রিঅ্যাক্টরের ইতিকথা
পানি কি জ্বলতে পারে
পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয় নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর। এতে নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ায় প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন হয়, যা পরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। রিঅ্যাকটর কী, কীভাবে কাজ করে তা ছোটদের জন্য খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে ‘রিঅ্যাকটরের ইতিকথা’ বইয়ে। আলেক্সেই ক্রিলোভের লেখা এই বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন বিজয় পাল। মস্কোর ‘রাদুগা’ প্রকাশন থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে…
কোনো এক রূপকথায় বলা হয়েছে যে, একবার দুই শেয়াল দিয়াশলাই নিয়ে গেল নীল সমুদ্রের ধারে, আর আগুন লাগিয়ে দিল সেই সমুদ্রে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল নীল সমুদ্র, আর দমকল বাহিনীর লোকেরা এসে পিঠে-পুলি ও শুকনো ব্যাঙের ছাতা ছুঁড়ে নেভাল সে আগুন। ‘আরে ধূর, যত সব বাজে কথা বলবে তুমি; ‘পানি আবার জ্বলে নাকি?’ সমুদ্রের পানি, নদীর পানি, হ্রদের পানি—কোনো পানিই জ্বলে না। পানি দিয়ে বরং আগুনই নেভানো হয়।’ ঠিকই কথা। তবে সম্পূর্ণ ঠিক নয়।
পানি নিজে জ্বলে না, সে ধ্রুব সত্য। কিন্তু মজার ব্যাপারটি হলো এই পানি দুটি উপাদান নিয়ে গঠিত, যার একটি অনায়াসে জ্বলে, আর অন্যটি জ্বলতে চমৎকার সাহায্য করে। ওগুলোর নাম হচ্ছে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। তবে এখানেই সব কথা শেষ নয়। স্বাভাবিক হাইড্রোজেনের মধ্যে কখনও কখনও সাধারণ অণুর চেয়ে দ্বিগুণ ভারী অণু উপস্থিত থাকে। এরূপ হাইড্রোজেনকে বলে হয় ভারী হাইড্রোজেন বা ডিউটেরিয়াম। শক্তির প্রাচুর্য নিয়ে মানুষের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা তার সঙ্গেই জড়িত।
বহুকাল আগে থেকেই জানা আছে যে ভারী হাইড্রোজেনের দুটি পরমাণু একসঙ্গে যুক্ত করলে নতুন একটি উপাদান, হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস মিলবে এবং অনেক শক্তি নিঃসৃত হবে। এক কিলোগ্রাম ডিউটেরিয়াম যে পরিমাণ শক্তি দেয়, ঠিক সেই পরিমাণ শক্তি দিতে পারে ১ কোটি ৪০ লাখ কেজি কয়লা। অবশ্য তার জন্য যদি কয়লা জ্বালানো যায়।
আর তুমি জানো, সাগর-মহাসাগরে কী পরিমাণ ডিউটেরিয়াম আছে? বিপুল পরিমাণ, তা দিয়ে মানবজাতির ৫ হাজার কোটি বছর চলবে।
তবে দুটি নিউক্লিয়াস একসঙ্গে যুক্ত করা খুব কঠিন কাজ। এজন্য ডিউটেরিয়ামকে সূর্যের তাপমাত্রা—২০ কোটি ডিগ্রি পর্যন্ত উত্তপ্ত করা প্রয়োজন! আর একমাত্র এরূপ উত্তাপের মধ্যেই ডিউটেরিয়ামের নিউক্লিয়াসগুলো একত্রে মিলিত হবে ও তাদের মধ্যে লুকায়িত শক্তি দান করবে।
কিন্তু এরূপ নারকীয় উত্তাপে প্রকৃতির সবকিছু বাষ্পীভূত হয়ে যায়, পরিণত হয় গ্যাসে—প্লাজমায়। তাহলে যে যন্ত্রটিতে ডিউটেরিয়াম গরম করা হবে তা-ও গ্যাস হয়ে যাবে? অবশ্যই। তার মানে, কিছুই করা যাবে না? সুখের বিষয় যে, আসলে তা কিন্তু ততটা নৈরাশাজনক নয়।
ব্যাপারটি এই যে, প্লাজমা হচ্ছে পদার্থের কণিকা আর টুকরোর মিশ্রণ। ইলেকট্রন, নিউট্রন, নিউক্লিয়ার টুকরো এবং পরমাণুর আস্ত আস্ত নিউক্লিয়াস। এর সবগুলোই বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত। বিজ্ঞানীরা এই সুযোগটাই নিলেন। তাঁরা প্লাজমাকে চুম্বক ক্ষেত্রে (ম্যাগনেটিক ফিল্ডে) ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন।
চুম্বক ক্ষেত্র কী? সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে চেষ্টা করা যাক।
তুমি নিশ্চয়ই চুম্বক দেখেছ। ধাতুর এই টুকরোটি লোহার সবকিছু (পেরেক, পিন, ক্লিপ) নিজের দিকে টানে। নিজেও লোহার সঙ্গে আটকে থাকে।
আজ অবধি পৃথিবীতে কেউ ডিউটেরিয়ামকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় গরম করতে এবং তার কাছ থেকে কার্যোপযোগী শক্তি সংগ্রহ করতে পারেনি।
তুমি যেসব বই পড়েছ কিংবা অদূর ভবিষ্যতে পড়বে, তার অনেকগুলোতে চুম্বক এবং লৌহচূর্ণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বর্ণনা আছে। একটা পিচবোর্ডে কিছুটা লৌহচূর্ণ রাখো। পিচবোর্ডটির নিচ থেকে চুম্বক দিয়ে সামান্য আঘাত করো। লৌহচূর্ণের স্তূপটি জাদুর মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। স্তূপের পরিবর্তে দেখা দেবে স্পষ্ট ও সুন্দর বৃত্ত, লৌহচূর্ণ সৃষ্ট বৃত্ত। বলাই বাহুল্য, এখানে কোন জাদু নেই। ব্যাপারটা খুব সহজ, লৌহচূর্ণকে প্রভাবিত করেছে চুম্বক ক্ষেত্র এবং তা বাধ্যের মতো তার শক্তিরেখা (লাইন অব ফোর্স) বরাবর সারি বেধে দাঁড়িয়ে পড়ে।
চুম্বকের চারপাশে শক্তিরেখা আছে সবসময়, তা লৌহচূর্ণ থাকুক আর নাই বা থাকুক। চূর্ণগুলো স্রেফ অদৃশ্য রেখাগুলোই ডেভেলপ করে ফোটোর কাগজে ডেভেলপার যেমন ছবি ডেভেলপ করে তা অনেকটা তারই মতো। শক্তিরেখার এই জালটিই চার্জযুক্ত প্রতিটি কণাকে নির্দিষ্ট পথে চলতে বাধ্য করে। তাকে যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে উড়তে দেয় না। চুম্বকমুষ্টি বিভিন্ন দিকে উড়ন্ত প্লাজমা চেপে সরু ফিতার মতো করে রাখে। ফিতা ও যন্ত্রের দেয়ালের মাঝে শূন্যতা দেখা দেয়। এতে দেয়ালগুলো আস্ত ও অক্ষত থেকে যায়।
চুম্বকের চাপ (ম্যাগনেটিক প্রেসার) আরও একটি ভালো কাজ করে। নিউক্লিয়সগুলো যাতে একত্রে মিলিত হতে শুরু করে তার জন্য ওগুলোকে সংখ্যায় অনেক হতে হবে। তাহলেই নিউক্লিয়াসগুলো সহজে পরস্পরকে খুঁজে পেতে পারে। চুম্বক ক্ষেত্র নিউক্লিয়াসগুলোকে একটি স্তূপে জড় করে, আগে হোক পরে হোক তারা পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খায়, একত্রে মিলিত হয় এবং শক্তি নিঃসৃত করে।
কিন্তু…
এ সবকিছুই আপাতত স্বপ্ন। আজ অবধি পৃথিবীতে কেউ ডিউটেরিয়ামকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় গরম করতে এবং তার কাছ থেকে কার্যোপযোগী শক্তি সংগ্রহ করতে পারেনি। সত্যি যে সোভিয়েত বিজ্ঞানীয়া (বর্তমান রাশিয়া) ‘তকামাক’ নামে এক সিরিজ যন্ত্র ডিজাইন ও আবিষ্কার করেছেন। ‘তকামাকের’ সবশেষ মডেলে ইতিমধ্যে ২ কোটি ডিগ্রি তাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। তা প্রয়োজনীয় তাপমাত্রার চেয়ে মাত্র ১০ গুণ কম। আপাতত তকামার যন্ত্রগুলোতে শক্তি-খরচ হচ্ছে যা শক্তি পাওয়া যায় তার চেয়ে অনেক যেশি, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুসন্ধান ও গবেষণা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
প্লাজমাকে বশীভূত করা খুবই কঠিন কাজ। চুম্বক জালে তা নিরবচ্ছিন্নভাবে ছিদ্র খুঁজে বেড়ায়, ছিদ্র যত করেই হোক না কেন তাতে কিছু এসে যায় না। যেই কোনো ছিদ্র খুঁজে পায়, অমনি তা প্রবল বেগে বাইরের দিকে হটতে থাকে। ডিউটেরিয়ামের নিউক্লিয়াসগুলো—আর এগুলোর জন্যই বোনা হয় চুম্বক জালটি—তখন বিভিন্ন দিকে উড়ে যায় এবং আবার সবকিছু আরম্ভ করতে হয় একেবারে শুরু থেকে।
সেই অন্য বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়াস থেকে শক্তি পাওয়ার অন্যান্য উপায়ও খুঁয়েছেন। যেমন সোভিয়েত পদার্থবিদ আকাদেমিশিয়ান নিকোলাই বাসোড অনুসৃত উপায়টির বিষয়ে বলা যাক। ভারী পানির ছোট্ট একটা ফোঁটা, যা ডিউটেরিয়ামের পরমাণু দ্বারা সম্পৃক্ত, ঠান্ডায় জমানো হয়। ফলে সেটি পিনের অগ্রভাগের সমান আয়তনের ক্ষুদ্র এক টুকরো বরফের আকার ধারণ করে। গুটিকাটির ওপর ছাড়া হয় লেজার রশ্মি। লেজার—এ হচ্ছে ক্রিস্ট্যাল বা গ্যাসযুক্ত পাইপ, যা বিপুল শক্তিসম্পন্ন আলোকরশ্মি দিয়ে ‘গুলিবর্ষণ করে’। রশ্মির আঘাতে গুটিকাটি অত্যধিক মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে উঠে। তার মধ্যে অবস্থিত ডিউটেরিয়াম নিউক্লিয়াসগুলো একত্রে মিলিত হতে এবং শক্তি নিঃসৃত করতে শুরু করে। ছোট্ট একটি বিস্ফোরণ ঘটে। রশ্মির তলায় নিয়ে আসা হয় নতুন একটা নিশানা (অর্থাৎ গুটিকা), তারপর আরও একটা। ফলে একটির পর একটি বিস্ফোরণ ঘটতেই থাকে। প্রতিটি বিস্ফোরণ আলাদাভাবে দেয় অল্প শক্তি, তবে সবগুলো একসঙ্গে দেয় অনেক। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন যে যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি পেতে হলে প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষেও পারমাণবিক জ্বালানিযুক্ত কুড়িটা গুটিকা ‘বিস্ফোরণ করা’ প্রয়োজন।
থার্মোনিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর কোটি কোটি বছর ধরে আমাদের মাথার ওপর ঝুলছে, এবং তা হচ্ছে আমাদের অতি পরিচিত, অতি প্রিয় সূর্য।
গুটিকা-নিঃসৃত তাপ তরল লিথিয়ামকে উত্তপ্ত করবে। এ হচ্ছে এক ধরনের ধাতু। লিথিয়াম সে তাপ দেবে পানিকে। ভারী পানিকে নয়, সাধারণ পানিকে। পানি পরিণত হবে বাষ্পে, আর বাষ্প যাবে টার্বাইনে।
বিপুল তাপ (২০০ ০০০ ০০০ ডিগ্রি—চাট্টিখানেক কথা নয়!) নিউক্লিয়াসগুলোর মিলনকে বলা হয় থার্মোনিউক্লিয়ার প্রক্রিয়া (ল্যাটিন ভাষায় থার্মো কথাটির অর্থ হচ্ছে ‘উষ্ণ বা উত্তপ্ত’)।
প্রকৃতিতে—তবে পৃথিবীতে নয়—এই প্রক্রিয়াগুলো হচ্ছে অতি সাধারণ ব্যাপার। থার্মোনিউক্লিয়ার শক্তি মানুষ তখনও ব্যবহার করত যখন তারা জানতই না যে তারা—মানুষ।
থার্মোনিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর কোটি কোটি বছর ধরে আমাদের মাথার ওপর ঝুলছে, এবং তা হচ্ছে আমাদের অতি পরিচিত, অতি প্রিয় সূর্য।
তার অভ্যন্তরে বহু লাখ কোটি বছর ধরে চলছে অবিরাম থার্মোনিউক্লিয়ার প্রক্রিয়া। এই সুদীর্ঘ কাল পৃথিবীতে এসে পড়ছে শক্তির প্রবল এক ধারা।
সারা আকাশে ছড়িয়ে আছে প্রাকৃতিক রিঅ্যাক্টরসমূহ, অর্থাৎ নক্ষত্রসমূহ। তবে তারা এতই দূরে অবস্থিত যে তাদের শক্তি আমাদের কাছে প্রায় পৌঁছায়ই না। আর তা নিঃসীম মহাকাশে হারিয়ে যায়।
থার্মোনিউক্লিয়ার প্রক্রিয়া ভালো কেবল শক্তির প্রাচুর্যের জন্যই নয়। তার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ গুণটি হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা।
থার্মোনিউক্লিয়ার শক্তিকেই খুব সম্ভব বিদ্যুতে রূপান্তরিত করা হবে। এ কথা সত্যি যে ওই স্টেশনগুলোর নাম কী হবে তা এখনও ভাবা হয়নি, তবে স্টেশনগুলো যে দেখা দেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এর জন্য আমাদের আর বেশিকাল অপেক্ষা করতে হবে না—বড় জোর দশ-পনেরো বছর। অন্তত বিজ্ঞানীরা তাই বলেন।
হাইড্রোজেনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে আরও একটি চিত্তাকর্ষক ও গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা। তা একদিন সবার পরিচিত পেট্রলের স্থান নেবে। এর জন্য অন্ততপক্ষে দুটি কারণ রয়েছে।
প্রথম কারণটি তোমাদের জানা। ইঞ্জিনে পেট্রোল জ্বালানো—সে হচ্ছে বেহিসেবীর মতো কাজ করা। রুশ রসায়নবিদ দিমিত্রি মেন্ডেলিভই বলেছিলেন যে তেল (কিংবা পেট্রোল) জ্বালানো হচ্ছে টাকা দিয়ে উনুন ধরানোরই শামিল। এবং তা একেবারে খাঁটি কথা, বিশেষত আজ এ সত্যটি সবাই বুঝতে পেরেছে। আগেই বলা হয়েছে যে তেল দিয়ে প্রস্তুত করা যায় কাপড় ও ঔষধ থেকে শুরু করে আহারযোগ্য এবং এমনকি সুস্বাদু ক্যাভিয়ার অবধি হাজারো রকমের নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। অথচ এখন আমরা এই তেল ব্যবহার করছি পেট্রোল, কেরোসিন আর ব্ল্যাক ওয়েল হিসেবে। আর তার মানে হচ্ছে আমরা জ্বালাচ্ছি তৈরি না হওয়া শার্ট, স্যুট, মেশিনের যন্ত্রাংশ, ওষুধ ও খাদ্য দ্রবা...
এখন রাসায়নিক পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করা হয় তেল থেকে। পদ্ধতিটি খুবই ব্যয়বহুল এবং তাতে হাইড্রোজেন মিলে কম। তবে অন্য একটি পদ্ধতিও রয়েছে—বৈদ্যুতিক পদ্ধতি।
এবার দ্বিতীয় কারণটি। আজ সঠিকভাবে জানা গেছে যে জ্বলনের বর্জ্য আমাদের গ্রহের বায়ুমণ্ডল দূষিত করে, এবং যতই সময় যাচ্ছে এরূপ অবস্থার ততই বেশি অবনতি ঘটছে। প্রতিটি মোটর গাড়ি বছরে বায়ুমণ্ডলে এক টন পরিমাণ অতি ক্ষতিকর পদার্থ নিক্ষেপ করে। তা প্রকৃতির মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে, সৌর রশ্মি আটকে রাখে, বড় বড় শহরের বায়ু বিষাক্ত করে তোলে।
পৃথিবীর পথে পথে চলছে ২৫ কোটিরও বেশি মোটর গাড়ি, আকাশে উড়ছে শত সহস্র বিমান, সমুদ্রগুলোতে চলাচল করছে হাজার হাজার জাহাজ, এবং প্রতিটি মোটর গাড়ি, প্রতিটি বিমান, প্রতিটি জাহাজ আকাশ মলিন করে।
কিন্তু মানুষের অন্য উপায় নেই। সে নিরুপায়, কারণ তেল আর পেট্রলের মতো এত চমৎকার আর কোনো জ্বালানি মিলছে না।
আপাতত মিলছে না। তবে ভবিষ্যতে খুব সম্ভব মিলবে। এরূপ জ্বালানি হতে পারে হাইড্রোজেন। এমনকি মিখাইল লমনোসভও (প্রথম রুশ প্রকৃতিবিদ, কবি ও ইতিহাসবিদ) জানতেন যে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মেলালে পাওয়া যায় পানি, নিঃসৃত হয় তাপ।
এ ব্যাপারে আগ্রহী হলেন বিজ্ঞানী আর ইঞ্জিনিয়াররা। অনেকে মনে করেন যে হাইড্রোজেনই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট জ্বালানি। প্রথমত, সাগর ও মহাসাগরের পানিতে তা সঞ্চিত আছে অতি বিপুল পরিমাণে। দ্বিতীয়ত, হাইড্রোজেন দহনের সময় কোথাও উবে যায় না। অক্সিজেনের সঙ্গে মিলিত হয়ে তা সেই একই পানি সৃষ্টি করে। সেই জন্য হাইড্রোজেন হচ্ছে সবচেয়ে নির্মল জ্বালানি।
হাইড্রোজেন ইঞ্জিনের নির্গমন চিমনি দিয়ে বের হবে অক্ষতিকর জলীয় বাষ্প।
হাইড্রোজেন জ্বালানি কাজ করতে পারবে যেকোনো যানবাহনে, শিল্পে, বাড়িঘর গরম রাখবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।
এখন রাসায়নিক পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করা হয় তেল থেকে। পদ্ধতিটি খুবই ব্যয়বহুল এবং তাতে হাইড্রোজেন মিলে কম। তবে অন্য একটি পদ্ধতিও রয়েছে—বৈদ্যুতিক পদ্ধতি। এর নাম ইলেকট্রলিজিস।
পানির মধ্যে ছাড়া হয় প্রবল বিদ্যুৎ প্রবাহ। তা পানিকে বিভক্ত করে হাইড্রোজেন ও অন্যান্য অণুতে। হাইড্রোজেন হচ্ছে হালকা গ্যাস। তা ওপরিভাগে উঠে আসে এবং পানি থেকে লাফ মারে। ঠিক তখনই তাকে ধরে সিলিন্ডারে সংগ্রহ করা হয়।
ইলেকট্রলিজিসের জন্য অনেক বিদ্যুৎ প্রয়োজন। তাই আমাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তি থাকলেই আমরা ঠিকমতো হাইড্রোজেন নিষ্কাশন করতে পারি। আর সে পর্যাপ্ত অর্জিত হবে একমাত্র তখনই যখন পৃথিবীতে ঠিকমতো কাজ শুরু করবে পারমাণবিক ও থার্মোনিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো।
তাহলে এরূপ একটি শিকল বা চেইন দেখা দিচ্ছে: নিউক্লিয়ার প্রক্রিয়া—বিদ্যুৎ—ইলেকট্রলিজিস—অক্সিজেন, ইঞ্জিনের জ্বালানি।
ইঞ্জিনিয়ার এমনকি ঠিকও করে ফেলেছেন, কার্যক্ষেত্রে এই চেইনটি কীরূপ দেখাবে। সাগর-মহাসাগরে নির্মিত হবে ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ওগুলোর বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হবে জলজ নিষ্কাশনের কাজে। প্রাপ্ত হাইড্রোজেন পাইপ মাধ্যমে প্রেরিত হবে স্থলে। কারখানায় এই হালকা গ্যাসকে পরিণত করা হবে তরল পদার্থে এবং পাইপ মাধ্যমে কিংবা সিলিন্ডারে করে যাদের প্রয়োজন তাদের দেওয়া হবে।
আমরা পরিচিত হলাম শক্তি লাভের দুটি চেনের সঙ্গে। প্রথমটির শুরুতে—জ্বালানি। তার মধ্যে আছে রাসায়নিক শক্তি।
কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তত সহজ নয়। তরল হাইড্রোজেন এমনকি ঘরের তাপমাতায়ও দ্রুত উবে যায়। সে জন্য যে পাত্রে তা রাখা হয় সেই পাত্রটি এঁটে বন্ধ করা উচিত, তাই নয় কি? কিন্তু এমতাবস্থায় ঢাকনীর তলায় খুবই তাড়াতাড়ি প্রচুর পরিমাণ হাইড্রোজেন-বাষ্প জমা হবে এবং পাত্রটি ফেটে যাবে। তাই হাইড্রোজেন রাখা হয় খোলা পাত্রে—ডিউয়ারে। ডিউয়ারের রহস্যটি হচ্ছে এই যে তা ঠিক ততটুকুই খোলা যাতে ফেটে না যায় এবং যথাসম্ভব কম পরিমাণ হাইড্রোজেন নষ্ট হয়। ক্ষতির মাত্রা যাতে খুব অল্প হয় সেজন্য হাইড্রোজেনকে শূন্যাঙ্কের নিচে ২০০-২৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড অবধি শীতল করা দরকার। সে হচ্ছে অত্যধিক শীতলাবস্থা। বোঝাই যাচ্ছে যে এরূপ থার্মোফ্ল্যাক্স প্রস্তুত করা খুব কঠিন ও জটিল কাজ। বিশেষত মোটর গাড়ির জন্য। তা সাধারণ পেট্রোল ট্যাংকের চেয়ে বড় হলে চলবে না।
তাহলে এসো, এবার পেছন পানে তাকানো যাক। স্মরণ করা যাক, আমরা কী কী জানলাম, তার একটা খতিয়ান করি।
আমরা পরিচিত হলাম শক্তি লাভের দুটি চেনের সঙ্গে। প্রথমটির শুরুতে—জ্বালানি। তার মধ্যে আছে রাসায়নিক শক্তি। জ্বালানি পুড়িয়ে আমরা এই রাসায়নিক শক্তিকে তাপশক্তিতে রূপান্তরিত করি। জ্বালানি চেইনই হচ্ছে আজ প্রধান।
দ্বিতীয় চেইনের গোড়াতে আছে পারমাণবিক নিউক্লিয়াস, যা হচ্ছে পারমাণবকি কিংবা নিউক্লিয়ার শক্তির ভাণ্ডার। নিউক্লিয়াস বিভক্ত করে আমরা নিউক্লিয়ার শক্তিকেও তাপশক্তিতে রূপান্তরিত করি। অদূর ভবিষ্যতে আমরা নিউক্লিয়াসের মিলন থেকেও তাপ পাব। নিউক্লিয়ার চেইন আজ প্রধান নয়। তবে ভবিষ্যতে তা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এই দুই চেইনের জরুরি সংযোগ হচ্ছে তাপ, তাপশক্তি। জ্বালানি চেইনে ও নিউক্লিয়ার চেইনে তাপশক্তি ছাড়া লোকের চলতে পারে না এবং কোনোদিন চলবে বলেও মনে হয় না...
তবে এই দুটি চেইনই সব নয়। মানবজাতির হাতে শক্তির অন্যান্য উৎসও রয়েছে, আর তার মানে অন্যান্য শক্তি চেইনও আছে। কোনটি লোকে কাজে লাগাচ্ছে অনেক কাল থেকে। আর কোনটির দিকে সবে তারা নজর দিচ্ছে।