আবিষ্কার

‘সামালকে! সামালকে!’ চিল্লাচ্ছে আসগর খালাসিদের উদ্দেশে। লোকগুলো দাঁড়িয়ে আছে কোমরপানিতে। ছোট কিন্তু ভারী একটা কাঠের বাক্স টেনে আনার কোশেশ করছে তারা বোটের রেলিংয়ের ওপর দিয়ে। এটাই শেষ। আসগরের আনা বাকি ৯টি ক্রেট ইতিমধ্যে নামানো সারা।

‘আরিব্বাবা! গরম কী! চুলার ওপর আছি মনে হচ্ছে।’ গুঙিয়ে উঠল সে। গলায় ঝোলানো ব্যান্ডানা দিয়ে মোটা, কালো গর্দানখানা মুছছে। টান মেরে খুলে ফেলল পরনের শার্ট। ঘাম-চুপচুপে কাপড়টা ছুড়ে ফেলল সৈকতের বালুতে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খোলো। খুলে ফেলো, ভায়া। কেউ নেই এখানে। কেউ দেখবে না।’

বেজার মুখে তাকিয়ে আছি ছোটখাটো স্কুনারটার দিকে। মাইলখানেক দূরে রয়েছে ওটা তীর থেকে। ঢেউয়ের দোলায় মৃদু দুলছে। আবার তিন হপ্তা পর আমাদের নিতে আসবে জাহাজটা।

উদোম হলাম জামাটা খুলে, ‘এবার বলো দেখি, কী ভূত চাপল তোমার মাথায়! যন্ত্রপাতি নিয়ে এই দোজখে এলাম কেন আমরা? যে গরম...বাপ রে বাপ! মনে হচ্ছে, কালকের মধ্যেই গা থেকে খসে পড়বে চামড়া।’

‘নেভার মাইন্ড। ওই সূর্য আমাদের কাজে লাগবে। ভালোই হলো, ঠিক মাথার ওপর এখন সুয্যিমামা।’

‘বিষুবরেখায় অবস্থান করলে তো তা-ই থাকবে সব সময়,’ গজগজ করতে করতে বললাম। চোখ সরাচ্ছি না জাহাজটার ওপর থেকে, ‘সব ভূগোলের বইতেই লেখা আছে এটা।

কাছে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মাল্লারা।

ধীরেসুস্থে ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢোকাল বন্ধুটি। বের করে আনল একতাড়া নোট।

‘চলবে এতে?’ টাকা বিলাতে বিলাতে জানতে চাইল আসগর।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল একজন।

আরও পড়ুন

‘এবার তাহলে জাহাজে ফিরে যাও তোমরা। মনে করিয়ে দিয়ো ক্যাপ্টেন চৌধুরীকে, ২০ দিনের মধ্যে এখানে তাকে দেখতে চাই আমরা।’ ফিরল আসগর আমার দিকে, ‘চলো দোস্ত, হাত লাগাই ঝটপট। আর তর সইছে না আমার।’

চোখ বড় বড় করে তাকালাম ওর দিকে, ‘সত্যি বলছি, ভাই, এখনো বুঝতে পারছি না, কেন আমাদের আসতে হলো এখানে। অ্যাডমিরালের সামনে মুখ খুলতে অসুবিধা ছিল, বুঝেছিলাম সেটা। কিন্তু এখন তো মনে হয় খুলে বলতে পারো।’

ঠোঁট বাঁকাল আসগর। বালুর দিকে চোখ নামিয়ে বলল, ‘পারি তো অবশ্যই। সব ব্যাপারই বলব আমি তোমাকে। আপাতত সময় নেই হাতে।’

মনে হলো সত্যি বলছে না। তবে আর কিছু বললাম না তাকে। পিচ্ছিল হাতে বেগুনি হয়ে ওঠা ঘাড় ডলছে আসগর। এই কাজ করে সে বরাবর মিথ্যা বলার সময়। জানি আমি। যা বোঝার, বোঝা হয়ে গেছে আমার।

‘বুঝতেই তো পারছ, বন্ধু, ইন্টারেস্টিং একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চলেছি। হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখতে চাই, জীবনের তাড়নায় প্রাণ ফোটে কিনা ধাতুর বুকে।’ দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছে তাকে। অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

এগিয়ে গেলাম বন্ধুর দিকে। ওর খোলা কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘আর সে জন্যই ১০ ক্রেট পুরোনো লোহা নিয়ে এসেছ, তাই না?’

‘হ্যাঁ রে, ভাই! এখন তোমার প্রথম কাজ হচ্ছে, ১ নম্বর ক্রেটটা খুলে ফেলা—নম্বর দেওয়া আছে, দেখো। খুলে যা যা আছে, বের করো সব। তাঁবু, পানি, টিনের খাবার পাবে ওটার মধ্যে। কয়েকটা যন্ত্রপাতিও আছে, বাকি বাক্সগুলো খুলতে কাজে লাগবে।’

‘আচ্ছা।’ বললাম অস্ফুটে। চলে গেলাম ১ নম্বর ক্রেটটার কাছে।

পরের দুটি ঘণ্টা ব্যয় হলো আমাদের সৈকতে তাঁবু খাটাতে আর কোদাল, ক্রোবার, হাতুড়ি, বাটালি, একগাদা স্ক্রু-ড্রাইভার এবং আরও কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে গিয়ে সেটায় ঢোকানোর কাজে। হরেক পদের খাবারের টিন আর মিষ্টি পানির কনটেইনার গাদা করে রাখলাম একটা জায়গায়।

এটা-ওটা হুকুম করলেও আসগর নিজেও ষাঁড়ের মতো খাটল। আসল কাজটা শুরু করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল আসলে।

আরও পড়ুন
পরের দুটো দিন ধাতব খণ্ডগুলো দ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে বেড়ালাম আমরা। ছোট ছোট স্তূপে বালুর ওপর রাখা হলো ওগুলো। কিছু আবার পুঁতে দেওয়া হলো মাটির নিচে।

কাজে ব্যস্ত থাকায় খেয়ালই করিনি, কোন ফাঁকে গাঙচিল নামের জাহাজটি নোঙর তুলে হারিয়ে গেছে দিগন্তের ওপারে।

ম্যাপে দেখেছি, দ্বীপটি গোলাকার। আড়াই মাইলের বেশি হবে না ব্যাসে। আসগর জানাল, যেসব জায়গায় লাল পেনসিলের দাগ দেওয়া ম্যাপে, অন্য বাক্সের জিনিসগুলো সেখানে নিয়ে যেতে হবে।

‘কিন্তু জিনিসগুলো কী?’ বলি আমি ধৈর্যহারা হয়ে।

জবাবে ঠোঁট টিপে হাসল কেবল আসগর।

রাতের খাওয়াদাওয়ার পর খোলা হলো বাকি ক্রেটগুলো, বাদ রইল শুধু ১০ নম্বরটা। আসগর বলল, পরে খুলবে ওটা। ক্রেটগুলোর ঢাকনা খুলেই চোয়াল ঝুলে গেল আমার বিস্ময়ে। নানা আকার-আকৃতির ধাতব বার আর স্ল্যাবে ভর্তি ওগুলো।

পরের দুটো দিন ধাতব খণ্ডগুলো দ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে বেড়ালাম আমরা। ছোট ছোট স্তূপে বালুর ওপর রাখা হলো ওগুলো। কিছু আবার পুঁতে দেওয়া হলো মাটির নিচে। কাজ শেষ করে তাঁবুর কাছে ফেরার পর দশম ক্রেটটা খোলার নির্দেশ দিল আসগর।

খুলে ফেললাম বাক্সটা। আজব দেখতে একটা যন্ত্র বেরোল ভেতর থেকে, যেটিকে প্রথম দর্শনে মনে হয় ধাতুর তৈরি খেলনা কাঁকড়ার মতো। অর্ধবৃত্তাকার আয়নার মতো কিছু একটা চকচক করছে ওটার পিঠে আর আয়নার মাঝখানটায় রয়েছে কালচে লালরঙা ক্রিস্টাল।

‘কী বুঝলে?’ ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল আসগর।

কাঁধ ঝাঁকালাম অনিশ্চিত ভঙ্গিতে।

‘কাঁকড়াটা নিয়ে বালুর ওপর রাখো।’

পালন করলাম নির্দেশ। বেশ হালকা ওটা, ‘এখন?’ প্রশ্ন আমার।

‘আগে গরম হয়ে উঠুক জিনিসটা।’

আরও পড়ুন
এক সপ্তাহের মধ্যেই রোবট কাঁকড়ায় ভরে গেল গোটা দ্বীপ। ধাতুর একটা স্তূপ শেষ হওয়ার পর সারা দ্বীপ চষে ঠিকই আরেকটা স্তূপ খুঁজে বের করে ফেলে এরা।

মিনিট কয়েক পর লক্ষ করলাম, কাঁকড়ার পিঠের আয়নাটি ধীরে ধীরে সূর্যের দিকে ঘুরে যাচ্ছে!

তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। ওদিকে হাসিতে ভরে উঠেছে আসগরের মুখের চেহারা।

পানির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে খেলনাটা, একটু পর পানি পান করতে শুরু করল রীতিমতো! পিপাসা মেটার পর সরে এল আবার জলের কিনার থেকে।

ভয়মিশ্রিত বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেল অন্তরটা, ‘তোমার আবিষ্কার?’ জানতে চাইলাম।

‘হুম। তাঁবুতে যাই, চলো। আগামীকাল সকালে মজার একটা জিনিস দেখাতে পারব আশা করছি।’

পরদিন ঘুম থেকে উঠে সাগরে নেমেছি গোসল করতে। এমন সময় দূর থেকে ভেসে এল আসগরের উত্তেজিত কণ্ঠ, ‘জলদি এসো, ইকবাল! শুরু হয়ে গেছে ব্যাপারটা!’

ছুট দিলাম আওয়াজ লক্ষ করে। কিছুক্ষণ পর ধাতুর একটা স্তূপের সামনে আবিষ্কার করলাম দোস্তকে। আমার আগেই ঘুম ভেঙেছে ওর। পায়ের কাছে একটা নয়, দুটো কাঁকড়া।

‘আরে! আরেকটা এল কোত্থেকে?’ বিস্মিত আমি। ‘স্তূপটার মধ্যে কি লুকিয়ে ছিল ওটা?’

মাথা নাড়ল আসগর, ‘না।’

‘তাহলে?’

‘ওটা জন্ম নিয়েছে!’ মিটিমিটি হাসছে বন্ধুবর।

‘মানে?’

‘প্রথমটা থেকে জন্ম নিয়েছে ওটা।’

ভীষণ নাড়া খেলাম শুনে। দাঁড়ার সাহায্যে স্তূপ থেকে টুকরা টুকরা করে ধাতু কেটে মুখের মধ্যে চালান করে দিচ্ছে কাঁকড়া দুটো আর একটু পরপর হিসহিস আওয়াজে স্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে আসছে ওগুলোর মুখ থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা কাঁকড়ার সামনের প্ল্যাটফর্মের ওপর তৃতীয় আরেকটার আউটলাইন তৈরি হতে শুরু করল!

‘হায়, খোদা!’ চিৎকার ছাড়ি আমি। মনে হলো, যেন দুঃস্বপ্ন দেখছি।

সে রাতে সত্যি সত্যিই দুঃস্বপ্ন দেখলাম। ঝাঁকে ঝাঁকে ধাতব কাঁকড়া ঘিরে ধরেছে আমাকে! পালানোর পথ নেই!

এক সপ্তাহের মধ্যেই রোবট কাঁকড়ায় ভরে গেল গোটা দ্বীপ। ধাতুর একটা স্তূপ শেষ হওয়ার পর সারা দ্বীপ চষে ঠিকই আরেকটা স্তূপ খুঁজে বের করে ফেলে এরা। একদিন দেখলাম, দস্তার একটা পাত নিয়ে মারামারি লাগিয়েছে দুটো কাঁকড়া। একপর্যায়ে দেখি, অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী কাঁকড়াটি ইলেকট্রিক স্পার্কের সাহায্যে কাটতে শুরু করল প্রতিপক্ষকে। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটি ঘটল এরপর। আক্রান্ত কাঁকড়াটিকে টুকরা টুকরা করে নিজের মুখের মধ্যে পুরতে লাগল বিজয়ী কাঁকড়া! মনে পড়ে গেল সেই অমোঘ বাণী—জীবন ঠিকই পথ খুঁজে নেয়।

আরও পড়ুন

সেদিন রাতে হঠাৎ ভেঙে গেল ঘুমটা। মনে হলো, ঠান্ডা, ভারী কোনো কিছু যেন গা বেয়ে উঠছে। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। অন্ধকারে কিছু ঠাওর করতে পারলাম না প্রথমে। টর্চ জ্বালাতেই দেখি, আট পায়ে বিদ্যুদ্বেগে ছুটে তাঁবুর বাইরে পালিয়ে গেল একটা রোবট কাঁকড়া।

মুহূর্তপরই বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ দৃশ্যমান হলো বাইরে। বুঝলাম, ধাতুর খোঁজে তাঁবুতে ঢুকেছিল কাঁকড়াটি। আমাদের খাবারের টিন খুঁজে পেয়ে চুরি করে নিয়ে গেছে!

পরিশিষ্ট

সমুদ্রের তীরে মৃতের মতো পড়ে আছি আমরা। দৃষ্টি দিগন্তরেখার দিকে প্রসারিত। ওখানেই দেখা মিলবে আমাদের জাহাজটির।

শম্বুকগতিতে বয়ে চলেছে সময়। নির্দয় সূর্য যেন নড়বে না বলে পণ করেছে মাথার ওপর থেকে। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর আমরা। খাবার আর পানির সব টিন কেটে শেষ করেছে হারামি কাঁকড়াগুলো। তাঁবু খাটানোর উপায় নেই। কারণ, বালুতে গাঁথা ধাতব গোঁজগুলো উধাও। একইভাবে গায়েব হয়েছে ধাতুর তৈরি রিংগুলোও, যেগুলোয় রশি ঢুকিয়ে খাড়া করা হয়েছিল তাঁবু। প্রতিটি ধাতব হুক, বোতাম, বাকল খেয়ে সাফ করে ফেলেছে আসগরের ওই খুদে রোবটগুলো। এককথায়, বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর আবিষ্কার। সারা দ্বীপে বোধ হয় একটি কণা ধাতুও নেই এখন!

প্যারাবোলিক আয়নাটি ভেঙে ফেললে অথবা কাঁকড়াদেহের ভেতর থেকে অ্যাকিউমুলেটর বের করে আনলেই অকেজো করে দেওয়া যেত বজ্জাতগুলোকে। কিন্তু এখন আর সে উপায় নেই। অসংখ্য কাঁকড়া একে অন্যকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে দ্বীপজুড়ে। আশা শুধু একটাই, নিজেরা কামড়াকামড়ি করে শেষ হয়ে যাবে এরা। কিন্তু কথা হচ্ছে, সে পর্যন্ত টিকব তো আমরা?

বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে

*লেখাটি ২০২৩ সালের নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত