পানির শক্তি আমরা কীভাবে ব্যবহার করি

পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয় নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর। এতে নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ায় প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন হয়, যা পরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। রিঅ্যাকটর কী, কীভাবে কাজ করে তা ছোটদের জন্য খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে রিঅ্যাকটরের ইতিকথা বইয়ে। আলেক্সেই ক্রিলোভের লেখা এই বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন বিজয় পাল। মস্কোর ‘রাদুগা’ প্রকাশন থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে…

এমন দৃশ্য হয়তো তুমি দেখেছ, কাঠের নালী থেকে ব্লেড-বসানো চাকায় পড়ছে জলধারা। চাকাটি ঘুরছে এবং বড় একটি চ্যাপ্টা পাথর ঘোরাচ্ছে, ওটার নাম পেষণি। পাথরের মাঝখানে ছিদ্র। তাতে ঢালা হচ্ছে শস্য। পেষণি অচল এক ভিত্তির ওপর ঘর্ষিত হচ্ছে এবং পেষণের মাধ্যমে শস্যকে ময়দায় পরিণত করছে।

ময়দা গিয়ে পড়ছে বস্তায়, আর যাঁতাচালক বস্তাগুলো বোঝাই করছে ঘোড়ার গাড়িতে। এই হচ্ছে সেই বিখ্যাত জলীয় যাঁতাকল বা ময়দাকল যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানবজাতিকে খাদ্য জুগিয়েছে।

কিংবা এমন ব্যাপারও হয়তো লক্ষ্য করেছ। জলীয় চাকা থেকে চলে গেছে মোটা একটি বিম। বিমে দস্তযুক্ত কয়েকটা চাকা।

চাকাগুলো ঘোরাচ্ছে তুরপুন (বা ড্রিল), হাতুড়ি তুলছে কিংবা কামারে ভস্ত্রা (হাপর) ফুলাচ্ছে। ও হচ্ছে কলঘর, মেকানিকেল ওয়ার্কশপ।

ময়দার কলে শস্য চূর্ণ করা হতো। কলঘরে তৈরি করা হতো জাহাজের জন্য নোঙর অথবা ঘোড়ার নাল। এসব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের কাজ চলত, আর ওখানে কাজ করত বিভিন্ন ধরনের মেশিন। তবে কাজের জন্য শক্তি পেত একটি উৎস থেকে। ওই উৎসটি হচ্ছে পানি।

মধ্য যুগে ভেনিস নগরীতে এমনকি বিশেষ একটি পুকুরও ছিল যেখানে আয়োজিত হত যন্ত্রবিদদের প্রতিযোগিতা। তাঁরা অচল পানিকে কাজ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করতেন। বলাই বাহুল্য, তাঁদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতো।
আরও পড়ুন

পানির শক্তি গতিতে। আমরা যত চেষ্টাই করি না কেন বদ্ধ পানিতে কিন্তু কোনো চাকাই ঘুরেবে না।

তবে এ ব্যাপারটি সবাই সব সময় বোঝেনি। মধ্য যুগে ভেনিস নগরীতে এমনকি বিশেষ একটি পুকুরও ছিল যেখানে আয়োজিত হত যন্ত্রবিদদের প্রতিযোগিতা। তাঁরা অচল পানিকে কাজ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করতেন। বলাই বাহুল্য, তাঁদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতো। উদ্ভাবকরা নিজেদের অকৃতকার্যতার বিভিন্ন কারণ দর্শাতেন। কেউ কেউ বলতেন, পানি ছিল অত্যধিক ঠান্ডা, কেউ কেউ বলতেন, সূর্য অত্যধিক গরম। কিন্তু আসল কারণটি ছিল অন্যত্র। পানি যে একেবারেই বইছিল না...

তা কোথা থেকে এবং কোথায় বইছে আমাদের নদ-নদীগুলো? ওগুলো ওপর থেকে নিচের দিকে বইছে। পাহাড়-পর্বত থেকে নিম্নভূমিতে, আর শেষ পর্যন্ত সমুদ্র অভিমুখে। নদীগুলোকে কী চলতে বাধ্য করছে? কোন শক্তি এই বিশাল পানিকে নিয়ে যাচ্ছে শত শত হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে, সাগর-মহাসাগরের দিকে? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা আছে। সে হচ্ছে অভিকর্ষ শক্তি। গ্লাস থেকে পড়া পানি তো হামেশাই মেঝের ওপর দেখা যায়।

আরও পড়ুন

কিন্তু যে পানি নিজে কেবল ওপর থেকে নিচের দিকে বইতে পারে, তা পাহাড়ের ওপরে ওঠে কীভাবে? তাকে কোন শক্তিশালী পাম্প ওখানে তুলে দেয়? সেই পাম্প হচ্ছে সূর্য।

সূর্য রশ্মি তপ্ত করে কেবল পাথর, বালু আর উদ্ভিদকেই নয়। তা গরম করে হ্রদ, সাগর আর মহাসাগরের পানিও। জলীয় বাষ্প উঠে অনেক উচ্চে, বায়ুমণ্ডলে এবং তা প্রতি মিনিটে সঙ্গে নিয়ে যায় শত কোটি টন পানি। বাষ্প যখন শীতল বায়ুস্তরে পৌঁছে তখন তা আবার পানিতে পরিণত হয়। সেই পানি ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পৃথিবীর দিকে ছুটতে থাকে এবং বৃষ্টি কিংবা তুষারের আকারে তার ওপরিভাগে বর্ধিত হয়। পৃথিবীতে তা নদীনালার সৃষ্টি করে, যা ফের খরবেগে অথবা মন্থর গতিতে পানি বয়ে নিয়ে যায় সমুদ্র অভিমুখে। এই প্রক্রিয়ার আর শেষ নেই…।

এই মহান গতিটিকে বলা হয় প্রকৃতির জলাবর্ত। হাজার হাজার বছর আগেকার মতো পানি আজও মানুষের সেবা করছে। এটা সত্যি যে তা এখন কেবল শস্য পেষণ করছে না কিংবা কামারশালার হাপরে স্রেফ আগুনই জমকিয়ে তুলছে না। তার প্রধান কাজ—বিদুৎ উৎপাদন।

নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়। বাঁধে রাখা হয় বিশাল দ্বারযুক্ত কয়েকটি পাইপ। প্রতিটি পাইপে স্থাপিত হয় ব্লেডযুক্ত চাকা—অর্থাৎ হাইড্রোলিক টার্বাইন, অথবা সহজ ভাষায় পানি-চালিত টার্বাইন। বিম টার্বাইনকে যুক্ত করে বৈদ্যুতিক জেনারেটরের সঙ্গে।

পানি বাঁধে বাধা পেয়ে ফুলতে শুরু করে। তা যতই বেশি ওপরে উঠতে থাকে, তাতে ততই অধিক শক্তি সঞ্চিত হয়। যখন পাইপের দ্বার খোলা হয়, পানি টার্বাইনের দিকে ছোটে এবং বিপুল চপের সঙ্গে তার ব্লেডে আঘাত করে। টার্বাইন পাক খেতে আরম্ভ করে। তার সঙ্গে পাক খায় বৈদ্যুতিক জেনারেটর এবং তা বিদ্যুৎ প্রস্তুত করে।

আরও পড়ুন