আরিয়ানার মা

সেন্ট্রাল কমিউনিকেশন সিস্টেম এখন এই ড্রোনগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে

আরলিনের হলোগ্রামটি নিয়ে আরিয়ানার বাবা অনেক্ষণ বসে থাকলেন নিজ অফিসে। অনুমতি ছাড়া কারো মস্তিষ্কের হলোগ্রাম করা এখন কঠিন অপরাধ। কিন্তু আরলিনের উইল অনুযায়ী মৃত্যুর পরে তার মস্তিষ্ক ত্রিমাত্রিক স্ক্যান করে এই হলোগ্রাম তৈরি হয়েছে। তা এখন তার হাতে। কিন্তু আরলিন কেন এ কাজটি করল, তা বুঝতে পারলেন না।

মানুষের এমন অনেক স্মৃতি থাকে যা অন‍্যের না জানাই ভালো। এ কারণেই হয়তো আমরা অন‍্যের চিন্তা বুঝতে পারি না। আর মেয়েরা তো এক গভীর সাগর। সেখানে অনেক কিছুই থাকে একান্ত গোপনীয়।

তার মৃত স্ত্রীর প্রতি সম্মান জানিয়ে আরিয়ানার বাবা স্মৃতির হলোগ্রামটি নিজের অফিসের লকারেই রেখে দিলেন। পুরো এক ইয়োট্টাবাইট (১০২৪) তথ্যের এই হলোগ্রামে আরলিনের সব স্মৃতিই রয়েছে। তার ছেলেবেলা থেকে কৈশোর, একসঙ্গে কাটানো সময় থেকে শুরু করে তাদের মেয়ে আরিয়ানার জন্ম পর্যন্ত সব স্মৃতিই এখানে আছে। মানুষ কি তাহলে এক ইয়োট্টাবাইট তথ‍্যভান্ডারে রূপান্তরিত হওয়ার জন‍্যই জন্মেছে?

আরও পড়ুন
বলবেন তার মা একটি মিশনে দূরের কোনো গ্রহে গেছে। এমন তো হরহামেশাই হচ্ছে। হাইপারড্রাইভ দিয়ে আমরা কত দূরের গ্রহে চলে যাচ্ছি, হলোগ্রাফিক ছায়ার সঙ্গে কথা বলছি।

অফিসের সব জানালা বন্ধ এবং সেন্ট্রাল কম্পিউটার সিস্টেমের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স থেকে স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। তবুও তার একটু বাইরের বাতাস পেতে ইচ্ছে হলো। জানালা খুলে দেখল, আকাশে উড়ছে হরেক রকমের ড্রোন। কোনোটি খাবার পৌঁছে দিচ্ছে, আবার কোনোটিতে চড়ে মানুষ যাতায়াত করছে। তার তৈরি ড্রোনগুলোকেও উড়তে দেখা যাচ্ছে। ড্রোনগুলোর ওপরে সূর্যের আলো পড়ায় ঝলমল করছে।

দুই.

আরিয়ানার চতুর্থ জন্মদিন তিনি খুব সাদামাটাভাবে পালন করলেন। নিজের কিছু সহকর্মীকে ডেকেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিল অফিসের নতুন চিফ সাইন্টিস্ট ড. সোম। বড় হলরুমের কোনায় হালকা মিউজিক বাজছিল। সবাই গল্প করতে ব্যস্ত। ড. সোম তার পাশে এসে বললেন, ‘আর কিছুদিন পর মেয়েটি সবকিছু বুঝতে শিখবে। মায়ের অভাব কীভাবে পূরণ করবেন?’

ড. সোমের কথাটা ঠিক বুঝলেন না তিনি। তাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি কোনো পাত্রীর জন্য ঘটকালি করছেন?’

ড. সোম বললেন, ‘নাহ, ঠিক সেরকম নয়। আসলে আমার কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। তাই ভাবছিলাম আপনার আরিয়ানার মায়ের স্মৃতি দিয়ে একটি সিস্টেম তৈরি করে দিলে কেমন হয়?’

আরিয়ানা তো গিনিপিগ নয়। ওকে নিয়ে পরীক্ষা করব কেন?

আহা, আমি সেভাবে বলিনি। মেয়েটি তার মায়ের সঙ্গে গল্প করবে, এতে তার মায়ের অভাব পূরণ হবে।

কিন্তু বড় হলে আরিয়ানাকে আমি কি বোঝাব?

বলবেন তার মা একটি মিশনে দূরের কোনো গ্রহে গেছে। এমন তো হরহামেশাই হচ্ছে। হাইপারড্রাইভ দিয়ে আমরা কত দূরের গ্রহে চলে যাচ্ছি, হলোগ্রাফিক ছায়ার সঙ্গে কথা বলছি। আসল মানুষটাকে না পেলেও তার ছায়ার সঙ্গে কথা বলছি। এক্ষেত্রেও আরিয়ানা তার আসল মায়ের পরিবর্তে তার স্মৃতি দিয়ে তৈরি কোনো হলোগ্রামের সঙ্গে কথা বলতে পারবে।

ড. সোমের কথাটি সেদিন তিনি খুব পাত্তা দিলেন না। কিন্তু কিছুদিন পরে তার মনে হলো, হয়তো আরিয়ানার মানসিক বিকাশের জন্য ব্যাপারটি ভালো ভূমিকা রাখবে।

তিন.

আরিয়ানার মন খারাপ। তার ক্লাসের পরীক্ষার রিপোর্ট খুব খারাপ এসেছে। স্কুল ছুটির পর যে ট্রান্সপোর্টার ড্রোনটি তাকে বাসায় পৌঁছে দেয়, তা ঠিক সময়েই স্কুলের সামনে চলে এসেছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালিত এই ট্রান্সপোর্টারে উঠেই সে সিট বেল্টটা লাগিয়ে নেয়। পুরো কাচ দিয়ে ঘেরা ট্রান্সপোর্টারের ভেতর থেকে শহরের বিশাল অট্টালিকাসহ দূরের সমুদ্র পরিষ্কার দেখা যায়। মনে হতো এখনি সে পড়ে যাবে। কিন্তু কিছুদিন পর অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন ড্রোনে আর কখনোই দুর্ঘটনা ঘটে না।

আরও পড়ুন
আরিয়ানা রুমে ঢুকে ট্রান্সপোর্টারে মাকে কল দেয়। মা মেসেজ দেয় একটি শাটলে আছে। কিছুক্ষণ পরে কল ব্যাক করবে। একটু পরে মা তাকে কল দেয়। হলোগ্রামটি অন করার সঙ্গে সঙ্গে তার মায়ের অবয়ব তার রুমের মাঝখানে ফুটে ওঠে।

সেন্ট্রাল কমিউনিকেশন সিস্টেম এখন এই ড্রোনগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ড্রোনে উঠেই সে পুরো কাচ ঘোলাটে করে দেয়। বাইরে থেকে আর কেউ তাকে দেখতে পাবে না। তার মনটা খারাপ। সেটা তার মাকে বলতে না পারলে ভালোই লাগবে না। কিছুক্ষণ পর ট্রান্সপোর্টারটি বাসার ল্যান্ডিং স্টেশনে পৌঁছে যায়।

ভেতরে ঢুকেই আরিয়ানা ল্যান্ডিং স্টেশনটি বন্ধ করে দেয়। সেটি সুন্দরভাবে দেয়ালে সেঁটে গিয়ে একটি জানালায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। কেউই আর বুঝতেই পারবে না, এটি তার অ্যাপার্টমেন্টের ট্রান্সপোর্টার নামার জায়গা। আরিয়ানা জুতোর শেলফে পা রাখতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে জুতোটি খুলে যায়। কোনায় তাদের বাসার রোবটকর্মী জুলি দাঁড়িয়ে আছে। যদিও রোবটের কোনো লিঙ্গ নেই, তবুও নারীর মতো করে তার নাম দেওয়া হয়েছে জুলি। সে তার বাসার কাজগুলো দেখাশোনা করে।

জুলি বলল, স্বাগতম, আরিয়ানা।

ধন্যবাদ, জুলি।

জুলি কি তার চেহারা দেখে বুঝে ফেলেছে যে তার মন খারাপ? আরিয়ানা ভাবে, হয়তো বুঝতে পেরেছে। এমন বুদ্ধিমত্তা নিশ্চয়ই তাদের দেওয়া হয়েছে। কেননা এরপর জুলি আর কোনো কথা বলেনি। অন্যান্য দিন এটা সেটা প্রশ্ন করে জ্বালাতন করে। আরিয়ানা বোঝে, জুলি তার সঙ্গী হতে চায়।

কিন্তু আরিয়ানার ঠিক রোবটের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না। তার ভালো লাগে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে। মা কত সুন্দরভাবে তার মনের কথা বুঝে ফেলে। মা তো মা-ই, তাঁর জায়গা কি কখনো দখল করা যায়?

এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এতদিন ধরে তাকে গল্প শুনিয়েছে, উপদেশ দিয়েছে। কত স্মৃতি তাতে

আরিয়ানা রুমে ঢুকে ট্রান্সপোর্টারে মাকে কল দেয়। মা মেসেজ দেয় একটি শাটলে আছে। কিছুক্ষণ পরে কল ব্যাক করবে। একটু পরে মা তাকে কল দেয়। হলোগ্রামটি অন করার সঙ্গে সঙ্গে তার মায়ের অবয়ব তার রুমের মাঝখানে ফুটে ওঠে। বাস্তব মা-ই যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আরিয়ানার খুব ইচ্ছে করে মাকে জড়িয়ে ধরবে। হলোগ্রামকে জড়িয়ে ধরা যায় না, তাই মন খারাপ করে থাকে। মায়ের সঙ্গে কুটকুট করে এটা সেটা গল্প করে আরিয়ানা।

এদিকে জুলি রান্নাঘরে রান্না শুরু করেছে। যদিও বেশিরভাগ খাবারই প্যাকেটে প্রসেস করা। তারপরেও সে প্ল্যান করতে থাকে কী করে আরিয়ানার মনটা ভালো করবে। সে জানে, এখন আরিয়ানাকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। কথাও বলা যাবে না। কিছুদিন এই মন খারাপটা থাকবে। তারপরেই আরিয়ানা একদিন কথা বলবে তার সঙ্গে। অন্তত তার কয়েক বছরের তথ্য সেটাই বলে।

চার.

সেদিন বাবার সঙ্গে খাবার টেবিলে দেখা হলো। তার কিছুক্ষণ আগেই বাবা এসেছে তা সে জানে। অন্তত দেয়ালে রাখা বাসার সেন্সরের ড‍্যাশবোর্ড বলে দিচ্ছে বাবা এখন বাসায়।

আচ্ছা বাবা, মা কবে আসবে? বাবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মেয়ে।

আরিয়ানা, তোমাকে তো বলেছি একটি হাইপারড্রাইভের দুর্ঘটনায় তোমার মা একটি গ্রহে আটকে পড়েছে। সেখান থেকে ফিরতে আরও আট বছরের মতো লাগবে।

কেন বাবা?

হাইপারড্রাইভে আমরা দ্রুত অনেক দূরে চলে যেতে পারি, কিন্তু সমস্যা হলো, যেখান থেকে যেখানে পৌঁছাব, সেই দুই দিকেই আমাদের হাইপারড্রাইভের টানেল থাকতে হবে। তাহলেই সেই টানেলের ভেতর দিয়ে আমরা আলোর চেয়ে বেশি গতিতে যেতে পারব। অনেক দূরে দূরে একেকটি হাইপারড্রাইভের টানেল বসানো হয়, যেন আমরা সেখানে যেতে পারি। তোমার মা তেমনি একটি হাইপারড্রাইভ বসানোর কাজে গিয়েছে। যেখানে একটি দুর্ঘটনার কারণে সেই এক্সিট টানেলটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই তাদের ম্যানুয়ালি বিশাল দূরত্ব পার হয়ে পাশের একটি হাইপারড্রাইভ টানেলের মাধ্যমে যেতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন
আরিয়ানা একদিন জুলিকে হ্যাক করে ফেলল। তার ভেতরের সিস্টেমটির নিয়ন্ত্রণ সে নিজেই নিয়ে নেয়। এর ভেতরের গঠন দেখে আরিয়ানা খুব মজা পেল। যেহেতু এটি বাসার দেখাশোনার কাজ করে, তাই বাইরের কোনো সিস্টেমের সঙ্গে জুলি যুক্ত নয়।

গরম সুপটি খেতে খেতে আরিয়ানা তার বাবার কথা শোনে। ছোটবেলা থেকেই এই ব্যাখ্যাটি আরিয়ানা শুনে এসেছে। কিন্তু তবু সে তা মানতে পারে না। যদিও সে জানে, প্রথম হাইপারড্রাইভের টানেল কাউকে না কাউকে বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে বসাতে হয়েছে। আরিয়ানাও মায়ের মতো শাটলে করে বিভিন্ন গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যেতে চায়। কোন শাটল কেমন চলে, তার বিস্তারিত খুঁটিনাটি তার মতো আর ক্লাসে কেউই জানে না।

মা যে মিশনে আছে, সেই মিশনের বিস্তারিত তথ্য সে বের করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেটি তাদের স্টারপিডিয়াতে (বিভিন্ন গ্রহ ও নক্ষত্রের তথ্যভান্ডার) নেই। আরিয়ানা ভাবে, খুব সম্ভবত কোনো গোপনীয় মিশনে তার মা গিয়েছে। এখন মানুষ ছড়িয়ে রয়েছে অনেক গ্রহে। পুরোনো দিনের চর দখলের মতো এখন গ্রহ দখল করা নিয়েও যুদ্ধও লেগে আছে। তার মা কি সেরকমই কোন বিপদজনক মিশনে আছে?

বাবা তাঁর ড্রোন তৈরির কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তেমন ক্লাসিফায়েড কোনো কাজ তিনি করেন বলে মনে হয় না। কিন্তু তার মায়ের সবকিছুই কেমন যেন অদ্ভুত। যদিও এখন শিশুরা বড় হচ্ছে রোবটের হাতেই। তারাই ওদের দেখাশোনা করে। তারপরেও পরিবারের বন্ধন এখনও ভেঙ্গে পড়েনি। এখনও সংসার নামে প্রতিষ্ঠানটি টিকে আছে।

নিজের মেয়েকে তার মা দেখতে আসবে না! বছরের পর বছর মিশন নিয়ে থাকবে, তা আরিয়ানা ঠিক মেনে নিতে পারে না। তার স্কুলের অনেকে এভাবেই বড় হচ্ছে। তাই ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আরিয়ানা তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চায়।

পাঁচ.

মায়ের কলগুলো যে গ্রহ থেকে আসে, সেটি সে বের করার চেষ্টা করে। সেটার জন্য প্রথমে শিখতে শুর করে কম্পিউটার সিস্টেম সম্বন্ধে। বাবার শরণাপন্ন হয়। বাবা তাকে বুঝিয়ে দেন, কীভাবে কম্পিউটার কাজ করে। একদিন বাবা তাকে শেখান, মেশিন ল্যাঙ্গুয়েজ কী, কীভাবে সেটি বুঝতে হয়। ইন্টারফেস নিয়ে মোটামুটি ভালো কাজ শিখে ফেলেছে সে। আশপাশের জিনিসপত্রগুলোকে হ্যাক করা শুরু করে আরিয়ানা। ব্যাপারটা যে এমন মজার, তা ভেবেই সে খুব এক্সাইটেড। মানে রীতিমতো ঘুম হারাম।

আরিয়ানা একদিন জুলিকে হ্যাক করে ফেলল। তার ভেতরের সিস্টেমটির নিয়ন্ত্রণ সে নিজেই নিয়ে নেয়। এর ভেতরের গঠন দেখে আরিয়ানা খুব মজা পেল। যেহেতু এটি বাসার দেখাশোনার কাজ করে, তাই বাইরের কোনো সিস্টেমের সঙ্গে জুলি যুক্ত নয়। এর মধ্যে কোনো তথ্য সংরক্ষিত থাকে না। শুধু লজিক এবং পুরোনো তথ্যগুলো সংরক্ষিত থাকে। এরপর সে আরও বড় কিছু হ্যাক করার কথা ভাবে। এরপর চেষ্টা করে একটি সিস্টেম দাঁড় করিয়ে ফেলল, যেটি তার মায়ের সমস্ত যোগাযোগ ট্র্যাক করতে পারবে।

মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর সে খুঁটিনাটি বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু ঠিক কোথা থেকে এই সিগন্যালটি আসছে, তা বের করতে পারল না। যদিও সাধারণত তাদের গ্রহের সিগন্যালগুলো বেশ কিছু নোড (কম্পিউটারের যোগাযোগের একটি স্থান) থেকে আসে। কিন্তু এই সিগন্যালটি আসছে অন্য কোনো নোড থেকে। আরিয়ানা ব্যাপারটি কাউকে বলল না। কিন্তু সেই বিশেষ যোগাযোগটি কোথা থেকে হতে পারে, তা বের করার জন্য মোটামুটি উঠে পড়ে লাগল। কিন্তু কোনো হদিস করতে পারে না। একটু পর জুলি তাকে খাবার জন্য ডাকে। আরিয়ানা আজ জুলিকে বলেছিল, সে বেকড মাছ খাবে। আরিয়ানা বাবার জন্য অপেক্ষা করে। বাবাকে মেসেজ পাঠাতেই বাবা জানালেন, ট্রান্সপোর্টার ড্রোনে আছেন। একটু পরেই আসবে।

আরও পড়ুন
ওপেন ডে মানে, নির্দিষ্ট কোনো গ্রহ দেখার জন্য বাইরের জনগণের জন্য ট্যুরের ব্যবস্থা। আরিয়ানা সেই ট্যুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সেদিন ছিল তার ছুটির দিন। আরিয়ানা ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে দেখে, বাবা তার ল্যাবে চলে গেছেন বেশ সকালেই।

জুলি ল্যান্ডিং স্টেশনটি খুলে দেয়। আরিয়ানা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাবা একটি নতুন ধরনের ড্রোন তৈরি করছেন। সেটি দিয়েই মনে হয় আসছেন। বাবাকে সে অনেকবার বলেছে, এটি একটি পরীক্ষামূলক ড্রোন, এতে না উঠতে। ওটা এখনো বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হয়নি। তবুও বাবা নিজের তৈরি করা জিনিসে নিজেই গিনিপিগ হয়ে ট্রায়াল দিচ্ছেন। আচ্ছা, যারা কোনো কিছু উদ্ভাবন করে, তারা তাদের উদ্ভাবিত জিনিসের প্রেমে পড়ে যায় কেন?

ছয়.

এরপর অনেক খেটেখুটে আরিয়ানা সেই অজানা নোড মোটামুটি বের করতে পারে। একটি নতুন গ্রহ আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীরা ওই নোডটি ব্যবহার করে। তার মা কোন গ্রহ থেকে যোগাযোগ করে, তা সে বের করে ফেলল। অবাক হয়ে দেখল, আসলে সেই নোডটি তাদের গ্রহ থেকে খুব একটা দূরে নয়। বেশ কাছেই। খুব সম্ভবত কোনো গোপন প্রজেক্টে মা আছে। তাই হয়তো এমন লুকোচুরি। ব্যাপারটি সে এভাবেই ভেবে নেয়।

সেদিন আরিয়ানার খুব খুশি লাগে। সে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। কিন্তু বাবাকে একেবারেই বুঝতে দেয় না। এই ভালোলাগা কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারছে না। মানুষ যদি কিছু কষ্ট একা নিজের মধ্যে পুষে রাখতে পারে, তবে আনন্দও নিজের মধ্যে রাখা যায়। আরিয়ানাও তাই করল। সেই গ্রহটিতে কীভাবে যাবে, তার খোঁজ নিতে থাকে আরিয়ানা। হঠাৎ আবিষ্কার করে, সেটির ওপেন ডে খুব সামনেই আছে।

ওপেন ডে মানে, নির্দিষ্ট কোনো গ্রহ দেখার জন্য বাইরের জনগণের জন্য ট্যুরের ব্যবস্থা। আরিয়ানা সেই ট্যুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সেদিন ছিল তার ছুটির দিন। আরিয়ানা ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে দেখে, বাবা তার ল্যাবে চলে গেছেন বেশ সকালেই। বাবার ড্রোনটি এসেছিল। ল্যান্ডিং স্টেশন খুলতে গিয়ে দেখে, তা বেশ সকালে আরেকবার খোলা হয়েছিল।

ভেতরে ঢুকেই আরিয়ানা ল্যান্ডিং স্টেশনটি বন্ধ করে দেয়। সেটি সুন্দরভাবে দেয়ালে সেঁটে গিয়ে একটি জানালায় রূপান্তরিত হয়ে যায়

বাবাকে খুব অদ্ভুত লাগে। ল্যাবে কি এমন কাজ করে যে এমন ডুবে থাকে। জুলিকে একটি ড্রোন ট্যাক্সির জন্য যোগাযোগ করতে বলে। ট্যাক্সিটি আসতেই সে ট্যুরের মিটিং পয়েন্টে চলে যায়। সেখান থেকে তাদেরকে আরেকটি শাটলে করে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে গিয়ে দেখে, বেশিরভাগই বয়স্ক লোকজন। তার সমবয়সী কেউ নেই। এসব ছোটখাটো গ্রহ দেখার আগ্রহ খুব বেশি মানুষের নেই। আর গ্রহটিতে মজার বা অদ্ভুত কোনো জিনিসও নেই। তাই ওই গ্রহ দেখার জন্য মানুষের আগ্রহ কম।

তারপরেও এত কম মানুষ দেখেও অবাক হয়নি আরিয়ানা। একটু পরেই তাদের শাটল চলা শুরু হলো। সত্যি সত্যিই তার মায়ের সঙ্গে দেখা হবে। এমন একটি দিনের জন্য সে কত বছর ধরে অপেক্ষা করেছিল।

সাত.

শাটলটি এসে পৌঁছাল সেই গ্রহের ল্যান্ডিং স্টেশনে। তাদের একটি ওয়েটিং রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। সবাইকে দেওয়া হলো একটি করে পানীয়। খাবারদাবার বেশ ভালো মানের। মনে হয় গ্রহটি আকর্ষণীয় নয় বলেই খাবারের প্রতি নজর দেওয়া হয়েছে। এখানে আসার আগে আরিয়ানা হোমওয়ার্ক করে এসেছিল, ঠিক কোনো জায়গা থেকে তার মা যোগাযোগ করে। তার হাতের ট্যাবলেট ডিভাইসে সে তার ম্যাপ ও আনুষঙ্গিক তথ্যগুলো নিয়ে এসেছিল। আরিয়ানা খুব উত্তেজিত ছিল। কী বলবে সে মাকে? সে কি জড়িয়ে ধরবে?

ট্যুরের লোকজন গ্রহের বিভিন্ন অংশে তাদের নিয়ে যাচ্ছিল। এই গ্রহটি মূলত বিজ্ঞানীদের ল্যাবের কাজে ব্যবহৃত হয়। আরিয়ানাকে গাইড করছিল একদল রোবট। একটু পর পর হলোগ্রামে বলে দিচ্ছিল, ল্যাবের কোনো জায়গায় কী কাজ হয়। তারপর আরিয়ানাকে একটি সুন্দর বাগানের কাছে নিয়ে গেল। সেখানে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। কোথাও ঠান্ডা, আবার কোথাও মরুভূমির মতো পরিবেশ। সেই পরিবেশের গাছগুলো সেখানে কীভাবে বেঁচে থাকে, তার বর্ণনা দিচ্ছে গাইড রোবটগুলো।

আরিয়ানা হাতের ট্যাবলেটে দেখল, সে তার মায়ের জায়গাটির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। খুব সাবধানে সে গাইডের অংশ থেকে বের হয়ে গেল। বাথরুমে যাওয়ার রাস্তা ধরে অন্য একটি রাস্তা দিয়ে লুকিয়ে বেরিয়ে গেল। তার গলায় যে গাইডের পাসটি ঝুলছিল, সেটা খুলে রেখে দিল।

হঠাৎ তাকে কেউ একটি কফি শপের পাস দিয়ে গেল। এখন তাকে দেখে কেউ বুঝতে পারবে না যে সে অন্য গ্রহের বাসিন্দা। কিন্তু আরিয়ানার মনে হচ্ছিল, পুরো কফিশপের সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে জানে, তার পাশের রুমই তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। রুমটির খোঁজেই সে এখানে এসেছে। সাবধানে সে অপেক্ষা করতে লাগল, কখন সেই রুম থেকে কেউ বের হয়। কাউকে বের হতে দেখলেই সে ঢুকে পড়বে। কফিশপের কোনার একটি চেয়ারে অপেক্ষা করতে লাগ্ল। একটু পরেই একজন লোক সেই গেট থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দরজার দিকে এগোতে লাগল। কিন্তু বেশি হুড়োহুড়ি করলে তাকে অস্বাভাবিক লাগবে বলে সে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে গেল। কিন্তু যখন সে সেখানে ঢুকতে যাবে, ততক্ষণে দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল। খুব আফসোস হতে লাগল আরিয়ানার। এমন একটি দুর্লভ মুহূর্ত সে হাতছাড়া করে ফেলল! দরজা একটি সিকিউরিটি সিস্টেমের মাধ্যমে লক করা। সে হয়তো চেষ্টা করলে সেটি হ্যাক করতে পারত, কিন্তু মূল প্যাসেজের দরজাটা হওয়ায় এবং পাশেই একটা কফিশপ থাকায় লোকজনের যাতায়াত বেশি। ফলে সহজেই সন্দেহের কারণ হতে পারে।

আরও পড়ুন
ঠিক বুঝতে পারল না। সে আশা করছিল, এখানে একজন জলজ্যান্ত মানুষ থাকবে। কিন্তু এই রুমে তো শুধু সার্ভার। কোনো লজিক তার মাথায় কাজ করছে না। এমন কেন হবে?

আরিয়ানার টেনশন বাড়তে থাকল। আমাদের সব আবেগ যখন এরকম একত্রিত হয়ে যায়, তখন মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে? তা মনে হয় বিজ্ঞানীদের জানা নেই। একটি চেয়ারে বসে সে আবার সুযোগের অপেক্ষা থাকল। এদিকে বেশি দেরি হলে গাইডের লোকজন নিশ্চয়ই তাকে খোঁজা শুরু করবে। ট্যাবলেটটি নিয়ে সে একটি বই খুলে প্রস্তুত হয়ে থাকল। এমনভাবে প্রস্তুত হলো, যেন দরজার কাছে পৌঁছাতে বেশি সময় না লাগে। চেয়ারটি দরজার দিকে সামান্য ঘুরিয়ে সে অপেক্ষা করছে। এদিকে কফিশপে একটি রোবট খাবার সার্ভ করছে। সে কিছু খাবার অর্ডার দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বসে থাকার চেষ্টা করল। ট্যাবলেটে বইটা শুধু খোলাই থাকল,  কিন্তু পড়া হচ্ছে না।

আর কখন সুযোগ আসবে? সেই যেন ফুরাচ্ছে না। অপেক্ষার সময়গুলো এত দীর্ঘ হয় কেন?

আট.

একটু পরে খেয়াল করল, দরজা দিয়ে একটা ক্লিনার রোবট বের হচ্ছে। এবার আর আগের মতো ভুল করল না। ক্লিনার রোবটটি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুত আরিয়ানা সেই দরজা দিয়ে ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটি। কিন্তু ভেতরে ঢুকে দেখল, সেটা কম্পিউটারের কোনো সার্ভার রুমের মতো। দেখে মনে হলো, সুপার কম্পিউটারের সার্ভারগুলো যেমন হয়, এটিও তেমন। তবে এই রুমের যে সিস্টেমগুলো আরিয়ানা দেখতে পাচ্ছে, তা বাইরের সাধারণ সিস্টেমের মতো নয়। গঠনগুলো আলাদা, আর সার্ভারের ওপরে বাবার প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা রয়েছে। সার্ভারগুলোতে বিভিন্ন নাম ও নোডগুলোর নামও আছে।

শাটলটি এসে পৌঁছাল সেই গ্রহের ল্যান্ডিং স্টেশনে। তাদের একটি ওয়েটিং রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। সবাইকে দেওয়া হলো একটি করে পানীয়

আরিয়ানা তার ট্যাবলেটটি বের করে নোডের পুরো নামটি দেখে সেটি খুঁজতে শুরু করল। একদম কোনায় সেই নোডে লেখা সার্ভারটি খুঁজে পেল। সবগুলো নোডের নিচে একটি করে নাম। তার নোডটির নাম মিলিয়ে নিচে দেখল সেখানে তার মায়ের নাম লেখা, ‘আরলিন’। ওটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর দিয়ে যেন হিমশীতল একটি স্রোত বয়ে গেল। নোডের নিচে তার মায়ের নাম থাকবে কেন? তার মানে, যোগাযোগের সিগন্যাল যে নোড থেকে আসছে, সেটি শুধু তার মা ব্যবহার করে?

ঠিক বুঝতে পারল না। সে আশা করছিল, এখানে একজন জলজ্যান্ত মানুষ থাকবে। কিন্তু এই রুমে তো শুধু সার্ভার। কোনো লজিক তার মাথায় কাজ করছে না। এমন কেন হবে? কিছুক্ষণ চিন্তিত থাকায় সে বের হওয়ার কথাটা ভাবেইনি। কিন্তু এখন তো রুম থেকে বের হতে হবে।

কীভাবে বের হবে? বের হতেও তো সিকিউরিটির লগটি খুলতে হবে। এসব ভাবতেই সে দেখল, কেউ দরজাটি খুলছে। সার্ভারের পাশেই সে দাড়িয়ে দরজা খোলার অপেক্ষাতে থাকল। কিন্তু অপর পাশে দরজা খুলতেই দেখলেন, ড. সোম। তার বাবার এই কলিগ মাঝেমধ্যে আরিয়ানার বাসায় যায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।

নয়.

ড. সোম আরিয়ানাকে তাঁর রুমে নিয়ে গেলেন। আরিয়ানা সেই রুমে ঝোলানো পোস্টার দেখে বুঝতে পারল, আসলে সেই সার্ভার রুমটি মূলত একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেম। সেখান থেকেই আঁচ করতে পারল, এতদিন যাকে ‘মা’ বলে গল্প করেছে, সে কোনো রক্ত মাংসের মানুষ নয়, একটি এআই মাত্র।

এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এতদিন ধরে তাকে গল্প শুনিয়েছে, উপদেশ দিয়েছে। কত স্মৃতি তাতে। কিন্তু পরে যখন জানতে পারল, তার সত্যিকারের মায়ের স্মৃতি, তার লজিক ও চিন্তার প্রণালীকে ব্যবহার করে এই সিস্টেমটি কাজ করে, তখন কেন যেন সে তার মাকে খুঁজে পেল। আবার সে সার্ভার রুমে গিয়ে ‘আরলিন’ লেখার ওপর হাত বুলিয়ে নিল। সেখানে মনে হয় মায়ের স্পর্শ খুঁজে নিল আরিয়ানা।

কখন যে বাবার হাত এসে পড়ল আরিয়ানার কাঁধে, তা সে খেয়াল করেনি। বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আরিয়ানা হু হু করে কেঁদে উঠল। আজকের মানব সভ্যতা আবেগ-অনুভূতিগুলো জলাঞ্জলি দিয়ে অনেক দূর চলে এসেছে। কিন্তু আরিয়ানার কান্না যেন প্রযুক্তি আজও জয় করতে পারেনি।

আরও পড়ুন