আপনি স্যার কী করেন?
- আমি কী করি সেটা আপনার জানার কথা, জেনেশুনেই তো আমাকে এখানে এনেছেন।
- তা অবশ্য ঠিক, আপনার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ স্যার। বোঝেন তো স্যার পুলিশে চাকরি করি...আপনার মতো সম্মানিত লোককেও ধইরা আনতে হইল। সত্যি কথা বলতে কি স্যার, এই ফাইলে আপনের বিরুদ্ধে এক শ ছাপ্পান্নটা অভিযোগ আছে।
৬৫ বছরের পক্বকেশ বিজ্ঞানী ডক্টর সাদেক মাহফুজ চারদিকে তাকালেন। আট ফিট বাই বারো ফিটের ছোট্ট একটা ঘরে তারা দুজন বসে আছেন, ওপরে কড়া পাওয়ারের একটা লাইট জ্বলছে। এটা সম্ভবত স্পেশাল ব্রাঞ্চের একটা কোনো ইন্টারোগেশন রুম। এএসপি সাইমুন সারোয়ার আর বিজ্ঞানী ডক্টর সাদেক মাহফুজুল্লাহ বসে আছেন সেই রুমে। বয়স্ক বিজ্ঞানী কি মনে করে তার চওড়া কাঁধটা একটু ঝাঁকানোর মতো ভঙ্গি করলেন। ‘আমি আসলে নিজেকে একজন টাইম স্টপার মনে করি।’
- এটা কী স্যার?
- প্রক্রিয়াটা জটিল।
- তবু স্যার যদি একটু বলতেন। আমি স্যার আসলে আপনার বিরাট ভক্ত। আপনার ওই টাইম ডায়ালেশ বইটা পড়ছি। মারাত্মক বই স্যার। তবে খুব কঠিন স্যার... পুরোটা বুঝি নাই।
- তাহলে এটাও বুঝবেন না।
- তবু স্যার যদি বলতেন একটু।
- আমি আসলে সময়কে মাঝেমধ্যে থামাই। মানে বলতে পারেন থামাতে পারি।
- বলেন কী স্যার! এত ডেঞ্জারাস কথা বললেন। সময়কে থামায়ে কী করেন?
- কিছু করি না, তবে করব।
- কী করবেন?
- অনেক কিছু করার আছে। যেমন ধরেন আপাতত একটা ‘কসমিক ওয়্যারের’ গতিপথ রুদ্ধ করতে হবে। এটা করতে হবে কারণ আমাদের এই সৌরজগৎকে রক্ষা করার জন্য।
- কসমিক ওয়্যারটা কী স্যার?
- বাংলায় এটাকে বলতে পারি ‘মহাজাগতিক তার’। এটা একটা চাবুকের মতো ব্যাপার; কয়েক হাজার বা লাখ ব্ল্যাকহোলের আকর্ষণ শক্তি নিয়ে এটা মহাবিশ্বে ছুটে বেড়াচ্ছে, বলতে পারেন মনে হবে কেউ চাবুক হাঁকাচ্ছে...
- বলেন কী স্যার, এ তো পুরাই তেলেসমাতি ব্যাপার!
- একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই আপনাকে। এই কসমিক ওয়্যারটা ধরেন যদি পৃথিবীর বিষুবরেখা দিয়ে যায়, তাহলে এক সেকেন্ডের এক মিলিয়ন ভাগের সময়ের মধ্যে পৃথিবীর দুই মেরু একসঙ্গে হয়ে যাবে।
- দাঁড়ান দাঁড়ান স্যার...
- কী হলো?
- স্যার আপনার এই কথা শুইনা আমার মাথা চক্কর দিয়া উঠছে। এক কাপ চা না খাইলে এই চক্কর থামব না। আপনে চা খাইবেন? পাঁচ মিনিট বসেন স্যার আপনার লাইগা চা পাঠাই, আমিও এক কাপ খায়া আসি বলে এএসপি সাহেব বের হয়ে গেলেন।
বোকা বানানো এত সহজ? ফিজিকসে লেটার ছিল আমার ম্যাট্রিকে। ইন্টারে দুই নম্বরের লাইগা লেটার মিস হইছে...আচ্ছা যাই আর দুয়েকটা কথা জিগায়া চালান দিয়া দেই।
এক কাপ চা খেতে পারলে অবশ্য মন্দ হতো না, ভাবলেন ডক্টর সাদেক মাহফুজুল্লাহ। নিজের ল্যাবে যখন থাকেন, তখন তিনি ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা খান। এরা তাকে নিয়ে ঠিক কী করতে চাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে ১৫৬টা অভিযোগ কে করল? একবার অবশ্য প্রফেসর জিলানীর একটা গুরুত্বপূর্ণ থিওরিতে তিনি একটা জটিল ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এতে প্রফেসর জিলানী যে ভয়ানক নাখোশ হয়েছেন, সেটা বেশ বোঝা গেছে। প্রফেসর জিলানী সরকারের খুব পছন্দের লোক। এটা হতে পারে, তিনিই নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন। তা নাড়ুন, কিন্তু এখন এই মুহূর্তে তার ল্যাবে থাকা খুব খুব জরুরি। আগামী ৬ থেকে ১২ ঘণ্টা তার জন্য তো বটেই ,এই সৌরজগতের জন্য খুবই জরুরি...যে কসমিক ওয়্যারটা ছুটে আসছে, তার গতি কল্পনাকেও হার মানায়।
- স্যার কি বুঝলেন? এএসপি সাইমুন সারোয়ারকে আরও দুয়েকজন জুনিয়ার অফিসার ঘিরে ধরল।
- আগে চা দেও জলদি।
চা চলে এল সঙ্গে সঙ্গে। আর এক শলা বেনসন অ্যান্ড হেজেজ।
- আরে কিসের বিজ্ঞানী, এই লোক পুরাই ভুয়া...।
- আরে আমি তো স্যার আগেই বলছিলাম। এই লোকেরে আগে একটা বাঁশডলা দেই।
- লোকটা কী বলে স্যার? আরেকজন অফিসার প্রশ্ন করে।
- সে নাকি সৌরজগৎ রক্ষা করতে নামছে... হা হা হা। হাসিতে তার সঙ্গে গলা মেলাল অন্যরা।
- একটা চাবুক নাকি ঘুইরা বেড়াইতাছে...এই সব হাবিজাবি...নয়ছয় বুঝাইতাছে আমারে। আরে আমারে বোকা বানানো এত সহজ? ফিজিকসে লেটার ছিল আমার ম্যাট্রিকে। ইন্টারে দুই নম্বরের লাইগা লেটার মিস হইছে...আচ্ছা যাই আর দুয়েকটা কথা জিগায়া চালান দিয়া দেই। তোমরা চালানের কাগজপত্র রেডি করো।
- স্যার সিগারেট খাইবেন না?
- না, পরে।
- স্যার, ডলা দিমু একটা?
- অবশ্যই, এমন ডলা দিবা যেন বিজ্ঞানে ব-ও আর মুখে নিতে না পারে...ফাজিলের ফাজিল। আমারে চাবুক শিখায়।
- স্যার এইটা নিয়া ভাইবেন না। আখেরি ডলা দিব।
- দেইখ আবার মাইরা ফেইল না।
এএসপি সাহেব আবার এসে বসলেন প্রফেসর মাহফুজুল্লাহর সামনে।
- স্যার চা খাইছেন?
- চা দেয় নাই তো।
- এ্যাঁ দেয় নাই? সব ফাজিলের ফাজিল। আচ্ছা স্যার আপনি কি নেশা করেন?
- মানে?
- মানে ডাইল-ফেন্সি, গাঁজা এসব চলে?
প্রফেসর বুঝতে পারলেন, লোকটা অন্য ফর্মে এখন তার সাথে কথা বলছে। এবং সম্ভবত এটাই তার আসল ফর্ম। ঠিক তার এক্সপেরিমেন্টার মতো। সময় এক ফর্মে আছে, অন্য ফর্মে নিলে সবকিছু বদলে যায়। তিনি মৃদু হাসলেন।
- না খাই না। আচ্ছা আমাকে কী করা হবে?
- কিছু না স্যার, আরেকটু কথাবার্তা বলি। তারপর আপনি চলে যাবেন। আচ্ছা স্যার, ছোটবেলায় টাইম ট্রাভেল নিয়ে একটা গল্প পড়েছিলাম। দারুণ লাগছিল...স্যার কি টাইম ট্রাভেল করেন? আপনি তো সময় থামায়া ফেলেন...
- না, আমাকে ঠিক টাইম ট্রাভেল করতে হয় না। তবে অন্যভাবে এটা সম্ভব।
- কীভাবে স্যার?
- এটা বেশ জটিল। আপনার সাবজেক্ট কী ছিল?
- কি বলেন স্যার ম্যাট্রিকে ফিজিকসে লেটার ছিল আমার, ইন্টারে দুই নম্বরের জন্য লেটার মিস হইছে... ওইটা মিস হইছে জলিল স্যারের কারণে। ব্যাটা ছিল একটা বাটপার ট্যাকা খায়া... যাউক বাদ দেন; তারপর তো স্যার পুলিশে ঢুইকা গেলাম।
- তাহলে হয়তো আপনি বুঝবেন।
- জি স্যার অবশ্যই বুঝব।
- আমি সময়কে ভেঙে ফেলি...
- বলেন কি স্যার, ক্যামনে ভাঙেন? ইট ভাঙার মতো নাকি? হাতুরি দিয়া যে ইট ভাঙে...ওই রকম?
- না, ঠিক সে রকম না।
- তাহলে?
- সময়কে যদি চতুর্থ মাত্রা ধরি... তাহলে পঞ্চম মাত্রায়…
- আচ্ছা স্যার আপনার ওই যে টাইম ডায়ালেশন বইটা, ওইটা নাকি নকল?
প্রফেসর হাসলেন, ‘আপনি তো ওই বইটা পড়েছেন, আপনার কী মনে হয়েছে?’
- ধুর স্যার আসলে ওইসব ভুয়া বই আমি পড়ি না। ওইটা তো স্যার পুরাই নীলক্ষেত প্রোডাকশন। হাবিজাবি কী সব চোথামোথা মাইরা লিখছেন...
প্রফেসর বুঝতে পারছেন, লোকটা তার আসল ফর্মে ফিরে আসছে ধীরে ধীরে...লোকটা আসলে ভয়ংকর। সময়কে এক সেকেন্ডের মিলিয়ন ভাগের এক ভাগে থামানোর পর অন্যান্য মাত্রা যেভাবে প্রথমে থমকে যায়, তারপর ফিরে আসতে শুরু করে প্রবল বিক্রমে...যেন অনেকটা ওই রকম।
- আচ্ছা আমাকে যেতে হবে। খুব জরুরি। প্রফেসর এবার জোর গলায় বললেন।
- কই যাইবেন স্যার?
- আমার ল্যাবে।
আগের না খাওয়া বেনসন সিগারেটটা ধরিয়ে এএসপি সাহেব তার রুমে ঢুকতে পারলেন না। জুনিয়ার অফিসার তিনজন ছুটে এল।
- স্যার যদি আপনেরে যাইতে না দেই, কী করবেন?
- তারপরও আমাকে যেতে হবে। আপনারা যেতে না দিলে আমি আমার মতো করে যাব।
- কীভাবে স্যার? টাইম ট্রাভেল?
- ঠিক তা না। আমি নিজেকে ভেঙে ফেলব যেভাবে সময়কে ভাঙি ...অণু–পরমাণুতে...তারপর...
এএসপি উঠে দাঁড়াল। ‘ভাঙেন স্যার, ভাঙতে থাকেন, হাতুরি লাগলে বলেন আইনা দেই। আমি আইতাছি...’
বাইরে এসে এএসপি সাহেব বড় করে হাই তুললেন। জুনিয়ার অফিসাররা আগের মতো ঘিরে ধরল।
- স্যার ঘটনা কী?
- ঘটনা আবার কী, কাগজপত্র রেডি কইরা চালান কইরা দেও। খালি খালি সময় নষ্ট।
- ডলা দিব না স্যার?
- অবশ্যই, দেইখ আবার মাইরা ফেইল না।
আগের না খাওয়া বেনসন সিগারেটটা ধরিয়ে এএসপি সাহেব তার রুমে ঢুকতে পারলেন না। জুনিয়ার অফিসার তিনজন ছুটে এল।
- স্যার? স্যার??
- কী হইছে?
- উনি স্যার উনার রুমে নাই।
- কি ক্কি?? বলছ??
তিনিও ছুটে গেলেন। সত্যি রুমটা ফকফকে ফাঁকা। মানে কী?
- স্যার উনি উধাও! একটা শিরশিরে অনুভূতি এএসপি সাইমুন সারোয়ারের মেরুদণ্ড বেয়ে নিচের দিকে নেমে গেল। গলার কাছটা কেমন যেন দম বন্ধ লাগছে। টেবিলটার ওপর প্রফেসর সাহেবের পকেটের নীল বলপয়েন্ট কলমটা ক্যাপ খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। সবাই খেয়াল করে দেখল, বলপয়েন্ট কলম দিয়ে সম্ভবত প্রফেসর সাহেব কিছু একটা লিখে গেছেন টেবিলের ওপর। সবাই ঝুঁকে পড়ল লেখাটার ওপর, ইংরেজিতে লেখা—‘Everthing is theroretically imposible. until it is done’।