ল্যুভিয়া দু পিসেস
‘মাছ খেতে কেমন লাগে বাবা?’
সাত বছরের ছেলে শিকুর প্রশ্ন শুনে একটু চমকে গেলেন সুবিদ আলী। ছেলেকে কি তিনি কখনো মাছ-মাংস খাওয়াতে পেরেছেন? ছোট থাকতে? তাঁর এখন মনে পড়ে না, শেষ কবে তিনি নিজে মাছ–মাংস চোখে দেখেছিলেন।
একসময় তাঁরা নিজেদের বাড়িতে গরু–ছাগল পুষতেন। পেলেপুষে এদের বড় করতেন, দুধ খেতেন। কখনো শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতেন। আবার বাজারে মাংস কিনতেও পাওয়া যেত। এখন নতুন আইনে পশুপাখি মারা নিষেধ। শুধু নিষেধ নয়, ভয়ংকর অপরাধ। পশুপাখি মারা তো দূরের কথা, এখন এদের দেখাই মেলা ভার। গহিন জঙ্গল ছাড়া কোনো পশুপাখি নেই কোথাও। কিছু গৃহপালিত প্রাণী আছে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত খামারে। দুধ, ডিম, মাংসের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে অনেক আগেই। কেবল বড়লোকেরাই তা খেতে পারে। আর সব পাখির মতো হাঁস–মুরগিও প্রায় বিলুপ্ত। পুকুর, নদীতে মাছ নেই। এই পৃথিবীর সব ভোজ্য প্রাণী মানুষ একাই চেটেপুটে খেয়ে শেষ করেছে। খামারে উচ্চ ব্যয়ে যা কিছু প্রাণী পোষা হয়, তার ওপর সাধারণের অধিকার নেই। তাদের জীবন এখন তাই আমিষশূন্য।
সুবিদ আলী ছেলেকে আদর করে পাশে বসান। কপালে চুমু খেয়ে বলেন, ‘মাছ–মাংস খাওয়া ভালো নয়, সোনা। প্রাণীদের তো প্রাণ আছে। মাংস খাওয়া মানে, একটা প্রাণীকে হত্যা করা। আগে মানুষ মাংসাশী ছিল। তারা অসভ্য। তাদের কারণেই দুনিয়ায় এই বিপর্যয় নেমে এসেছে।’
‘কিন্তু গাছেদেরও তো প্রাণ আছে, বাবা!’ মানতে চায় না শিকু। ‘আমরা যে শাকপাতা, সবজি খাই। ফলপাকুড় খাই। গাছেরা বুঝি ব্যথা পায় না?’
‘পায়। কিন্তু গাছদের তো আমরা মেরে ফেলি না। তারা আবার ফল দেয়। আবার সবজি ধরে। আমরা গাছে পানি দিই, সার দিই। ওদের ভালোবাসি। তাই না? তার বিনিময়ে তারা আমাদের খাবার দেয়।’
তারপর শিকু আর তার মা–বাবা দুপুরবেলা খেতে বসেন। সেই রোজকার শাকপাতা, গাজর, বাঁধাকপি আর ডাল। শিকুর আর এসব খেতে ভালো লাগে না। সে স্কুলের লাইব্রেরিতে দেখেছে, বইয়ের পাতায় পাতায় ইলিশ মাছের ছবি। মাছের রাজা নাকি ছিল ইলিশ। ওদের বাড়ির কাছে যে পদ্মা নদী, তার ইলিশ নাকি ছিল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সেরা। একবার খেলে হাতে তার খুশবু লেগে থাকত সারা দিন। আশ্চর্য, কোথায় গেল সেই সব মাছ? কীভাবে পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে গেল সব মাছ, পাখি আর প্রাণী?
শিকু স্কুলের পর সারা দিন নদীর ধারে, মেঠো পথে হেঁটে বেড়ায়। নদীর পানি নিস্তরঙ্গ, স্বচ্ছ সবুজ। এই নদীতে নাকি মাছ কিলবিল করত একদিন। জেলেরা সার সার নৌকা নিয়ে শেষ রাতে বেরিয়ে পড়তেন মাঝনদীর দিকে, মাছ ধরার জন্য। নৌকাভর্তি মাছ নিয়ে ফিরতেন তাঁরা। সেই মাছ চলে যেত শহরে, অন্য দেশে, সারা পৃথিবীতে। এসব সে শুনেছে তার বন্ধু জামিলের কাছে। জামিলদের পূর্বপুরুষ জেলে ছিল। তার দাদুও নাকি নিজ হাতে মাছ ধরেছেন এই পদ্মার বুক থেকে। তবে তার বাবা এখন কৃষিকাজ করেন। নিজেদের বাড়ির সামনে একটুখানি জমিতে সবজি ফলান। তা দিয়ে পরিবারের পেট ভরে। সর্বভুক মানবজাতি আজ বাধ্য হয়েই নিরামিষাশী হয়েছে। কিন্তু যদি পৃথিবীর গাছগাছালিও একদিন শেষ হয়ে যায়? কথাটা ভেবে শিকু ভয়ে কেঁপে ওঠে। তাহলে তো তাদের সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে।
একদিন স্কুলের ড্রয়িংখাতায় সুন্দর একটা মাছ এঁকেছিল শিকু। কিন্তু কী রং করবে, তা বুঝতে পারছিল না। বাধ্য হয়ে ছবিটা সে জামিলকেই দেখাল।
‘এটা কী মাছ বল দেখি?’ জিজ্ঞেস করল শিকু।
‘উম–ম–ম’—একটু চিন্তা করে জামিল উত্তর দিল, ‘মনে হয় কাতলা মাছ। দাদু বলেছেন, কাতলা মাছের মাথা বড় হয়। আর হাঁ–টা বিরাট। দেখছিস না, মাথাটা একটু বড় আঁকা হয়ে গেছে?’
‘কাতলা মাছের রং কী?’
‘মনে হয় নীল। চল দাদুকে জিজ্ঞেস করি।’
জামিলের দাদু চোখের কাছে খাতাটা এনে খনখন করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘এটা কাতলা মাছের মতো তো নয় রে!’
‘তাহলে কি এটা ইলিশ?’ শিকু লোভাতুর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
‘উঁহু। ইলিশের শরীরটা পেটানো, এই রকম মোটা হোঁতকা নয়। ভারি সুন্দর দেখতে তারা। রুপালি রং পিছলাইয়া পড়ে তাদের শরীর থিকা। আহা, কী সুন্দর ছিল ইলিশ মাছগুলা!’
শিকু আর জামিলও মনে মনে ভাবে, ‘ইশ্! আহা।’
‘এইটা বরং দেখতে কেমন কই মাছের মতো হইছে!’ দাদু বলেন।
‘কই মাছ? সে আবার কেমন?’ জামিল জিজ্ঞেস করল।
দাদুর কথা শুনে শুনে তাদের দুই বন্ধুর স্কুলের খাতা নানা কিসিমের মাছের ছবিতে ভরে উঠল। কালো লম্বা চিকন মাছগুলো শিং মাছ। পেটের কাছটা একটু চ্যাপটা রুই মাছের।
‘সে খুব চালাক মাছ। বর্ষাকালে অনেক বৃষ্টি হইলে পুকুর–নদী থিকা উইঠা আইসা তরতর কইরা গাছে উইঠা যাইত। আমাদের এই উঠানেই কাদায় গড়াগড়ি করা কত কই মাছ ধরছি ছোডোকালে। হাত দিয়া।’
দাদুর গল্প অবিশ্বাস্য লাগে শিকু আর জামিলের কাছে। মাছ বুঝি গাছে ওঠে? কী যে সব আজগুবি কথা!
‘আরে ওঠে ওঠে। তোগো দাদার ধানখেতের কাদা থিকা কত বাইন মাছ ধরছি হাত দিয়া জানস? বাইন মাছ খাইতে মাংসের লাহান। খুব স্বাদ।’
সেই কথা শুনে সেদিন বাড়ি ফিরে আবার প্রশ্নটা করেছিল শিকু, ‘আচ্ছা, মাংস খেতে কেমন লাগে, বাবা?’
আর শিকুর বাবা আবার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিব্রত হয়েছিলেন। আহা, ছেলেটা তার কোনো দিন মাছ–মাংসের স্বাদ পেল না! এ কেমন গজব পড়ল দুনিয়ায়?
দাদুর কথা শুনে শুনে তাদের দুই বন্ধুর স্কুলের খাতা নানা কিসিমের মাছের ছবিতে ভরে উঠল। কালো লম্বা চিকন মাছগুলো শিং মাছ। পেটের কাছটা একটু চ্যাপটা রুই মাছের। বেলে মাছের শরীর একটু ডোরাকাটা। আইড় মাছের মুখটা সুচালো। আর ইলিশ! ইলিশের ছবি এঁকে মন ভরে না শিকুর। সত্যিকারের ইলিশ না জানি কত সুন্দর! আর খেতে?
স্কুলে খাতা জমা দিলে শিকুর ছবি বিশেষ পুরস্কার পেল বার্ষিক পরীক্ষায়। দুটি ছবি বড় করে বাঁধাই করে রাখা হলো তাদের ক্লাসের দেয়ালে। ক্লাস টিচার শুভ স্যার বললেন, ‘শিকু আর জামিল একটা হারানো ঐতিহ্য তুলে ধরেছে তাদের ছবিতে। আমাদের যে একটা সোনালি অতীত ছিল, লোকে বলত “মাছে ভাতে বাঙালি”, তা তো আমরা ভুলেই গেছি সেই কবে। শিকু আর জামিল আবার মনে করিয়ে দিল সেই সব কথা।’
শুভ স্যার ইলিশ নিয়ে একটা ক্লাসই নিয়ে ফেললেন উত্তেজিত হয়ে। ইলিশের আসল নিবাস ছিল সমুদ্রে। ডিম পাড়ার সময় হলে তারা মাইলের পর মাইল সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে চলে আসত নদীর মোহনায়।
সবাই হাততালি দিল শুভ স্যারের কথা শুনে। ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে ভিড় করে বাঁধাই করা সেই সব মাছের ছবি দেখল। এগুলো লোকে খেত! না জানি কেমন খেতে এই সব মাছের তৈরি পদ। কেউ কেউ ঘেন্না ভরে বলল, ছি, সাপের মতো দেখতে এই প্রাণীগুলো বুঝি খাওয়া যায়? কেমন বিশ্রী।
‘এইটা কি ইলিশ?’ চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল একটা মেয়ে।
‘হুম। এইটাই ইলিশ!’ উত্তর দিল শিকু গর্বভরে।
‘ইশ্–শ–শ্। শুনেছি ইলিশ খেতে খুব মজা।’
‘হুম–ম, মাছের রাজা হলো ইলিশ।’
শুভ স্যার ইলিশ নিয়ে একটা ক্লাসই নিয়ে ফেললেন উত্তেজিত হয়ে। ইলিশের আসল নিবাস ছিল সমুদ্রে। ডিম পাড়ার সময় হলে তারা মাইলের পর মাইল সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে চলে আসত নদীর মোহনায়। ঝাঁকে ঝাঁকে। আর এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার কারণেই তাদের শরীরের চর্বির ধরন পাল্টে যেত। এ জন্যই ইলিশ এত সুস্বাদু।
শিকু ক্লাসের পর কত কিছু ভাবে। আচ্ছা, সমুদ্রে কি এখনো ইলিশরা থাকে? এমন কি হতে পারে যে মানুষের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে তারা আর নদীতে আসে না? তারা এখন লুকিয়ে থাকে সমুদ্রের গভীর জলে? যদি কখনো সমুদ্র ফুঁসে ওঠে, প্রচণ্ড ঝড় হয়, তাহলে কি আবার উঠে আসতে পারে মাছেরা তাদের গোপন ঠিকানা ছেড়ে?
পদ্মাপারের কিশোর শিকু আর জামিলরা এভাবে আমিষ ছাড়াই বড় হতে থাকে। তারা মাছের ছবি আঁকে বটে, কিন্তু জীবনে কখনো মাছের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয় না। এমনকি জামিলের দাদুর মতো মানুষ মারা যাওয়ার পর মাছের গল্প বলার মতো মানুষেরাও হারিয়ে যায়। তারপর একদিন আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটে।
বাবা ঘরের দরজা অবধি আসতে না আসতেই ঝড়টা যেন একেবারে তাদের উঠানে চলে এল। মটমট করে ডাল ভাঙছে। ওদিকের ছোট গুদামঘরের চালা উড়ে গেল।
সেদিন আকাশ কালো হয়ে এসেছিল বহুদিন পর। দুপুরবেলাতেই মনে হচ্ছিল যেন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। শিকুর মা তাড়াহুড়ো করে উঠান ও ছাদ থেকে সব ধোয়া কাপড় তুলে আনতে শুরু করেন। মাত্রই জমিতে আলুর বীজ বুনেছেন শিকুর বাবা, এখন অসময়ে ঝড়–বৃষ্টি হলে বীজ নষ্ট হয়ে যাবে—এ কথা ভেবে চিন্তিত হয়ে উঠেন তিনি। আবহাওয়া খারাপ বলে তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল, বই–খাতা নিয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরছিল শিকু আর জামিল। সেই সময় পুব আকাশে একটা অদ্ভুত কালো ঘূর্ণি দেখে অবাক হয়ে গেল তারা। ঠিক সিনেমায় দেখা পারমাণবিক বোমার ধোঁয়ার মতো দেখতে ঘূর্ণিটা, সাপের মতো মুচড়ে মুচড়ে এগিয়ে আসছে তাদের গ্রামের দিকে।
ঘূর্ণিঝড়! জামিল ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে শিকুর হাত ধরে দৌড় দিল। গ্রামের লোকেরাও ভয়ে যে যার বাড়ির দিকে ছুটল। প্রচণ্ড বাতাসে যেন উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব গাছপালা। শিকুদের বাড়ির সামনের নারকেলগাছগুলো বাতাসের ধাক্কায় নুয়ে পড়ছিল মাটিতে। শিকু বাড়িতে ঢুকতেই মা তাকে জড়িয়ে ধরে দ্রুত ছুটলেন ঘরের ভেতরে, বড় চৌকিটার নিচে আশ্রয় নিলেন। সারা বাড়ি যেন থরথর করে কাঁপছে।
‘বাবা, ও বাবা!’ ভয়ে চিৎকার করে ডাকল শিকু।
‘আসছি শিকু। চালের বস্তাগুলো ভিজে যাবে। ঢেকে দিয়ে আসি।’
বাবা ঘরের দরজা অবধি আসতে না আসতেই ঝড়টা যেন একেবারে তাদের উঠানে চলে এল। মটমট করে ডাল ভাঙছে। ওদিকের ছোট গুদামঘরের চালা উড়ে গেল।
‘ইয়াল্লা!’ চিৎকার করে উঠলেন শিকুর মা। ‘এখন কী হবে? বাড়িটা না মাথার ওপর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে!’
তখনই চৌকির নিচ থেকে তারা শুনতে পেল, বাড়ির ছাদ আর উঠানে জোরে জোরে নুড়িপাথর পড়ছে। কে পাথর ছুড়ছে ওদের? আরে না, এ তো শিলাবৃষ্টি! চেঁচিয়ে উঠলেন মা। কতকাল শিলাবৃষ্টি হয় না এই গ্রামে। সত্যি বলতে কি, শিলাবৃষ্টি কখনো চোখেই দেখেনি শিকু জীবনে। মায়ের কাছে এই প্রথম শুনল। কেমন দেখতে হয় শিলাগুলো? বরফের মতো? পাথরের টুকরার মতো? শিলার শব্দে কান পাতা দায়। খুটখাট, ধুমধুম। পড়ছে তো পড়ছেই। অবশেষে ঝড় আর এই তাণ্ডব কখন শেষ হলো, তারা জানে না। রাত ভোর হতে নীরবতা নেমে এল চারদিকে। ঘূর্ণিঝড়টা তাদের গ্রাম লন্ডভন্ড করে দিয়ে চলে গেছে দূরে। একটা আশ্চর্য নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে ঝড়ের পর। ভোরের আলো ফুটে উঠতে একে একে গ্রামবাসী বেরিয়ে এল বাইরে। আর বেরিয়ে এসে তারা যা দেখল, তা দুই চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারল না।
তাদের উঠান আর বাড়ির চালে, মেঠো পথে, পুকুরের পাড়ে, ধানের খেতে—সর্বত্র পড়ে আছে হাজার হাজার মাছ! হ্যাঁ, মাছ। এগুলোকেই মাছ বলে। কোনোটার মুখ বড়, কোনোটার সুচালো, কোনোটার লেজ লম্বা, কোনোটার ছোট, কোনোটার রং চকচকে রুপালি, কোনোটার লালচে গোলাপি—কত কত রকমের মাছ। গত রাতে কারও বাড়ির চাল উড়ে গেছে, ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, কারও গোটা ঘরই ভেঙে গেছে—তবু তারা আনন্দে মেতে উঠল। শিলাবৃষ্টি নয়, গত রাতে আকাশ থেকে মাছের বৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা দয়াময়। তিনি আমিষ পাঠিয়েছেন তাদের জন্য। তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য। ছেলেমেয়েরা অন্তত একটা দিন মাছের স্বাদ পাবে জীবনে। একটা ভীষণ ঝড়ের পর গ্রামবাসী মনের আনন্দে মাছ কুড়াতে থাকল।
