ক্যানিয়ন দে শেই
গিরিখাতে ঢোকামাত্র মনে হলো সূর্যটা পশ্চিমে আরও হেলে গেল। শেষ হেমন্তের সময় কটনউডগাছগুলোর পাতা আরও একটু হলদে হয়ে এল। আমার নাভাহো গাইড পেরি বিগে বলল, ‘এই ক্যানিয়নে আমরা পাঁচ হাজার বছর ধরে বাস করছি। এই জায়গা পৃথিবীর মধ্যে স্পেশাল।’
পেরির কথায় মানসপটে ভেসে উঠল এই দৃশ্য—গিরিখাতের ওপরে, মালভূমির কিনারে পেরির পূর্বপুরুষেরা—আনাসাজি আদিবাসীরা—বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘কাল তারা অতিদূর আকাশের সীমানার কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে/ করে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন—’
গিরিখাতের ওপর তখনো সূর্যটা মৃদু হয় জ্বলছিল। দুই পাশে লাল বেলেপাথরের দেয়াল, হাজার ফুটের ওপর উঠে গেছে। কোটি কোটি বছরের পাললিক শিলা ধীরে ধীরে বৃষ্টির জলধারায়, ছোট স্রোতস্বিনীর আঘাতে ক্ষয়িত হয়েছে, উন্মোচিত হয়েছে তার স্তরীভূত আস্তরণ। দু-একটি গোলাকার ঘর চোখে পড়ল, তাদের পাশে ছোট ক্ষেত। কিন্তু এ ছাড়া পুরো ক্যানিয়নই শূন্য বলা যায়। আমাদের জিপগাড়ির দীর্ঘ চলন্ত ছায়া পড়ছিল রক্তিম পাথরের খাড়াই পর্বতগাত্রে। অ্যারিজোনা স্টেটের মধ্যে এটি নাভাহো অঞ্চল, ভাড়া করতে হবে নাভাহো গাইড আর তার ফোর–হুইল ড্রাইভ গাড়ি, যা কিনা গিরিখাতের নিচের সমতলের উঁচু-নিচু এবড়োখেবড়ো পথে চলতে পারে।
পেরি বলল, ‘দেড় শ বছর আগে কিট কারসনের ইউনিয়ন আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ না করে এখানে নাভাহোরা আশ্রয় নিয়েছিল। পরে কারসন তাদের বন্দী করে চার শ মাইল দূরে ফোর্ট সামনারে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়।’
বললাম, ‘আমি জানি। এ মুহূর্তে আমি ফোর্ট সামনার থেকে আসছি।’
পেরি আশ্চর্য হয়, ‘ফোর্ট সামনার? ওখানে কী করছিলেন আপনি?’
সোনালি পাতার অ্যাসপেন আর সিকামোরগাছের ঝোপের মাঝখান দিয়ে কিছু বুনো ঘোড়া ছুটে গেল। পেরি একটা জায়গায় গাড়ি থামাল। আঙুল তুলে কিছুটা ওপরে, গিরিখাতের দেয়ালে একটা বড় কুলঙ্গির মতো গুহায়
বললাম, ‘আমি জ্যোতির্বিদ, মহাকাশ থেকে আসা গামা রশ্মি নিয়ে গবেষণা করি। আমাদের গামা দুরবিন একটা বিশাল হিলিয়াম বেলুনের নিচে বেঁধে বায়ুমণ্ডলের একেবারে ওপরে প্রায় ৪০ কিলোমিটার ওপরে ওড়াতে হয়। ফোর্ট সামনার এমন একটা জায়গা, যেখানে নাসার বেলুন টিম এসে বিভিন্ন গবেষক দলকে তাদের দুরবিন আকাশে ওড়াতে সাহায্য করে।’
পেরি কী বুঝল জানি না, আমি আরও বললাম, ‘ওখানে গিয়েই জানতে পারি, ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত ফোর্ট সামনারে নাভাহো ও আপাচে জাতির কিছু মানুষকে আটক করে রাখা হয়। সেখানে একটি স্মৃতি পার্কও রয়েছে এ বিষয়ে। তখনই জানলাম, তারা ক্যানিয়ন দে শেই গিরিখাতে আত্মসমর্পণ করেছিল। আপনি কি গেছেন ফোর্ট সামনারে?’ পেরি মাথা ঝাঁকায়, বলে, ‘এ রকম দুঃসহ স্মৃতির জায়গায় যেতে চাই না।’
সোনালি পাতার অ্যাসপেন আর সিকামোরগাছের ঝোপের মাঝখান দিয়ে কিছু বুনো ঘোড়া ছুটে গেল। পেরি একটা জায়গায় গাড়ি থামাল। আঙুল তুলে কিছুটা ওপরে, গিরিখাতের দেয়ালে একটা বড় কুলঙ্গির মতো গুহায় একটা পাথরের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখাল। বলল, ‘আমরা এই জায়গাকে বলি “ৎসেয়া”—পর্বতগাত্রে প্রাচীন পবিত্র স্থান। নাভাহোরা এমনভাবে পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে ছিল যে কারসন তাদের খুঁজেই পাচ্ছিল না। পরে এক উন্মাদ নাভাহো নারী এক গুহার বাইরে এসে চিৎকার করতে থাকে, তখনই কেবল ইউনিয়ন আর্মি লুকানো নাভাহোদের খুঁজে পায়। অনেকে মনে করে, এই ৎসেয়া থেকেই সেই নারী বের হয়ে এসেছিল। কিট কারসন সব নাভাহোকে ধরতে পারলেও সেই নারীকে ধরতে পারেনি। তার শেষ পর্যন্ত কী হয়, কেউ জানে না, তাকে আর কেউ দেখেনি। আমরা সেই নারীর নাম দিয়েছি “আস-জাঁ দো নিঝো-নি-লেৎসা দা”। এর মানে হলো আস-জাঁ বা নারীকে দেখা যায় না।’
গিরিখাতের পড়ন্ত বিকেলের সুনসান নীরবতার মধ্যে কাঠঠোকরার আওয়াজ পাওয়া যায়। একটা হাওয়া পশ্চিম থেকে অ্যাসপেন, বার্চ আর সিকামোরের পাতাদের দুলিয়ে যায়—শিরশির শিরশির শব্দ হয় তাতে। একটু থেমে পেরি যোগ করে, ‘অনেক সময় ক্যানিয়ন থেকে বের হতে হতে আমার রাত হয়ে যায়। যদি চাঁদের আলো থাকে, মনে হয়, সেই নারীকে যেন আমি ওখানে ক্ষণিকের জন্য দেখতে পাই। সাদা রঙের স্কার্ট। এই গিরিখাতে যত সময় থাকবেন, তত আপনি এর সঙ্গে মিশে যেতে থাকবেন। কায়োটি হবেন অথবা হরিণ কিংবা নীল সোয়ালো পাখি অথবা আস-জাঁ।’
গা অল্প শিরশির করে ওঠে, তবু কাছ থেকে ‘ৎসেয়া’টা দেখার খুব কৌতূহল হচ্ছিল, পেরি যেন আমার ইচ্ছাটা ধরতে পেরে বলল, ‘ওপরে উঠতে চাইছেন?’ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে যোগ করল, ‘আপনি একাই যান, আমার এখন আর পাহাড়ে ওঠানামা সয় না। কিন্তু ৪০ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসবেন। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে গিরিখাত অন্ধকার হয়ে যায়।’
পা বাড়ানোর আগে পেরি বলল, ‘এই জিনিস সঙ্গে রাখুন।’ দেখলাম, একটা সবুজ ছোট চাকতি, ম্যালাকাইট হবে। বিনা বাক্য ব্যয়ে চাকতিটা নিয়ে পকেটে রাখলাম। কী কারণে পেরি সেটা দিল, জিজ্ঞেস করলাম না।
আকাশে সূর্য ছিল না, কিন্তু আকাশটা উজ্জ্বল ছিল, নীল রঙে নয়, গোলাপি একটা আভায়। ভাবলাম, আমিই আমার বাস্তবতা তৈরি করি।
আমার ছোট ব্যাকপ্যাকটা পিঠে নিয়ে রওনা হলাম। ঝরা পাতা পেরিয়ে ওপরে ওঠার একটা সরু পথ খুঁজে পেলাম। সমতল ছেড়ে ওপরে উঠতে থাকল পথটা, ওপর থেকে নিচটা সুন্দর লাগছিল। গাছের হলদে লাল মাথাগুলো সমতলে রঙিন কার্পেট বিছিয়ে রেখেছিল। পাথরের ভিটাটা পর্যন্ত পৌঁছাতে মিনিট পনেরো সময় লাগল।
খোলা গুহাটাতে ঢুকতে স্যাঁতসেঁতে ভাব পেলাম। হঠাৎ যেন সবকিছু ঠান্ডা হয়ে এল। ভাঙা বাড়িটির ছাদ নেই, পাথরের ওপর পাথর বসিয়ে দেয়াল বানানো। তাতে হাত রাখলাম, ভীষণ ঠান্ডা, মুহূর্তে হাত জমে গেল। আশ্চর্য হয়ে হাতটা দেখলাম, এমন যেন পরিত্যক্ত ভিটাটি আরেকটি আবহাওয়ায় অবস্থান করছে। ব্যাকপ্যাক থেকে জ্যাকেটটা বের করে পরে নিলাম। ধ্বংসাবশেষের পেছনে বেশ কিছুটা খোলা জায়গা। সেখানে দেয়ালের মধ্যেই একটা ছোট দরজার মতো খোলা প্রবেশপথ। এখানে কি এটা থাকার কথা? ব্যাকপ্যাক থেকে টর্চ বের করে জ্বালিয়ে ওই খোলা জায়গা দিয়ে ঢুকলাম। সুড়ঙ্গের মতো। কিছুক্ষণ চলার পর পথটা উন্মুক্ত হয়ে গেল। গুহার ছাদটা অনেক ওপরে উঠে গেল, নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা বড় অ্যাম্ফিথিয়েটারে। না, এ রকম জিনিস এখানে থাকার কথা নয়, থাকলে সবাই জানতাম। শুধু আমার জন্য কি পথটা খোলা হয়েছে? এ রকম মহাজাগতিক যোগাযোগের ক্ষমতা কি আমার আছে? সেই বিশাল হলঘরের শেষে একটা দরজা, তাতে সাধারণ একটা পিতলের গোলাকার নব। নবটায় হাত দিয়ে ঘোরালাম, দরজা খুলে গেল। একটা পাহাড়ি তৃণভূমি, সেখানে ছোট্ট একটা কাঠের কুটির, সামনে একটা উপলব্যথিত স্রোতস্বিনী। অ্যারিজোনার ক্যানিয়ন দে শেইয়ের বাইরে এ কোন জগৎ? এখানে কি আস-জাঁর থাকার কথা?
আকাশে সূর্য ছিল না, কিন্তু আকাশটা উজ্জ্বল ছিল, নীল রঙে নয়, গোলাপি একটা আভায়। ভাবলাম, আমিই আমার বাস্তবতা তৈরি করি। এটা একটা স্বপ্ন ছাড়া আর কী হতে পারে? কুটিরটা ছাড়িয়ে জলের দিকে এগোলাম, দূরে পাহাড়ের রেখা দেখা যায়। একটা ছোট ঝোপের পাশে পাথরের ওপরে সে বসে ছিল, দূর থেকে দেখতে পাইনি। একটা সাদা ফ্রক, মুখাবয়ব একজন নাভাহো নারীর মতোই। আমাকে দেখে সে আশ্চর্য হলো না, যেন আমারই অপেক্ষা করছিল। আমাকে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করল একটা পাথরে বসতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম (ইংরেজিতে), ‘আপনি কি নাভাহো?’ সে এমনভাবে তাকাল যেন আমার ভাষা বুঝতে পারেনি। তারপর হয়তো কিছুটা বুঝল, বলল, ‘আউ, শি এই নাবিহো আস-জাঁ ইনিশে।’ নাবিহো বুঝলাম, অর্থাৎ নাভাহো, আস-জাঁ কথাটাও বুঝলাম। তাহলে এটা ঠিক যে এই নারী নাভাহো। দেড় শ বছর আগে এই নারীকে ক্যানিয়নে দেখা গিয়েছিল? সে নাভাহো ভাষায় আরও কিছু বলল; বুঝতে পারল—আমার কিছু বোধগম্য হচ্ছে না। এরপর পাশে পড়ে থাকা একটা গাছের ডাল নিয়ে মাটিতে ছবি আঁকা শুরু করল।
প্রথমে বুঝলাম, সে আঁকছে ক্যানিয়ন দে শেই। তারপর গিরিখাতের গায়ে সেই ভিটার ধ্বংসাবশেষ; তারপর সেই সুড়ঙ্গ, যা দিয়ে আমি এখানে এসেছি, তার কুটির, এই স্রোতস্বিনী। স্রোতস্বিনী পার হয়ে একটি পাহাড়ের শ্রেণি, সেটির পর বহু তিন কোনা গঠন। এগুলো কি বাড়ি?
হঠাৎ আকাশটা অন্ধকার হতে শুরু করে। এতক্ষণ আলো তাহলে কোথা থেকে আসছিল? কিন্তু আস-জাঁ কেমন যেন বিচলিত হয়ে উঠল। ওর জায়গা থেকে উঠে আমাকে হাত ধরে সুড়ঙ্গের কাছে নিয়ে গেল। তারপর কিছু বোঝার আগেই আমাকে ঠেলা দিয়ে সুড়ঙ্গের অন্ধকারে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বিমূঢ়। দরজাটার পিতলের নব ঘুরিয়ে এবার দরজাটা খুলতে পারলাম না। ফিরে আসি আবার সেই ভিটায়, বাইরে রোদ ঝলমল করছে, যেখানে অন্ধকার থাকার কথা। সূর্য দেখলাম পূর্ব দিকে। একটা পুরো রাত কি পার হয়ে গেছে? নিচে পেরি বিগে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বললাম, ‘আমি মাত্র ঘণ্টাখাকের জন্য গিয়েছিলাম, এর মধ্যে রাত পেরিয়ে গেল। তুমি নিশ্চয় আমার জন্য চিন্তা করছিলে?’
পেরি বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?’
আমি বললাম, ‘তুমি জানতে সবকিছু, তোমার সঙ্গে কি সেই নারীর দেখা হয়েছে?’
পেরি বলে, ‘হ্যাঁ, আমার সঙ্গে তার একবারই দেখা হয়েছে। সেবার আমি দুই দিন পর ফিরে আসি, অথচ আমার মনে হয়েছিল, এক ঘণ্টাও কাটেনি। আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে হলো আপনি এ রহস্যের সমাধান দিতে পারবেন।’
আমি মাথা নাড়লাম, ‘না, আমার কাছে সমাধান নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি, সেই নারী উন্মাদ নয়।’
‘না, সে উন্মাদ নয়,’ সায় দেয় পেরি।
এক সপ্তাহ পর ফোর্ট সামনার থেকে আমাদের বেলুন উড়ল। আমরা ছয় হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত কর্কট পালসারের নীহারিকা থেকে আসা গামা রশ্মি পর্যবেক্ষণ করলাম।
ম্যালাকাইটের চাকতিটা পেরিকে ফেরত দেওয়ার আগে সেটা ভালো করে দেখলাম। সবুজে-কালো সমান্তরাল রেখাগুলো ঢেউ খেলে গেছে। পেরি বলল, ‘এই চাকতি আমি ৎসেয়াতে খুঁজে পাই।’ চাকতির সেই অপরূপ ঢেউগুলোর মধ্যে তথ্য সংগৃহীত আছে। পেরি আর আমার জন্য এই চাকতি আরেকটি জগতের পথ উন্মোচিত করেছে। এই চাকতি কি সেই ত্রিকোণ বাড়িগুলোর প্রাণীরা রেখে গিয়েছিল?
ক্লান্ত হয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে কাজে ফিরতে হলো ফোর্ট সামনারে। ফিরতে ফিরতেই সেই আস-জাঁ নারীর স্মৃতি ক্ষয় হতে থাকল। আদৌ কি আমি অন্য কোনো জগতে গিয়েছিলাম? তবু ফিরে কাগজ–কলম নিয়ে বসলাম।
দেড় শ বছর পার হয়ে গেছে। অথচ সেই আস-জাঁ নারীর বয়স বিশ-পঁচিশ বছরের বেশি বাড়েনি। সেটা সম্ভব, যদি সে একটা বিশাল কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের ঠিক বাইরে কোনো গ্রহে বাস করে। সেই গ্রহ গহ্বরকে প্রদক্ষিণ করবে, গ্রহের অধিবাসীরা গহ্বরের প্রচণ্ড মহাকর্ষ শারীরিকভাবে বুঝতে পারবে না। কারণ, তারা একধরনের মুক্ত পতনের মধ্যে থাকবে, কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুযায়ী তাদের সময় শ্লথ হবে। আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটা ৪০ লাখ সৌরভরের ব্ল্যাকহোল আছে। আমার হিসাবে, একটা ৪০ লাখ সৌরভরের ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের ব্যাসার্ধ হবে ১২ মিলিয়ন কিলোমিটারের মতো, অর্থাৎ সূর্য থেকে বুধ গ্রহের কক্ষপথের দূরত্ব থেকেও কম। ওই রকম দূরত্বে বসবাস করা অসম্ভব বলতে হবে। কারণ, কৃষ্ণগহ্বরে আপতিত বস্তুরা যে পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করবে, তাতে সবকিছু ভস্মীভূত হওয়ার কথা। হয়তো সেই ব্ল্যাকহোল এখন শান্ত আছে। সেখানে কোনো কিছু আপতিত হচ্ছে না, হয়তো সেখানকার অধিবাসীরা নতুন বাসস্থান খুঁজছে। হয়তো তারা সৃষ্টি করতে পেরেছে, যাকে আমরা বলি ‘আইনস্টাইন-রোজেন সেতু’, যা কিনা বহুদূরের দুটি স্থানের মধ্যে একটা শর্টকাট। হয়তো…
এক সপ্তাহ পর ফোর্ট সামনার থেকে আমাদের বেলুন উড়ল। আমরা ছয় হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত কর্কট পালসারের নীহারিকা থেকে আসা গামা রশ্মি পর্যবেক্ষণ করলাম। এই এক সপ্তাহে আমার প্রতীতি হলো যে ক্যানিয়ন দে শেইতে আমার অভিজ্ঞতা অলীকমাত্র। তবু কাজ শেষে ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে যাওয়ার পথে গাড়ি ঘোরালাম ক্যানিয়নের উদ্দেশে। পথের দুই পাশে ছিল ভূতাত্ত্বিকদের স্বর্গ—কোটি কোটি বছরের টেকটনিক সঞ্চালন, ভূমি উত্থান, অগ্ন্যুৎপাতের অবশেষ, স্তরীভূত আগ্নেয়শিলা, কালো লাভা, ধারালো গিরিখাত। ডান পাশে দূরে দেখলাম ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি মাউন্ট টেইলারের ছায়া-পরিলেখ। মাউন্ট টেইলার—নাভাহো জাতির দক্ষিণ সীমানার পবিত্র পাহাড়। তারা এটাকে বলে ‘ৎসজেশ’—উচ্চারণ করার চেষ্টা করলাম কয়েকবার। ক্যানিয়ন দে শেই পৌঁছে বাইরের অফিসে গিয়ে খোঁজ করলাম পেরি বিগের। পেরির খোঁজ করছি দেখে একটি তরুণ নাভাহো ছেলে ডেস্কের পেছন থেকে বেরিয়ে এল। বলল, ‘পেরিকে এক সপ্তাহ হলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
তাকে বললাম, ‘তোমরা কি ৎসেয়াতে খোঁজ করেছ?’
সে আশ্চর্য হলো। বলল, ‘ৎসেয়াতে ওঠা বারণ, এমনকি নাভাহো গাইডদেরও। কেউ সেখানে অনুমতি ছাড়া গেলে জরিমানা দিতে হয়।’
বুঝলাম ৎসেয়াতে আমাকে ঢুকতে দেবে না। এরপর আমার আর বিশেষ কিছু করার ছিল না। ক্যালিফোর্নিয়ার পথ ধরলাম। পেরিয়ে গেলাম ফ্ল্যাগস্টাফ শহরের পাশে
বললাম, ‘পেরি আমাকে বলেছে যে সে ৎসেয়ার পেছনে একটা পথ খুঁজে পেয়েছে, তা নাকি তাকে অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে সে একজন নাভাহো নারীর সাক্ষাৎ পায়, যে নারীকে নাকি কিট কারসনের সময় দেখা গিয়েছিল।’
তরুণটির মুখাবয়ব আমার কথায় গম্ভীর হয়ে ওঠে। বলে, ‘আমাদের লোকেরা বলাবলি করছে, পেরি তৃতীয় জগতে ফিরে গেছে। নাভাহো সৃষ্টিতত্ত্বের পুরাণ বলে, আমাদের এই বিশ্ব হলো ৪ নম্বর। এর আগের তিনটে ঠিকমতো কাজ করেনি।’ নাভাহোরা খুব সহজেই বিভিন্ন জগতের কথা বলতে পারে। একটু থেমে যোগ করে, ‘ওই নারী উন্মাদ ছিল।’ এরপর ছেলেটি কাঁধ ঝাঁকায়, এসব নিয়ে সে বেশি ভাবতে চায় না।
অস্ফুট স্বরে বললাম, ‘ওই নারী হয়তো উন্মাদ ছিল না। সেই নারী এসেছিল নাভাহোদের সতর্ক করতে। হয়তো কিট কারসনের চেয়ে আরও ভয়াবহ শত্রুদের হাত থেকে বাঁচাতে।’
ছেলেটি বলল, ‘কিছু বলছেন?’
মাথা নাড়ালাম, ‘না।’
বুঝলাম ৎসেয়াতে আমাকে ঢুকতে দেবে না। এরপর আমার আর বিশেষ কিছু করার ছিল না। ক্যালিফোর্নিয়ার পথ ধরলাম। পেরিয়ে গেলাম ফ্ল্যাগস্টাফ শহরের পাশে, নাভাহো জাতির প্রাচীন পশ্চিম সীমানা, যাকে তারা বলত ‘ডুকুস্লিদ’ পাহাড়, এখন সবাই যাকে ‘সান ফ্রান্সিসকো চূড়া’ নামে চেনে। সেই চূড়ায় তুষার জমে ছিল, মাথায় একটা মেঘের মুকুট, যেটাকে মনে হচ্ছিল একটা ইউএফও। ভাবলাম ভালোই হলো, আস-জাঁকে সঙ্গ দিতে পারবে পেরি বিগে। হয়তো দুজনে মিলে সেই সুদূর কৃষ্ণগহ্বরের ত্রিকোণ বাড়ির সভ্যতা থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারবে। হয়তো পরেরবার ক্যানিয়ন দে শেইতে আমার সঙ্গে পেরির আবার দেখা হবে।
