈল নিষ্কাশনের জন্য, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। অনেক পানি দরকার কৃষি অর্থনীতির জন্যও। এমন সব জায়গা রয়েছে যেখানে আছে প্রচুর রোদ, উর্বর মাটি। কিন্তু পানি নেই। লোকে ওখানে খাল কাটে, পাম্পের সাহায্যে নদী ও হ্রদ থেকে পানি নিয়ে যায় শুল্ক প্রান্তরে।
পৃথিবীর প্রধান পানিভাণ্ডার হচ্ছে সাগর-মহাসাগর। কিন্তু তোমরা জানো, পানি ওখানে লবণাক্ত। সমুদ্রের পানি ব্যবহারের আগে তা লবণহীন করা হয়। ও কাজটি করা হয় এভাবে, লোনা পানি ফুটানো হয়। তা থেকে বাষ্প উঠতে থাকে। ওই বাষ্প কন্ডেন্সারে (ঘনীকরণ পাত্রে) সংগ্রহ করে শীতল করলেই লবণহীন পানি পাওয়া যায়। তারপর স্বাদের জন্য সামান্য লবণ যোগ করলেই সেই পানি খাওয়া যায়, তা দিয়ে স্নান করা যায়, কিংবা বাগানে ও খেতে সেচ দেওয়া যায়। ডেকচি থেকে কাইট সরিয়ে তাতে ফের লোনা সমুদ্রে পানি ঢালা হয়। তবে খোদ কাইটগুলোও কিন্তু দরকারী জিনিস। তাতে থাকে মূল্যবান পদার্থ ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, এমনকি কিছুটা সোনাও।
পানি লবণহীন করার জন্য প্রয়োজন প্রচুর শক্তি। আর এই শক্তি জোগাতে পারে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে কাস্পিয়ান সাগরের পূর্ব তীরে পানিশূন্য উত্তপ্ত মরুভূমিতে অবস্থিত শেভ্চেঙ্কো শহরটি। তোমরা হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই ধরে নিয়েছ যে মাটি ওখানে একেবারে সমতল, প্রখর রৌদ্রে রাস্তাঘাট ফেটে খান খান হয়ে যাচ্ছে, ঘাস কিংবা গাছপালা কিছুই নেই। না, আসলে কিন্তু তা নয়। ওখানে পানি আছে প্রচুর। আছে ছায়াচ্ছন্ন বীথি আর ফোয়ারা। শহরের সব জায়গায় রয়েছে ফুল-বাগান। এই সব বিস্ময় সৃষ্টি করে মানুষ। শেভচেঙ্কোতে নির্মিত হয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ওখানে উৎপাদিত শক্তির প্রায় সবটাই ব্যবহৃত হয় ক্ষমতাসম্পন্ন পানি পরিশোধন কেন্দ্রে। তা শহরকে জোগায় পানি আর শিল্পকে কাঁচামাল। সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ লবণ এবং আরও অনেককিছু।
(চলবে…)
মূল: আলেক্সেই ক্রিলোভ
অনুবাদ: বিজয় পাল
অঙ্গসজ্জা: আন্দ্রেই প্লাতোনভ