দ্য ওয়েপন

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ঘরের ভেতরটা প্রায় অন্ধকার, বাইরে সন্ধ্যা নামছে। অতি জরুরি একটি প্রজেক্টের প্রধান ড. জেমস গ্রাহাম নিজের প্রিয় চেয়ারে বসে গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন। পাশের ঘর থেকে তাঁর ছেলের ছবির বইয়ের পাতা ওলটানোর শব্দ ভেসে আসছে।

সারা দিন কাজ শেষে সন্ধ্যায় নিজ ঘরে স্বল্প আলোয় নীরবে বসে থাকা ওনার সবচেয়ে প্রিয়। এই ঘরে বসেই তিনি সৃজনশীল চিন্তা ও সেরা কাজের সূত্র পেয়ে যান। কিন্তু আজ তাঁর মন কাজ করছে না। মনজুড়ে রয়েছে মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে। তাঁর একমাত্র ছেলে, যে পাশের ঘরে বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছে। বছরখানেক আগে প্রথম জানতে পারেন যে তাঁর ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী। সব সময় হাসিখুশি থাকে; এর মানে এই নয় যে সব ঠিকঠাক আছে। কত মানুষের এমন সন্তান আছে, যারা সব সময় শিশুই থেকে যাবে, মানসিক বয়স কখনো বাড়বে না। কখনো তাঁকে ছেড়ে চলেও যাবে না। এটার অবশ্যই যুক্তিযুক্তকরণ আছে। কিন্তু যুক্তিযুক্তকরণ যখন ভুল হবে, তখন…

ডোরবেল বেজে উঠল।

গ্রাহাম চেয়ার ছেড়ে উঠে প্রায় অন্ধকার ঘরের আলো জ্বালালেন, তারপর হলওয়ে পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। বিরক্ত হলেন না; আজ রাতে এই সময়ে নিজের চিন্তাধারায় বাধা পড়াকে তিনি স্বাগতই জানাবেন।

দরজা খুলে দিলেন। এক অপরিচিত অতিথি ওপাশে দাঁড়িয়ে। লোকটা বললেন, ‘ড. গ্রাহাম? আমার নাম নেমান্ড। আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে। আমি কি কিছুক্ষণের জন্য ভেতরে আসতে পারি?’

কথা বন্ধ হয়ে গেল অতিথির, খোলা দরজা দিয়ে শোবার ঘরের দিকে চোখ পড়তেই। দরজা দিয়ে ১৫ বছর বয়সের এক ছেলে এসে ঘরে ঢুকল। ছেলেটি নেমান্ডকে লক্ষ করেনি। দৌড়ে গেল গ্রাহামের দিকে।

গ্রাহাম লোকটার দিকে ভালো করে তাকালেন। ছোটখাটো মানুষ। বর্ণনা দেওয়ার মতো নয়। বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। সম্ভবত রিপোর্টার বা কোনো ইনস্যুরেন্সের এজেন্ট।

লোকটা কে, তাতে কিছু যায় আসে না। গ্রাহাম বললেন, ‘অবশ্যই। ভেতরে আসুন মিস্টার নেমান্ড।’

কিছুক্ষণ কথা বললে তিনি চিন্তামুক্ত থাকবেন। মন পরিষ্কার করে চিন্তাগুলো সরিয়ে রাখলেন অন্যদিকে।

‘বসুন, বসুন,’ লিভিং রুমে লোকটাকে ঢুকতে বললেন গ্রাহাম। ‘ড্রিংক চলবে?’

নেমান্ড বললেন, ‘না না, ড্রিংকের দরকার নেই।’

তিনি একটা চেয়ারে বসলেন, গ্রাহাম নিজেও একটা সোফায় বসলেন।

আরও পড়ুন

ছোটখাটো মানুষটি দুই হাতের আঙুল পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে বসে রইলেন। এরপর একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘ড. গ্রাহাম, আপনি সেই বিজ্ঞানী, যার যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার পৃথিবী থেকে মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে।’

ছিটগ্রস্ত মানুষ, গ্রাহামের মনে হলো। লোকটা কী কাজ করেন, তা জিজ্ঞেস করে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। এটা একটা বিব্রতকর সাক্ষাত্কার হবে। তিনি উদ্ধতপনা পছন্দ করেন না, যদিও উদ্ধতপনাই তাঁকে আজ মুক্তি দিতে পারে।

‘ড. গ্রাহাম, আপনি যে অস্ত্রের ওপর কাজ করছেন—’

কথা বন্ধ হয়ে গেল অতিথির, খোলা দরজা দিয়ে শোবার ঘরের দিকে চোখ পড়তেই। দরজা দিয়ে ১৫ বছর বয়সের এক ছেলে এসে ঘরে ঢুকল। ছেলেটি নেমান্ডকে লক্ষ করেনি। দৌড়ে গেল গ্রাহামের দিকে।

‘ড্যাড, গল্প বলবে না?’ বলেই হেসে উঠল। এক বছরের অবুঝ শিশুর হাসি।

গ্রাহাম এক হাত দিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। অতিথির দিকে তাকালেন তিনি। লোকটা তার ছেলে সম্পর্কে কিছু জানেন কি না, বোঝা যাচ্ছে না।

ওদিকে নেমান্ডের চেহারায় বিস্ময়ের লেশমাত্র নেই। গ্রাহাম ধারণা করলেন, লোকটা সব জানেন।

‘হ্যারি—’ গ্রাহাম স্নেহ ও উষ্ণতা মাখিয়ে বললেন, ‘বাবা এখন ব্যস্ত আছে। কিছুক্ষণের জন্য তোমার ঘরে ফিরে যাও; আমি একটু পর আসছি, তারপর গল্প শোনাব।’

‘চিকেন লিটল? তুমি আমাকে চিকেন লিটল শোনাবে তো?’

‘তোমার যখন পছন্দ, তখন তা–ই হবে। এখন দৌড় দাও। দাঁড়াও, হ্যারি, ইনি নেমান্ড।’

অতিথির দিকে তাকিয়ে হাসল ছেলেটি।

হঠাৎ কপালে ঘাম জমে উঠল তাঁর। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে, গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বিছানার পাশে গিয়ে বসলেন। ‘হ্যারি, আমাকে দেখতে দেবে ওটা?’ সতর্কভাবে উপহারটি হাতে নিয়ে যখন পরীক্ষা করছিলেন, তখন তাঁর হাত কাঁপছিল।

নেমান্ড বললেন, ‘হাই হ্যারি!’ তার দিকে ফিরে হাসল ছেলেটি, হাত ছেড়ে দিয়েছেন গ্রাহাম। এবার নিশ্চিত হলেন, নেমান্ড তাঁর ছেলের বিষয়ে জানেন: তার হাসি নিশ্চিত করছে, ছেলেটির শারীরিক বয়স নয়, মানসিক বয়সের বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন।

ছেলেটি নেমান্ডের হাত ধরল। দেখে মনে হলো, সে নেমান্ডের কোলে উঠে বসবে। গ্রাহাম সুন্দরভাবে ছেলেকে নিজের কাছে টেনে নিলেন। বললেন, ‘হ্যারি, নিজের ঘরে যাও।’

ছেলেটি কিছু না বলে নিজের ঘরে গেল, তবে দরজা লাগাল না।

নেমান্ড চোখ তুলে তাকালেন গ্রাহামের দিকে। তারপর আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, ‘আমার ভালো লেগেছে ওকে।’ আরও বলল, ‘আপনি ওকে যা পড়ে শোনান, তার সব কি বাস্তব?’

আরও পড়ুন

গ্রাহাম বিষয়টা বুঝতে পারলেন না। নেমান্ড বললেন, ‘চিকেন লিটেলের কথা বলছি। ওটা একটা গল্প—কিন্তু চিকেন লিটেলের সব সময় কি আকাশ থেকে আছড়ে পড়া সঠিক বা বাস্তবসম্মত?’

গ্রাহামের হঠাৎ নেমান্ডকে মনে ধরল, যখন তিনি তাঁর ছেলের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে শুরু করলেন। পরমুহূর্তে মনে হলো, সাক্ষাত্কারটা শেষ করা দরকার। তাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, আপনি নিজের আর আমার সময় নষ্ট করছেন, মিস্টার নেমান্ড। আমি আপনার পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তি সম্পর্কে জানি। কারণ ও যুক্তি-পরামর্শ আমি হাজারবার শুনেছি। হয়তো আপনার চিন্তাভাবনার ভেতর সত্য আছে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি একজন বিজ্ঞানী এবং শুধুই একজন বিজ্ঞানী। এটা ঠিক যে জনসাধারণ জানে, আমি অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করছি—আলটিমেট অস্ত্র নিয়ে—কিন্তু আমার নিজের মনে হয়েছে, আমি যে বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করি, সেই বিজ্ঞানের অগ্রগতির বাই প্রোডাক্ট হিসেবে অস্ত্রটির জন্ম হয়েছে। কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা আমার ভাবনা নয়। অস্ত্র আবিষ্কার করাই আমার কাজ।’

‘কিন্তু ড. গ্রাহাম, মানব জাতি কি আলটিমেট অস্ত্রের জন্য প্রস্তুত?’

ভ্রু কোঁচকালেন গ্রাহাম, ‘আমি আমার মতামত আপনাকে দিয়ে দিয়েছি, মিস্টার নেমান্ড।’

নেমান্ড ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘বেশ, আপনি যখন কিছু বলতে চাইছেন না, তখন আর কিছু বলব না।’ নিজের কপালে একবার হাত বুলিয়ে নিলেন। ‘চলে যাচ্ছি, ড. গ্রাহাম। তারপরও...আপনি আমাকে যে ড্রিংক অফার করেছিলেন, সেটা কি পরিবর্তন করতে পারি?’

গ্রাহামের বিরক্তি ভাবটা চলে গেল। বললেন, ‘অবশ্যই। হুইস্কি, নাকি পানি?’

‘অপূর্ব।’

গ্রাহাম ক্ষমা চেয়ে কিচেনের ভেতর গেলেন। হুইস্কির বোতল, পানি, বরফের টুকরো আর গ্লাস নিয়ে এলেন।

‘হ্যারি—’ গ্রাহাম স্নেহ ও উষ্ণতা মাখিয়ে বললেন, ‘বাবা এখন ব্যস্ত আছে। কিছুক্ষণের জন্য তোমার ঘরে ফিরে যাও; আমি একটু পর আসছি, তারপর গল্প শোনাব।’

লিভিং রুমে ফিরে দেখলেন, নেমান্ড হ্যারির শোবার ঘর থেকে বের হয়ে আসছেন। নেমান্ডকে বলতে শুনলেন, ‘গুড নাইট, হ্যারি।’ হ্যারি খুশি খুশি গলায় বলল, ‘নাইট, মিস্টার নেমান্ড।’

গ্রাহাম ড্রিংক বানালেন। নেমান্ড দ্বিতীয় পেগ নিতে চাইলেন না। বিদায় নিতে প্রস্তুত হলেন।

নেমান্ড বললেন, ‘ডক্টর, আমি অনুমতি ছাড়া আপনার ছেলেকে একটা ছোট উপহার দিয়ে এসেছি। আপনি যখন ড্রিংক আনতে গেলেন, সে সময়। আশা করি আপনি রাগ করেননি। আমাকে ক্ষমা করবেন।’

‘অবশ্যই। ধন্যবাদ। শুভরাত্রি।’

গ্রাহাম দরজা বন্ধ করে দিলেন। লিভিং রুমের ভেতর দিয়ে ছেলের রুমে গেলেন। বললেন, ‘হ্যারি, এবার গল্প পড়ে শোনাব—’

হঠাৎ কপালে ঘাম জমে উঠল তাঁর। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে, গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বিছানার পাশে গিয়ে বসলেন। ‘হ্যারি, আমাকে দেখতে দেবে ওটা?’ সতর্কভাবে উপহারটি হাতে নিয়ে যখন পরীক্ষা করছিলেন, তখন তাঁর হাত কাঁপছিল।

তিনি মনে মনে ভাবলেন, ‘একমাত্র উন্মাদরাই নির্বোধের হাতে রিভলবার তুলে দিতে পারে।’

আরও পড়ুন