চলে গেলেন হিগস বোসনের জনক পিটার হিগস

‘হিগস বোসন’ কণার জনক, নোবেল জয়ী ব্রিটিশ তত্ত্বীয় পদার্থবিদ পিটার হিগস মারা গেছেন। তাঁর কাজের মাধ্যমেই জানা গেছে বস্তুর ভরের উৎস কী। বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

পিটার হিগসবিবিসি

মারা গেছেন ‘হিগস বোসন’ কণার জনক, নোবেল জয়ী ব্রিটিশ তত্ত্বীয় পদার্থবিদ পিটার হিগস। ৮ এপ্রিল, সোমবার স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন ৯৪ বছর বয়সী এই বিজ্ঞানী। তাঁর নামে নামকৃত হিগস বোসন কণাটি ‘ঈশ্বর কণা’ বা ‘গড পার্টিকেল’ নামে খ্যাত। এই কণা—আসলে, এ কণার জন্য সৃষ্ট হিগস ক্ষেত্রই মহাবিশ্বের সব বস্তু কণার ভরের জোগান দেয় বলে দাবি করেছিলেন পিটার হিগস ও তাঁর দল। সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে এ কণার অস্তিত্ব শনাক্ত করা হয় ২০১২ সালে। সে জন্য ২০১৩ সালে ফ্রাঙ্কোই ইংলার্টের সঙ্গে যুগ্মভাবে নোবেল পুরস্কার পান পিটার হিগস।

গত শতাব্দীর ৭০ দশকে বেশ কজন বিজ্ঞানী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন হিগস বোসনের। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম ছিলেন স্কটল্যান্ডের এডিনবরার তত্কালীন অধ্যাপক পিটার হিগস। আরও ছিলেন বিজ্ঞানী টম কিবল, ফিলিপ অ্যান্ডারসন, কার্ল হেগেন, ফ্রাঁসোয়া ইংলার্ট, রবার্ট ব্রাউট ও জেরাল্ড গুরালনিক।

প্রশ্নটা ছিল, বস্তু কণারা ভর পায় কোত্থেকে? ধরে নেওয়া হয়, প্রকৃতিতে এমন একটা অতিরিক্ত কণা আছে, যার নিজের ভর আছে এবং সে শূন্যের মধ্যে খানিকটা শক্তি ছড়িয়ে রাখে। শূন্য অবস্থায় শক্তি বিরাজ করা কোয়ান্টাম তত্ত্বে নতুন কথা নয়। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এর মূল সুর। সে জন্য অবশ্য প্রথমে জানতে হবে, ভর কী।

কোনো স্থির বস্তুকে বাহ্যিক কোনো বলের (Force) সাহায্যে ধাক্কা দিলে সে কত তাড়াতাড়ি গতি পাবে, তা নিশ্চিত করে তার ভর। ভর যত বেশি হবে, সে গতি পাবে তত ধীরে। ধরা যাক, শুকনো স্বাভাবিক রাস্তায় একটা লোক হাঁটছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর হাঁটার গতি স্বাভাবিক। কিন্তু রাস্তায় যদি হাঁটুসমান পানি জমে থাকে, তবে তাঁর হাঁটার গতি আর আগের মতো থাকবে না। বেশ কমে যাবে। আবার পানির বদলে রাস্তায় যদি মধু জমে থাকে, তবে হাঁটার গতি কমে যাবে আরও বেশি।

হিগস বোসন কণা শূন্যের মধ্যে শক্তি ছড়িয়ে রাখে। জমাট শক্তির এই ক্ষেত্রকেই বলে হিগস ফিল্ড বা হিগস ক্ষেত্র। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের পর মৌলিক কণাগুলো যখন সৃষ্টি হয়েছিল, তখন এরা সবাই ছিল ভরশূন্য। আইনস্টাইনের E=mc2 সমীকরণের ভেতরেই লুকিয়ে আছে—বস্তু ও শক্তি আসলে সমতুল্য। তাই জমে থাকা শক্তিও জমে থাকা বস্তুর মতো। সেই জমাট শক্তিকে ঠেলে সামনে এগোতে গেলে সব কণারই স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হয়, তারপর ভরহীন সেই কণাদের ছুটতে হয় শূন্যের মধ্যে জমাট শক্তির ওই বাধা ঠেলে। অর্থাৎ হিগস ফিল্ডের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় মৌলিক কণাগুলো হিগস ফিল্ডের জমাট শক্তির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। ফলে তার গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। কণাগুলোকে তখন ভারী মনে হয়। এভাবেই কণারা ভর লাভ করে। এই বিষয়টাই প্রমাণ করে, তাদের ভর আছে।

এখানে দুটো বিষয় স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন। এক, হিগস বোসন সরাসরি মৌলিক কণাদের ভরের জোগান দেয় না, বরং এই কাজটি করে হিগস ক্ষেত্র। হিগস বোসনের নিজেরও ভর আছে। সেটাও আসে এই হিগস ক্ষেত্র থেকে। আর দুই, খেয়াল করলে দেখবেন, ইতিমধ্যেই বলেছি, হিগস ক্ষেত্র মৌলিক কণাদের ভরের জোগান দেয়। কোথাও বলিনি, পদার্থের সব ভর হিগস ক্ষেত্র থেকে আসে। কেন?

সাধারণ সব পদার্থ গঠিত হয় ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে। ইলেকট্রন একটি মৌলিক কণা, তাই একটি ইলেকট্রনের সব ভরই হিগস ফিল্ড থেকে আসে। প্রোটন কিন্তু মৌলিক কণা নয়। দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্ক মিলে প্রোটন তৈরি হয়। আপ কোয়ার্কের ভর ২.৩ MeV (মেগা ইলেকট্রন ভোল্ট), আর ডাউন কোয়ার্কের ভর ৪.৮ MeV। হিসেব অনুয়ায়ী, একটি প্রোটনের ভর হওয়ার কথা—(২.৩+২.৩+৪.৮) = ৯.৪ MeV। কিন্তু একটি প্রোটনের ভর আসলে ৯৩৮.২৮ MeV। তাহলে প্রোটনের বাকি ভর আসে কোথা থেকে? প্রোটনের বাকি ভর আসে শক্তিশালী নিউক্লীয় বলক্ষেত্র থেকে। বিদ্যুৎচুম্বক বলক্ষেত্র যেমন পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রন ও প্রোটনকে ধরে রাখে, তেমনি শক্তিশালী নিউক্লীয় বল দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্ককে একত্রে বেঁধে রেখে প্রোটন তৈরি করে। এই বেঁধে রাখার কাজটি করে শক্তিশালী নিউক্লীয় বলের কণা গ্লুয়ন। প্রোটনের বাকি ভরটুকু আসে এই ভরহীন গ্লুয়নের গতিশক্তি থেকে। দেখা যাচ্ছে, একটি প্রোটনের মোট ভরের ১ শতাংশেরও কম ভর আসে হিগস ক্ষেত্র থেকে।

তাহলে আলোর কণা ফোটন ভরহীন কেন? কারণ, ফোটন শুধু তারই সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় অংশ নেয়, যার নিজস্ব বৈদ্যুতিক চার্জ আছে। হিগস বোসন চার্জহীন কণা। তাই তার শূন্যে ছড়ানো জমাট শক্তিও কোনো চার্জ বহন করে না। এ কারণেই আলোর কণা তার মধ্য দিয়ে চলতে গেলে বাধা পায় না। তাই ফোটন কণার স্থির ভর শূন্য।

পিটার হিগস
উইকিমিডিয়া

এটুকু বুঝে ফেললে এবারে, একটু উল্টোভাবেও কথাটা বলা প্রয়োজন। কারণ, আসলে হিগস ফিল্ডের এক ধরনের কোয়ান্টাম উত্তেজনার কারণে হিগস বোসন কণা তৈরি হয়। অর্থাৎ হিগস বোসন কণা শনাক্ত করা গেলে হিগস ক্ষেত্রের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। এ কারণেই গোটা বিশ্বের সব পদার্থবিদ এই কণাটির জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠেন।

হিগস বোসনের কল্যাণে দুর্বল নিউক্লীয় তত্ত্বটির যে কাঠামো দাঁড়িয়েছিল এবং তা থেকে যেসব ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, গত দুই দশকে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। পাওয়া যায়নি স্বয়ং কণাটিকেই। তারপর ২০০৮ সালে চালু হয় লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার বা এলএইচসি। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী কণাত্বরক যন্ত্র। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল হিগস বোসন কণা খুঁজে বের করা।

এলএইচসির সাইক্লোট্রন বা কণাত্বরক যন্ত্রে প্রবল গতি নিয়ে প্রোটন কণার স্রোত ছোটাছুটি করে পরস্পরকে ধাক্কা মারে। এ থেকে তৈরি হয় বহু ধরনের কণা। কিছু ভারী কণাও তৈরি হয়। তবে এগুলো অস্থায়ী। দ্রুতই এগুলো কয়েকটা হালকা কণার জন্ম দিয়ে নিজে বিলুপ্ত হয়ে যায়। হিগস কণার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটার কথা। সাইক্লোট্রনে জন্ম নেওয়া নানা ধরনের কণাকে পর্যবেক্ষণ করে, তাদের উত্স যে অন্য কণা নয়, হিগস কণা—এটা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এ প্রকল্পের পদার্থবিদদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

অবশেষে ২০১২ সালের ৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এলএইচসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, হিগস বোসন কণার অস্তিত্ব প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাঁরা এখন শতভাগ নিশ্চিত, নতুন আবিষ্কৃত কণাটিই হিগস বোসন। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় হিগস ক্ষেত্রের অস্তিত্ব। জবাব মেলে বহুদিনের একটা প্রশ্নের—বস্তুর ভরের উত্স কী।

হিগস বোসন কণার জনক পিটার হিগসের জন্ম ১৯২৯ সালের ১৯ মে। তাঁর দুই সন্তান—ক্রিস ও জনি। তাঁর স্ত্রী জোডি ২০০৮ সালে মারা গিয়েছেন। পিটার হিগসের প্রতি বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, উইকিপিডিয়া ও বিজ্ঞানচিন্তা

আরও পড়ুন