প্রতি সেকেন্ডে পৃথিবীতে প্রায় ৪৪টি বজ্রপাত হয়। অর্থাৎ বছরে বজ্রপাত হয় প্রায় ১.৪ বিলিয়ন বার! এর ৭০ শতাংশই হয় ক্রান্তীয় অঞ্চল বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে। এসব বজ্রপাতের কারণে প্রতিবছর পৃথিবীজুড়ে প্রচুর মানুষ মারা যান। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুধু বাংলাদেশেই প্রতিবছর মারা যান প্রায় ১৫০ জন।
বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে থাকা মারাত্মক বিপদজনক। একই কথা কি আকাশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উড়োজাহাজের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। বিশেষ করে ওঠা বা নামার ক্ষেত্রে দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্ন হচ্ছে, উড়োজাহাজের ওপরে কি বজ্রপাত হয়? হলে ক্ষতিটাই-বা কেমন হয়?
এ প্রশ্নের উত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যারোনটিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনিকসের অধ্যপক জন হান্সম্যান বলেন, ‘উড়োজাহাজ আকাশে থাকার সময় এর ওপর বজ্রপাত হতে পারে। বর্তমানে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজগুলো তাই বজ্রপাত প্রতিরোধী করে তৈরি করা হয়।’
অর্থাৎ আকাশে থাকা অবস্থায় বজ্রপাত হলেও নিরাপদ থাকে উড়োজাহাজ। যদিও কোনো উড়োজাহাজে বজ্রপাত হলে সেটা অবতরণের পরে আগাগোড়া চেক করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতির নিশানা পাওয়া যায় না।
যুক্তরাষ্ট্রে বজ্রপাতের কারণে সর্বশেষ ১৯৬৭ সালে একটি বাণিজ্যিক বা যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছিল। এরপর আর কোনো উড়োজাহাজ বজ্রপাতের কারণে মারাত্মক ক্ষতি মুখে পড়েনি।
মানুষের তৈরি যন্ত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম জটিল যন্ত্র উড়োজাহাজ। পেট্রোলিয়াম জাতীয় জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়িয়ে শক্তি তৈরি হয় এতে। এই শক্তি উড়োজাহাজের ইঞ্জিনকে সচল রাখে। জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরি করে উড়োজাহাজের ভেতরে চালানো হয় নানা ছোটখাটো যন্ত্র, যেমন রাডার, বৈদ্যুতিক বাতি, এসিসহ আরও নানা কিছু।
বজ্রপাত মূলত তড়িৎ আধানের প্রচণ্ড প্রবাহ। বিদ্যুৎশক্তির এই প্রবল প্রবাহের ফলে সৃষ্টি হয় প্রচুর তাপের। সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৩০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। বজ্রপাতে উৎপন্ন তাপ অনেক সময় এর চেয়েও বেশি হয়।
বজ্রপাতের ছোঁয়া কোনোভাবে উড়োজাহাজের জ্বালানী ট্যাংক বা বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশের ওপর লাগলেই দূর্ঘটনা সুনিশ্চিত। তাই উড়োজাহাজকে নিরাপদ রাখতে হলে, বজ্রপাতের পুরো শক্তি এর দেহের ওপর দিয়েই নিতে হবে। প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না ভেতরে। প্রকৌশলীরা সেই কাজটিই করেছেন।
উড়োজাহাজের ভেতরে বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য তারগুলো খুবই যত্নের সঙ্গে শক্তিশালী অপরিবাহক বা ইনসুলেটর দিয়ে মোড়ানো থাকে। জ্বালানী ট্যাংকও বিদ্যুৎ নিরোধী করে তৈরি করা হয়। মূল কারিগরিটা ফলানো হয় উড়োজাহাজের দেহে। অ্যালুমিনিয়াম, টাইটেনিয়াম, স্টিলের মতো ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি হয় বাইরের অংশ। পুরো দেহটি কাজ করে ফ্যারাডে খাঁচার মতো। অর্থাৎ এখানে বজ্রপাত হলে ইলেক্ট্রনের স্রোত পুরো দেহে ছড়িয়ে পড়ে আবার বায়ুমণ্ডলে চলে যায়। ফলে ভেতরের সবকিছু থাকে সুরক্ষিত।
বজ্রপাত তাই উড়োজাহাজের জন্য ঝুঁকির কারণ নয়। তবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বাতাসের চাপ, শিলাবৃষ্টি ঘূর্ণিবায়ু এগুলো উড়োজাহাজের জন্য বেশ ক্ষতির কারণ হতে পারে
জন হান্সম্যানের মতে, ‘বজ্রপাত সাধারণত উড়োজাহাজের নাক বা পাখায় আঘাত হানে। এরপর পুরো দেহ প্রবাহিত হয়ে লেজের অংশ দিয়ে বেরিয়ে যায় বাতাসে।’
বর্তমানে বোয়িং ৭৮৭ এবং এয়ারবাস এ৩৫০-এর মতো উড়োজাহাজগুলো কার্বন ফাইবারের মতো অপরিবাহী যৌগিক উপাদানের মিশ্রণে তৈরি করা হয়। ফলে ফিউজিলেজ (উড়োজাহাজের মূল দেহ) এবং ডানার বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা হ্রাস পায়। উড়োজাহাজ হয় আরও নিরাপদ।
বজ্রপাত তাই উড়োজাহাজের জন্য ঝুঁকির কারণ নয়। তবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বাতাসের চাপ, শিলাবৃষ্টি ঘূর্ণিবায়ু এগুলো উড়োজাহাজের জন্য বেশ ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সূত্র: টাইম ম্যাগাজিন
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা