বিদায় বিজ্ঞানী পিটার হিগস

নোবেল জয়ী পদার্থবিদ পিটার হিগস

কণাপদার্থবিজ্ঞানীদের সাধের স্ট্যান্ডার্ড মডেলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কণাটির নামকরণ করা হয়েছিল তাঁর নামানুসারে। বিজ্ঞানীরা বলেন হিগস বোসন, তবে গোটা দুনিয়া অবশ্য একে চেনে ‘ঈশ্বর কণা’ নামেই। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার জ্ঞান অনুযায়ী পদার্থের মৌলিক কণাদের ভর সৃষ্টির নেপথ্যে কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে হিগস বোসন, তথা হিগস ফিল্ডের।

পিটার হিগসের জন্ম ২৯ মে, ১৯২৯; ইংল্যান্ডের নিউক্যাসেল-আপন-টাইন শহরে। বাবা টমাস হিগস ছিলেন বিবিসির সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার। পিটারের শৈশব কেটেছে ব্রিস্টল শহরে। স্থানীয় যে কোথাম গ্রামার স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, একসময়ে সেখানে পড়াশোনা করেছেন আরেক দিকপাল ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক। তারপর সিটি অব লন্ডন স্কুল হয়ে কিংস কলেজ। ১৯৪৭ সালে পদার্থবিদ্যায় ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৫৪-তে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন হিগস। থিসিসের শিরোনাম, ‘সাম প্রবলেমস ইন দ্য থিওরি অব মলিকিউলার ভাইব্রেশনস’ (Some problems in the theory of molecular vibrations)।

১৯৬০ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার পদে যোগ দেন ড. পিটার হিগস। ছাত্রজীবন থেকেই এডিনবরা তাঁর প্রিয় শহর। এই শহরই জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সয়েলের জন্মভুমি, যিনি আবিষ্কার করেছিলেন তড়িৎ ও চৌম্বকত্ব আদতে একই বলের ভিন্ন প্রকাশরূপ। একে তড়িৎ-চুম্বকত্ব বলে। আলো একপ্রকার তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ।

আরও পড়ুন

ছাত্রাবস্থায় নিউক্লীয় অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও যোগ দিয়েছিলেন হিগস। আন্দোলনের সূত্র ধরেই পরিচয় হয়েছিল জোডি উইলিয়ামসনের সঙ্গে। ১৯৬৩-তে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন ওঁরা। পরে অবশ্য রাজনীতি ছেড়ে বিজ্ঞানই তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে। ১৯৬৪ সাল নাগাদ ৩৫ বছর বয়সী অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর পিটার হিগস একটি গবেষণা প্রবন্ধে এমন এক কণার অস্তিত্ব সম্পর্কে বলেছিলেন, যেটি ভূমিকা রাখে পদার্থের মৌলিক কণার ভর সৃষ্টির নেপথ্যে। প্রায় একই সময়ে অবশ্য আরও দুই বিজ্ঞানী একইরকম এক কণার কথা বলেছিলেন আলাদা গবেষণাপত্রে। তাঁরা হলেন ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া ইংলার্ট এবং রবার্ট ব্রাউট।

সময়টা বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক৷ হিগস বোসনের খোঁজে কাজ শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্রে৷ ৫৪ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গে এই পেল্লায় যন্ত্র বসাতে খরচ আনুমনিক ১ হাজার কোটি ডলার৷ কিন্তু কিছুদূর কাজ এগোনোর পরেই অর্থবরাদ্দে পিছু হটল সরকার৷ দেশের সাধারণ মানুষের করের টাকায় বিজ্ঞানের রহস্য উন্মোচনের যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দিহান দেশের কর্তাব্যক্তিরা। সংকটে বিজ্ঞানীদের এই মহাযজ্ঞ৷ এগিয়ে এলেন নোবেলজয়ী পদার্থবিদ লিওন লেডারম্যান৷ সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে দেশের রাস্ট্রপ্রধানদের এই গবেষণার গুরুত্ব বোঝাতে কলম ধরলেন তিনি৷ বিজ্ঞানসাংবাদিক ডিক টেরেসির সঙ্গে লিখে ফেললেন আস্ত একটা বই। স্ট্যান্ডার্ড মডেল ও হিগস বোসনের কথাও সেখানে লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখতে অভ্যস্ত বিজ্ঞানী বইটির এমন এক খটোমটো নাম দিলেন, যা মোটেই পছন্দ হলো না প্রকাশকের। বিরক্ত লেডারম্যান বইয়ের নাম পাল্টে রাখলেন দ্য গড-ড্যাম পার্টিকেল (The God-damn Particle)। ইংরেজিতে ‘গড-ড্যাম’ (God-damn) কথাটি ব্যবহৃত হয় ‘দুত্তেরি-ছাই’ জাতীয় একটা ভাব বোঝাতে। কিন্তু প্রকাশকের বদান্যতায় ওই ‘ড্যাম’ অংশটা বাদ পড়ে বইটি প্রকাশ পায় দ্য গড পার্টিকেল (The God Particle) নামে।

বিজ্ঞানসাংবাদিক ডিক টেরেসির সঙ্গে লিখে ফেললেন আস্ত একটা বই। স্ট্যান্ডার্ড মডেল ও হিগস বোসনের কথাও সেখানে লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখতে অভ্যস্ত বিজ্ঞানী বইটির এমন এক খটোমটো নাম দিলেন, যা মোটেই পছন্দ হলো না প্রকাশকের। বিরক্ত লেডারম্যান বইয়ের নাম পাল্টে রাখলেন দ্য গড-ড্যাম পার্টিকেল
আরও পড়ুন

বিজ্ঞানী হয়েও বইয়ের নামে ‘গড’ শব্দটি কেন ব্যবহার করলেন, তার দুটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন লেডারম্যান। একে তো এমন কণাকে শনাক্ত করতে গিয়ে নাজেহাল বিজ্ঞানীদের বানাতে হচ্ছে এক এলাহি কলাইডার। তাই তিনি বলতে চেয়েছিলেন ‘গড-ড্যাম’ পার্টিক্যাল। তা ছাড়া বইয়ের অষ্টম পরিচ্ছদে তিনি শোনালেন এক কাহিনি, ঠিক যেন বাইবেলে বর্ণিত ‘টাওয়ার অব ব্যাবেল’ নির্মাণ পর্বের ঢঙে। সেই যখন এক ভাষা ও এক সমাজের মানুষেরা সবাই হাত লাগাল এক বিশাল মিনার গড়তে, যার চূড়া গিয়ে পৌঁছাবে একেবারে স্বর্গে। মানুষের আকাশ ছোঁয়ার তোড়জোড় দেখে সর্বশক্তিমান মানুষের মধ্যে করে দিলেন হরেক রকমের ভাষা। চারদিকে শুরু হলো চরম বিশৃঙ্খলা। মিনার তৈরি আর হয়ে উঠল না। এই ঘটনার প্যারোডি করেই লিখলেন লেডারম্যান। তাঁর কাহিনি অনুযায়ী কণাজগতের বিশৃঙ্খলা দূর করতে স্বয়ং সর্বশক্তিমান মানুষের হাতে তুলে দিতে চাইলেন হিগস বোসন, যাতে মানুষ সন্ধান পায় এই অপূর্ব সৃষ্টির। সত্যিই তো এমন একটা কণা, যা নাকি গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে ভরের যোগান দেয়, তার নামের সঙ্গে ‘ঈশ্বর’ শব্দটি জুড়ে থাকা মানেই তো পাঠকের আগ্রহ অনেকগুণ বাড়িয়ে তোলা! হয়েছিলও তাই। প্রকাশের ঠিক পরেই বেস্টসেলার হয়ে ওঠে বইটি। আর হিগস বোসন সাধারণের মনে জায়গা করে নেয় ‘গড পার্টিকেল’ বা ‘ঈশ্বর কণা’ নামে। যদিও এসব করে বাঁচানো যায়নি সুপারকন্ডাক্টিং সুপারকলাইডার তৈরির প্রকল্প। প্রায় ২৪ কিলোমিটার সুড়ঙ্গ খোঁড়ার পর মার্কিন সরকার সেই প্রকল্প বাতিল করে দেয়।

পিটার হিগস
এই যন্ত্রেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। ডিটেক্টরের তথ্য বিশ্লেষণ করে ওঁরা ১২৫ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট (GeV) শক্তিসম্পন্ন একধরনের কণার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন, যা চরিত্রে অনেকটা হিগস বোসনের মতোই। গবেষকদের মতে, এই কণাটি হিগস বোসন হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯.৯৯৯ শতাংশ

গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীদের হাতে তখন সার্নের লার্জ ইলেকট্রন পজিট্রন কলাইডার (EPL) এবং শিকাগোর ফার্মিল্যাবে টেভাট্রন প্রোটন-অ্যান্টিপ্রোটন কলাইডার। কিন্তু চাই আরও শক্তিশালী কলাইডার। ঠিক সেই সময়েই সার্ন লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (LHC) তৈরির প্রস্তুতি নেয়। অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে প্রায় পনের বছর পর ২০০৮ সালের শেষ দিকে কাজ করতে শুরু করে এলএইচসি। পেল্লায় আকারের এই যন্ত্রটিতে হ্যাড্রন জাতীয় কণাদের (যারা কোয়ার্কের সমন্বয়ে তৈরি, যেমন প্রোটন, নিউট্রন, ইত্যাদি) মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো হয়। এলএইসির প্রধান তিনটি অংশ—কলাইডার, ডিটেক্টর এবং যন্ত্রগণনা বা কম্পিউটিং (Computing)। ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এলএইচসি সুড়ঙ্গে মাত্র চারটি সুনির্দিষ্ট বিন্দুতে তীব্র গতিশীল প্রোটন-প্রোটন (বা ভারী আয়ন) কণাস্রোত মুখোমুখি ধাক্কা খায়। এই যন্ত্রেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। ডিটেক্টরের তথ্য বিশ্লেষণ করে ওঁরা ১২৫ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট (GeV) শক্তিসম্পন্ন একধরনের কণার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন, যা চরিত্রে অনেকটা হিগস বোসনের মতোই। গবেষকদের মতে, এই কণাটি হিগস বোসন হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯.৯৯৯ শতাংশ। ৪ জুলাই, ২০১২ যখন সার্নের অডিটোরিয়ামে এই ঘোষণা হচ্ছে, তখন অনেক বিজ্ঞানীর সঙ্গে শ্রোতার আসনে বসে স্বয়ং পিটার হিগস। চোখে তাঁর আনন্দাশ্রু। জানালেন, ‘ভাবতে পারিনি আমার জীবদ্দশাতেই এই কণাটিকে খুঁজে পাওয়া যাবে।’ অবশেষে সম্পূর্ণতা পেল পদার্থবিদদের সাধের স্ট্যান্ডার্ড মডেল। ঠিক পরের বছরই পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় পিটার হিগস এবং ফ্রাঁসোয়া ইংলার্টকে। (বেঁচে থাকলে হয়তো রবার্ট ব্রাউটও পুরস্কারটার ভাগীদার হতেন। কিন্তু ২০১১ সালে মারা যান তিনি।) 

১৯৯৬ সালে চাকরি থেকে অবসর নিলেও পিটার হিগস দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সহকর্মী ও ছাত্রদের সঙ্গে গবেষণার কাজ চালিয়ে গেছেন, এমনকি অসমর্থ শরীরেও নিয়মিত পদার্থবিদ্যার কনফারেন্সে যোগ দিতেন। ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কিত পরীক্ষানিরীক্ষা নিয়েও খুব উৎসাহী ছিলেন তিনি। বিগত কয়েক বছর ধরে সেন্ট্রাল এডিনবরার ঐতিহাসিক নিউ টাউন পাড়ায় মহান স্কটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ম্যাক্সওয়েলের জন্মস্থানের কাছাকাছি একটি অ্যাপার্টমেন্টের ছয় তলায় থাকতেন ড. হিগস। বয়স হয়েছিল অনেক। দিন কয়েক ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। অবশেষে গতকাল ৮ মার্চ, ২০২৪ এডিনবরায় নিজের বাড়িতেই ৯৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই বিজ্ঞানী।

লেখক: শিক্ষক, রসায়ন বিভাগ, শ্রী রামকৃষ্ণ বয়েজ হাই স্কুল, কোচবিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত