পরমাণুর বেশিরভাগ জায়গা খালি হলেও আমরা কেন দেয়ালের মধ্য দিয়ে হাঁটতে পারি না
মার্ভেলের অ্যাভেঞ্জার্স: এইজ অব আলট্রন মুভিতে আমরা প্রথম ভিশন-এর দেখা পাই। এই চরিত্রটিকে ঠিক রোবট বলা যায় না, বলতে হবে সিন্থেজয়েড। অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে জৈব অঙ্গাণু দিয়ে তৈরি। ভিশন দেয়ালের ভেতর দিয়ে ভূতের মতো হাঁটতে পারে। আবার হ্যারি পটার বই ও মুভি সিরিজে জাদুশিক্ষার্থীদের দেখা যায়, সোজা দেয়াল ভেদ করে পৌঁছে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্ম নাইন অ্যান্ড থ্রি কোয়ার্টার্সে। মুভিতে এরকম অনেক কিছুই দেখা যায়! কিন্তু বাস্তবে দেয়ালের ভেতরে ঢুকতে চাইলে নাকে-মুখে ব্যথা পাওয়া ছাড়া কপালে আর কিছু জুটবে না। কিন্তু পরমাণুর তো বেশির ভাগটাই ফাঁকা। তাহলে আমরা কেন সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে দেয়ালের ভেতরে ঢুকতে পারি না?
জানেন নিশ্চয়ই, এই বিশ্বের সবকিছু শুধু পরমাণু দিয়েই তৈরি। আর পরমাণুর ভেতরটা আসলেই ফাঁকা! পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে ছোট্ট নিউক্লিয়াস। এই নিউক্লিয়াস পুরো পরমাণুর তুলনায় প্রায় এক লাখ গুণ ছোট। আর ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে অনেক দূরে ঘুরতে থাকে। কিন্তু তবু দেয়াল বা যেকোনো কঠিন জিনিসকে এত কঠিন মনে হয় কেন? কেন আমরা এর ভেতর দিয়ে হেঁটে চলে যেতে পারি না?
এর পেছনে বিজ্ঞানের দুটি দারুণ মজার নিয়ম কাজ করে। এক, তড়িৎচুম্বকীয় বিকর্ষণ এবং দুই, পাউলির বর্জন নীতি।
আমরা জানি, পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে প্রোটন, মানে ধনাত্মক চার্জ। আর তাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে ইলেকট্রন বা ঋণাত্মক চার্জ। এই দুই বিপরীত চার্জের টানেই পরমাণুটা টিকে থাকে। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিকসের অদ্ভুত দুনিয়ায় ইলেকট্রন সূর্যের চারপাশে গ্রহের মতো নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে না। বরং এটি একটি ‘সম্ভাবনার মেঘ’ তৈরি করে। কল্পিত এই সম্ভাবনার মেঘ থেকে দেখা যায়, ইলেকট্রনটি কোথায় কোথায় থাকতে পারে। এই ইলেকট্রন মেঘের কারণে পরমাণুর বাইরের দিকটা হয় ঋণাত্মক চার্জযুক্ত। আমরা বিষয়টাকে সহজভাবে বুঝতে আপাতত শুধু ইলেকট্রন বলব।
এবার ভাবুন তো, আপনি একটা দেয়ালের দিকে হেঁটে গেলে কী হবে? সহজভাবে ভাবলে, আপনার নাকটা গিয়ে প্রথমে দেয়ালে ধাক্কা খাবে। অর্থাৎ আপনি নাকে ব্যথা পাবেন। কিন্তু একটু বিজ্ঞানের আলোকে ভাবুন তো! আগেই বলেছি, এই বিশ্বের সবকিছু পরমাণু দিয়ে তৈরি। তার মানে, আমি এবং আপনিও ওই পরমাণু দিয়ে তৈরি। আমাদের শরীরে আছে কোটি কোটি পরমাণু। আমাদের দেহের বাইরের দিকে থাকে এই পরমাণুর ইলেকট্রন। আবার দেয়ালও যেহেতু পরমাণু দিয়ে তৈরি, তাই দেয়ালেরও কোটি কোটি পরমাণুর ইলেকট্রন আছে। আপনার আর দেয়ালের ইলেকট্রন পরস্পরকে প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা দেয়। সমমেরুর দুটি চুম্বক যেমন একে অপরকে ধাক্কা দেয়, অনেকটা সেরকম। মূলত এই তড়িৎচুম্বকীয় বিকর্ষণের কারণেই আপনি দেয়ালের ভেতরে ঢুকতে পারেন না।
এবার ভাবুন, আপনি পর্যাপ্ত চাপ দিলেন, যাতে দেয়ালের পরমাণুর ইলেকট্রন ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারেন। তাহলে কি দেয়ালের মধ্যে ঢুকতে পারবেন? না, তাও পারবেন না। কারণ, আপনি পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ করলেই সামনে আসবে পাউলির বর্জন নীতি। এই নীতি খুব সহজ। এর মূল কথা হলো, ইলেকট্রনের মতো কণাগুলো খুব স্বাধীনচেতা। মানে দুটি ইলেকট্রন একই সময়ে একই জায়গায় একই অবস্থায় থাকতে পারে না।
একটু বুঝিয়ে বলি। ধরুন, একটা ক্লাসরুমে ৪০টি চেয়ার আছে। প্রত্যেকটা চেয়ারে একজন করে শিক্ষার্থী বসা। নতুন কোনো শিক্ষার্থী এলে তাকে বসার জন্য খালি চেয়ার খুঁজে নিতে হবে। যে চেয়ারে একজন বসে আছে, সেখানে তো আরেকজন বসতে পারবে না। ইলেকট্রনের বৈশিষ্ট্যও ঠিক সেরকম। যখন আপনার শরীরের পরমাণু আর দেয়ালের পরমাণু খুব কাছাকাছি চলে আসে, ইলেকট্রনগুলোর আর বসার মতো জায়গা থাকে না। পাউলির এই নীতিই তাদের একে অপরের ভেতর ঢুকে যেতে বাধা দেয়। এই দুটো নীতির কারণেই কঠিন পদার্থকে আমরা কঠিন হিসেবে অনুভব করি।
এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কি দেয়াল ভেদ করা একেবারেই অসম্ভব? সাধারণ উত্তর হলো, হ্যাঁ। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিকসের দুনিয়ায় এসব অসম্ভবই সম্ভব! এখানে কণাগুলো শুধু বলের মতো আচরণ করে না, তরঙ্গের মতোও আচরণ করে।
যেহেতু তরঙ্গটাই বলে দেয় কণাটা কোথায় থাকতে পারে, তাই খুব সামান্য একটা সম্ভাবনা থেকেই যায় যে কণাটা হুট করে দেয়ালের ওপারে হাজির হয়ে যাবে!
ভাবুন, একটা কণার তরঙ্গ এসে দেয়ালে ধাক্কা খেল। সাধারণ নিয়মে তো ওটা ফিরে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতে তরঙ্গটা দেয়ালের কাছে এসে হঠাৎ থেমে যায় না, বরং দেয়ালের ভেতরে এর শক্তি একটু একটু করে কমতে থাকে। দেয়ালটা যদি যথেষ্ট পাতলা হয়, তাহলে সেই তরঙ্গের একটা ক্ষীণ অংশ হয়তো দেয়ালের ওপারে পৌঁছেও যেতে পারে! আর যেহেতু তরঙ্গটাই বলে দেয় কণাটা কোথায় থাকতে পারে, তাই খুব সামান্য একটা সম্ভাবনা থেকেই যায় যে কণাটা হুট করে দেয়ালের ওপারে হাজির হয়ে যাবে! এই অদ্ভুত ঘটনাটাকেই বলে ‘কোয়ান্টাম টানেলিং’। এখানে বিষয়টা অতিসরলীকরণ করে বলা হলো। তবে বাস্তবে এই কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের কারণেই আমাদের ইলেকট্রনিক যন্ত্রগুলো কাজ করে।
এবারের প্রশ্ন হলো, আপনার পুরো শরীরটা দেয়াল ভেদ করে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটা? সংখ্যাটা শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। এটা প্রায় ১০১০^৩০ ভাগের এক ভাগ! পৃথিবীর কোনো ক্যালকুলেটর এই সংখ্যা হিসাব করতে পারবে না। ফলাফল দেখাবে শূন্য। সম্ভাবনাটা এত কম যে এই মহাবিশ্বের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এককথায়, দেয়ালের ভেতরে ঢুকে হাঁটার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।
