এলিয়েনের নাম এলি।
আসল এলিয়েন না। সিনেমার এলিয়েন। সিনেমার এলিয়েন চরিত্রে অভিনয় করছে মাহবুব মিরেজ। এ সময়ের সুপারস্টার। পরপর তিনটা সিনেমা হিট। থিয়েটারে যেমন লোক টেনেছে, তেমনই দর্শক তাকে দেখছে ওটিটিতে। ফলে স্বভাবতই হাবভাব একটু বেশি। বেঁকে বসল। বলল, ‘এলি নামটা ভালো না!’
এক শ বার ভালো। শেক্সপিয়ার দ্য গ্রেট বলেছেন, ‘নামে কী আসে যায়! বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়।’ তোমার নাম এলি না বেলি—এসব ভাবার দরকার আছে? তুমি অভিনেতা, অভিনয়ে মন দাও। ভালো অভিনয় করলে তোমার নাম বিষ্ঠা হলেও দর্শক তা মনে রাখবে!
মাহবুব মিরেজকে এসব বলা দরকার। কিন্তু কে বলবে? যেহেতু সে সুপারস্টার, সবাই তাকে তেলানোতে লেগে আছে। রাজা যত বলে, পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ…।
ফলে আমার ডাক পড়ল।
দুর্ভাগ্যক্রমে এই সিনেমার লেখক আমি। মূল যে গল্প লিখেছিলাম, যেটা বেরিয়েছিল হৃদয় থেকে, সেটা যে আসলে কী ছিল, একদমই ভুলে গেছি। কারণ, গল্প থেকে চিত্রনাট্য চলার পথে আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে প্রডিউসারের অর্থনৈতিক লোহিত সাগর, পাড়ি দিতে হয়েছে ডিরেক্টরের আতলামির সাহারা মরুভূমি। মিটিংয়ে বসতেই মাহবুব মিরেজ বলল, ‘আপনি রাইটার?’
‘জি!’
‘এই সব কী লিখছেন?’
‘সিন লিখছি, ভাই।’
‘কোনো সিনেই সিনের সেন্স নাই। আর এলি নাম রাখছেন কেন হিরোর! নাম তো মেয়েলি…হিরোর নাম এ রকম হবে কেন?’
মেজাজ মাথায় চড়েছিল, সেটা কোনোমতে গিলে খেলাম। বললাম, ‘আসলে এই ফিল্মে হিরোর চরিত্রটা ঠিক ফিল্মি না, রিয়েলিস্টিক। নামও তাই…’
‘ফিল্মি না? তো আমরা কী বানাচ্ছি? এই যে ডিরেক্টর, ফিল্ম বানাইতেছি না আমরা?’
ডিরেক্টর গলে আইসক্রিম—‘জি জি, ভাই। ফিল্মই তো বানাইতেছি। হেবি হিট ফিল্ম হইব ভাই! দেইখেন!’
‘আর দেখাদেখি! হিরোর নাম এলি থাকলে এই ফিল্ম জীবনেও হিট করবে না। আমি লিখে দিচ্ছি!’
সিগারেট টানতে টানতে ডিরেক্টর আমার কাছে ঘ্যানাল—‘ক্যান প্যারা নিতেছেন ভাই, নামটা বদলায়া দেন!’
‘আরে এলিয়েনের নাম এলি রাখছি, সমস্যা কী?’
‘ভাই, ঘাড়ত্যাড়ামি কইরেন না তো...পিকে সিনেমা দেখছেন না? ওইখান থেকে তো কয়টা সিন মাইরাও দিছেন…পিকের মতো একটা নাম রাখেন। ওকে রাখেন। ওকে?’
‘না, ওকে না। নায়কের নাম এলিই থাকবে। রাখলে রাখেন, না রাখলে এই স্ক্রিপ্টে কাজ করার দরকার নাই!’
এইবার আমি ভয় পাই। এইসব হিরোর ক্ষমতা সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই, তাদের নেই…এদের আসলে থানা-পুলিশ-আইন-আদালত—সব পকেটে থাকে; হিরোইনদের থাকে বেশি…কিন্তু সুপারস্টার হলে হিরোদেরও কম নয়।
কথাগুলো বলে এজেন্সি থেকে ফট করে বেরিয়ে এলাম। আমার অবশ্য এ রকম করে বলার অবস্থা নেই। একটা ফ্যামিলির সঙ্গে সাবলেট থাকি। সেখানে চার মাসের ভাড়া বাকি…চার নং ছত্রিশ হাজার টাকা। কাজটা হলে প্রডিউসার আমাকে ৫০ হাজার টাকা দেবে বলেছে। সেটা পেলে আরও কয়েক মাসের বাড়িভাড়ার চিন্তা শেষ হতে পারে।
রাতে ঘুম আসে না। দু–একবার ফোন দেখি। ডিরেক্টর ফোনও দেয় না, মেসেজও দেয় না। আগের মতো ডিরেক্টর আর নেই…এদের সবার মেরুদণ্ডে সমস্যা! খালি শুয়ে পড়ে। ন্যাতানো...পোতানো!
২
সকালে ধাম ধামাধাম শব্দে ঘুম ভাঙল।
ঢাকার কিছু বলা যায় না। কাল পাশের বিল্ডিং ভালো ছিল, আজ দেখা যাবে সেটা ভাঙা শুরু হয়েছে। আমি জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম, কিন্তু না...বিল্ডিং ঠিকই আছে। কিন্তু ধাম ধামাধাম শব্দও আছে। গিয়ে দরজা খুললাম হুড়মুড় করে। দেখি, ডিরেক্টর দাঁড়িয়ে আছে। আক্ষরিক অর্থেই থরথর করে কাঁপছে, ‘আপনার ফোন, আপনার ফোন বন্ধ ক্যান?’
‘কই বন্ধ! ও আচ্ছা…চার্জ নাই হয়তো! রাতে খেয়াল ছিল না! আপনার কী হইছে? কাঁপতেছেন ক্যান?’
‘হিরো…আমাদের হিরো…মাহবুব ভাই…’
‘কী হইছে? মারা গেছে?’
‘ধুররর! আলাইবালাই কী কন এই সব! মাহবুব ভাই সকাল থেকে আপনাকে খুঁজতেছে…’
এইবার আমি ভয় পাই। এইসব হিরোর ক্ষমতা সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই, তাদের নেই…এদের আসলে থানা-পুলিশ-আইন-আদালত—সব পকেটে থাকে; হিরোইনদের থাকে বেশি…কিন্তু সুপারস্টার হলে হিরোদেরও কম নয়। আমি যে নায়কের নাম বদলাব না বলে এসেছি...হিরোর সম্ভবত প্রেস্টিজে লেগেছে। এবার আমাকে জাস্ট...
শুকনা গলায় হিরোর বাড়িতে পৌঁছালাম। গুলশান এলাকার ডুপ্লেক্স বাড়ি। সাদা রং। বাড়ি দেখলে বুকের কাছটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এত সুন্দর বাড়ি…সামনে একচিলতে জায়গা। পেছনে দোলনা, বাগান, ফুল, প্রজাপতি! অন্যের লেখা সংলাপ তোতাপাখির মতো আউড়ে–আউড়ে এত কিছু! এদিকে আমার বাড়িভাড়া বাকি!
লম্বা করিডর। সেটা পেরোলে ভেতরবাড়ির দরজা। পুরোটাই কাচ। সেটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় একটা ফুটবল মাঠ। এটাই নাকি ড্রয়িংরুম। সাত-আট পদের সোফা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একেকটায় বসলে মানুষ হারিয়ে যায়। তার একটায় বসে আছে মাহবুব মিরেজ। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। অবাক ব্যাপার বটে!
ভারি যত্ন করে আমাকে একটা সোফায় বসাল সুপারস্টার। তারপর কোমল গলায় জানতে চাইল, ‘নাশতা করেছেন?’
একটা ব্যাপার বলে রাখি, উঠতি লেখকদের এ ধরনের প্রশ্ন অমার্জনীয় অপরাধ। নাশতা এরা করে না, করার পরিস্থিতি থাকে না। ‘দিন আনি দিন খাই’ ধরনের মানুষও দিনে দিনে খাওয়া খেতে পায়। উঠতি লেখকদের স্বপ্ন ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘খেয়েছি।’
‘ও।’
‘চুরি না, চুরি না। আপনি যে সিনেমা লিখেছেন, সেই সিনেমাই আমি কালকে রাত্রে নেটফ্লিক্সে দেখেছি…২ ঘণ্টা ১৭ মিনিটের ফিল্ম। আমি আছি, মায়ামণি আছে…আমি এলি, মায়ামণি রুনার রোল করছে!’
একটু যেন হতাশই হলো মাহবুব মিরেজ। ডিরেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি যাও। আমি ভাইয়ের সঙ্গে স্ক্রিপ্ট নিয়ে ডিসকাশন করি।’
ডিরেক্টর ছাগলের মতো মাথা নাড়াল কিছুক্ষণ, কিন্তু সেদিকে খেয়ালই করল না মাহবুব মিরেজ। আমাকে বলল, ‘চলুন…’
কোন দিকে কে জানে! কিন্তু বলার মধ্যে একটা শ্রদ্ধা আছে যে আমি তাতে বিস্মিত হয়ে পা বাড়ালাম।
৩
লম্বা একটা সুইমিংপুল। সেখানে মাহবুব মিরেজের সঙ্গে শুয়ে আছি। ওপরে রোদ, পায়ের কাছে পানি। কখনো কখনো পা ছুঁয়ে যাচ্ছে। গ্লাসে কোমল পানীয়। দু–এক চুমুক দিয়ে দেখেছি। খালি পেট থাকার কারণে ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে উঠছে। যেকোনো সময় বমি হয়ে যাবে। কিন্তু মাহবুব মিরেজ এরই মধ্যে অনেকটা খেয়ে ফেলেছে। একটা সাদা টাওয়েল শরীরে জড়িয়ে আছে। আমার সন্দেহ হচ্ছে টাওয়েলটা যেকোনো সময় খুলে যাবে। মাহবুব মিরেজ হঠাৎই বলে উঠল, ‘আপনার স্ক্রিপ্টটা কালকে রাতে দেখলাম!’
‘দেখলাম মানে? পড়ছেন?’
‘না, না। পড়ি নাই তো।’
‘আপনি তো বলছেন এর আগে যে পড়ছেন। বলছিলেন, সিনে কোনো কিছু নাই!’
‘ওইগুলা কথার কথা! সবাইকেই বলি।’
‘তাহলে কালকে মাত্র পড়ছেন?’
‘কালকে পড়ি নাই। কালকে দেখছি।’
‘ভাই রে, ক্যামনে দেখছেন? স্ক্রিপ্ট কি শুট হয়েছে যে দেখবেন!’
‘সেটাই তো! কিন্তু আমি দেখেছি…আমি রাতে নেটফ্লিক্স দেখার জন্য ঢুকেছি টিভিতে...তখনই দেখলাম আমাকে…’
‘মানে? নেটফ্লিক্সে আপনার কোনো কনটেন্ট নাই!’
‘কিন্তু এলি আছে।’
‘মানে? কই…দেখি…আমি কোনো কিছু চুরি করিনি। কসম!’
‘চুরি না, চুরি না। আপনি যে সিনেমা লিখেছেন, সেই সিনেমাই আমি কালকে রাত্রে নেটফ্লিক্সে দেখেছি…২ ঘণ্টা ১৭ মিনিটের ফিল্ম। আমি আছি, মায়ামণি আছে…আমি এলি, মায়ামণি রুনার রোল করছে!’
‘হার্ডড্রাগ নিতেছেন আজকাল?’
‘আমি সত্যি দেখেছি ভাই। আমি হয়তো আপনাকে বোঝাতে পারব না। দেখার সময় বারবার মনে হচ্ছিল, এটা আপনার লেখা সিনেমাটাই। দেখা শেষ হলে আপনার স্ক্রিপ্ট মিলিয়ে দেখেছি, একদম ঠিক আছে!’
‘আচ্ছা। ফাইন। এ বিষয়ে আর কী কথা বলতে চান? সিনেমা পছন্দ হয়নি? রিরাইট করতে হবে স্ক্রিপ্ট? এমনিতেই রিরাইট করতে করতে আমার জান বেরিয়ে গেছে ভাই; হয় কাজটা করেন, নইলে কইরেন না…আমি আর এই সবে নাই!’
‘না, না। সিনেমাটা তো খুবই ভালো হয়েছে। রিরাইটের দরকার নাই। কিন্তু আমার সঙ্গে আরও একটা ঘটনা ঘটেছে। তাই আপনাকে ভোর থেকে খুঁজছি পাগলের মতো!’
‘আপনার মনে হয় না যে এক রাত হিসাবে আপনার জীবনে অনেক বেশি ঘটনা ঘটে যাচ্ছে! প্রথমত, আপনি এমন একটা সিনেমা দেখলেন, যে সিনেমা এখনো তৈরি হয়নি, তারপর সেই সিনেমার স্ক্রিপ্ট মিলিয়ে দেখলেন তা একই আছে…অথচ ওই সিনেমা আপনি এখন দেখছেন, যেটা প্ল্যাটফর্মটাতে নেই এবং এরপর আবারও ভোরের দিকে আপনার সঙ্গে নতুন কোনো ঘটনা ঘটেছে?’
‘নতুন এবং উদ্ভট! উদ্ভট এবং খুবই আজব! এবং…’
আমি মাথা নাড়িয়ে না বলতে চাইলাম। কিন্তু বলা হলো না। দেখলাম এলি লাফিয়ে এসে মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আমার ব্যথা হওয়ার কথা…কিন্তু তা না হয়ে এক অদ্ভুত আমেজ ছড়িয়ে পড়ছে মাথা থেকে সারা শরীরে।
‘ভাই রে, আমার মনে হয় আপনার কিছুদিন রেস্ট দরকার। কাউকে নিয়ে দেশের বাইরে থেকে ঘুরে আসেন। আগের যুগের মানুষেরা আপনার এই অবস্থাকে বলত মাথা গরম হয়ে যাওয়া। যাদের সামর্থ্য থাকত, তারা হাওয়া বদল করতে যেত…আপনারও আসলে হাওয়া বদল দরকার! আপনার তো সামর্থ্য আছেই…ইউরোপ–আমেরিকা ঘুরে আসেন!’
‘আমি একটা জিনিস পেয়েছি। আমার ধারণা, এটা আপনার স্ক্রিপ্টের সঙ্গে রিলেটেড।’
‘কী জিনিস পেয়েছেন?’
মাহবুব মিরেজ উঠে দাঁড়াল। টাওয়েলটা খুলে পড়ল না ঠিকই, বরং অদ্ভুতভাবে ঝুলে থাকল তার কোমরে। পেটানো শরীর। আমার দিকে তাকিয়ে টলোমলো চোখে বলল, ‘প্লিজ আসেন! নিজের চোখেই দেখবেন!’
উঠে বসা ছাড়া আমার অন্য কোনো কিছু করার রইল না।
৪
মাহবুব মিরেজের বেডরুম। মাহবুব মিরেজ নিজের শরীরটা খাটের নিচে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ডাক দিচ্ছে বারবার কাউকে। বলছে, ‘এলি…এলি…’ আমি বললাম, ‘এলি না বলে গেলি বলে দেখেন! এতক্ষণে হয়তো চলে গেছে!’
চোখ লাল মাহবুব মিরেজের, ‘সবটা আপনার কাছে ইয়ার্কি মনে হচ্ছে, না?’
‘অবশ্যই ইয়ার্কি! আসলে কালকে আমি বলেছি যে ফিল্মটা দেব না আমি…এ জন্য আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন! শোনেন, নাম যদি এলি না থাকে, তাহলে এখনো বলছি, এই স্ক্রিপ্ট আমি দেব না!’
দেখলাম মাহবুব মিরেজ আর আমার কথা শুনছে না। আর কাঁধের ওপর দিয়ে তার দৃষ্টি চলে গেছে পেছনে। আমিও ঝট করে ঘুরে তাকালাম। দেখলাম, একটা সবুজ বল, না বল তো নয়, বলের মতো কিছু একটা, যার চোখ আছে, নাকও আছে…কানগুলো খরগোশের মতো, আমাকে দেখেই টিপিস করে পলক ফেলল। মাহবুব মিরেজ বলল, ‘ও কাল ভোরে এসেছে। বলছে, ওর নাম এলি। ও চায় সিনেমাটা হোক…কারণ, সিনেমাটা নাকি ওরই বায়োগ্রাফি। ওকে কি আপনি চেনেন? এর আগে কখনো কথা হয়েছে?’
আমি মাথা নাড়িয়ে না বলতে চাইলাম। কিন্তু বলা হলো না। দেখলাম এলি লাফিয়ে এসে মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আমার ব্যথা হওয়ার কথা…কিন্তু তা না হয়ে এক অদ্ভুত আমেজ ছড়িয়ে পড়ছে মাথা থেকে সারা শরীরে। মাহবুব মিরেজ বলল, ‘ভাই, আপনি ঠিক আছেন? ইমতিয়াজ ভাই, ঠিক আছেন আপনি? শুনতে পাচ্ছেন?’
আমি বললাম, ‘এলি!’