দুর্বল নিউক্লীয় বল কী, এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ

দুর্বল নিউক্লীয় বলের নাম কেন দুর্বল? অথচ এই বল না থাকলে সূর্যই জ্বলত না! প্রোটনকে নিউট্রনে বদলানোর মাধ্যমে পৃথিবীতে জীবন টিকিয়ে রাখা এই রহস্যময় শক্তিটি কীভাবে কাজ করে?

দুর্বল পারমাণবিক বল কণাপদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানছবি: মার্ক গার্লিক/ সায়েন্স ফটো লাইব্রেরি

মহাবিশ্বে মোট চার ধরনের মৌলিক বল আছে—মহাকর্ষ বল, বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল, সবল নিউক্লীয় বল এবং দুর্বল নিউক্লীয় বল। এর মধ্যে দুর্বল বলের নামটাই একটু অদ্ভুত, তাই না? এটা এতই দুর্বল যে, এর অস্তিত্ব নিয়ে একসময় বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামাতেও চাননি। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, এই দুর্বল নিউক্লীয় বল যদি না থাকত, তাহলে আমাদের সূর্য জ্বলত না! পৃথিবী জমাট বরফের মতো ঠান্ডা থাকত। এই বল কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, চলুন তা জানা যাক।

এই গল্পের শুরু ১৯৩০-এর দশকে। বিজ্ঞানীরা তখন ল্যাবরেটরিতে বসে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখছিলেন। তাঁরা দেখলেন, পরমাণু থেকে হঠাৎ করে খুব জোরে একটা ইলেকট্রন বেরিয়ে আসছে। আর ইলেকট্রন বের হওয়ার পর সেই মৌলটাই বদলে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে তো নতুন মৌল হয়ে যাচ্ছে। কখনো বদলে যাচ্ছে পরমাণুর আইসোটোপ। এই ঘটনাকে তাঁরা নাম দিলেন বিটা ক্ষয়।

আরও পড়ুন

কিন্তু প্রশ্ন হলো, নিউক্লিয়াসের ভেতরে কী এমন ঘটল যে, হঠাৎ একটা ইলেকট্রন ছেড়ে দিল? এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন ইতালির বিখ্যাত বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি। তিনি বললেন, প্রকৃতিতে হয়তো একটি নতুন বল আছে। আমরা জানতাম, পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন। ফার্মি বললেন, এই নতুন শক্তি একটা প্রোটনকে নিউট্রনে বদলে দিতে পারে, কিংবা হতে পারে উল্টোটাও। মানে নিউট্রনকেও বদলে দিতে পারে প্রোটনে। আর এই বদলানোর সময় বেরিয়ে আসে একটা ইলেকট্রন এবং নিউট্রিনো নামের ছোট্ট একটা কণা।

এনরিকো ফার্মি

ফার্মির এই ধারণাটা ছিল শুধুই অনুমান। কিন্তু তিনি একদম সঠিক ছিলেন! ফার্মির সেই ধারণা বাস্তবে প্রমাণিত হয়ে জন্ম হলো একটি নতুন বলের—দুর্বল নিউক্লীয় বল। এটা এতই অদ্ভুত যে, বাকি তিনটি বলের চেয়ে এর চরিত্র একেবারেই আলাদা।

আরও পড়ুন
এই দুর্বলতার পেছনে একটা মজার কারণ আছে। প্রকৃতির অন্য সব বলের কণাগুলোর কোনো ভর নেই। ওগুলো সব ভরহীন এবং হালকা।

দুর্বল বলের এমন কিছু ক্ষমতা আছে, যা আর কোনো শক্তি পারে না। যেমন, এটি একটা কোয়ার্ককে অন্য রকম কোয়ার্কে বদলে দিতে পারে। কোয়ার্ক হলো আরও ছোট্ট কণা, যা দিয়ে প্রোটন আর নিউট্রন তৈরি। এই বদলানোর ক্ষমতা থাকার কারণেই প্রোটন আর নিউট্রন জায়গা বদল করতে পারে।

হয়তো ভাবছেন, এর এত ক্ষমতা থাকতে নাম কেন দুর্বল বল? কারণ, এটা সত্যিই খুব দুর্বল। বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের কথা নিশ্চয়ই জানেন। দুর্বল বলের শক্তি তার থেকে এক লাখ গুণ কম! শুধু তাই নয়, এর কাজের পরিসীমাও অতি ক্ষুদ্র। একেবারে পরমাণুর ভেতরের ছোট্ট একটা জায়গায় এটি কাজ করে। একটু দূরে গেলেই এর শক্তি আরও কমে যায় কয়েক হাজার গুণ।

পিটার হিগস
উইকিমিডিয়া

এই দুর্বলতার পেছনে একটা মজার কারণ আছে। প্রকৃতির অন্য সব বলের কণাগুলোর কোনো ভর নেই। ওগুলো সব ভরহীন এবং হালকা। কিন্তু দুর্বল বলের বাহক কণা হলো W ও Z বোসন। এই কণাগুলো প্রোটনের চেয়েও ভারী! ভাবুন একবার, প্রোটন যেখানে পরমাণুর কেন্দ্রে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ কণা, সেখানে এই বাহকরা তার চেয়েও বেশি ভারী।

১৯৪০ ও ৫০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা যখন এটা বুঝলেন, তাঁরা হতভম্ব হয়ে গেলেন। কেন এই বাহক কণা এত ভারী? এর কোনো ব্যাখ্যা ছিল না তখনো। পিটার হিগস নামের একজন বিজ্ঞানী সেই ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি হিগস বোসন নামের একটা বিশেষ কণার কথা বললেন। মূলত হিগস বোসনের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করতেই দুর্বল বলের এই ভারী বাহকের প্রয়োজন হয়েছিল। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য ২০১৩ সালে পিটার হিগস পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান।

আরও পড়ুন
এতক্ষণ বোঝা গেল, দুর্বল নিউক্লীয় বল আসলেই দুর্বল, এর বাহক কণা বেশি ভারী এবং এটা নিয়ম ভাঙে। কিন্তু এই বলের দরকারটা কী?

দুই

প্রকৃতির সব মৌলিক বল একটি দারুণ নিয়ম মেনে চলে। একে বলে প্যারিটি সিমেট্রি। সহজ কথায়, আপনি যদি কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করেন এবং সেই একই পরীক্ষা আয়নার ভেতরে দেখেন, তাহলে দুটি ফলাফল একই আসা উচিত। ঠিক যেমন আয়নায় আপনার ডান হাত এবং বাঁ হাত একই রকম, শুধু দিক উল্টো। 

কিন্তু দুর্বল বল এই নিয়ম ভেঙে দেয়। দুর্বল বলের মাধ্যমে তৈরি হওয়া একটি কণার নাম নিউট্রিনো। নিউট্রিনো সব সময় বাঁ হাতি হয়। মানে কণাটির ঘূর্ণন তার গতির দিকের তুলনায় সব সময় ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে হয়।

আপনি যদি দুর্বল বলের একটি প্রক্রিয়া আয়নার মধ্যে দেখেন, তাহলে সেখানে আপনার ডানহাতি নিউট্রিনো দেখা উচিত। কিন্তু প্রকৃতিতে কোনো ডানহাতি নিউট্রিনোর অস্তিত্ব নেই! এ কারণেই দুর্বল বল একমাত্র বল, যা প্রকৃতির এই নিয়ম লঙ্ঘন করে।

এতক্ষণ বোঝা গেল, দুর্বল নিউক্লীয় বল আসলেই দুর্বল, এর বাহক কণা বেশি ভারী এবং এটা নিয়ম ভাঙে। কিন্তু এই বলের দরকারটা কী?

দরকার আছে। আসলে দুর্বল বল না থাকলে সূর্য জ্বলত না এবং আমরাও বেঁচে থাকতাম না। বিষয়টা বুঝিয়ে বলি। সূর্যের ভেতরে যখন দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে হিলিয়াম তৈরি করতে চায়, তখন একটা সমস্যা হয়। দুটো প্রোটন একে অপরকে ঠেলে দেয়, তারা মিলতে চায় না। তখন একটা প্রোটনকে আগে নিউট্রনে বদলাতে হয়। তাহলে ওরা জোড়া বাঁধতে পারে। এই জোড়াকে বলে ডিউটেরন। এরপর এই ডিউটেরনরা মিলে হিলিয়াম তৈরি করে, আর সেই প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে আসে বিপুল পরিমাণ শক্তি। আর প্রোটনকে নিউট্রনে বদলানোর এই কাজটা কে করে? হ্যাঁ, দুর্বল নিউক্লীয় বল! অর্থাৎ, আমরা যে সূর্যের আলো পাই, উষ্ণতা পাই এবং পৃথিবীতে যে জীবন আছে, এই সবকিছু সম্ভব হয়েছে এই দুর্বল বলের কারণে। অর্থাৎ নামে দুর্বল হলেও কাজে কিন্তু ভারি শক্তিশালী!

সূত্র: স্পেস ডটকম

আরও পড়ুন