রিঅ্যাক্টরের ইতিকথা
বাষ্প ইঞ্জিনের কথা
পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয় নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর। এতে নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ায় প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন হয়, যা পরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। রিঅ্যাকটর কী, কীভাবে কাজ করে তা ছোটদের জন্য খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে রিঅ্যাকটরের ইতিকথা বইয়ে। আলেক্সেই ক্রিলোভের লেখা এই বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন বিজয় পাল। মস্কোর ‘রাদুগা’ প্রকাশন থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে…
লোকে বলে, অনেক অনেক বছর আগে চুলোর ধারে বসে ছিল একটি ছেলে। সে দেখছিল, কীভাবে টগবগ করে পানি ফুটছিল ডেকচিতে। ঢাকনা ঠেলে বেরিয়ে আসছিল বাষ্প। ঢাকনাটা লাফাচ্ছিল আর শব্দ করছিল।
‘কী ব্যাপার, ওটা এভাবে লাফাচ্ছে কেন?’ ভাবল ছেলেটি। সে একটা ন্যাকড়া নিয়ে ঢাকনাটা চেপে ধরল। কিন্তু ধরে রাখতে পারল না। অজানা এক শক্তি নিচ থেকে ঢাকনাটা ঠেলছিল। ছেলেটির নাম ছিল জেমস ওয়াট।
যুগ যুগ ধরে লোকে পানি ফুটিয়ে আসছে। ডেকচিতে তারা স্যুপ রাঁধত, মাছ-মাংস আর শাক-সবজি সেদ্ধ করত। পানি যাতে তাড়াতাড়ি ফোটে, সে জন্য তারা ডেকচি ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে দিত।
ডেকচিতে যখন পানি ফোটে, তখন বাষ্প সৃষ্টি হয়। ডেকচি যদি ভালো ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করা হয়, তাতে বাষ্পের পরিমাণ ক্রমে বাড়তে থাকে। তা তখন সবদিকে চাপ দিতে শুরু করে: পানিতে, ডেকচির গায়ে এবং অবশ্যই ঢাকনায়। বের হওয়ার পথ খোঁজে। শেষ পর্যন্ত বাষ্প ঢাকনা তুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। ঢাকনা বন্ধ হয়ে গেলে বাষ্প ফের ফাঁদে আটকা পড়ে। আবার তা জমা হতে থাকে এবং অবশেষে ঢাকনা তুলতে চেষ্টা করে। রান্নাঘরে এমন দৃশ্য তুমি নিজেই বহুবার দেখেছ। দুই শতাব্দী আগে জেমসও ঠিক একই ব্যাপার লক্ষ করছিল।
জেমসের যখন ষোলো বছর পূর্ণ হলো, তিনি মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপে চাকরিতে ভর্তি হলেন। ওখানে পাম্প মেশিন, বাষ্পীয় মেশিন মেরামত করা হতো। কালক্রমে তিনি একজন অতি নিপুণ যন্ত্রবিদ হয়ে উঠলেন, সৃষ্টি করলেন চমৎকার এক বাষ্পীয় মেশিন
পাথর, পানিপূর্ণ বালতি বা ওই ঢাকনাটা তোলার জন্য শক্তি প্রয়োজন। তার মানে, যে বাষ্প ডেকচির ঢাকনাটা ঠেলে তুলছে, তা এই শক্তির অধিকারী। এ কথা আগেও বিজ্ঞানীদের জানা ছিল। ওয়াটের জন্মের শতাধিক বছর আগেই দুই ইংরেজ যন্ত্রবিদ টমাস নিউকোমেন ও টমাস স্যাভেরি এমন মেশিন গড়েছিলেন, যা জলীয় বাষ্পের শক্তি ব্যবহার করত। বাষ্পীয় মেশিনগুলো কয়লা খনি থেকে পাম্প করে পানি তুলত, কয়লাপূর্ণ ট্রলি টানত, মালপত্র ওঠাত-নামাত। কিন্তু ওই মেশিনগুলো ছিল কম শক্তিশালী, ভারী এবং ভীষণ ‘পেটুক’। একদিনে একেকটি মেশিন ‘খেয়ে ফেলত’ পর্বত পরিমাণ কয়লা আর টন টন পানি। আর কাজের মতো কাজ করত এই একটুখানি।
জেমসের যখন ষোলো বছর পূর্ণ হলো, তিনি মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপে চাকরিতে ভর্তি হলেন। ওখানে পাম্প মেশিন, বাষ্পীয় মেশিন মেরামত করা হতো। কালক্রমে তিনি একজন অতি নিপুণ যন্ত্রবিদ হয়ে উঠলেন, সৃষ্টি করলেন চমৎকার এক বাষ্পীয় মেশিন।
তা ছিল তিনটি ঢাকনাযুক্ত একটি ‘ডেকচি’। দুটি আঁট করে বন্ধ করা হতো। আর তৃতীয়, অভ্যন্তরীণ ঢাকনাটা—চাপদণ্ড বা পিস্টন—চলতে পারত। কখনও চাপদণ্ডের ওপর দিয়ে, কখনও নিচ দিয়ে ছিদ্রপথে বাষ্প যেত ‘ডেকচি’তে, অর্থাৎ সিলিন্ডারে; এবং তাতে চাপদণ্ড ওঠা-নামা করত। চাপদণ্ড যুক্ত থাকত পাম্প বা মেশিনের সঙ্গে। চাপদণ্ড চললে পাম্প কাজ করত ও মেশিন ঘুরত।
বাষ্প পাওয়ার উদ্দেশ্যে বিশেষ বাষ্পীয় বয়লারে পানি ফুটানো হতো। তা থেকে পাইপ দিয়ে বাষ্প যেত মেশিনে।
অন্যান্যদের মেশিনের চেয়ে ওয়াটের মেশিনটি ছিল অনেক উন্নততর। তাতে পানি ও কয়লা খরচ হতো কম। মেশিনটি কাজ করত দ্রুত এবং তাতে লাভ হতো বেশি।
ওয়াটের মেশিন দিয়েই শুরু হয় প্রসিদ্ধ ‘বাষ্পের শতাব্দী’। কলকারখানার চিমনি দিয়ে উড়তে লাগল ধোঁয়া। নদী-সমুদ্রে চলতে শুরু করল প্রথম জাহাজগুলো। তাদের আর অনুকূল হাওয়ার অপেক্ষা করতে হতো না। বাষ্পীয় মেশিনের সাহায্যে জাহাজকে পাল ছাড়া যেদিকে ইচ্ছা সেদিকেই নিয়ে যাওয়া যেত।
রেলের ওপর দিয়ে ছুটল প্রথম স্টিম এঞ্জিনগুলো। একশটি ঘোড়া একসঙ্গে যা মাল টানত, তারচেয়ে ঢের বেশি মাল টানতে পারত এসব ইঞ্জিন। উদ্ভাবিত হলো বাষ্পীয় মোটর গাড়িও। দুনিয়া বদলে যাচ্ছিল বড় তাড়াতাড়ি।
তবে ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটেনি। এমনকি পন্ডিত ব্যক্তিরাও সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারেননি, তাঁদের হাতে কী বিরাট শক্তি রয়েছে।
একদা ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের কাছে এলেন সাদামাঠা পোশাক পরিহিত এক যুবক। তিনি সম্রাটের সামনে মেলে ধরলেন অসাধারণ এক জাহাজের নক্সা। তাতে পাল নেই, উঁচু মাস্তুল নেই। জাহাজের মাঝখানে ছিল লম্বা ও সরু একটি চিমনি। তা দিয়ে বেরোচ্ছিল ধোঁয়ার কালো কালো কুণ্ডলি। জাহাজের দুই পাশে দেখা যাচ্ছিল বিরাট বিরাট চাকা। তখনকার দিনে সে ছিল এক বিভীষিকাময় চিত্র। নেপোলিয়ন সেই উদ্ভাবকের কথা শেষ পর্যন্ত না শুনেই তাঁকে তাড়িয়ে দিলেন। তার বারো বছর পরে সম্রাটকে নির্বাসনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেন্ট ইয়েলেনা দ্বীপে। হঠাৎ ডান দিকে দেখা গেল একখানি জাহাজ... তুমি ধরতে পেরেছ কোন জাহাজ? অবশ্যই ওই জাহাজটি। লম্বা চিমনি, বিরাট বিরাট চাকা। তাতে পত্পত করে উড়ছিল নেপোলিয়নের মারাত্মক শত্রু ব্রিটেনের পতাকা। পরে জানা গেল যে রবার্ট ফুল্টন—এই নাম ছিল জাহাজের উদ্ভাবকের—ফরাসি সম্রাট কর্তৃক বিতাড়িত হওয়ার পর সোজা ইংল্যান্ড চলে যান। ওখানে সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর উদ্ভাবন স্বীকৃতি লাভ করল...
সম্রাটকে নির্বাসনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেন্ট ইয়েলেনা দ্বীপে। হঠাৎ ডান দিকে দেখা গেল একখানি জাহাজ... তুমি ধরতে পেরেছ কোন জাহাজ? অবশ্যই ওই জাহাজটি। লম্বা চিমনি, বিরাট বিরাট চাকা। তাতে পত্পত করে উড়ছিল নেপোলিয়নের মারাত্মক শত্রু ব্রিটেনের পতাকা
রাশিয়ায় বাষ্পীয় মেশিন গড়েছিলেন বিখ্যাত যন্ত্রবিদ ইয়েফিম চেরেপানোভ ও তাঁর পুত্র মিরন চেরেপানোভ। তাঁদের মেশিনগুলো কাজ করত আকরিক ক্ষেত্রে এবং কর্মশালায়। আর ১৮৩৪ সালে চেরেপানোভরা উরালে চালু করেন রাশিয়ার প্রথম রেলপথ—তাতে ছিল স্টিম ট্র্যাকশন।
শত বছর ওয়াটের মেশিনের চেয়ে উৎকৃষ্টতর কোনো মোশন দেখা যায়নি। কিন্তু একদিন এক ঘটনা ঘটল।
ইংল্যান্ডে আয়োজিত হলো জাহাজের এক প্যারেড। জাহাজগুলো নিজ নিজ জায়গা নিল। নাবিকেরা সারি বেধে দাঁড়িয়ে ছিল ডেকে। এমন সময় জাহাজগুলোর সামনে দেখা দিল ছোট্ট একখানি জাহাজ। ওটাকে কেউ ওখানে আসার জন্য আমন্ত্রণ করেনি। নৌ-সেনাপতি জাহাজটিকে বন্দরে নিয়ে আসার হুকুম দিলেন। তার পশ্চাদ্ধাবন করল সবচেয়ে দ্রুতগামী জাহাজটি। কিন্তু কে আর তার নাগাল ধরে! ছোট্ট জাহাজখানি অনায়াসেই দূরে চলে যায়।
তার ক্যাপ্টেন ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার চার্লস পার্সনস। তিনি নিজের জাহাজটিতে স্থাপন করেন নতুন এক ইঞ্জিন—বাষ্পীয় টার্বাইন।
বাষ্পীয় মেশিন দেখতে ছিল পাম্পের মতো—ওপর-নিচ, ওপর-নিচ, আর টার্বাইন—ব্লেড বসানো লাটিমের মতো। প্রসঙ্গত, লাতিনে ‘টার্বো’ মানে লাটিম। পাইপ-নজল থেকে বাষ্প ধারা বেরিয়ে ব্লেডগুলোকে আঘাত করে এবং তার ফলে টার্বাইন ঘুরতে থাকে।
ইঞ্জিনের উদ্ভাবক জার্মান ইঞ্জিনিয়ার রুডোল্ফ ডিজেল। পিটার্সবুর্গের ‘রাশিয়ান ডিজেল’ কারখানার শ্রমিক আর ইঞ্জিনিয়াররা প্রায় ওই সময়ই নিজস্ব একটি মেশিন নির্মাণ করলেন। তা ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট, হালকা, এবং সবচেয়ে বড় কথা, কাজ করত সস্তা জ্বালানি-তেল দিয়ে
পার্সনস এই ‘লাটিম’টি কাত করে রাখলেন এবং টার্বাইনের বিমে স্ক্রু প্রপেলারটি মজবুত করে স্থাপন করলেন। টার্বাইন ঘুরলে স্ক্রু প্রপেলারও ঘুরত, এবং ফলে জাহাজটিও দ্রুত এগিয়ে চলত।
আজ টার্বাইন কেবল সাগর-মহাসাগরই পাড়ি দেয় না। তার প্রধান কর্মস্থল—বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো, যেখানে তাপকে রূপান্তরিত করা হয় বিদ্যুতে।
একশ বছর আগে আরও একটি ইঞ্জিন উদ্ভাবিত হয়েছিল। তা-ও শক্তি পেত জ্বালানি থেকে। তবে জ্বালানি জ্বলত বাষ্পীয় বয়লারের অগ্নিকুণ্ডে নয়, খোদ ইঞ্জিনটির অভ্যন্তরে। সে জন্য তার নামই হলো: অভ্যন্তরীণ দহনের ইঞ্জিন বা ইন্টারন্যাল কমবাশন ইঞ্জিন। সংক্ষেপে—আই. সি. ই.।
তা দেখতে বাষ্পীয় মেশিনের মতো সেই একই রকম সিলিন্ডার আর চাপদণ্ড। তবে তার বাষ্পের প্রয়োজন নেই, বয়লার এবং মোটা মোটা বাষ্পীয় পাইপের প্রয়োজন নেই। তা কাজ করে এভাবে।
সিলিন্ডারে ঢালা হয় তরল জ্বালানি—তেল বা পেট্রল। ওখানে তা জ্বলে ওঠে, এবং তার ফলে সৃষ্টি হয় উত্তপ্ত গ্যাস। ওই গ্যাস চাপদণ্ডের ওপর চাপ দেয় এবং তাকে ঠেলতে থাকে। আর চাপদণ্ড ঘোরাতে থাকে বিম, যাতে লাগানো আছে চাকা বা স্ক্রু প্রপেলার।
ইঞ্জিনের উদ্ভাবক জার্মান ইঞ্জিনিয়ার রুডোল্ফ ডিজেল। পিটার্সবুর্গের ‘রাশিয়ান ডিজেল’ কারখানার শ্রমিক আর ইঞ্জিনিয়াররা প্রায় ওই সময়ই নিজস্ব একটি মেশিন নির্মাণ করলেন। তা ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট, হালকা, এবং সবচেয়ে বড় কথা, কাজ করত সস্তা জ্বালানি-তেল দিয়ে।
আজ অভ্যন্তরীণ দহনের ইঞ্জিন হচ্ছে যানবাহনের প্রধান কর্মী। চারদিকে একটু ভালো করে চেয়ে দেখো। নদী-সমুদ্রে চলেছে স্টিমার আর জাহাজ। রেলপথে খাটছে ডিজেল এঞ্জিন। রাস্তা দিয়ে ছুটছে মোটর গাড়ি। আকাশে উড়ছে বিভিন্ন ধরনের বিমান আর হেলিকপ্টার। খেতে কাজ করছে ট্রাক্টর আর কম্বাইন। এ সবকিছুই ভাসছে, চলছে বা উড়ছে এই সাদাসিধে ও অল্পতে তুষ্ট ইঞ্জিনটির কল্যাণে।