রিঅ্যাক্টরের ইতিকথা
সৌর শক্তি
পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয় নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর। এতে নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ায় প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন হয়, যা পরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। রিঅ্যাকটর কী, কীভাবে কাজ করে তা ছোটদের জন্য খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে রিঅ্যাকটরের ইতিকথা বইয়ে। আলেক্সেই ক্রিলোভের লেখা এই বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন বিজয় পাল। মস্কোর ‘রাদুগা’ প্রকাশন থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে…
‘চিরদিন আলো দিক সূর্য’—এ হচ্ছে শিশুদের গানের একটা কথা। আকাশে যখন সূর্য থাকে, যখন চারদিকে অনেক আলো ও তাপ, তখন কী ভালোই না লাগে।
সৌর শক্তি—সে হচ্ছে পৃথিবীতে প্রাণের উৎস, সূর্যের তাপে অঙ্কুরোদ্গম হয়, ফল পাকে ও গমে রস দেখা দেয়, বিশাল ও উঁচু গাছগুলো আকাশ ‘স্পর্শ’ করতে চায়, ঘাসের সবুজ গালিচা আবৃত করে মাটি।
কিন্তু মরুভূমিতে, যেখানে পানি নেই, প্রখর সূর্যতাপে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বালু, ফাটতে থাকে পাথর। ওখানে সূর্যের সঞ্জীবক শক্তি পরিণত হয় বিনাশী ও অপ্রয়োজনীয় এক শক্তিতে।
‘অতিরিক্ত’ সৌরশক্তি আছে কেবল মরুভূমিতেই নয়। প্রতিটি সূর্য রশ্মিই তো আর নিজের ঘাস কিংবা পাতা খুঁজে পায় না। রৌদ্র শহরের রাস্তাগুলোর অ্যাসফল্ট আর বাড়ির ছাদ গরম করে। মানুষ বহুকাল আগে থেকেই ভাবছে, কীভাবে এই ‘অতিরিক্ত’ শক্তিটির সদ্ব্যবহার করা যায়।
তারা গড়ল বিভিন্ন ধরনের অনেক সৌরযন্ত্র। তার মধ্যে সবচেয়ে সাদাসিধেটি হলো—বিবর্ধক কাচ বা ম্যাগনিফাইয়িং লেন্স। তুমি নিশ্চয়ই নিজ হাতে তা ধরে থাকবে। ওই কাচ সূর্যালোক সংগ্রহ করে এবং তা থেকে সরু রশ্মির আকারে নিঃসৃত আলোতে জ্বলতে শুরু করে কাঠের টুকরো, কাগজ এবং সময় সময় এমনকি—বলতে আপত্তি নেই—তোমার প্যান্টও। কাচ, অর্থাৎ লেন্স যত বড় হবে, সৌর সূচও তত শক্তিশালী হবে। প্যান্ট জ্বালানোর পক্ষে একেবারে ছোট্ট একটি লেন্সই যথেষ্ট। আর রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে কেটলিতে চায়ের পানি ফোটানোর জন্য লেন্সটি হতে হবে ট্রাক্টরের চাকার সমান। আর বালতি কিংবা পিপে ভরা পানি ফোটানোর জন্য? তার জন্য প্রয়োজন অনেক বড় বড় লেন্স।
এককথায়, এটা সৌর শক্তি ‘ধরার’ শ্রেষ্ঠ উপায় নয়। তুমি সম্ভবত সৌর ব্যাটারির কথা শুনেছ। ওগুলো মহাকাশযানকে শক্তি জোগায়। আর হয়তো ছবিতেই তুমি তা দেখেছ। ওগুলো দেখতে কারুকার্য খচিত ঝাঁঝরি-পাখার মতো। এই ব্যাটারি তৈরি করা হয় বিশেষ জিনিস—অর্ধ-পরিবাহী বা সেমি-কণ্ডাক্টর সামগ্রী দিয়ে। সৌর কণিকার আঘাতে তাতে সৃষ্টি হয় বিদ্যুৎ।
এই বিদ্যুৎ দিয়ে পূর্ণ করা হয় প্রায় মোটর গাড়িরই মতো সাধারণ ব্যাটারিগুলো। এবং মহাকাশযানেও সর্বদা বিদ্যুৎ শক্তি থাকে।
সৌর ব্যাটারিগুলো আপাতত খুব একটা ভালো কাজ করছে না। তা ধৃত সৌর শক্তির কেবল দশমাংশই বিদ্যুতে ‘রপান্তরিত করে’। তাই এই ব্যাটারি ব্যবহৃত হয় একমাত্র মহাকাশেই যেখানে অন্য উপায়ে শক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
তবে সৌর ব্যাটারিগুলো যদি অন্ততপক্ষে তিনগুণ ভালোভাবে কাজ করে, তাহলে তা পৃথিবীতেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
আমাদের কাছে সূর্য প্রেরিত সমগ্র শক্তি ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছে না। আমাদের গ্রহটি বায়মণ্ডলের পুরু স্তর, মেঘ, কলকারখানার চিমনি দিয়ে নির্গত ছাইভস্ম এবং ধূলিকণা দিয়ে ঢাকা।
সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র সম্ভবত গড়া হবে মরুভূমিতে। উত্তপ্ত বালুকে ঢেকে দেওয়া হবে বিশাল অর্ধ-পরিবাহী ‘কম্বল’ দিয়ে। সূর্য রশ্মি তাকে দেবে আপন শক্তি এবং পরিণত হবে বিদ্যুৎ প্রবাহে। স্টেশনে সেই বিদ্যুৎ সংগ্রহ করে পরে তার মাধ্যমে তা সরবরাহ করা হবে বাড়িতে বাড়িতে, কলকারখানায়, স্কুলে...।
কিন্তু আমাদের কাছে সূর্য প্রেরিত সমগ্র শক্তি ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছে না। আমাদের গ্রহটি বায়মণ্ডলের পুরু স্তর, মেঘ, কলকারখানার চিমনি দিয়ে নির্গত ছাইভস্ম এবং ধূলিকণা দিয়ে ঢাকা। সে জন্যই বিজ্ঞানীরা এখন মহাকাশে একটি ‘অর্ধ-পরিবাহী’ বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়ার চেষ্টা করছেন। ওখানে সৌররশ্মির জন্য কোনো ধরনের বাধা নেই। কেন্দ্রটির উৎপাদিত বিদ্যুৎকে পরিণত করা হবে ক্ষমতাসম্পন্ন বেতার তরঙ্গে (রেডিও ওয়েভ) এবং তা পৃথিবীতে প্রেরিত হবে। আর এখানে এই রশ্মি আবার পরিণত হবে বিদ্যুৎ প্রবাহে।
বিজ্ঞানীরা আরও একটি ‘সৌর’ ডিজাইন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। ওটা তাঁদের ‘বাতলে দিয়েছে’ খোদ প্রকৃতিই।
তুমি জানো যে উদ্ভিদ আর প্রাণীর জন্য শক্তির উৎস হলো সূর্য। গাছের পাতা এবং ঘাস প্রচুর পরিমাণ সূর্য-রশ্মি সংগ্রহ করে। ওগুলোর শক্তির প্রভাবে উদ্ভিদের কোষগুলোতে এক পদার্থ পরিণত হয় অন্য পদার্থে। ওসব পদার্থেই সঞ্চিত হয় শক্তি। তবে তা আর সৌরশক্তি নয়, রাসায়নিক শক্তি। আমরা যখন ভাত ও দুধ খাই, আমরা ঠিক ওই শক্তিটাই ব্যবহার করি। মানুষের জন্য খাদ্যও যে শক্তির উৎস! যেমন সূর্য হচ্ছে উদ্ভিদের জন্য শক্তির উৎস।
জীবন্ত কোষেরা কীভাবে সূর্য-রশ্মি ব্যবহার করে, তা যদি তাদের কাছে শেখা যেত! আর পরে লব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে গড়া যেত জীবন্ত কোষের চেয়ে শতকোটি গুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন কৃত্তিম কিছু ‘কোষ-কারখানা’।
দ্রব অনেক সূর্য-রশ্মি শুষে নেয়, এবং তার ফলে ওগুলোতে সৃষ্টি হয় রাসায়নিক শক্তি কর্তৃক ‘পুর দেওয়া’ নতুন কিছু পদার্থ।
তাহলে মরুভূমিগুলোতে এবং যেখানেই প্রচুর রোদ আছে, সেখানেই দেখা দিতে পারে বিস্ময়কর সব শক্তিক্ষেত্র। কল্পনা করো: দক্ষিণের প্রখর সূর্যতপ্ত মরুভূমির হলদে বালুর ওপর দিয়ে এঁকে-বেঁকে চলেছে স্বচ্ছ পাইপগুলো। পাইপগুলোর ভেতর দিয়ে বইছে ‘জ্যান্ত’ অথবা, রসায়নবিদদের ভাষায়, জৈব দ্রবগুলোর নদী। ওই দ্রবগুলো ঠিক উদ্ভিদের কোষের দ্রবেরই মতো।
দ্রব অনেক সূর্য-রশ্মি শুষে নেয়, এবং তার ফলে ওগুলোতে সৃষ্টি হয় রাসায়নিক শক্তি কর্তৃক ‘পুর দেওয়া’ নতুন কিছু পদার্থ। পাম্পের সাহায্যে দ্রবগুলো প্রেরিত হয় কল-কারখানার কর্মশালায়। ওখানে তা ফিল্টারে পরিস্রুত করে শক্তি-সমৃদ্ধ দ্রব্যাদি নিয়ে নেওয়া হয়। ‘ফসল’ তুলে নিয়ে দ্রবতে প্রয়োজনীয় পদার্থ যোগ করা হয় এবং ফের তাকে পাঠানো হয় শক্তির সন্ধানে।
মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রায় তা-ই করে আসছে। তারা মাটিতে বীজ বপন করে, অঙ্কুরের যত্ন নেয় এবং ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করে কবে সূর্য-রশ্মির প্রভাবে উদ্ভিদ বড় হবে, পেকে উঠবে এবং আপন কোষগুলোতে পুষ্টিকর পদার্থ সঞ্চিত করবে। উদ্ভিদ তুলে ফেলা হয় এবং ভবিষ্যৎ ফসলের জন্য সংগ্রহ করে রাখা হয় বীজ। আর তারপর খাওয়া হয় গম, যব, টমেটো, আলু, গাজর কিংবা বীট। যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, এগুলো থেকে নেওয়া হয় শক্তি-সমৃদ্ধ দ্রব্যগুলো।
কৃত্রিম ‘সৌর’ ক্ষেত্রগুলোর জন্য প্রচুর জায়গা প্রয়োজন। আর পৃথিবীতে এরকম জায়গার অভাব নেই। তা আছে আফ্রিকায়—বিখ্যাত সাহারা মরুভূমি, এশিয়ায়—গোবি মরুভূমি, সোভিয়েত ইউনিয়নে—কারাকুম মরুভূমি।
তা এই ‘সৌর’ ক্ষেত্রগুলো থেকে কি প্রচুর শক্তি মিলবে? হ্যাঁ, প্রচুরই বৈকি—আজ আমাদের হাতে নিষ্কাশিত সব জ্বালানি দিয়ে যে শক্তি উৎপাদিত হয়, তার চেয়ে ৬০ গুণ বেশি।
তা ছাড়া জ্বালানি ও পারমাণবিক ‘খোরাকের’ সঙ্গে সঙ্গে সৌর ‘খোরাক’ ব্যবহৃত হলে তা প্রকৃতির কোনো ক্ষতি করবে না। তা বায়ুমণ্ডল, জল ও মাটি দূষিত করবে না।
আর গরম জায়গাগুলো থেকে ঠান্ডা জায়গাগুলোতে শক্তি প্রেরণ করে লোকে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তার ফলে আমাদের গ্রহ বসবাসের পক্ষে আজকের চেয়ে ঢের বেশি আরামজনক হয়ে উঠবে।
ব্যাপারটি খুবই প্রলোভনজনক, তাই নয় কি? আর হয়তো-বা তুমি ভাবছ এ সবই অলীক কল্পনা। আপাতত অবশ্য কল্পনাই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা তো কাজে লেগে গেছেন। তার মানে, সৌরক্ষেত্র একদিন দেখা দেবেই।