মিস্টার ক্যাপারম্যানের বার
আমি খুঁজছিলাম সেই হোটেল, যেখানে ববি কেনেডি গুলিবিদ্ধ হন। ওই বছর খুব গরম পড়েছিল, গ্রীষ্মের হলকা হাওয়ায় উঁচু পামগাছের পাতাগুলো ঝলসে ফ্যাকাশে বাদামি হয়ে গিয়েছিল, লস অ্যাঞ্জেলেস উপত্যকার ওপর গাড়ির ধোঁয়ার হালকা স্তর প্রায় সময় ঢেকে রাখত উত্তরের পাহাড়ের ঢালগুলোর শুষ্ক হলদে রং। কেউ আমাকে বলেছিল পারসিং স্কয়ারের পাশে কোনো এক হোটেলে ববি কেনেডি নিহত হয়েছিলেন। এক ছুটির দিনে পারসিং স্কয়ার খুঁজে পেলাম।
শহরের প্রায় কেন্দ্রে পারসিং স্কয়ার। খুব ছোট একটা পার্ক। তার মধ্যে শুধু অল্প একটু জায়গায় ঘাস বোনা, বাকিটা চৌকো টালি দিয়ে বাঁধানো। এক পাশে একটা ফোয়ারা। কিছু বেঞ্চ। ফোয়ারার পাশে বেঞ্চে কিছুক্ষণ বসেছিলাম ঠান্ডা জলের ছিটা পাওয়ার আশায়। তারপর হেঁটে পার্কের উত্তর-পশ্চিম কোনায় পৌঁছে দেখলাম, রাস্তার ওপারে হোটেল বিল্টমোর। তার সম্মুখভাগ ইউরোপীয় রেনেসাঁ স্থাপত্যের আদলে তৈরি।
রাস্তা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকব কি না, তা নিয়ে ইতস্তত করছিলাম। এ হোটেলে ভাড়া থাকছি না, ঢুকতে দেবে কি? সাহস করে ঢুকলাম, কেউ বাধা দিল না।
প্রথমে বড় হলঘর, মর্মর ফোয়ারা, ব্রোঞ্জের সিঁড়ি, ট্রাভেরটাইন আর ওক কাঠের দেয়াল, সূক্ষ্ম সূচির পর্দা। হোটেলের কর্মচারীরা কাজে ব্যস্ত। তাদের ববি কেনেডিকে নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ হলো না। একটা করিডর পার হয়ে দেখলাম বার। বার টেবিলটার সামনে লাল চামড়া দিয়ে মোড়া সারি দিয়ে কয়েকটা উঁচু চেয়ার সাজানো, টেবিলের পেছনে কয়েকটি তাকে আলোকিত রংবেরঙের তরলের বোতল, ওপরে স্ফটিক ঝাড়বাতি। বড় ঘরটির অন্যদিকে শৌখিন সোফা, তারপর গ্র্যান্ড পিয়ানো, তার পেছনে ইতালীয় রেনেসাঁ ফ্রেমে বাঁধানো বড় উপবৃত্তাকার আয়না।
দূরের একটি সোফায় বসে দুই তরুণ-তরুণী খুব নিচু স্বরে কথা বলছিল। এ ছাড়া বার ঘরটিতে আর কেউ ছিল না। মূল বার টেবিলের পেছনে একজন মধ্যবয়সী পুরুষ মাথা নিচু করে গ্লাস পরিষ্কার করছিল। সাহস করে তার সামনে গিয়ে লাল চামড়া মোড়া উঁচু চেয়ারে বসলাম। লোকটি মাথা তুলে আমাকে সম্ভাষণ করল। জিজ্ঞেস করল, আমার কী চাই। বারে বসে ককটেল অর্ডার করায় অভ্যস্ত নই। কিছুটা কাঁপা গলায় বললাম, ম্যানহাটান। ম্যানহাটান নামে একটা ককটেলের নাম কোথাও পড়েছিলাম, তার মধ্যে যে কী থাকে, সেটা জানতাম না। বারম্যান হেসে বলল, অবশ্যই!
দেখা গেল, হোটেল বিল্টমোরে ববি কেনেডি গুলিবিদ্ধ হননি। ঘটনাটি ঘটেছিল ওখান থেকে মাইল তিনেক দূরে হোটেল অ্যাম্বাসেডরে। কিন্তু হোটেল বিল্টমোর আমাকে কেমন যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণে ধরে রাখল।
আমার আমেরিকা বাসের তখন দুই যুগ পার হতে চলেছে। ছাত্র হয়ে এসেছিলাম অণুজীববিদ্যা পড়ব বলে, কিন্তু নানা তালগোলে, মূলত দেশ থেকে আগত আরেক সহপাঠীর চক্রান্তে—হ্যাঁ, চক্রান্তেই বলব, বিশ্বাসঘাতকতাও বটে, পাঠে ছেদ পড়ে। সে অন্য কাহিনি, লিখে রেখেছি, আপনাদের সময় হলে পড়বেন। পরে ব্যবস্থাপনাবিদ্যায় পড়াশোনা করে ছাত্র-ভিসা বজায় রাখি। এখন একটা গাড়ি বেচার ব্যবসায় হিসাবরক্ষকের কাজ করছি। যে কারণে এ দেশে এসেছিলাম, তা সার্থক হলো না। বাড়িতে নিকটজনদের নিজের ব্যর্থতার কথা না বলে মিথ্যা বলে চললাম—আমি কোনো উচ্চমার্গীয় গবেষণায় নিযুক্ত।
দেখা গেল, হোটেল বিল্টমোরে ববি কেনেডি গুলিবিদ্ধ হননি। ঘটনাটি ঘটেছিল ওখান থেকে মাইল তিনেক দূরে হোটেল অ্যাম্বাসেডরে। কিন্তু হোটেল বিল্টমোর আমাকে কেমন যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণে ধরে রাখল। এরপরে সেখানে সপ্তাহে একবার যেতাম। আমার মতো নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য হোটেলটি নয়। কিন্তু সেটার স্ফটিক ঝাড়বাতি, মর্মর ফোয়ারা, ব্রোঞ্জের সিঁড়ি, ট্রাভেরটাইন আর ওক কাঠের দেয়াল, সূক্ষ্ম সূচির পর্দা আমাকে মোহিত করে রাখত। আমার কোনো নির্দিষ্ট ছুটির দিন ছিল না, কিন্তু যেদিন ছুটি পেতাম, তার আগের সন্ধ্যায় হোটেল বিল্টমোরে আমার হাজিরার অন্যথা হতো না।
সেখানে যাওয়ার আরেকটি কারণ ছিল। আমি যেতাম হোটেলের বারে, যেখানে খুব বিখ্যাত জ্যাজশিল্পীরা বাজাতে আসত। আমি অনেকের নাম জানতাম না, কিন্তু বারের চেয়ারে বসে তন্ময় হয়ে পিয়ানো শুনতাম, আর আমার মিথ্যা জীবন ভুলে যেতাম। হোটেলে ভাড়া না থেকে বাইরে থেকে হুট করে ঢুকে পড়তে সংকোচ হতো, কিন্তু সরাসরি বারে চলে গেলে কেউ সে রকম খেয়াল করত না। প্রথম দিকে স্যুট-টাই পরে যেতাম, এমন যেন আমি হোটেলে থাকছি। পরে বারের ম্যানেজার মিস্টার ক্যাপারম্যানের সঙ্গে খাতির হয়ে গেলে পোশাক নিয়ে অত মাথা ঘামাতাম না।
মিস্টার ক্যাপারম্যানের বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। ওয়াইন, ব্রান্ডি, কনিয়াক ককটেলের হিসাব যেমন জানেন, আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যায়ও তেমন পারদর্শী। বারের এক কোনায় একটা টেবিল ছিল, সেখানে একটা কম্পিউটার রাখা। তবে দূর থেকে বোঝা যেত না। নতুন কোনো সৃজনশীল ভিডিও গেম এলে ক্যাপারম্যান সেটা কম্পিউটারে বসাতেন, অনেকেই সেখানে গিয়ে খেলত।
এ রকম করে বছরখানেক গেল। একদিন ক্যাপারম্যান বললেন, ‘আমাদের প্রযুক্তির লোকেরা এক নতুন ভিডিও গেম বসিয়ে গেছে। একে নাকি এআই বলে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফটওয়্যার।’ ক্যাপারম্যান আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন ঘরের এক কোনায় একটা বুথের দিকে। আগে এই কামরা দেখিনি, খুব বড় নয়। ক্যাপারম্যান বললেন, ‘তোমার তো সাহিত্যে উৎসাহ আছে। এই গেমটায় বিখ্যাত সাহিত্যিক আর আর্টিস্টদের একটা করে ত্রিমাত্রিক সংস্করণ করা হয়েছে, যেগুলো খেলায় অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে। এটা ঠিক গেম নয়, তুমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারো। প্রশ্ন করতে পারো, তারা যতটুকু পারে উত্তর দেবে। তারাও তোমাকে প্রশ্ন করতে পারে, আর তোমার উত্তর থেকে তারা শিখবে।’
সেদিন আর কেউ ছিল না। ক্যাপারম্যান আমাকে বুথটির দিকে যেতে ইঙ্গিত করলেন। ছবি তোলার জন্য এ রকম পর্দাঢাকা বুথ কয়েক বছর আগেও মার্কিন দেশের দোকানগুলোর ‘মলে’ বা মার্কেটে দেখা যেত। বুথটির ভেতরে ঢুকে দেখি স্লট মেশিনের মতো একটা বড় বাক্স। নিচে টাকা ঢোকানোর একটা সরু ফাঁকা জায়গা আর কিছু বোতাম, ওপরে একটা কাচের মতো স্ক্রিন, একজন কি দুজন মানুষ বসতে পারে, এ রকম একটা বেঞ্চ। দরজা বন্ধ করে বসলাম। টাকার জায়গায় একটা ডলারের নোট ঢোকালাম। স্ক্রিনে কিছু নাম উঠল, মূলত কার সঙ্গে কথা বলতে চাই, নাম বেছে নিতে হবে। হেমিংওয়ে, মিশিমা, সিলভিয়া প্লাথ, ভ্যান গগ, কোয়েস্টলার—এ রকম কিছু। ভাবলাম, এ নামগুলোর মধ্যে কিছু যোগসূত্র আছে। কিন্তু সেটা নিয়ে কিছু না ভেবে হেমিংওয়ের নামে চাপ দিলাম। কিছুদিন আগেই ফর হুম দ্য বেল টোলস পড়েছি। স্ক্রিন কালো হয়ে গেল, তারপর লেখা ফুটে উঠল—‘আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এক বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি ও তাঁর স্ত্রী বেঁচে গেছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলতে ওনাকে বিছানা ছেড়ে উঠে আসতে হচ্ছে। একটু সময় লাগবে।’
এখন হেমিংওয়েকে মনে হলো না কোনো কম্পিউটারকৃত ত্রিমাত্রিক মূর্তি, বরং মনে হলো একজন রক্তমাংসের মানুষ। খুব রাগ হলো। বললাম, ‘খালি তৃণভোজীদের খেলেন, সিংহ যদি খেতে পারতেন, তো বুঝতাম।
ভাবলাম বেশ ইন্টারেস্টিং তো। হেমিংওয়ে দু-দুবার বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে। এটা আমাদের এআই বেশ কৌশলে ঢুকিয়েছে। পাঁচ মিনিট পার হলো, কারও দেখা নেই। সাত মিনিটের মাথায় আর ধৈর্য ধরতে না পেরে বুথের দরজা খুলে বের হতে চাইলাম। কিন্তু দেখলাম, দরজা বন্ধ। সেকি? দরজা কী করে বন্ধ হলো? দরজায় আঘাত করে ক্যাপারম্যানকে ডাকতে যাব, এর মধ্যে সামনের স্ক্রিনে হেমিংওয়ে ভেসে উঠল। ত্রিমাত্রিক পাপা আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, সাদা দাড়ি, সাদা চুল। বলল, ‘তোমাকে বসিয়ে রাখতে হলো, আমার জখম এখনো সারেনি ঠিকমতো।’ তার গলাটা যেমন হওয়া উচিত, তেমনই হলো, যদিও আগে কখনো শুনিনি।
কী মনে করে যেন বলে উঠলাম, ‘আপনার প্রাণী মারতে আফ্রিকা যাওয়ার দরকার ছিল কি? আর ওই বিমান দুর্ঘটনায় মরলে দু–একটা নিরীহ জন্তু আপনার হাত থেকে বাঁচতে পারত।’ হয়তো এটি আসল হেমিংওয়ে নয় বলেই কথাগুলো বলতে পারলাম, সফটওয়্যারের হেমিংওয়ের অনুভূতি আঘাত পাবে না।
হো হো করে হেসে ওঠে আর্নেস্ট, বলে, ‘এ রকম প্রাণী হত্যায় আমার কোনো গ্লানি নেই। তারা তো কোনো না কোনো সময় মারাই যেত, তাই না? আমার শিকারবিদ্যা প্রকৃতিতে সে রকম বড় হস্তক্ষেপ নয়। আর তৃণভোজীদের মাংস আমরা খেতাম, চামড়া আর শিং সংগ্রহে রাখতাম, কিছুই নষ্ট হতো না।’
এখন হেমিংওয়েকে মনে হলো না কোনো কম্পিউটারকৃত ত্রিমাত্রিক মূর্তি, বরং মনে হলো একজন রক্তমাংসের মানুষ। খুব রাগ হলো। বললাম, ‘খালি তৃণভোজীদের খেলেন, সিংহ যদি খেতে পারতেন, তো বুঝতাম।’
আবার হো হো করে হাসে সে এবং বলে, ‘আমি যদি কাচের ওপারে যেতে পারতাম তো তোমাকে মুষ্টিযুদ্ধে আহ্বান করতাম।’ বললাম, ‘জানি, বক্সিং আপনার খুব প্রিয় ছিল। বলেছিলেন, আমার সাহিত্য কিছুই না, মুষ্টিযুদ্ধই সব। এসব ফালতু বাগাড়ম্বরের অর্থ কী? যারা তাদের লেখায় বেশি মনোযোগ পায়, তারা এ রকম বাগাড়ম্বর করতে পারে।’
মনে হলো, সে কিছুটা আহত হয়েছে। সিরিয়াস মুখ করে বলল, ‘আমার সম্বন্ধে তুমি বোধ হয় বেশি কিছু জানো না। আমার তথাকথিত সাহিত্যজীবনে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আমি জীবনকে বুঝতে চাই তার প্রতিটি চলন্ত কর্মে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। ষাঁড়ের লড়াই, মাছ ধরা, গন্ডার মারা, মুষ্টিযুদ্ধ, অ্যাবসিন্থ পান, যুদ্ধক্ষেত্র…আর কিছু কি বাকি রেখেছি?’
‘নতুন প্রেমের সন্ধান?’
হো হো করে হাসে সে আবার। এদিকে আমার খুব রাগ হচ্ছিল। মনে হলো হেমিংওয়ের কথাগুলো বাজারে প্রচলিত তার কিছু উক্তি থেকে নেওয়া হয়েছে, এখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোনো ছাপ নেই। তবে তার দেহটা গঠন করতে পেরেছে ভালোমতো। বললাম, ‘এসব করেও আপনার তৃপ্তি হলো না, শেষে আত্মহত্যা করলেন!’
তার মুখাবয়ব অন্ধকার হয়ে গেল। বলল, ‘এসব বাজে কথা বলছ কেন? দেখছই তোমার সঙ্গে আমি কথা বলছি।’
বুঝলাম, আমি ১৯৫৪ সালের হেমিংওয়ের সঙ্গে কথা বলছি। হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন ১৯৬১ সালে। বললাম, ‘বলুন তো, আমরা কোথায় আছি এখন?
‘কোথায় আবার? আফ্রিকায়। কেন? তুমি কি আমাকে প্রশ্ন করে জেনে নিচ্ছ যে আমার মাথা ঠিক আছে কি না?’
আফ্রিকায়? আমি একটু বিভ্রান্ত হলাম। তারপর মনে পড়ল, শিকার করতে এসে হেমিংওয়ে ও তার স্ত্রী বিমান দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর নাইরোবি এসেছিলেন।
বললাম, ‘শেষ রক্ষা মনে হয় করতে পারোনি তুমি। তোমার এক হলিউড বান্ধবীকে বলেছিলে যে তুমি এত জন্তু আর মাছ মারো, যাতে তোমার নিজেকে মারতে না হয়।’
হেমিংওয়ে বলল, ‘জানো তো, তোমরা সাংবাদিকেরা ধরেই রেখেছিলে মেরি আর আমি বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছি। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের এত সহজে মৃত্যু হয় না।’ সেটা ঠিকই, মনে মনে বলি, মৃত্যু শুধু তোমার নিজের হাতেই হবে। বললাম, ‘আমি সাংবাদিক নই।’
‘ওহ,’ সে বলল, ‘কেন জানি মনে হলো তুমি সাংবাদিক। তুমি বলছিলে, আমি আত্মহত্যা করেছি। এই বিমান দুর্ঘটনাকে তো আত্মহত্যা বলা যাবে না। তবে সাংবাদিকেরা অনেক কিছু জানে, যা সাধারণ মানুষ জানে না। মনে হয় তুমি অনেক কিছু জানো। আমি কোনো ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস করি না; তোমার “আত্মহত্যা” কথাটা শুনে অনেক কিছু মনে হলো। অনেক অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও আমি খুব মানসিক বিষণ্নতায় ভুগি। সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। আত্মহত্যার কথা ভাবিনি যে এমন নয়।’
এবার হেসে উঠি আমি। বললাম, ‘আমার এক প্রিয় কবি ছিলেন। আছেনই বলব, কবিরা তো আর মরেন না। জীবনানন্দ দাশ তাঁর নাম। তিনি “বোধ” নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। তার মধ্যে লিখেছিলেন “সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,/ সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়/ শূন্য মনে হয়,/ শূন্য মনে হয়।”’ আর সেই ১৯৫৪ সালেই জীবনানন্দ কলকাতায় ট্রামের নিচে পড়ে মারা গিয়েছিলেন। ভারত ভাগ হয়েছিল তো জানো। দেশভাগ-উত্তর জীবনানন্দ জীবিকার খোঁজে হন্যে হয়ে কলেজ থেকে কলেজে ছুটেছেন। জীবনের শূন্যতার কথা তাঁর থেকে আর কে এমন করে ভেবেছিল?
দেখলাম এই হেমিংওয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছে। তারপর বলল, ‘এটা মনে হয় জানুয়ারি মাস, আর দাশ কবে মারা গিয়েছিলেন?’
‘অক্টোবরে।’
‘তুমি তাহলে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা?’ হেমিংওয়ের কথায় কোনো শ্লেষ ছিল না।
আমি কী বলব ভেবে পাই না, এ খেলার পেছনের সত্য কথাটি বললে হয়তো হেমিংওয়ে অন্তর্হিত হবে।
‘আর আমি? আমি কবে মারা যাব?’
উত্তরটা দিতে একটু চিন্তা করলাম। বছরটা মনে করতে চাইলাম, তাকে কি সেটা বলা ঠিক হবে? ভাবলাম, এআই নির্মিত মানুষ, তার অনুভূতিও নিতান্ত কৃত্রিম, বলেই দেখি। বললাম, ‘মনে হয় ১৯৬১ সালে।’
চুপ করে থাকে সে।
বললাম, ‘শেষ রক্ষা মনে হয় করতে পারোনি তুমি। তোমার এক হলিউড বান্ধবীকে বলেছিলে যে তুমি এত জন্তু আর মাছ মারো, যাতে তোমার নিজেকে মারতে না হয়।’
‘আভা গার্ডনারকে বলেছিলাম,’ আবার হো হো করে হাসে সে।
আমার আবার রাগ হতে থাকে। বলি, ‘আমি জানি না পৃথিবীর কাছে তুমি কী প্রমাণ করতে চেয়েছিলে, পৌরুষত্ব মনে হয়। তোমার লেখাও তেমন। তার মধ্যে কোনো মিষ্টতা নেই, সব অলংকার খুলে ফেলে, সব প্রসাধন ধুয়ে ফেলে যা বাকি থাকে, ফর হুম দ্য বেল টোলস পড়ে আমার তা–ই মনে হয়েছে।’
ভেবেছিলাম সে রাগ করবে, কিন্তু দেখলাম মিটিমিটি করে হাসছে। বলল, ‘ও বইটা তাহলে তুমি পড়েছ। জানো, তোমার সঙ্গে কয়েক মিনিটের আলাপে অনেক কিছু জানলাম নিজের সম্বন্ধে। জানি না তুমি কিছু জেনেছ কি না নিজের সম্বন্ধে। তোমার জীবনকে কেমনভাবে দেখো তুমি?’
বুথটা কেমন জানি অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে, আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে। আমার জীবনের কৈফিয়ত দিতে আমি এখানে আসিনি।
না, এসবের কিছুই সে করেনি, দেখেনি, পায়নি; কিন্তু জীবনের সারশূন্যতা সে বুঝেছিল ওসব না করেই। তোমার প্রিয় ম্যাটাডরদের নিয়েও তার একটি লাইন ছিল।
‘আরেকটা ব্যাপার হলো, আমার এখানে কিছু সঙ্গী আছে, তারা সব ঠিক আমার সময়ের না,’ হেমিংওয়ে বলতে থাকে, ‘সিলভিয়া প্লাথ খুব ভালো কবিতা লিখত, মিশিমা গল্প। সিলভিয়া বলতে গেলে অপ্রকৃতিস্থ, আর মিশিমা তো একেবারে চরমপন্থী। একদম ফ্যানাটিক, বুঝলে। আমার সঙ্গে তারা কেন এখানে আছে, ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।’
আমি ততক্ষণে বুঝেছি, কেন ওখানে ওরা আছে। কিন্তু আমাকে এখান থেকে উঠতে হবে, আমার কাজ আছে। আমি বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই পাপা বলে ওঠে, ‘দাঁড়াও, তোমার জীবনানন্দ সম্পর্কে আরও কিছু বলো। কীভাবে সে মারা গেল? জীবনানন্দ সম্পর্কে জানতে হেমিংওয়ে মরিয়া।
‘কীভাবে?’ মনে করার চেষ্টা করলাম আমি, ভাবলাম একটা উত্তর আপাতত দিয়ে দিই, আমাকে এ ঘর থেকে বের হতে হবে দ্রুত। বললাম, ‘জীবনানন্দ দাশ সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিলেন, একটা ট্রামলাইন পার হতে হতে হঠাৎ কী মনে করে ট্রামের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন।’
‘তারপর?’ ধৈর্য ধরে না পাপা হেমিংওয়ের।
‘তারপর কয়েক দিন পরে তিনি হাসপাতালে মারা গেলেন।’
‘তাহলে এটা ঠিক আত্মহত্যা বলে প্রমাণিত নয়।’
‘তোমার আত্মহত্যাকেও প্রথমে নিতান্ত দুর্ঘটনা বলা হবে, তুমি তোমার প্রিয় শটগান পরিষ্কার করছিলে। এত সকালে কেউ বন্দুক পরিষ্কার করে?’
‘আমার ভবিষ্যৎ আমি জানতে চাই না।’
‘আমারও ঠেকা নেই তোমাকে জানাতে, আমার এখান থেকে বের হতে হবে।’
‘দাঁড়াও,’ হেমিংওয়ের কণ্ঠে আকুলতা, ‘তোমার জীবনানন্দ কোনো দিন আফ্রিকা গিয়েছিল, কিলিমানজারোর নিচে সিংহ শিকার করেছিল? পাম্পালোনায় ষাঁড়ের সামনে দৌড়েছিল? ক্যারিব সাগরে টুনা ধরেছিল? যুদ্ধ দেখেছিল? বহু নারীর সঙ্গ পেয়েছিল?’
‘না, এসবের কিছুই সে করেনি, দেখেনি, পায়নি; কিন্তু জীবনের সারশূন্যতা সে বুঝেছিল ওসব না করেই। তোমার প্রিয় ম্যাটাডরদের নিয়েও তার একটি লাইন ছিল।’
‘তাই? কী ছিল সেটা?’
‘আমি তো তার সব লাইন মুখস্থ করে রাখিনি, কিন্তু এ লাইনটি মনে আছে, “আজ মৃত্যু, এর আগে ম্যাটাডরদের মৃত্যু ছিল নাকি স্পেনে?” ওখানে মৃত্যু নিয়ে অনেক কিছু লেখা ছিল, আমার মনে নেই, “ভয় নেই, মৃত্যু নয় কোনো এক অপদার্থ অন্যায় আলোক,” এ রকম কিছু।’
‘এর মানে কী?’
‘তা আমি বলতে পারব না,’ এই বলে আমি উঠি।
‘তোমার কি মনে হয় আমি যা করেছি, দেখেছি, পেয়েছি, তা জীবনের অর্থহীনতার বিরাট বিবরকে ভর্তি করতে? না, আমি জীবনকে চ্যালেঞ্জ করেছি, সেই চ্যালেঞ্জের মধ্যে জীবনের অর্থ,’ হেমিংওয়ে বলে।
পেছনের একটা দরজা খুলে যায়, একটা বড় হলঘর, আধো-অন্ধকার। চোখটা সয়ে এলে দেখলাম মর্মরের ফোয়ারা, ব্রোঞ্জের সিঁড়ি, ট্রাভেরটাইন আর ওক কাঠের দেয়াল, সূক্ষ্ম সূচির পর্দা, এক পাশে মিস্টার ক্যাপারম্যানের বার।
‘তাতে শেষ রক্ষা হলো না,’ বিড়বিড় করে বলি আমি। বের হতে চাই। কিন্তু বের আমি হতে পারি না। দরজা বন্ধ। চিৎকার করি, ‘মিস্টার ক্যাপারম্যান! মিস্টার ক্যাপারম্যান!’ দরজায় ধাক্কা দিই, কিন্তু ক্যাপারম্যানের সাড়া পাওয়া যায় না।
বুথটি আরও অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। সামনের স্লট মেশিনের বড় বাক্সটা ঘুরতে থাকে, আমার বসার চেয়ারটাও আমাকেসহ ঘোরে, যতক্ষণ না সেটা স্লটের বাক্সটার ওখানে চলে যায়। আমার সামনে একটা কাচ নেমে আসে, নিজেকে আবিষ্কার করি সেখানে, যেখানে হেমিংওয়ে এতক্ষণ বসে ছিল, কিন্তু সামনে হেমিংওয়েকে দেখতে পেলাম না। পেছনের একটা দরজা খুলে যায়, একটা বড় হলঘর, আধো-অন্ধকার। চোখটা সয়ে এলে দেখলাম মর্মরের ফোয়ারা, ব্রোঞ্জের সিঁড়ি, ট্রাভেরটাইন আর ওক কাঠের দেয়াল, সূক্ষ্ম সূচির পর্দা, এক পাশে মিস্টার ক্যাপারম্যানের বার। ছিল অনেক মানুষ। নারী–পুরুষের জটলা। প্রথম দর্শনে মনে হলো, তাদের কাউকে আমি চিনি না। এর মধ্যে একজন জাপানি চেহারার মানুষ, এবার মনে পড়ল মিশিমার নাম। এখানে কি ববি কেনেডি আছে? না, কোনো কেনেডিরই এখানে থাকার কথা নয়। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এখান থেকে মুক্তি নেই। সেই মানুষের জটলা থেকে বেরিয়ে আসে পাপা হেমিংওয়ে। আমার দিকে এগোতে এগোতে বলে, ‘আমাদের এই সভায় সুস্বাগত, জীবনানন্দ দাশ।’ ভাবলাম, কোথায় কবে আমি জানি ট্রামের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম।