শূন্য

অলংকরণ: রাকিব

‘আসলে,’ অগাস্ট পয়েন্টডেক্সটার বলল, ‘অতি আত্মবিশ্বাস বা অতি গর্ব বলে একটা কথা আছে। গ্রিকরা যেটাকে বলত হুব্রিস। দেবতাদের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের শামিল বলে গণ্য হতো এটা। প্রথমে হুব্রিস, এরপর আত বা অতি স্পর্ধা এবং সবশেষে শাস্তি বা পতন।’ ফ্যাকাশে নীল দুই চোখে অস্বস্তিতে হাত বোলায় সে।

‘দারুণ কিছু জানলাম,’ ড. এডওয়ার্ড অধৈর্য কণ্ঠে বলে। ‘কিন্তু আমি যা বললাম, তার সঙ্গে কি এর কোনো সম্পর্ক আছে?’ লম্বা সময় ধরে ভ্রু কুঁচকে রাখার কারণে কপালে সমান্তরাল বেশ কটা ভাঁজ পড়ে গেছে তার।

‘আলবত আছে,’ পয়েন্টডেক্সটার বলে। ‘টাইম মেশিন জিনিসটা বানানো তো ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তোমার এই অতি আত্মবিশ্বাস আমার ভালো লাগছে না। তুমি কী করে এতটা নিশ্চিত হচ্ছ যে তোমার টাইম মেশিন কোনো প্যারাডক্স সৃষ্টি না করে নির্বিঘ্নে সময়ের মাত্রার মধ্যে বিচরণ করবে?’

‘তুমি যে এ সময়ে এসেও মনে মনে এতটা কুসংস্কার লালন করো, তা দেখে অবাক হচ্ছি,’ ব্যারন বলে। ‘টাইম মেশিন অন্য সব মেশিনের মতোই একটা যন্ত্র! এটাকে এত নম নম করার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। একটা লিফট যেভাবে ওঠানামা করে, গাণিতিকভাবে টাইম মেশিনও ঠিক সেভাবেই কাজ করে। এর মধ্যে স্পর্ধা, আত্মবিশ্বাস বা শাস্তির কী আছে বুঝলাম না।’

‘একটা লিফট কিন্তু কখনো প্যারাডক্স তৈরি করতে পারে না। টাইম প্যারাডক্সের নাম শোনোনি তুমি? লিফটে চড়ে পাঁচতলা থেকে চারতলায় গেলে তোমার দাদার শৈশবে পৌঁছে তাকে মারতে পারবে না।’

ভীষণ হতাশ, অধৈর্য ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল ড. ব্যারন। ‘এ কথা শোনার অপেক্ষায় ছিলাম এতক্ষণ। জানতাম এ রকম কিছু বলবে। এটাও বলতে পারতে যে অতীতে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে খুন করে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস বদলে ফেলছি, তাই না? যাহোক, এসব তর্কে জড়াতে চাই না এখন। তোমাকে সামনাসামনি আরেকবার জিজ্ঞেস করছি, টাইম মেশিনে করে যাবে আমার সঙ্গে?’

‘ম-মনে হয় না,’ দ্বিধান্বিত স্বরে বলে পয়েন্টডেক্সটার।

‘বিষয়টি তুমি এ রকম অযথা জটিল করছ কেন? আমি তো ইতিমধ্যে ব্যাখ্যা করেছি তোমাকে, সময় অপরিবর্তনীয়। আমি যদি এখন অতীতে যাই, সেটার অর্থ আগেও নিশ্চয় গিয়েছিলাম। আমি এখন যা-ই সিদ্ধান্ত নিই না কেন, অতীতে ইতিমধ্যে সেটা করে ফেলেছি। তাই কোনো কিছু বদলাবে না এবং প্যারাডক্সও তৈরি হবে না। অতীতে যদি আমি আমার দাদাকে ছোট থাকতে খুন করার সিদ্ধান্ত নিই এবং কাজটি করে ফেলি, তাহলে আমার আজ এখানে থাকার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু আমি তোমার সামনে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছি, দেখতেই পাচ্ছ। অর্থাৎ দাদাকে খুন করিনি। এখন যত উপায়েই খুন করার পরিকল্পনা করি বা খুন করার চেষ্টা করি, তাতে কোনো লাভ হবে না। কিছুই বদলাবে না। আমি কী বলছি, বুঝতে পারছ?’

আরও পড়ুন
‘দারুণ কিছু জানলাম,’ ড. এডওয়ার্ড অধৈর্য কণ্ঠে বলে। ‘কিন্তু আমি যা বললাম, তার সঙ্গে কি এর কোনো সম্পর্ক আছে?’ লম্বা সময় ধরে ভ্রু কুঁচকে রাখার কারণে কপালে সমান্তরাল বেশ কটা ভাঁজ পড়ে গেছে তার।

‘তোমার কথা বুঝতে পারছি আমি, কিন্তু তুমি যা বলছ, তা কি ঠিক?’

‘ঠিক হবে না কেন! ইউনিভার্সিটিতে তোমার মেশিন নিয়ে না পড়ে গণিত নিয়ে পড়া উচিত ছিল,’ চেষ্টা করেও কণ্ঠস্বর থেকে বিরক্তি দূর করতে পারল না ব্যারন। ‘শোনো, এই মেশিন বানানো সম্ভব হয়েছে স্পেস ও টাইমের মধ্যে কিছু প্রমাণিত গাণিতিক সমীকরণের কারণে। গণিত খুব একটা না বুঝলেও এটা তো বোঝো তুমি? মেশিনটার অস্তিত্ব আছে, সেটাই প্রমাণ করছে, গবেষণার সময় আমি যেসব গাণিতিক সমীকরণ নিয়ে কাজ করেছি, তা নির্ভুল। তাই না? তুমি কিন্তু দেখেছ, গত সপ্তাহে আমি কয়েকটা খরগোশ ভবিষ্যতে পাঠিয়েছিলাম। গতকাল সেগুলো খুঁজে পেয়েছি, যেন শূন্য থেকে উদয় হয়েছে। আবার একটা খরগোশ খুঁজে পাওয়ার এক সপ্তাহ পর সেটাকে অতীতে পাঠাতেও দেখেছ। ওগুলো কিন্তু বহাল তবিয়তে ছিল।’

‘হ্যাঁ, মানছি তোমার কথা।’

‘তাহলে নিশ্চয় এটাও মানবে, যে সমীকরণের ওপর ভিত্তি করে আমি মেশিনটা বানিয়েছি, সেটা প্রমাণ করছে, সময় কিছু সুবিন্যস্ত অপরিবর্তনশীল কণার মাধ্যমে তৈরি। যদি এই কণাগুলোর বিন্যাসে কোনো পরিবর্তন আসে, তাহলে আমার সমীকরণগুলো ভুল প্রমাণিত হবে এবং এ মেশিন কাজ করবে না। এ ধরনের পরিভ্রমণ আর সম্ভব হবে না তখন।’

আবারও চোখ কচলায় পয়েন্টডেক্সটার। ভাবছে সে। ‘গণিতের ব্যাপারে আমার আরেকটু ধারণা থাকলে

ভালো হতো।’

ব্যারন বলে, ‘যে সত্যগুলো তোমার সামনে আছে, সেগুলো একটু তলিয়ে দেখো না ভাই! তুমি একটা খরগোশ দুই সপ্তাহ আগে পাঠাতে চেয়েছিলে, কিন্তু সেটা মাত্র এক সপ্তাহ অতীতে যায়। সে ক্ষেত্রে একটা প্যারাডক্স তৈরি হতো, তাই না? কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল? ইন্ডিকেটর এক সপ্তাহের কাছে গিয়ে আটকে যায়, কিছুতেই নড়ছিল না। অর্থাৎ চাইলেও প্যারাডক্স তৈরি করা যাবে না। এবার আসবে তো আমার সঙ্গে?’

সম্মতির অতল গহ্বরের প্রান্তে দাঁড়িয়েও শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসল পয়েন্টডেক্সটার। ‘না,’ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে সে।

আরও পড়ুন
‘এটাই বলছিলাম,’ বিড়বিড় করে বলে পয়েন্টডেক্সটার। ‘হুব্রিস। ঔদ্ধত্য। আমি আসলে বুঝতে পারছি না, এ রকম একটা কাজের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখার ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে কি না। কে জানে কোথায় আটকে যাব।’

‘কাজটা যদি আমার পক্ষে একা করা সম্ভব হতো, তাহলে কখনোই তোমাকে বলতাম না। কিন্তু তুমি ভালো করে জানো, মেশিনটা এক মাস ধরে পরিচালনা করার জন্য দুজন মানুষের দরকার। স্ট্যান্ডার্ডগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য কাউকে লাগবে আমার, যাতে একদম ঠিক সময়ে ফিরে আসতে পারি। তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইছি আমি। কারণ, আমার মতে, এ মেশিনের ঠিকঠাক কাজ করার কৃতিত্ব আমার এবং তোমার সমান সমান। এখন তুমি কি তৃতীয় কাউকে জড়াতে চাও এসবের সঙ্গে? যেখানে আমরা দুজন হতে পারি পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম দুই সময় পরিভ্রমণকারী। আজ থেকে ১০০ বছর বা হাজার বছর পর কী হবে, তা জানতে পারব আমরা। কিংবা চাইলে দেখা করে আসতে পারব নেপোলিয়নের সঙ্গে! আমাদের ক্ষ-ক্ষমতা হবে...’ ব্যারনের উচ্ছ্বাস। ‘ঐশ্বরিক।’

‘এটাই বলছিলাম,’ বিড়বিড় করে বলে পয়েন্টডেক্সটার। ‘হুব্রিস। ঔদ্ধত্য। আমি আসলে বুঝতে পারছি না, এ রকম একটা কাজের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখার ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে কি না। কে জানে কোথায় আটকে যাব।’

‘হুব্রিস। আটকে যাওয়া। খালি ভয় দেখাচ্ছ তুমি। আমরা কেবল একটা লিফট যে রকম বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন তলার মধ্যে ওঠানামা করে, সে রকম সময়ের কণিকার মধ্যে বিচরণ করব। আর লিফটে চড়ার চেয়ে সময় পরিভ্রমণ বেশি নিরাপদ। লিফটের তার যেকোনো সময় ছিঁড়ে যেতে পারে, কিন্তু টাইম মেশিনের সঙ্গে অভিকর্ষের কোনো সম্পর্ক নেই, তাই ভূপতিত হওয়ারও কোনো আশঙ্কা নেই। কোনো সমস্যা হবে না। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি তোমাকে,’ ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে বুকে টোকা দিয়ে বলে ব্যারন। ‘একদম গ্যারান্টি!’

‘হুব্রিস,’ বিড়বিড় করে বলে পয়েন্টডেক্সটার, কিন্তু এবার সম্মতির অতল গহ্বরে লাফ দেয় সে।

একসঙ্গে ভেতরে পা রাখে দুজন।

গণিতবিদ না হওয়ার দরুন মেশিনটির কন্ট্রোল প্যানেলের বিভিন্ন বাটনের কাজ ব্যারনের মতো এত ভালো বোঝে না, তবে জানে, কখন কোনটা চাপতে হবে।

প্রপালশনের ওখানটায় বসেছে ব্যারন। তার সাহায্যে সময়ের মাত্রায় নির্দিষ্ট অক্ষ বরাবর সামনে এগোয় টাইম মেশিন। পয়েন্টডেক্সটার স্ট্যান্ডার্ড বাটনগুলোর সামনে বসে তাদের যাত্রা শুরুর মাত্রাগুলোর দিকে নজর রাখছে, যাতে যেকোনো সময় একদম শুরুর বিন্দুতে পৌঁছে যেতে পারে।

টাইম মেশিন চালু হওয়ামাত্র দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেতে শুরু করল পয়েন্টডেক্সটারের। লিফট ওঠানামা করার সময় পেটে যেমন গুড়গুড় করে, অনেকটা সে রকম। তুলনামূলক সূক্ষ্ম। তবে অত্যন্ত বাস্তব। ‘যদি...’ বলতে শুরু করল সে।

‘কোনো গড়বড় হবে না। প্লিজ! চুপ করে বসো!’ খেঁকিয়ে উঠল ব্যারন। ঠিক সেই মুহূর্তে ভয়ানকভাবে ঝাঁকি খেল গোটা মেশিন, দেয়ালে মুখ থুবড়ে পড়ল পয়েন্টডেক্সটার।

‘একি!’ ব্যারন বলে।

আরও পড়ুন
কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে ফিরে গেল ব্যারন। নড়ছে না কিছুই। কাজও করছে না। দরজাও বন্ধ হচ্ছে না। সবকিছু শূন্য!

‘কী হয়েছে?’ ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইল পয়েন্টডেক্সটার।

‘জানি না, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। ২২ ঘণ্টা ভবিষ্যতে অবস্থান করছি আমরা এখন। চলো, বের হয়ে দেখি।’

টাইম মেশিনের স্লাইডিং দরজা সরে গেল এক পাশে। বাইরে বেরিয়ে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় পয়েন্টডেক্সটারের। ‘কিছুই নেই এখানে!’

কিচ্ছু নেই। একদম না। কোনো আলো নেই। ফাঁকা! ব্ল্যাঙ্ক! শূন্য!

চিৎকার করে উঠল পয়েন্টডেক্সটার। ‘পৃথিবী যে ঘুরছে, সেটা আমলে নিইনি আমরা। এতক্ষণে মহাশূন্যজুড়ে সূর্যের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে কয়েক হাজার মাইল পাড়ি

দিয়েছে পৃথিবী।’

‘না,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলে ব্যারন। ‘সেটা ভুলিনি আমি। মেশিনটা এমনভাবে তৈরি যে যেখানেই যাক না কেন, পৃথিবীর সময়রেখা অনুসরণ করবে। তা ছাড়া পৃথিবী যদি সরে গিয়ে থাকে, তাহলে সূর্য কোথায়? তা-রা কোথায়?’

কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে ফিরে গেল ব্যারন। নড়ছে না কিছুই। কাজও করছে না। দরজাও বন্ধ হচ্ছে না। সবকিছু শূন্য!

হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলো পয়েন্টডেক্সটারের। নড়তে কষ্ট হচ্ছে। অনেক কষ্টে বলল, ‘তাহলে কী সমস্যা?’

ধীরপায়ে টাইম মেশিনের কেন্দ্রে গিয়ে দাঁড়াল ব্যারন। ‘সময় কণা। আমার ধারণা…আমরা দুটো…কণার বিন্যাসের…মধ্যে আটকে গেছি।’

হাত মুষ্টিবদ্ধ করতে গিয়েও পারল না পয়েন্টডেক্সটার। ‘বুঝছি না।’

‘অনেকটা লিফটের মতো। লিফটের মতো।’ আর কিছু উচ্চারণ করতে পারল না সে। ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না। ‘লিফট যে রকম…দুই ফ্লোরের মধ্যে আটকে যায়।’

পয়েন্টডেক্সটার তার ঠোঁটও নাড়াতে পারছে না এখন। শ্বাস নিতে পারছে না। নড়তে পারছে না। তবে ধীরে হলেও চিন্তা করতে পারছে। সময় বলে যখন কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকে না, তখন কিছুই ঘটতে পারে না। সব গতি থেমে যায়, লুপ্ত হয় চেতনা, সমাপ্তি ঘটে সবকিছুর। গাড়ি হঠাৎ থমকে গেলে যেমন জড়তার কারণে সামনে এগিয়ে যায় সবকিছু, ঠিক তেমনি নিজেদের ভেতরকার জড়তার কারণে এই কয় মিনিট তুলনামূলক স্বাভাবিকভাবে ঘটেছে সবকিছু।

মেশিনের ভেতরের বাতিটি আবছা হতে হতে নিভে গেল একসময়। সব অনুভূতি ভোঁতা হয়ে আসছে তাদের। সংজ্ঞা হারাবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে।

হুব্রিস, আত! ঔদ্ধত্য, পতন! শেষ চিন্তা খেলে গেল পয়েন্টডেক্সটারের মস্তিষ্কে।

এরপর অপমৃত্যু ঘটল চিন্তাশক্তির।

এখন কেবল নিশ্চলতা। এমন একটা জায়গায় আটকা পড়ল তারা, যেখানে অনন্ত-অসীমও অর্থহীন।

এখানে এখন সবকিছু শূন্য!

ব্ল্যাঙ্ক।

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন