ইলেকট্রন কি কক্ষপথে ঘোরে
ভুলটা করেছিলেন রাদারফোর্ড। সে ভুলে যুক্তি ছিল, পর্যবেক্ষণও ছিল। কিন্তু চোখের দেখাতে, কানের শোনাতেও কখনো কখনো ভুল হতে পারে; সেখানে সূক্ষ্ম এক কণা, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও যার দর্শন মেলে না, সেই বস্তু সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া তাই কঠিনই ছিল। রাদারফোর্ডেরও তাই ভুল হয়েছিল। প্রোটন আর নিউক্লিয়াসের চরিত্র বিশ্লেষণ করে ইলেকট্রনে বৈদ্যুতিক ধর্মের সঙ্গে সেগুলোর সমন্বয়ে বললেন, ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে। সেই ঘোরাটা আবার যেমন-তেমন নয়, সূর্যকে কেন্দ্র করে যেমন পৃথিবী ঘোরে, অন্য সাতটি গ্রহ ঘোরে, পৃথিবীর চারপাশে যেমন করে চাঁদ ঘোরে, ঠিক তেমন করেই নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে ইলেকট্রন। বৃত্তাকার কক্ষপথে। রাদারফোর্ডের যুক্তিটা কী ছিল?
রাদারফোর্ড একটি পরীক্ষা করেছিলেন। স্বর্ণপাত পরীক্ষা। তিনি আলফা রশ্মির আবিষ্কারক, যেগুলোর সন্ধান মেলে তেজস্ক্রিয় পদার্থে। তেজস্ক্রিয় মৌল থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্গত হয় এই রশ্মি। রাদারফোর্ড পরীক্ষা করে দেখেছিলেন, এই রশ্মি আসলে ধনাত্মক চার্জের কণার প্রবাহ, যে কণার নাম তিনি দিয়েছিলেন আলফা কণা। উচ্চগতির কিছু কণা দিয়ে তিনি পাতলা একটি স্বর্ণপাতকে আঘাত করে দেখেছিলেন। দেখলেন, বেশির ভাগ কণা স্বর্ণপাত ভেদ করে বেরিয়ে যায়। খুব অল্প কিছু কণার গতিপথ সামান্য বেঁকে যায়, বেশ কিছু কণা স্বর্ণপাতে প্রতিফলিত হয়ে উল্টো দিকে ফিরে আসে।
কেন এমনটা হলো, কেন সব কণা স্বর্ণপাতে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এল না? স্বর্ণের পাত তো নিরেট। তাহলে প্রতিফলিত হওয়াই স্বাভাবিক। আবার ভেদ করে বেরিয়েই যদি গেল, তবে কেন সব কটি গেল না?
১৯০৫ সালে আইনস্টাইন প্রমাণ করেন পরমাণুর অস্তিত্ব। বহুদিন ধরেই পরমাণু সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ভাসা-ভাসা ধারণা ছিল। তাঁরা মনে করতেন, পরমাণু আসলে যেকোনো বস্তুর বিল্ডিং ব্লক। যেমন একটি বিশাল ভবন বা ছোট পাকা ঘরের বিল্ডিং ব্লক হলো ইট। তেমনি সব বস্তুই পরমাণু নামের বিল্ডিং ব্লক দিয়ে তৈরি। পরমাণুর অস্তিত্ব প্রমাণের আগেই পাওয়া গেল ইলেকট্রন নামের ক্ষুদ্র কণা, যা ঋণাত্মক চার্জযুক্ত। পরমাণু ধারণা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ঝামেলায় পড়ে গেলেন বিজ্ঞানীরা। পরমাণুর চেয়ে ছোট এই চার্জযুক্ত কণারা আসলে কোথায় থাকে? জাপানি বিজ্ঞানী হান্তারো নাগাওয়াকা আর রাদারফোর্ডের গুরু জে জে টমসন দুটি পরমাণু মডেল দাঁড় করালেন। দুটি মডেলেই ইলেকট্রনকে পরমাণুর ভেতরে দেখানো হলো। কিন্তু দুটিই অনেকটা কল্পনাপ্রসূত। বৈজ্ঞানিক যুক্তি থাকলেও সেগুলোর পরীক্ষামূলক প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
গুরু প্রমাণ দিতে না পারলেও রাদারফোর্ডের মডেলটি তৈরিই হয়েছিল পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করে, স্বর্ণপাতের সেই পরীক্ষা থেকেই। তাঁর যুক্তি ছিল, স্বর্ণপাতও স্বর্ণের পরমাণু দিয়ে তৈরি। আলফা কণা আবার পরমাণুর চেয়ে ছোট৷ সেই কণা যখন স্বর্ণপাত ভেদ করে বেরিয়ে যাচ্ছে, তার মানে স্বর্ণপাত নিরেট নয়। এদের মধ্যে ফাঁক আছে। ফাঁকটা কি পরমাণুগুলোর মধ্যে? সেটাই যদি হতো, তাহলে স্বর্ণ এমন কঠিন রূপ নিতে পারত না, গ্যাসীয় পদার্থ হতো। ফাঁকটা আসলে পরমাণুর ভেতরেই থাকে। যেমন অনেকগুলো ক্রিকেট বল একসঙ্গে আঠা দিয়ে জুড়ে যদি একটা আয়তকার বস্তু তৈরি করা যায়, সেটা অনেকটা নিরেট বস্তুর রূপ নেবে, কিন্তু বলগুলোর ভেতরে তো ফাঁপা। পরমাণুকেও এমনটা ভাবা যেতে পারে। কিন্তু একেবারে ফাঁপা সে নয়, তাহলে এর ভরটা যাবে কোথায়! রাদারফোর্ড দেখলেন, পরমাণুর কেন্দ্রে জমাট কিছু আছে। সেই জমাট কেন্দ্রেই জমা হয়ে আছে পরমাণুর সবটুকু ভর। আর সেটা ধনাত্মক চার্জযুক্ত। সেই জমাট কেন্দ্র ভেদ করে আলফা কণা বেরিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু পরমাণুর কেন্দ্রে বাধা পেয়ে সেখানেই রয়ে যায় না সব আলফা কণা, কিছু কণা প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। এর একটাই মানে, পরমাণুর কেন্দ্র বিকর্ষণ করে আলফা কণাকে। সেটা তখনই সম্ভব, যদি কেন্দ্রে ধনাত্মক চার্জের কোনো কণা থাকে, যেহেতু আলফা কণা ধনাত্মক কণা।
রাদারফোর্ড নিশ্চিত হলেন, পরমাণুর কেন্দ্রীয় অঞ্চল ছাড়া পুরোটাই আসলে ফাঁকা অঞ্চল। সেই ফাঁক দিয়ে বেশির ভাগ আলফা কণা বেরিয়ে যায়।
তাহলে ইলেকট্রনগুলো কোথায় থাকে?
রাদারফোর্ড জানালেন, ইলেকট্রনগুলো ওই ফাঁকা অঞ্চলেই থাকে।
তাহলে ইলেকট্রন কেন আলফা কণাকে বাধা দেয় না?
ইলেকট্রনের চার্জ ধনাত্মক, অন্যদিকে আলফা কণা ধনাত্মক। তাই ঋণাত্মক ইলেকট্রনের আকর্ষণে আলফা কণারা বাধা পড়ার কথা। সেটা হয় না কেন, তার ব্যাখ্যাও দিলেন রাদারফোর্ড। বললেন, ইলেকট্রন খুবই হালকা, তুলনায় আলফা কণা খুবই ভারী। তাই প্রবল বেগে ছুটে আসা আলফা কণাকে কিছুতেই রুখতে পারে না ইলেকট্রন।
সেটা না হয় হলো, পরমাণুতে প্রোটন আর ইলেকট্রনের বিন্যাসটা কেমন?
প্রোটনগুলো জমাটবদ্ধ অবস্থায় কেন্দ্রে অবস্থান করে। সেই জমাট কেন্দ্রকে ঘিরে ঘোরে ইলেকট্রনগুলো। পরমাণুর কেন্দ্রে যতগুলো প্রোটন আছে, ঠিক ততগুলো ইলেকট্রন ঘুরবে সেগুলোকে কেন্দ্র করে।
ইলেকট্রন কেন ঘুরবে নিউক্লিয়াসের চারপাশে?
কারণ বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বল। ইলেকট্রনের একটি গতিশক্তি আছে। সেই গতিশক্তি নিয়ে ইলেকট্রন ছুটে বেরিয়ে যেতে চায় দূরে, সোজা পথে। কিন্তু নিউক্লিয়াসের ধনাত্মক চার্জ থেকে আসা বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় আকর্ষণ বল ইলেকট্রনকে নিজের দিকে টানে। কিন্তু ইলেকট্রন হুমড়ি খেয়ে নিউক্লিয়াসে পড়ে না তার গতিশক্তির কারণে, যেটা তাকে বাইরের দিকে পাঠিয়ে দিতে চায়। ইলেকট্রনের গতিশক্তিজনিত বল আর প্রোটন থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বল সমান, এদের অভিমুখ পরস্পরের বিপরীত দিকে। তাই পরস্পরকে তারা নাকচ করে দেয়। বেচারি ইলেকট্রন, এই দুই বলের পাল্লায় পড়ে খাবি খায়। দুইয়ের মন রক্ষা করে চলার জন্য তাই একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরতে বাধ্য হয়। মোটামুটি এটাই ছিল রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল। এই মডেলের সঙ্গে সৌরজগতের অনেকটা মিল আছে বলেই এটাকে সোলার সিস্টেম অ্যাটম মডেল বলে।
দুই
রাদারফোর্ডের তত্ত্বে যুক্তি ছিল; ছিল রোমান্টিকতাও। সৌরপরিবারের মতো বিশাল স্কেলে যেমনটা ঘটছে, তেমনটা ঘটছে পরমাণুর খুদে জগতেও! স্বপ্নের মতোই ব্যাপার। রাদারফোর্ড তাই খুশিতে আটখানা হওয়ার কথা। তা তিনি হয়েছিলেন। আটখানা হয়েছিল গোটা দুনিয়ার বিজ্ঞানীকুল। কিন্তু রাদারফোর্ডের সুখস্বপ্ন অন্যদের কপালে সইল না বেশি দিন। যে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলের জোরে রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলটি তৈরি করেছিলেন, সেই বলের একটি ধর্ম খারিজ করে দিল মডেলটিকে। খারিজের ব্যাপারটি প্রথম টের পেয়েছিলেন ডেনিশ বিজ্ঞানী নিলস বোর। তিনি দেখেছিলেন, ইলেকট্রন যদি নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরতে থাকে, তাহলে এর কক্ষপথ ক্রমেই ছোট হয়ে আসবে। একসময় এত ছোট হবে যে ইলেকট্রন আর নিউক্লিয়াসের মধ্যে কোনো দূরত্বই থাকবে না। তখন ইলেকট্রন হুমড়ি খেয়ে পড়বে নিউক্লিয়াসের ওপর। কিন্তু পরমাণুর যে চরিত্র, তাতে এমনটা ঘটা সম্ভব নয়। তাহলে পরমাণুর অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে।
এখন প্রশ্ন হলো, ইলেকট্রনের কক্ষপথ কেন ছোট হবে?
এর পেছনে রয়েছে বিদ্যুৎ–গতিবিদ্যা আর শক্তির সংরক্ষণ সূত্র। বিদ্যুৎ–গতিবিদ্যার যে হিসাব-নিকাশ, তাতে যেকোনো চার্জিত বস্তু যদি ঘুরতে শুরু করে বা কাঁপে, তাহলে সেটা স্থান–কালের বিদ্যুৎক্ষেত্রে আলোড়ন তুলবে। তৈরি হবে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গ। এই যে ঘূর্ণমান কণা, তার ঘূর্ণনের ফলে তৈরি হবে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গ—এর জন্য তো শক্তি দরকার হবে। সে শক্তি ইলেকট্রন পাবে কোথায়?
ইলেকট্রনের গতিশক্তি এখানে ব্যয় হবে। ফলে ক্রমাগত গতিশক্তি কমতে থাকবে। গতিশক্তি যত কমবে, তত নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ কেন্দ্রের দিকে সরে যাবে ইলেকট্রন। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত ছোট হবে কক্ষপথের ব্যাসার্ধ। একসময় ইলেকট্রন আর নিউট্রনের মধ্যে আর দূরত্বই থাকবে না। ইলেকট্রন পতিত হবে নিউক্লিয়াসে। এই সমস্যার সমাধান দিয়েছিলেন রাদারফোর্ডের শিষ্য নীলস বোর। তিনি ভেবেছিলেন, নিশ্চয়ই ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে চিরায়ত বিদ্যুৎ–গতিবিদ্যার নিয়মগুলো খাটে না। তাহলে কী করা যায়? তিনি হাত বাড়ান ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক আর আলবার্ট আইনস্টাইনের প্রতিষ্ঠিত কোয়ান্টাম তত্ত্বের দিকে। দেখান, প্ল্যাঙ্ক যেমন বলেছিলেন, আলো হলো গুচ্ছ গুচ্ছ শক্তির প্যাকেট, পরে যার নাম হয়ে যায় ফোটন। অর্থাৎ আলোর জন্য শক্তির একটি নির্দিষ্ট মান বেঁধে দিয়েছিলেন। বোর সেই কাজ করলেন পরমাণুর কক্ষপথে। তিনি ইলেকট্রনের জন্য কক্ষপথের শক্তি নির্দিষ্ট করে দিলেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে। তিনি দেখান, ইলেকট্রন শুধু কিছু নির্দিষ্ট শক্তির, নির্দিষ্ট ব্যাসের শক্তিস্তরেই অবস্থান করতে পারে। সেই কক্ষপথের একটি সর্বনিম্ন মান থাকবে। সেই মানের চেয়ে কম শক্তির কোনো কক্ষপথে ইলেকট্রন কখনোই যেতে পারবে না। তবে নির্দিষ্ট শক্তির ফোটন শোষণ এক শক্তিস্তর থেকে আরেক শক্তিস্তরে যেতে পারে লাফ দিয়ে। এটাকে কোয়ান্টাম লাফ বলে, মানুষের লাফ দেওয়ার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।
বোরের পরমাণু মডেলেও অনেক ত্রুটি রয়ে গিয়েছিল। বোর ইলেকট্রনের কক্ষপথে নাম পাল্টে রেখেছিলেন শক্তিস্তর।
তিন
নীলস বোর রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল ঠিক করলেন বটে, কিন্তু নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনের ঘূর্ণন বন্ধ করতে পারেননি। অর্থাৎ ইলেকট্রন যে গ্রহগুলোর মতো নিজের কক্ষপথে ঘোরে না, ব্যাপারটা বোরও ঠিকঠাক অনুধাবন করতে পারেননি।
বোরের পরমাণু মডেলেও অনেক ত্রুটি রয়ে গিয়েছিল। বোর ইলেকট্রনের কক্ষপথে নাম পাল্টে রেখেছিলেন শক্তিস্তর। তিনি বলেছিলেন, সেই শক্তিস্তরগুলো আসলে বৃত্তের মতো। এই তথ্য ঠিক শুধু হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষেত্রে। এতে শুধু একটি ইলেকট্রন থাকে। কিন্তু অন্য সব মৌলে ইলেকট্রনের সংখ্যা একের অধিক। এসব পরমাণুতে ইলেকট্রন কেমন হবে, তার ব্যাখ্যা বোর দিতে পারেননি। সেই সমস্যা সমাধান করেন জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আর্নল্ড সমারফেল্ড। তিনি দেখালেন, পরমাণুতে শুধু বৃত্তের মতো শক্তিস্তরই থাকে না বরং অনেকগুলো উপবৃত্তাকার শক্তিস্তর থাকে। সমারফেল্ডের মডেলটি ছিল যুগোপযোগী, কিন্তু সেই মডেলেও ইলেকট্রনের ঘোরা বন্ধ করা যায়নি। তার মানে, ইলেকট্রনের ঘোরাটাকেই এর ধর্মবৈশিষ্ট্য মনে করেছিলেন। কিন্তু গোল বাধে একটি প্রশ্নে।
বোর বলেছিলেন, এক শক্তিস্তরের ইলেকট্রন তার চেয়ে উচ্চ শক্তিস্তরে লাফ দিয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ইলেকট্রন শক্তি হিসেবে ফোটন শোষণ করবে। আবার উচ্চ শক্তিস্তরে যাওয়ার পর ইলেকট্রন সেখানে যতটুকু সময় থাকে, সেই অবস্থার ইলেকট্রনকে বলে উত্তেজিত অবস্থা। এ অবস্থা স্থায়ী নয়। উচ্চ শক্তিস্তরে যাওয়ার পর ইলেকট্রন দ্রুতই ফোটন বিকিরণ করে নিচের শক্তিস্তরে নেমে আসে।
এই ছিল ইলেকট্রনের নড়াচড়ার ব্যাখ্যা। কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর বোর বা সমারফেল্ড কারও কাছেই ছিল না। ইলেকট্রন একটি নির্দিষ্ট ও অনুমোদিত শক্তিস্তর ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে পারে না। তাহলে ইলেকট্রন যে লাফ দিয়ে এক শক্তিস্তর থেকে আরেক শক্তিস্তরে যায়, সেটা কীভাবে যায়? মানে শক্তিস্তরের মাঝখানে অন্য কোনো স্থানে বা বিন্দুতে ইলেকট্রনের অবস্থান করার কোনো অনুমোদন দেয় না কোয়ান্টাম তত্ত্ব। তাহলে দুই শক্তিস্তরের মাঝখানে ইলেকট্রনের কোনো অস্তিত্বই থাকার কথা নয়। এ এক জটিল সমস্যা। এর সমাধান কী?
ইলেকট্রনের ভর অতি সামান্য। তাই এর কম্পাঙ্ক একেবারে নগণ্য নয়। সত্যি বলতে কি, দ্য ব্রগলির এই নতুন তত্ত্ব প্রয়োগ করা হলো ইলেকট্রনের ওপর।
চার
ওপরের প্রশ্নটির জবাব যেমন সে সময় ছিল না বোর বা সমারফেল্ডের কাছে, অন্য কেউই সমাধানটি দিতে পারেননি। এরই মধ্যে ১৯১৭ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন কণাদের তরঙ্গচরিত্র নিয়ে কাজ করেন। আগে কোয়ান্টাম তত্ত্বে ম্যাক্স দেখিয়েছিলেন তরঙ্গরূপী আলোকতরঙ্গের কণাচরিত্রের সন্ধান। বোর সেটা ইলেকট্রনের মতো ভরযুক্ত বস্তুকণাদের ওপর প্রয়োগ করলেন। কিন্তু কেন করলেন, সেই প্রয়োগের ধরন-ধারণ বোর ব্যাখ্যা করতে পারেননি। বোরের দেখানো পথে হেঁটেই আইনস্টাইন ইলেকট্রনের তরঙ্গচরিত্র আছে কি না, তার উত্তর খুঁজতে শুরু করলেন। আইনস্টাইনের এই কাজ অনুপ্রাণিত করেছিল ফরাসি তরুণ লুই দ্য ব্রগলিকে। তিনি শুধু কণা ছোট-বড় সব ধরনের বস্তুর তরঙ্গচরিত্র দাঁড় করেছিলেন। ১৯২১ সালে এসে কিনারা পেয়ে গেলেন। তিনি বস্তুকণাদের তরঙ্গচরিত্রের সন্ধান দিলেন নিখাদ গণিতের সাহায্যে। সেই সমীকরণে তিনি কণাদের একই সঙ্গে তরঙ্গ ও কণাচরিত্রের ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হলেন শিল্পীর মতো দক্ষতায়। সেই সমাধান ম্যাক্স বর্নের মাধ্যমে পাঠালেন আইনস্টাইনের কাছে। আইনস্টাইন সেটি গণিতের কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখলেন একেবারে নির্ভুল। সেই সমীকরণের সাহায্যে যেকোনো ভারী বস্তুর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্ক বের করা সম্ভব। তবে একটা কিন্তু আছে। গতিশীল যেকোনো বস্তুর তরঙ্গ আছে ঠিক, কিন্তু ভর যার বেশি, কম্পাঙ্ক তত ছোট। তাই কণা পর্যায়ের বস্তু ছাড়া একটু বড়সড় বস্তুর কম্পাঙ্ক এত ছোট, তার পরিমাপ করা কঠিন।
ইলেকট্রনের ভর অতি সামান্য। তাই এর কম্পাঙ্ক একেবারে নগণ্য নয়। সত্যি বলতে কি, দ্য ব্রগলির এই নতুন তত্ত্ব প্রয়োগ করা হলো ইলেকট্রনের ওপর। সেই পরীক্ষায় লেটার মার্কস নিয়ে পাস করল ব্রগলির তত্ত্ব। ইলেকট্রন যে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে, সেই ইলেকট্রনেরও তরঙ্গধর্ম বের হলো। নতুন করে লিখতে হলো তখন বোর-সমারফেল্ড তত্ত্ব।
নতুন তত্ত্ব অনুযায়ী, ইলেকট্রন শুধু নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরেই না, একই সাথে কম্পিতও হয়। তখন বদলে যায় ইলেকট্রনের শক্তিস্তরের চিত্র। সেটা তখন উপরের ১ নং ছবির মতো দেখায়।
পাঁচ
লুই দ্য ব্রগলির সমীকরণ নতুন গতিপথ ঠিক করে দেয় কণাদের। তারপর সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা আসে জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ও অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী আরউইন শ্রোডিঙ্গারের কাছ থেকে। ১৯২৫ সালে হাইজেনবার্গ আর শ্রোডিঙ্গার দুই–দুইটি তত্ত্ব দিয়ে গুঁড়িয়ে দিলেন। একটি অনিশ্চয়তা নীতি, অন্যটি তরঙ্গ সমীকরণ। অনিশ্চয়তা নীতির মূল ভাব ছিল, ইলেকট্রনের মতো খুদে কণাদের ভরবেগ ও অবস্থান একই সঙ্গে নির্ণয় করা যায় না। কেন যায় না, তা নিয়ে অনেকবার আলোচনা হয়েছে, আরও হবে।
অন্যদিকে শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণের মূল ভাব ছিল, কোয়ান্টাম কণাদের কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পাওয়া কঠিন। তার চেয়ে কোনো একসময়ে কোনো এক বিন্দুতে কণাটির অবস্থান কোথায়, তার একটি সম্ভাবনা বলে দেওয়া যায়, কিন্তু কখনোই নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব অমুক সময়ে অমুক বিন্দুতে আছে কণাটি।
শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণ ও হাইজেনবার্গের তরঙ্গ। দুটির মিলিত ব্যাখ্যা থেকে এল কোয়ান্টাম সুপার পজিশনের ধারণা। সুপার পজিশন অনেকটা ভুতুড়ে ব্যাপার। একসঙ্গে কণা আর তরঙ্গ অবস্থায় থাকে কণাটি। এর নির্দিষ্ট কোনো অবস্থান নেই, নির্দিষ্ট কোনো বিন্দুতে একে পাওয়াই যাবে না। একটি কণা একই সঙ্গে বিভিন্ন দশায় থাকে, তাই একই সঙ্গে বিভিন্ন বিন্দুতে একে পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এই সুপার পজিশন ধারণা এসে বোর তত্ত্বের ত্রুটিটা অনেকটাই দূর করে দেয়। ইলেকট্রন যখন লাফ দিয়ে অন্য শক্তিস্তরে যায়, মাঝখানের সময়টাতে কোথায় থাকে? সুপার পজিশন বলে, মাঝখানের সময় বলে কিছু নেই—এক শক্তিস্তর থেকে লাফ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেক শক্তিস্তরে পৌঁছে যায়।
সেটা কীভাবে, সে ব্যাখ্যা দিলেন শ্রোডিঙ্গার। তিনি দেখালেন, পরমাণুর ইলেকট্রনকে কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পাওয়া যাবে না। ইলেকট্রন যেহেতু তরঙ্গের আকারে থাকে এবং তার কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান নেই, সুতরাং এর জন্য শক্তিস্তরে একটা মেঘের মতো তৈরি হবে। সেই মেঘের যেকোনো বিন্দুতে ইলেকট্রন থাকতে পারে। ঠিক কোথায় কোন বিন্দুতে থাকবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে কোনো একটা বিন্দুতে ইলেকট্রন থাকার সম্ভাবনা কতটুকু, সেটা শ্রোডিঙ্গারের দেওয়া অঙ্ক কষে বের করা যাবে। শ্রোডিঙ্গারের অঙ্কটি ছিল তরঙ্গ ফাংশনের একটি সমীকরণ। কিন্তু কোথায় কোন বিন্দুতে ইলেকট্রনকে নিশ্চিত করে পাওয়া যাবে, সে কথা বলতে পারে না। অর্থাৎ কেউ শতভাগ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না পরমাণুর শক্তিস্তরের অমুক বিন্দুতে ইলেকট্রনকে পাওয়া যাবে। তার বদলে তিনি পারবেন শক্তিস্তরের অমুক বিন্দুতে বা অমুক এলাকায় অমুক সময়ে ইলেকট্রনকে পাওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৮০ ভাগ বা ৩০ ভাগ কিংবা ১০০–এর নিচের যেকোনো সংখ্যা।
সুতরাং, ইলেকট্রন যে শক্তিস্তরে ঘুরছে—এ কথা এ যুগে বলাটা আসলে ভুল। ইলেকট্রন আছে পুরো শক্তিস্তরে। অনেকটা মেঘের মতো করে। আপনি যদি কোথাও এর অবস্থান জানতে চান, তাহলে অনিশ্চয়তা নীতির অনুযায়ী এর তরঙ্গ ভেঙে পড়বে, তখন সেই বিন্দুতে আপনি ইলেকট্রনকে খুঁজে পাবেন। তখন অবশ্য কণাটির ভরবেগ অনিশ্চিত হয়ে যাবে। তাই কোনো এক মুহূর্তে কোনো বিন্দুতে ইলেকট্রনকে খোঁজার অর্থ এই নয় যে ঠিক আগমুহূর্তে এটি এই বিন্দুর আগের বিন্দুতে অবস্থান করছিল। সেটা হতো, যদি ইলেকট্রন চিরায়ত গতিবিদ্যা মেনে চলত।
সুতরাং, নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রন ঘুরছে—এ কথা কোনো বিজ্ঞানপ্রেমীর বলা উচিত হবে না।