অদৃশ্য সময়

অলংকরণ: আরাফাত করিম

শহরে এসেছে ভীষণ ধুরন্ধর এক চোর। এত এত সিসিটিভি ক্যামেরা, ভিজিলেন্স, সেন্সরের মধ্যেও অনায়াসে জরুরি কাগজপত্র নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ কমিশনারের রীতিমতো ঘর্মাক্ত অবস্থা। এসব চুরির মালামালের মধ্যে রয়েছে সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি, ব্যাংকের অতি জরুরি কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ—এমনকি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের থিসিস পেপার পর্যন্ত। টাকাপয়সা, সোনাদানার প্রতি চোরের কোনো আগ্রহ নেই, বেশ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এসব বিচিত্র জিনিস দিয়ে চোর করবেটা কী? মনে হচ্ছে, চোরটা যেন মশকরা করছে সবার সঙ্গে। তার চেয়ে বড় কথা, চোরটা ঘটনাস্থল থেকে এমন অদৃশ্য হয়ে যায় কী করে বারবার?

জাতীয় ব্যাংকের ভল্ট থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজ যেদিন চুরি গেল, সেদিন কে কে অফিসে ঢুকেছিলেন আর বেরিয়েছিলেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেককে সিসিটিভি ক্যামেরায় শনাক্ত করেছে পুলিশ। কাউকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা হয়নি। প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি করা হয়েছে, বাদ যায়নি তাঁদের ঘরবাড়ি তল্লাশি করাও। তারপরও কোনো কিনারা হয়নি রহস্যের। মনে হচ্ছে, হাওয়ায় মিশে গিয়ে কেউ ভল্টে ঢুকে কাগজগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেছে। সেদিন সকাল ১০টা ১০ মিনিটে একবার ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সিকিউরিটিসহ ভল্ট খুলেছিলেন, আরেকবার খোলা হয়েছিল ব্যাংক বন্ধ হওয়ার আগে, বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে। দুটি ভিডিওই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন রাকিব, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ডিবির গোয়েন্দা। কোনোটাতেই কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। কর্মকর্তার সঙ্গে একজন বন্দুকধারী সিকিউরিটি ছিলেন, রফিক তাঁর নাম। তাঁকে যথেষ্ট ইনভেস্টিগেট করা হয়েছে। খুব নিরীহ সাধারণ একজন নিরাপত্তারক্ষী তিনি। পালাক্রমে যাঁদের ওপর এই ডিউটি পড়ে, তাঁদের একজন। আট বছর ধরে এই কাজ করে আসছেন, কোনো অভিযোগ নেই তাঁর নামে। কর্মকর্তাকেও ছাড়া হয়নি। পরপর দুই দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তাঁকে। তবে রাকিব জানেন, এই দুজনের কেউই চোর নন। চোর অন্য কেউ। কিন্তু ওই দিন ভল্টের আশপাশে আর কাউকে যেতে দেখা যায়নি! আশ্চর্য! তাহলে চোরটা ভূত নাকি?

জুনায়েদ হাসলেন না; বরং আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি রসিকতা করছি না, মিস্টার রাকিব। আপনি কি হেনসোজুৎসুর নাম শুনেছেন? বা টনপো টেকনিকের? নিনজারা এই কৌশল ব্যবহার করত। এটা ম্যাজিক নয়, এটা ছিল বিজ্ঞান।

থিসিস পেপারের ব্যাপারটা আরও রহস্যজনক। অধ্যাপক তাঁর গবেষণা সহকারীর সঙ্গে বসে কাজ করছিলেন। দুজন পাশাপাশি দুটি ল্যাপটপ নিয়ে। অধ্যাপকের ল্যাপটপে ছিল মূল ইকুয়েশনগুলো। এগুলো তিনি কারও সঙ্গে শেয়ার করেন না, এমনকি সহকারীর সঙ্গেও নয়। সহকারী কেবল থিসিস লেখায় তাঁকে সাহায্য করেন। এর মধ্যে একবার অধ্যাপক টয়লেটে গিয়েছিলেন। সে সময়কার ভিডিও খুব সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ করেছেন রাকিব। দেখা গেছে, সহকারী নিবিষ্ট মনে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন, কোনো দিকে না তাকিয়ে। একবার মাত্র তাঁকে ডান হাত তুলে মাথা চুলকাতে দেখা গেছে। ওই সময় তিনি সামান্য ডানে হেলে পড়েছিলেন বলে মুখটা সিসিটিভিতে অস্পষ্ট হয়ে পড়েছিল। সে একমুহূর্তের ব্যাপার। কিন্তু তার একটু পর অধ্যাপক ফিরে এসে আবিষ্কার করলেন, তাঁর ল্যাপটপ বদলে গেছে! মানে, ফিরে এসে টেবিলে তিনি যে ল্যাপটপটা পেলেন, সেটা তাঁর নয়! এ-ও কি সম্ভব?

আরও পড়ুন

চোরটার ইল্যুশন তৈরির দক্ষতা আছে, বললেন মিস্টার জুনায়েদ, পুলিশের ফরেনসিক এক্সপার্ট। সে কোনোভাবে নিজের পায়ের বা আঙুলের ছাপ তো লুকিয়েছেই, যদিও তা কঠিন কিছু নয়, তার ওপর ক্যামেরা ও মানুষের চোখকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছে। এর মানে, সে ঘটনাক্ষেত্রে ইল্যুশনারি ফিল্ড তৈরি করেছে।

রাকিব প্রশ্ন করলেন, কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব?

জুনায়েদ বললেন, নিনজা টেকনিক!

শুনে হেসে ফেললেন রাকিব। মিস্টার জুনায়েদ, আমি এমনিতেই অনেক দিগদারির মধ্যে আছি। প্লিজ, রসিকতা করবেন না।

জুনায়েদ হাসলেন না; বরং আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি রসিকতা করছি না, মিস্টার রাকিব। আপনি কি হেনসোজুৎসুর নাম শুনেছেন? বা টনপো টেকনিকের? নিনজারা এই কৌশল ব্যবহার করত। এটা ম্যাজিক নয়, এটা ছিল বিজ্ঞান।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

এসব বলে জুনায়েদ তৃতীয় ভিডিওটা অন করলেন। ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁর নিরাপত্তারক্ষীকে নিয়ে ভল্টে ঢুকছেন। সামনে কর্মকর্তা। পেছনে নীল পোশাক পরা রক্ষী, তাঁর কাঁধে বন্দুক। কর্মকর্তা এগিয়ে যাচ্ছেন, রক্ষী ঠিক তাঁর পিছু পিছু। সঠিক দূরত্ব আর পেস বজায় রেখে। এই যে! কর্মকর্তা আরেকটু এগিয়েছেন, কিন্তু নিরাপত্তারক্ষী এবার একটু পিছিয়ে পড়েছেন। সমানতালে এগিয়ে যেতে পারেননি। এবার তিনি রয়ে গেছেন ভেতরের দ্বিতীয় ক্যামেরার আওতার বাইরে।

—কিন্তু দেখুন, দেড় সেকেন্ড, তার মধ্যেই তো সে ঢুকে পড়েছে। পেস ঠিক রেখে কর্মকর্তার সঙ্গ নিয়েছে। খানিকটা কোনো কারণে পিছিয়ে পড়তেই পারে।

—এই দেড় সেকেন্ডেই ঘটনা ঘটে গেছে। বললেন জুনায়েদ।

শুনে মুখ হাঁ হয়ে গেল রাকিবের—মানে?

—মানে, এই দেড় সেকেন্ডে নিরাপত্তারক্ষী বদলে গেছে। এটি আর আগেরজন নন। এ অন্য কেউ। এটা হলো ডিসগাইসিং। নিনজারা এটা খুব ভালো পারত। বলা হয়, একজন প্রশিক্ষিত নিনজা একই সময়ে অন্তত সাতটি রূপ ধারণ করতে পারত। ভিক্ষুক, ব্যবসায়ী, কৃষক, সন্ত, পাপেটিয়ার—এক রূপ থেকে আরেক রূপে ট্রান্সফর্ম করতে তাদের একমুহূর্তের বেশি সময় লাগত না। কারণ, তারা এই ভিন্ন ভিন্ন বেশ একই সঙ্গে নিজের শরীরে বহন করত। এটাই হলো হেনসোজুৎসু টেকনিক।

রাকিবকে আশ্চর্যবোধক এক চিহ্নের মধ্যে রেখেই জুনায়েদ এবার অধ্যাপকের ভিডিওটা অন করলেন।

এই যে অধ্যাপকের সহকারী এক সেকেন্ডের জন্য ডানে হেলে পড়েছিলেন, ওই সময়ই তিনি পাল্টে গেছেন। তাঁর জায়গায় ঢুকে পড়েছে চোর। আমি নিশ্চিত। চোরটা হেনসোজুৎসু জানে। ভীষণ রকম ট্রেইনড।

আরও পড়ুন

অনেকক্ষণ নিজের ঠোঁট নিজেই কামড়ালেন রাকিব। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, কিন্তু ল্যাপটপ সরানো বা ভল্টে হাত দেওয়ার কোনো এভিডেন্স তো ভিডিওতে নেই। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ভল্ট কেবল কর্মকর্তাই স্পর্শ করেছেন, রক্ষী বা চোর, মানে আপনার দৃষ্টিতে, সে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল পেছনে। তাহলে সে চুরি করল কখন? আবার সহকারী যদি পাল্টেও যান, তাঁকে একবারও অধ্যাপকের ল্যাপটপে হাত দিতে দেখা যায়নি। তাহলে ল্যাপটপ চুরি করল কে?

জুনায়েদকেও চিন্তিত দেখাল এবার। এটাই আমাদের মূল সমস্যা। যে চোর হেনসোজুৎসু জানে, সে নিশ্চয় অপটিক্যাল ইল্যুশনও তৈরি করতে পারে। সে ওই মুহূর্তে ঘটনাস্থলে যে মুভমেন্টগুলো করছে, তা ক্যামেরা কোনো কারণে ধরতে পারছে না।

—এটা কীভাবে সম্ভব?

জুনায়েদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কয়েক পাক হেঁটে এলেন ঘরের ভেতর। তারপর কাছে এসে বললেন, একজনের কথা মনে পড়ছে। তিনি হয়তো সাহায্য করতে পারবেন।

—কে তিনি?

রাকিব পুরো বিষয় খুলে বললেন। আদ্যোপান্ত। বিষয়টির গুরুত্ব বুঝিয়ে। তবে তাতে লাভ হলো না। সেজান মৃদু হেসে বললেন, আপনারা ভুল করছেন। আমি কোনো গোয়েন্দা নই। আমি সাধারণ এক ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।

রাকিবের কথা শেষ হতে না হতেই তাঁর ফোন বেজে উঠল। ফোনে হ্যালো বলেই আঁতকে উঠলেন রাকিব। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।—হোয়াট?

জুনায়েদ চেয়ে রইলেন তাঁর দিকে। ফোন পকেটে রেখে রাকিব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, চাকরিটা আর থাকবে না।

—কেন?

—মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরের জরুরি কিছু নথি চুরি হয়েছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি। সেই একই ব্যাপার। তাঁর অফিসে কাউকে ঢুকতে দেখা যায়নি!

দুই

ঘর অন্ধকার করে যোগব্যায়াম করছিলেন ডক্টর সেজান। বিকেলের এই সময়ে, মানে সূর্য ডোবার একটু আগে, যোগব্যায়ামে বসেন তিনি। এটি তাঁকে মনঃসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। এ সময় দরজায় টোকা পড়তে স্বাভাবিকভাবেই বিরক্ত হলেন। একটা বড় নিশ্বাস ফেলে যোগ ছেড়ে উঠে দরজা খুললেন তিনি। সামনে দাঁড়িয়ে দুজন অচেনা লোক।

—আমি ডিবি ব্রাঞ্চের স্পেশাল ইনভেস্টিগেটর রাকিব রহমান—হাত বাড়িয়ে দিলেন দীর্ঘদেহী লোকটা। পাশের ছোটখাটো লোকটিকেও পরিচয় করিয়ে দিলেন—আর ইনি মিস্টার জুনায়েদ খান। আমাদের ফরেনসিক এক্সপার্ট।

অনাহূত দুই অতিথিকে বিরক্তির সঙ্গে বসতে বললেন সেজান। সাধারণত তাঁর বাড়িতে কোনো অতিথি আসেন না। তিনি অসামাজিক এবং নির্বিরোধী একা মানুষ। কারও সঙ্গে তেমন মেলামেশা করেন না। হকিং নামের বিড়ালটাই তাঁর একমাত্র সঙ্গী।

—বলুন, আমি কী করতে পারি?

রাকিব পুরো বিষয় খুলে বললেন। আদ্যোপান্ত। বিষয়টির গুরুত্ব বুঝিয়ে। তবে তাতে লাভ হলো না। সেজান মৃদু হেসে বললেন, আপনারা ভুল করছেন। আমি কোনো গোয়েন্দা নই। আমি সাধারণ এক ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তা-ও আমার ক্যারিয়ার তেমন ভালো নয়। এই মুহূর্তে চাকরি নেই। বেকার। না খেয়ে মরার দশা।

এবার মুখ খুললেন জুনায়েদ।

মিস্টার সেজান, এটা তো সত্যি যে হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার পিএইচডির বিষয়বস্তু ছিল মেটা অ্যাটম?

আরও পড়ুন

সেজান মাথা নাড়লেন, হুম। মেটা ম্যাটেরিয়াল বা মেটা অ্যাটম। একটা নতুন কনসেপ্ট। এ নিয়ে বেশ কাজ হচ্ছে। কিন্তু ও পড়াশোনা আমার কোনো কাজে আসেনি। আমাকে এ দেশে কেউ চাকরি দেয়নি। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ও নয়। পড়াটা আমার বৃথা গেছে।

—বিষয়টা আমাদের একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?

এই প্রথমবার সেজান তাঁর চোখে চোখ রেখে তাকালেন—আপনাদের চা দেব, না কফি? অন্ধকার হয়ে আসছে। দাঁড়ান, আলোটা জ্বেলে আসি।

—আমাদের কিছু লাগবে না। বলার চেষ্টা করলেন রাকিব। কিন্তু তার আগেই উঠে পড়েছেন সেজান। শোনা গেল, রান্নাঘরে গ্যাস জ্বালিয়েছেন তিনি, ঠুকঠাক শব্দ হচ্ছে। কাপ-পিরিচ বের করছেন। একটা তামাটে রঙের বিড়াল ম্যাও শব্দ করে পায়ের কাছ দিয়ে বের হয়ে গেল। চমকে উঠলেন রাকিব।

কয়েক মিনিট পরই অবশ্য ফিরে এলেন সেজান। হাতে ট্রে। ট্রের ওপর দুই কাপ রং-চা। একটা পিরিচে কিছু বাদাম। ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালালেন। আলো জ্বালানোর পর তাঁকে এবার স্পষ্ট দেখতে পেলেন রাকিব আর জুনায়েদ। উষ্কখুষ্ক চুল। দুটি বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। গলার একটু নিচে একটা ট্যাটু আঁকা। ট্যাটুতে লেখা ইংরেজি ‘আই’ শব্দটি।

সেজান ট্রে টেবিলে রেখে সোফায় বসলেন। তারপর কথা বলতে শুরু করলেন।

—আমার বিষয় ছিল আসলে ট্রান্সফরমেশন অপটিকস। সায়েন্সের এক নতুন বিষয়। এর উদ্দেশ্য হলো আলোর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা। আমরা জানি, আলোকরশ্মি সব সময় সোজা পথে চলে। কিন্তু যদি স্পেসকে বাঁকিয়ে দেওয়া যায়, তবে আলোর গতিপথ বাঁকানো সম্ভব। এটা আইনস্টাইনের থিওরি অব জেনারেল রিলেটিভিটি সমর্থন করে।

রাকিব চায়ের কাপ তুলে চুমুক দিলেন। চমৎকার সুগন্ধ চায়ে। আল গ্রে চা।

সেজান বলে চললেন, আসলে আলো যখন চলে, তখন তার গতিপথে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রিসিভার আর ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে ছোট ছোট পদক্ষেপ ফেলে চলে। এগুলোকে বলে মেটা অ্যাটম। জন পেনড্রি প্রথম এই থিওরি দেন যে এই মেটা ম্যাটেরিয়াল দিয়ে একটা ইনভিজিবল শিল্ড তৈরি করা সম্ভব।

কারণ ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন সেজান—আলোর গতিপথকে ম্যানিপুলেট করতে হলে এমন মেটা অ্যাটম চাই, যার ওয়েভলেংথ আলোর সমান। আর তা কখনোই সম্ভব নয়। দৃশ্যমান আলোর ওয়েভলেংথ মাইক্রোমিটারের ১০ ভাগের ১ ভাগের কম।

একটু নড়েচড়ে বসলেন জুনায়েদ। বিজ্ঞানের ছাত্র তিনি, মেডিকেলে না পড়লে ফিজিকস পড়তেন। ফিজিকস তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল। পারিবারিক চাপে ডাক্তারি পড়তে হয়েছে।

—ধরুন, একটি বস্তুকে একটি মেটা ম্যাটেরিয়াল শেলের কেন্দ্রে রাখা হলো। এবার আলোর গতিপথকে ওই বস্তুর চারদিকে বাঁকিয়ে দেওয়া হলো এমনভাবে যে তা আবার ওটা পেরিয়ে গিয়ে মিলিত হবে ওপাশে। এই যে ব্যাপারটা হলো, এমন।

এসব বলে একটা স্টিলের গোলক হাতে নিলেন ভদ্রলোক। রাখলেন চায়ের কাপের পিরিচের ওপর। তারপর তার ওপর একটু পানি ঢেলে দিলেন।

—এই যে পানিটা পুরো গোলকের চারপাশে ছড়িয়ে গিয়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পৌঁছাল, কিন্তু বস্তুর ভেতর দিয়ে গেল না; মানে বাঁকিয়ে গেল। আলোও এভাবে বাঁকিয়ে যেতে পারে কি না।

—তাহলে আলোটিকে ওই বস্তুর ভেতর দিয়ে যেতে হলো না, তাই তো? জুনায়েদ মনে হয় একটু ধরতে পারছেন ব্যাপারটা।

—একদম তা-ই। আর যদি আলোটা বস্তুর ভেতর দিয়ে না যায় বা বস্তুর ওপর না পড়ে ওপর-নিচ বা চারপাশ দিয়ে বাঁকিয়ে যায় এবং ওপারে গিয়ে আবার মিলিত হয়, তাহলে ওই বস্তুকে আপনি দেখতে পাবেন কি? প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন সেজান।

—মাই গড! পুরো বিষয় পরিষ্কার মনে হলো জুনায়েদের কাছে। সত্যি তো। তার মানে, বস্তুটি অদৃশ্য থাকবে আমাদের কাছে। মানে বস্তু সামনেই আছে, কিন্তু আমাদের চোখে নেই! মানে, আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

—এক্সাক্টলি! তুড়ি মেরে বললেন সেজান। এটাই ট্রান্সফরমেশন অপটিকস—কীভাবে বস্তুকে, এমনকি একজন গোটা মানুষকেই অদৃশ্য করে ফেলা যায়। এইচ জি ওয়েলস ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু আলোক প্রযুক্তির ব্যাখ্যা এটাই।

উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন এবার রাকিব, ডিবি গোয়েন্দা। তার মানে, চোরটা এই পদ্ধতি অবলম্বন করছে!

সেজান হাসলেন। বললেন, তা সম্ভব নয় মিস্টার রাকিব।

—কেন? কেন সম্ভব নয়? একটু আগে আপনিই তো বললেন যে সম্ভব।

—কারণ ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন সেজান—আলোর গতিপথকে ম্যানিপুলেট করতে হলে এমন মেটা অ্যাটম চাই, যার ওয়েভলেংথ আলোর সমান। আর তা কখনোই সম্ভব নয়। দৃশ্যমান আলোর ওয়েভলেংথ মাইক্রোমিটারের ১০ ভাগের ১ ভাগের কম। মেটা ম্যাটেরিয়ালকে এই পর্যায়ে সংকুচিত করা এখন পর্যন্ত অসম্ভব। তাই বিষয়টা থিওরি আর অঙ্কেই রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন রাকিব। বললেন, এমন তো হতে পারে, চোরটা বা তার পেছনে যারা কলকাঠি নাড়াচ্ছে, তারা এই সংকুচিত করার কোনো উপায় আবিষ্কার করে ফেলেছে।

সেজান খিকখিক করে হাসতে থাকলেন। বললেন, আমি যত দূর জানি, শব্দ বা সাউন্ড ওয়েভকে ধোঁকা দেওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে এই উপায়ে। ইনভিজিবল শিল্ড তৈরি করে একটা সাবমেরিন এখন সহজেই আশপাশের সোনার ডিটেক্টরগুলোকে ধোঁকা দিতে পারবে। মানে, কেউ বুঝতেই পারবে না যে এখানে একটা সাবমেরিন আছে। কিন্তু সাউন্ড ওয়েভ আর লাইট ওয়েভ সমান নয়। জিনিসটা মনে রাখবেন।

চা শেষ হয়েছে। তাঁদের কথাও শেষ। এবার উঠে দাঁড়ালেন রাকিব আর জুনায়েদ। অনেক কিছুই জানা হলো, কিন্তু চুরিরহস্য এখনো রহস্যই রয়ে গেল। তবু যেসব ক্লু পাওয়া গেল, তা–ইবা কম কী? তাঁরা সেজান সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলেন। তাঁদের পেছনে ম্যাও করে উঠল তাঁর হকিং নামের বিড়ালটি। পেছন ফিরে বিড়ালটির দিকে একটা হাসি দিলেন রাকিব। তারপর বেরিয়ে এলেন।

অফিসার দুজন বেরিয়ে গেলে হকিংকে কোলে নিয়ে মনে মনে একটা রবীন্দ্রসংগীতের সুর ভাঁজতে লাগলেন সেজান। ‘কেমন ক’রে, মনোহরণ, ছড়ালে মন মোর?।/ কেমন খেলা হল আমার আজি তোমার সনে!’

মেটা অ্যাটম দিয়ে ইনভিজিবল শিল্ড তৈরির জন্য হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফরমেশন অপটিকস ডিপার্টমেন্ট অপটিক ক্লোক ব্যবহারের কথা ভাবছিল। সেজান সেখানেই কাজ করতেন। অনেক দূর এগিয়েছিলেন তাঁরা। তারপর একসময় বুঝতে পেরেছেন, আলোর ওয়েভলেংথ যা, তাতে এটা সত্যি অসম্ভব। তখনই সেজানের মাথায় এসেছিল একটা নতুন আইডিয়া। স্পেস টাইম ক্লোক তৈরি করা কি সম্ভব? মানে আলোকে অদৃশ্য না করে মুহূর্তকে অদৃশ্য করে দেওয়া? ধরা যাক, এই মুহূর্তে এখানে যে ঘটনা ঘটল, সেই সময়টুকুকেই মহাকাল থেকে নেই করে দেওয়া?

ডক্টর সেজানের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে লিফটের সামনে এসে কেমন অস্বস্তি হতে লাগল রাকিবের। কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। কী, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। লিফটের ওপর ইনডিকেটরটা এসে ১৩-তে আটকাল। তাঁরা দুজন লিফটে প্রবেশ করলেন।

সেজান আবার তাঁর অসমাপ্ত ধ্যানে ও যোগব্যায়ামে বসলেন। সূর্য ডোবার আগেই তাঁকে এই ব্যায়াম শেষ করতে হয়। আজ দুই গবেট এসে তাঁর মহামূল্যবান সময়টুকু নষ্ট করেছে। যা-ই হোক, তিনি এই মুহূর্তগুলো অদৃশ্য করতে শিখেছেন এত দিনে। ফলে তিনি আবার আগের জায়গা থেকেই শুরু করতে পারলেন।

তিন

ডক্টর সেজানের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে লিফটের সামনে এসে কেমন অস্বস্তি হতে লাগল রাকিবের। কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। কী, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। লিফটের ওপর ইনডিকেটরটা এসে ১৩-তে আটকাল। তাঁরা দুজন লিফটে প্রবেশ করলেন। লিফট নিচে নেমে এল। এর মধ্যে একবার ৯ তলায় নামল। ঢুকল সবুজ শার্ট পরা এক ব্যক্তি। তারপর থামল ৪ তলায়। এবার একটা ছোট ছেলে। লিফট একেবারে নিচে নেমে এলে হঠাৎ বিদ্যুৎ-চমকের মতো মনে পড়ল রাকিবের। বিড়ালটা! প্রথমবার যখন ম্যাও করে উঠেছিল আর রাকিব তার দিকে তাকিয়েছিলেন, তখন বিড়ালটা ছিল তামাটে রঙের। আর বেরিয়ে আসার সময় যখন ম্যাও করে উঠল, এবারও রাকিব তাকিয়েছিলেন তার দিকে, তখন দেখেছেন, বিড়ালের রং সাদা! ব্যাপারটা ভেবে একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেলেন রাকিব। তারপর জুনায়েদকে ধরে বললেন, মেটা ম্যাটেরিয়ালস! আমরা ও বাড়িতে যা দেখেছি, তা ঠিক নয়। ওই লোকটা আমাদের ভুলভাল দেখিয়েছে! শিগগির চলুন।

আরও পড়ুন

লিফটের বাটন টিপে আবার ১৩ তলায় উঠে একেবারে বেকুব বনে গেলেন তাঁরা দুজন। অ্যাপার্টমেন্ট নম্বর ১৩ বাই ডি এখানে নেই। এখানে কেবল এ, বি এবং সি আছে। এ কী করে সম্ভব? একটু আগেই তাঁরা ১৩ বাই ডির সামনে এসে দরজা ঠকঠক করেছেন, ভেতরে ঢুকে চা খেয়েছেন, গল্প করেছেন। এখন তা কীভাবে নেই হয়ে গেল?

নিচে নেমে এসে রিসেপশনের লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলেন রাকিব। শুনলেন, ডি বলে কোনো ফ্ল্যাট এই দালানে নেই। আছে কেবল এ, বি এবং সি।

জুনায়েদ লোকটিকে পরিচয় দিয়ে বললেন, তোমার সিসিটিভি অন করো। দেখাও আমরা দুজন বিকেল ৪টা ৪৬ মিনিটে এদিক দিয়ে লিফটে উঠে কোথায় গেছি? কোন অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছি?

নিরাপত্তারক্ষী সিসিটিভি অন করার পর বিস্ময়াহত হয়ে তাঁরা দুজন দেখলেন, আজ বিকেলে তাঁরা দুজন আসলে কোথাও যাননি!

*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন