বেগুনি গরু

অলংকরণ: আরাফাত করিম

অক্টোবরের হিমশীতল সকাল। নিজের র‍্যাঞ্চের পাহাড়ের ঢালে বেগুনি রঙের একটা গরু দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন ফ্লয়েড আনসেলমো। বেশ আয়েশ করে ঘাস খাচ্ছে গরুটা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। মনে মনে ভাবলেন, নিশ্চয়ই হ্যালুসিনেশন হচ্ছে তাঁর।

পিকআপটা র‍্যাঞ্চের প্রবেশপথের কাছে এগিয়ে নিয়ে এলেন তিনি। ব্রেক কষে থামালেন সেটা। সিটের ওপর খানিকটা ঝুঁকে আরেকবার সেদিকে তাকালেন। গরুটাকে তখনো সেখানে দেখা গেল। আগের মতোই ঘাস চিবুচ্ছে। দৃশ্যটার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। একবার ভাবলেন, গরুটা হয়তো এখনই অদৃশ্য হয়ে যাবে। কিন্তু না, তেমন কিছু হলো না।

মাথাটা ধীরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে পিকআপ থেকে নেমে এলেন আনসেলমো। নুড়ি বিছানো রাস্তায় দাঁড়ালেন। সকালের সূর্যের ঝলসানো রোদ থেকে চোখ বাঁচাতে চোখের ওপর বিশেষ কায়দায় হাত রাখলেন। চোখ সরু করে তাকালেন আগের জায়গায়। কিন্তু দৃশ্যের কোনো নড়চড় হলো না। গরুটাকে তখনো সেখানেই দেখতে পেলেন তিনি।

হায় ঈশ্বর! বিড়বিড় করে বলে উঠলেন আনসেলমো। ভাবলেন, কে জানে, এরপর হয়তো গোলাপি হাতি দেখা যাবে। আজব ব্যাপার! মাতাল না হয়েই চোখের সামনে এসব কী দেখছি আমি!

সকালের হাড়কাঁপানো শীতল বাতাসে কেঁপে উঠলেন আনসেলমো। নিজেকে রক্ষা করতে কোটের কলারটা ছড়িয়ে দিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিকআপের দরজা থেকে হেঁটে রাস্তার উল্টো পাশের কিনারায় এলেন তিনি। রাস্তার পাশে শিশিরে ভেজা ঘাস। তাতে সাবধানে পা ফেলে বেগুনি গরুটা লক্ষ্য করে হাঁটতে শুরু করলেন। সামনের সাদা বেড়াটা অনায়াসে ডিঙালেন। তারপর ঢালু পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলেন আনসেলমো।

বেগুনি গরুটা যেখানে দাঁড়িয়ে ঘাস চিবুচ্ছে, ঢাল বেয়ে তার প্রায় ২০ ফুট দূরত্বে পৌঁছে গেলেন আনসেলমো। এখন অতিসতর্ক তিনি।

অর্ধেক পথ ওঠার পর গরুটার দিকে আরেকবার নজর বোলালেন। গরুটা যদি সত্যি সত্যি বেগুনি রঙের না হয়, তাহলে জঘন্য ব্যাপার হবে। তার চেয়ে রংটা লাইলাক শেডের হলেও বেশ হতো। তারপরও উজ্জ্বল সবুজ ঘাস আর বিবর্ণ, ধূসর ও সাদারঙা অন্য গরুগুলোর পটভূমিতে গরুটা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।

বেগুনি গরুটা যেখানে দাঁড়িয়ে ঘাস চিবুচ্ছে, ঢাল বেয়ে তার প্রায় ২০ ফুট দূরত্বে পৌঁছে গেলেন আনসেলমো। এখন অতিসতর্ক তিনি। জন্তুটার চারপাশে নিরাপদ দূরত্ব রেখে এক চক্কর দিলেন। কিন্তু আনসেলমোর দিকে ফিরেও তাকাল না গরুটা। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, ‘এই, এদিকে শোন, তুই সত্যি কিছু নয়। স্রেফ আমার কল্পনা।’

জন্তুটা সে কথায় পাত্তা না দিয়ে একমনে ঘাস খেতে লাগল।

‘গরু কখনো বেগুনি রঙের হয় না।’ নিজেকে প্রবোধ দিতে আপনমনেই বিড়বিড় করে উঠলেন আনসেলমো।

আলতো করে লেজ নাড়াল গরুটা।

সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন আনসেলমো। আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এবার হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে। তারপর ঘুরে ঢাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিজের বাড়িতে পৌঁছে গেলেন আনসেলমো। রান্নাঘরে তখন সকালের নাশতা তৈরি করছিলেন তাঁর স্ত্রী অ্যামি। ‘এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে,’ স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘অ্যামি, ওই পাহাড়ের ঢালে একটা বেগুনি গরুকে ঘাস খেতে দেখলাম,’ উত্তেজিত স্বরে বললেন আনসেলমো।

ডিশ টাওয়েলে হাত মুছতে মুছতে অ্যামি বললেন, ‘তোমার জন্য কফি বানিয়েছি।’

নিজের কান টানলেন আনসেলমো। ‘শুনতে পাচ্ছ না! আমি বললাম, রাস্তার ওপাশে পাহাড়ের ঢালে একটা বেগুনি গরু দেখেছি।’

‘হ্যাঁ, সোনা,’ অ্যামি জবাব দিলেন। তারপর কাপবোর্ডে থালাবাসন গাদা করে রাখতে লাগলেন।

বিরক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন আনসেলমো। তাঁর ফোরম্যান হ্যাঙ্ক রাইফোর্ডকে দেখা গেল সেখানে। দুধ দোয়ানোর চালাঘর থেকে এদিকেই আসছিল। ‘শুভ সকাল, মি. আনসেলমো,’ হ্যাঙ্ক বলল।

ভ্রুকুটি করে আনসেলমো বললেন, ‘হ্যাঙ্ক, আমি একটা বেগুনি গরুকে ওই পাহাড়ের ঢালে ঘাস খেতে দেখলাম।’

আনসেলমোর দিকে তাকাল হ্যাঙ্ক। আনসেলমো বলতে লাগলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম আমার বোধ হয় হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। কিন্তু গরুটার কাছে গিয়েছিলাম। দেখলাম, সত্যিই বেগুনি সেটা। ব্যাপারটা কী, কিছুই বুঝতে পারছি না।’

মালিকের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে হ্যাঙ্ক বলল, ‘আচ্ছা, তা–ই নাকি!’

‘তুমি তো মনে হয় এ রকম কিছু কখনো দেখোনি, নাকি?’

‘না, স্যার।’

মাথা দোলালেন আনসেলমো। ‘আমার সঙ্গে একবার গিয়ে দেখতে চাও?’

‘কিন্তু এখন যে হাতে বেশ কিছু কাজ আছে। সেগুলো শেষ করতে হবে।’

‘আচ্ছা, তাহলে পরে যেয়ো।’

‘অবশ্যই যাব। পরেই যাব তাহলে।’ এ কথা বলেই দ্রুত চোখের সামনে থেকে চলে গেল হ্যাঙ্ক।

আবার বাড়ির দিকে ফিরে চললেন আনসেলমো। হলরুমের টেবিলটা দ্রুত পায়ে পেরিয়ে সোজা টেলিফোনের কাছে চলে গেলেন। ডায়াল ঘুরিয়ে স্থানীয় সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক জিম প্লেয়ারকে ফোন করলেন।

ওপাশে জিম রিসিভার তুলতেই তিনি বললেন, ‘আনসেলমো বলছি।’

‘তোমার জন্য কী করতে পারি, ফ্লয়েড?’

‘কিছুক্ষণ আগে শহর থেকে এসেছি আমি। আমাদের র‍্যাঞ্চে ঢুকতেই পাহাড়ের পাশে একটা বেগুনি গরু দেখতে পেলাম। ঘাস খাচ্ছিল সেটা,’ হড়বড় করে বলে গেলেন আনসেলমো।

ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করল।

‘জিম, শুনতে পাচ্ছ?’ অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেন আনসেলমো।

‘বেগুনি গরু?’ শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেন প্লেয়ার।

‘ঠিক তা–ই। একটা বেগুনি গরু।’ আনসেলমো জবাব দেন।

ইউএফও নিয়ে তোমার এসব আজগুবি কথা পরে শুনব। এখন আমার হাতে সময় নেই।’ চাপা স্বরে হাসতে লাগলেন প্লেয়ার।
আরও পড়ুন

ফোনের অপর প্রান্তে আরেকবার নীরবতা নেমে এল। তবে এবার অল্প সময়ের জন্য। তারপর হাসতে হাসতে প্লেয়ার বললেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে রসিকতা করছ, তা–ই না?’

‘না।’ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন আনসেলমো।

‘শোনো ফ্লয়েড, আমি ভীষণ ব্যস্ত। ইউএফও নিয়ে তোমার এসব আজগুবি কথা পরে শুনব। এখন আমার হাতে সময় নেই।’ চাপা স্বরে হাসতে লাগলেন প্লেয়ার। ‘তুমিও হয়তো বলবে, তোমার ওই বেগুনি গরুটাও কোনো ফ্লাইং সসার থেকে নেমে এসেছে। অনেকেই তো এই ফ্লাইং সসার দেখার দাবি করে।’

‘জিম, ফ্লাইং সসার সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। শুধু জানি, একটা বেগুনি গরু আমাদের পাহাড়ের ঢালে ঘাস খাচ্ছে। তুমি এখানে একবার এলে তোমাকে স্বচক্ষে দেখাতে পারতাম।’ ধীরে ধীরে কথাগুলো বললেন আনসেলমো।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন প্লেয়ার। তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি আসছি। কিন্তু তুমি যদি আমার সঙ্গে রসিকতা করে থাকো, তাহলে কিন্তু...’

‘যে পাহাড়ের ঢালের কথা বলছি, সেটা হাইওয়ে থেকে আমাদের র‍্যাঞ্চের দিকে মাইলখানেকের মতো হবে। তোমার সঙ্গে ওখানেই দেখা করব আমি,’ আনসেলমো বললেন।

‘ওহ, পঁয়তাল্লিশ মিনিট,’ কিছুটা অসন্তোষের সুরে কথাটা বলে ফোন কেটে দিলেন জিম প্লেয়ার।

আরও পড়ুন

ফোন নামিয়ে রেখে দরজার দিকে এগোলেন আনসেলমো। দরজার কাছে পৌঁছাতেই অ্যামির সঙ্গে দেখা। ‘আবার কোথায় যাচ্ছ, সোনা?’

‘জিম প্লেয়ারের সঙ্গে দেখা করতে।’

‘কী জন্য?’

‘তাকে বেগুনি গরুটা দেখাতে যাচ্ছি।’

দুশ্চিন্তায় অ্যামির কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘ফ্লয়েড...’

‘এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব।’ বলেই বাইরে পা রাখলেন আনসেলমো।

পিকআপের ইঞ্জিন চালু করে র৵াঞ্চে ঢোকার রাস্তার দিকে এগোতে লাগলেন। পাহাড়ের ঢালের কাছে পৌঁছাতেই দেখলেন, বেগুনি গরুটা ঢালের দিকে বেশ কিছুটা নেমে এসেছে। সাদা বেড়ার অনেক কাছে এখন দাঁড়িয়ে আছে জন্তুটা।

ব্রেক কষে পিকআপ থামিয়ে নেমে পড়লেন আনসেলমো। ঘাস মাড়িয়ে সাদা বেড়াটার দিকে এগোতে লাগলেন। বেড়াটা ডিঙিয়ে গরুটার মুখোমুখি দাঁড়ালেন তিনি।

জন্তুটা তখনো আয়েশ করে ঘাস খাচ্ছিল। সামনে তাঁর উপস্থিতি যেন টেরই পায়নি ওটা।

পাই করে ঘুরে সেখান থেকে এক দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা হলো তাঁর। কিন্তু সে ইচ্ছাও মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল।

টলমল পায়ে জন্তুটার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। সতর্কভাবে হাত বাড়ালেন। জন্তুটার মাথা আলতো করে ছুঁয়ে দিলেন। তারপর একটু পেছনে সরে গেলেন আনসেলমো। বিড়বিড় করে বললেন, ‘শুরুতে কিছুটা সন্দেহ ছিল। কিন্তু তুই যদি সত্যি না হতিশ, তাহলে জঘন্য ব্যাপার হতো। বেগুনি রঙের না হলেও জঘন্য ব্যাপার হতো।’

জন্তুটা পেছনের পা সরিয়ে নিল।

‘তুই কোত্থেকে এসেছিস? জিম প্লেয়ার ফ্লাইং সসার, না ওই রকম কী যেন বলছিল। ওদের সঙ্গে আমার কোনো লেনদেন নেই, কিন্তু তু...’

কথাটা শেষ করতে পারলেন না আনসেলমো, তাঁর টুঁটি যেন কেউ চেপে ধরেছে। তাঁর হাতের দিকে চোখ আটকে গেল। কয়েক সেকেন্ড আগে এই হাত দিয়েই জন্তুটার মাথা স্পর্শ করেছেন তিনি।

তাঁর হাতের আঙুলগুলো বেগুনি হতে শুরু করেছে।

পাই করে ঘুরে সেখান থেকে এক দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা হলো তাঁর। কিন্তু সে ইচ্ছাও মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর বেগুনি জন্তুটা মাথা তুলল। প্রথমবারের মতো আনসেলমোকে তাকিয়ে দেখল।

প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে জন্তুটা বলল, ‘হাম্বা?’

‘হাম্বা,’ জবাব দিলেন আনসেলমো।

কয়েক মিনিট পর শহর থেকে জিম প্লেয়ার সেখানে এসে পৌঁছালেন। রাস্তার পাশের পাহাড়ের ঢালে তখন দুটি বেগুনি গরু দেখা গেল। একমনে সবুজ ঘাস খাচ্ছে গরু দুটি। বেশ আয়েশ করেই খাচ্ছে।

বিল প্রোনজিনি: মার্কিন লেখক। জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৩ এপ্রিল, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়। গোয়েন্দা কাহিনি, রহস্য, ওয়েস্টার্ন ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনির লেখক হিসেবে বেশ নামকরা।

*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন